Tuesday, 16 March 2021

"ও রাজা তোর কাপড় কোথায়---- কিছু ধেয়ে আসা প্রশ্নের উত্তর "

অনেকেই  আজকাল  কিছু প্রশ্ন করেই সমস্যা তুলে ধরেন কিন্তু তার  সমাধানের কোন সুরাহা না দিয়েই। অবশ্য প্রশ্ন  করা খুব সহজ ব্যাপার  নয় এবং যথেষ্ট  বুকের  পাটা  না থাকলে  তো একেবারেই  নয়। আর উত্তর,  সেটা তো অন্যলোকের  কাজ। মাথা খুঁড়ে মর এবার। 
একটা প্রশ্ন  উঠে এসেছে  যে প্রাক  দুহাজার  চৌদ্দ সালে যে ব্যাঙ্ক গুলো লক্ষাধিক  কোটি লাভ করছিল তারা হঠাৎই  আজ ধুঁকছে  কেন এবং তাদের  বাঁচাতে  কেন সরকারকে লক্ষ লক্ষ  কোটি টাকা মূলধনে  ঢালতে হলো? এই প্রশ্ন  জাগাটা খুবই  স্বাভাবিক এবং তার  উত্তরটাও  প্রায় সকলেই  জানেন।  কিন্তু  এর পিছনের  ঘটনা অনেকেই  জেনেও  না জানার  ভান করেন। দীর্ঘদিন ধরেই  ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ  অনাদায়ী  ঋণের বাস্তব  অবস্থা যেকোন  ভাবেই  হোক  না কেন  রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নজরে আনেন  নি বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেখেও দেখেননি।  কিন্তু যখন  রিজার্ভ ব্যাঙ্কের  গভর্নর  স্বয়ং রঘুরাম  রাজন সংসদে জানালেন  যে বিপুল পরিমাণ  অনাদায়ী  ঋণ বাণিজ্যিক  ব্যাঙ্কগুলি তাঁদের  নজরে  আনেননি তখন  রীতিমত  হৈচৈ  পড়ে যায়। তিনি আরও জানান  যে এই ঋণের  বেশিরভাগ টাই দুহাজার  ছয় থেকে  দুহাজার আট সালের। নিয়মানুযায়ী  প্রত্যেক  ঋণের জন্যই প্রভিশনিং করতে  হয় এবং যতক্ষণ অনাদায়ী  ঋণের শত প্রতিশত প্রভিশনিং না করা হচ্ছে ততক্ষণ  লোনকে  রাইট অফ করা যায়না। এমন ও হতে পারে যে লোন দেবার  কিছুদিন  পরেই  বোঝা গেল  যে লোনটা পরিশোধ  করতে  পারবেনা তখন  পুরো লোনের  টাকাটাই প্রভিশনিং  করতে হয় যার অর্থ  সরাসরি লাভ কমে যাওয়া ।সুতরাং, যে ব্যাঙ্ক গুলো এতদিন  লাভ  দেখিয়ে এসেছে  তারা আসলে  লোকসানে  ছিল  এবং অনাদায়ী  ঋণ না দেখানোয় তারা লাভ  দেখিয়েছে। এরপর  দুহাজার চৌদ্দ  সালে  জুন মাসে সরকারকে সেন্ট্রাল রিপোজিটরি  অব্  ইনফরমেশন  অন লার্জ ক্রেডিটস  গঠন করতে হয় যাতে  ভবিষ্যতে এই ধরণের  ঘটনার  পুনরাবৃত্তি না হয়।
সরকারি মালিকানাধীন এবং বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাঙ্কের  মধ্যে পার্থক্য  এখানেই  যে যেখানে  সরকারের  শেয়ার  একান্ন  শতাংশের  বেশি সেটা সরকারি  ব্যাঙ্ক  আর অন্যথায় বেসরকারী  মালিকানাধীন। যে কোন ব্যবসার মূল লক্ষ্য যে সংস্থা  যাতে লাভ করে এবং শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ বেশি  দিতে পারে। ব্যাঙ্ক  যখন  সরকারের  অধীনে আনা হয় তখন  মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল  যে এই ব্যাঙ্ক গুলো লাভ করবে এবং সেই লাভ  জনগণের  উদ্দেশ্যে ব্যবহার  করা হবে। কিন্তু  সরকারকে  যদি জনগণের  ট্যাক্সের  টাকা থেকে ব্যাঙ্কের  পুনরুজ্জীবনের  জন্য ব্যবহার  করতে হয় তাহলে  তো মূল উদ্দেশ্য ই ব্যর্থ হয়। এই কথাটা মনে রাখতে হবে সরকারি ব্যাঙ্ক বলেই সেটা যেমন  ইচ্ছা চলবে তা হয়না। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে সরকারি প্রকল্প ও যেমন বাস্তবায়িত  করতে হবে তেমনই সেই  ঋণ শোধ  করার  ব্যবস্থাও করতে হবে  যেটা একটা দুরূহ কাজ। কারণ  রাজনৈতিক  নেতাদের  চাপে অনেক  ঋণ দিতে হয় আবার  এই নেতারা ই ঋণগ্রহীতাদের  ঋণ পরিশোধ  না করার  জন্য উদ্বুদ্ধ  করেন।  এটা অনেকটাই  চোরকে  চুরি করতে  বলা আর গৃহস্থকে  সজাগ থাকতে বলা। এঁদের  চরিত্র  বদলানো শিবের  বাবার  অসাধ্য। তবে সবাইকে  এই দলে ফেলা যায়না। এখনও  অনেক  রাজনীতিবিদ  রয়েছেন  যাঁরা প্রকৃত ই সৎ কিন্তু তাঁরা আজ বিরল প্রজাতির।  এই ধরণের  চাপ বেসরকারি ব্যাঙ্কের  উপর চাপানো যায়না বলে তাদের লাভ  বা মুনাফা অনেক  বেশি এবং অনেক  বেশি লভ্যাংশ তাদের বিনিয়োগকারীদের তাঁরা দিতে পারেন যার নীট  ফল আরও  বেশিসংখ্যক বিনিয়োগকারী  আকৃষ্ট হন  এবং শেয়ারের  মূল্য ও চরচরিয়ে বেড়ে যায়। আর এই কারণেই  এইচ ডি এফ সি  ব্যাঙ্কের  ব্যালান্স  সিট এবং ব্রাঞ্চের সংখ্যা স্টেট ব্যাঙ্কের এক চতুর্থাংশ হলেও মার্কেট  ক্যাপিটালিজেশন  স্টেট ব্যাঙ্কের প্রায় দ্বিগুণ এবং আমাদের  দেশের  এক নম্বর  ব্যাঙ্ক। খুব সহজেই  যদি উত্তর  খুঁজতে  হয় তাহলে বলা যায় যে ঐ ব্যাঙ্ক  স্টেট ব্যাঙ্কের  চেয়ে বেশি যোগ্য।  কিন্তু এই উত্তরটা এত সহজ নয়। স্টেট ব্যাঙ্ক  করে আমজনতার  ব্যাঙ্কিং আর তারা করে বিশেষ শ্রেণীর  ব্যাঙ্কিং। সরকারের  যাবতীয় প্রকল্পের  রূপায়ণ স্টেট ব্যাঙ্কের  এবং অন্যান্য  সরকারি মালিকানাধীন ব্যাঙ্কের  মাধ্যমে হয় যেটা বেসরকারী  ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য  নয়। সুতরাং তারা যেখানে বেশি লাভ  হবে সেখানেই ঋণ দেবে এবং সেটা যাতে পরিশোধ  হয় তার ও ব্যবস্থা করে। প্রত্যন্ত  গ্রামে তাদের  উপস্থিতি খুবই নগণ্য। তাহলে আমজনতাকে  পরিষেবা কে দেবে-- সেই  সরকারি  ব্যাঙ্ক। সুতরাং দুজনের খেলার  জমি এক নয় এবং তুলনা করাটা সামগ্রিক ভাবে একটু অবিচার ই হবে সরকারি ব্যাঙ্কের  প্রতি। 

এবার  আসা যাক  সুদের হার  কমে যাওয়ার  ব্যাপারে।সুদের  হার  কমে গেলে  যাঁরা ব্যাঙ্কের  সুদের  উপর নির্ভরশীল তাঁদের  সংসার  চালানো ভীষণ কষ্টসাধ্য  হয়ে পড়ে। অথচ, দিনদিন জিনিস পত্রের  দাম  হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে।বৃদ্ধ বয়সে মানুষের খাবার  খরচ কমে যায় কিন্তু ওষুধের খরচ বহুদিন বৃদ্ধি পায়। তাহলে উপায় কি? নোট ছাপিয়ে সমস্যার কোন সমাধান  হবেনা। সেক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতি  হবে। ব্যাঙ্ক কে আগের  মতন সুদ দিতে গেলে ঋণে অন্তত চার শতাংশ সুদ বেশি নিতে হবে । আর তা না হলে তাকে ব্যবসা গোটাতে হবে। কর্মীদের বেতন ও ভাতা, বিদ্যুতের  খরচ এবং অন্যান্য  খরচ মিটিয়ে লাভ  করতে হলে ব্যাঙ্ক  কে প্রায় তের  বা চৌদ্দ  শতাংশ  সুদ পেতেই  হবে। প্রায়রিটি সেক্টরে  কমপক্ষে মোট ঋণের  চল্লিশ  শতাংশ  হতে হবে। মোট ঋণের  এক শতাংশ  অতি দরিদ্র মানুষের  জন্য দিতে হবে চার শতাংশ  সুদে। এদিকে ব্যাঙ্কের মোট ঋণ মোটামুটিভাবে  সমস্ত জমারাশির  ষাট শতাংশ  অতিক্রম  করবে না। এছাড়াও  ব্যাঙ্ক কে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের  কাছে কিছু টাকা স্ট্যাটুটরি  লিকুইডিটি রেডিও, ক্যাশ রিজার্ভ  রেসিও  বাবদ রাখতে হয়। সামান্য  একটা উদাহরণ দিলে জিনিস টা একটু পরিষ্কার  হবে। যদি মোট  ঋণ ষাট  টাকা হয় তবে প্রায়রিটি  সেক্টরে কম সে কম চব্বিশ টাকা দিতে হবে এবং ষাট  পয়সা  ডি আই আর লোন দিতে হবে আর বাকি পঁয়ত্রিশ টাকা চল্লিশ  পয়সা কমার্শিয়াল ও ইনস্টিটিউশনাল  লোন বাবদ দিতে হবে যেখানে বেশি হারে সুদ পাবে ব্যাঙ্ক।  কিন্তু  আন্তর্জাতিক  বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কস্ট অব ক্যাপিটাল কম হতেই  হবে। এছাড়াও  বিদেশ  থেকে অনেক কম সুদে লোন পাওয়ার সুযোগ  থাকার জন্য বড় শিল্পপতিরা  বিদেশ  থেকে লোন নেবে এবং সেক্ষেত্রে আমাদের  দেশীয় ব্যাঙ্কগুলো আরও  ধুঁকতে থাকবে। যদি বড় শিল্পপতিরা লোন না নেন তাহলে উৎপাদন  ব্যাহত হবে এবং বেকারের  সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে সুদের  হার  কমাতেই  হবে। আর এইখানেই  অর্থনীতিবিদদের  অনেক জটিল  গণনা করতে হয়। আমরা এই জটিল  গণনা না বুঝলেও কিছুটা আন্দাজ  করার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু যদি বোঝার  চেষ্টাই  না করি তাহলে সব আলোচনাই  বৃথা। এছাড়াও ঐ  সময়  মুদ্রাস্ফীতির হার  ছিল  অনেক  বেশি যেমন  আট সালে 8.35, নয় সালে 10.88,দশ সালে 11.99,এগারোয় 8.86,বারোয়9.31, তেরোয় 10.91, আর চৌদ্দ  সালে 6.35. বাস্তবিক  ক্ষেত্রে আমরা ঐ সময় ঋণাত্মক  সুদের হার  পেয়েছি। কিন্তু এটা অত্যন্ত  সত্যি কথা যে সংসার  চালাতে সবাই  হিমসিম  খাচ্ছে। এটাও খুব  সত্যি যে মধ্যবিত্তরা  চারদিক  থেকে মার খাচ্ছে। নেতাদের  চোখ ছলছল করে ওঠে গরীবদের  কথা ভেবে। যতরকম  ভাবে পার তাদের  সাবসিডি দেবার  কথা ভাবো আর তার  থেকে খানিকটা নিজেদের  পকেটে না গেলে ভাবব কেন?  যত্রতত্র  দান, গরীবদের  নামে প্রকল্প  চালু করে নিজেদের  পকেট ভরাতে না পারলে আমাদের  দেখবে কে? সাবসিডি  দিয়ে লোকদের  অথর্ব  না করে যাতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে সেই প্রচেষ্টা  কেউ  করতে চায়না কারণ  তখন  ঐ লোকজনেরা নেতাদের  পাশে ভিড় করবেনা। 

একটা কথা মনে রাখা দরকার  যে অলাভজনক  সরকারি সংস্থা বেসরকারী  হাতে গেলে ক্ষতি কিসের? দিনের পর দিন  সাধারণ  ট্যাক্সদাতাদের  টাকায় কিছু লোক মৌরসিপাট্টা করে আয়েস  করে বসে বসে খাবে আর এই ট্যাক্সদাতারা নির্বাক দর্শক  হয়ে থাকবে এটা চলতে পারেনা। যদি কাজ করতে ইচ্ছা না করে তবে সরে দাঁড়াও, বহুলোক  কাজের প্রতীক্ষায় রয়েছে। বেসরকারী শিল্পপতিরা নিষ্ক্রিয়তাকে  বরদাস্ত  করবেনা। আরও  একটা কথা জানার আছে যে কোন উন্নত দেশে সরকারের  কাজ রেগুলেটরের।  ব্যবসা চালানো সরকারের  কাজ  নয়। কমিউনিস্ট  দেশ চীন  তার  ষাট শতাংশ  সরকারি মালিকানাধীন উদ্যোগ বেসরকারী উদ্যোগপতিদের হাতে তুলে দিয়েছে এবং ফল স্বরূপ  আজ চীন  পৃথিবীর  এক অন্যতম  শক্তিধর দেশ।  সমস্ত  পৃথিবীর  মানচিত্র  থেকে কমিউনিজম  আজ বিলুপ্ত প্রায়। একমাত্র  দেশ  চীন , তারাও  আজ রিফর্মের  পথে হাঁটছে  আর আমাদের  দেশের  নব্য কমরেডরা এখনও  পুরানো ধারণাতেই নিমজ্জিত। 

কর্পোরেট  ট্যাক্স কম করাতেই কয়েকজন  শিল্পপতির  সম্পদ আড়াই আড়াইশো  শতাংশ বেড়েছে এই ধারণাটা  আদ্যোপান্ত  ভুল। শেয়ার  মার্কেট  সম্বন্ধে যাঁদের  বিন্দুমাত্র  ধারণা আছে  তাঁরা জানেন  যে বাজারে তাঁদের  উপর ভরসা না থাকলে তাঁদের শেয়ারের  দাম  কখনোই বাড়বেনা  আর সেই কারণেই  এইচ ডি এফ সি ব্যাঙ্ক  স্টেট ব্যাঙ্কের  থেকে অনেক ছোট  হলেও  তারাই  আজ ভারতবর্ষের  বৃহত্তম  ব্যাঙ্ক ( মার্কেট ক্যাপিটালিজেশন  হিসাবে)। 

এখন ভাবার  সময় আমরা শক্তিশালী  উন্নত  দেশ হবো না উন্নতিশীল দেশ হিসাবে ভিক্ষার  পাত্র নিয়ে উন্নত দেশের  মুখাপেক্ষী থাকব।