গত দুবছর করোনার প্রকোপে লোক সেরকম ভাবে উৎসব উদযাপন করতে পারেনি, সাধারণ গরীবগুর্বোদের অবস্থা তো আরও তথৈবচ। চারদিকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা ছিল সীমাহীন। না আছে রোজগার পাতি, না আছে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভালোমন্দ কিছু কিনে দেওয়ার সামর্থ্য। এবছর মায়ের আগমনের আগেই করোনা নামক দৈত্য বিদায় নিয়েছে , অবশ্য একেবারেই যে আপদ বিদায় হয়েছে তা নয়, নব কলেবরে নতুন নামে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন কিন্তু টীকার প্রভাবেই হোক আর মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়ার জন্যই হোক তারা এখন মরিয়া হয়ে গেছে। সমস্ত রাজ্যে দুর্নীতির রমরমা, এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ কিন্তু এ সত্ত্বেও পূজোর সংখ্যা বেড়েছে আর তারই সঙ্গে বেড়েছে লোকের আয় করার ক্ষমতা বিশেষ করে এই সময়। দুর্নীতির নাগপাশে আষ্টে পৃষ্টে বাঁধা সরকারের নেতা মন্ত্রীরা কিন্তু টিভি চ্যানেলে কোমরবেঁধে ঝগড়া দেখলেই আপ্তবাক্য মনে পড়ে যায় চোরের মায়ের বড় গলা। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার উপরতলায় চোর এবং সাধুর কুশল বিনিময় দেখলে মনেই হবেনা যে কিছুক্ষণ আগেই টিভির চ্যানেলে এরা প্রায় বাহুযুদ্ধে সামিল হচ্ছিল। আসলে ব্যাপারটা কি,বর্তমান দলে কখন দমবন্ধ অবস্থা হবে কেউ জানেনা, সুতরাং নতুন পদক্ষেপে যাতে বিন্দুমাত্র দুর্ভোগ না হয়, তার আগাম প্রস্তুতি রাখা সবসময়ই ভাল। পূজোর বাজেটে কেউ কম যায়না। প্রতিবছর বাজেটের পরিমাণ বেড়েই চলেছে এবং প্রতিটি পূজোরই পৃষ্ঠপোষক কোন নেতা বা মন্ত্রী। যার যেমন ওজন, তার বাজেটের ওজন ও সেইরকম। নেতারা চাপ দেন ব্যবসায়ীদের আর তাঁরা থোড়াই নিজের পকেট থেকে দেন, সুদে আসলে সাধারণ মানুষের পকেট কাটেন। এর ওপর আছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। ফি বছর বাড়ছে পূজোয় সরকারী অনুদান। যত পূজো,ততই অনুদান। দেশে চাকরির সংস্থান নেই, যোগ্য চাকরি প্রার্থীকে ঘেঁচুকলা দেখিয়ে অযোগ্য লোকজনদের উৎকোচের বিনিময়ে চাকরি দিয়ে দেওয়া, এ এক অসহনীয় পরিস্থিতি। ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়াশোনার চল কমেছে, মাস্টার মশাইদের সম্মান কমেছে, ফলে ফুলে বেড়েছে শুধু নেতা,মন্ত্রী ও তাঁদের পারিষদবর্গের। রমরমিয়ে রথের চাকা চালিয়ে যান নেতা, চাকার তলায় পিষ্ট হন সাধারণ জনতা। যত কম বলা যায় ততই মানসিক শান্তি বজায় থাকে। আরে বাবা, এত কথা বলা কেন? খেয়ে দেয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারনা? সেটা পারলেই আসবে অপার শান্তি।
গতকয়েক বছর ধরে এক নতুন হুপোৎ হাজির হয়েছে। সেটা হচ্ছে দরিদ্র জনগণের উপকার করা। কিছু লোকের এটা বরাবরের অভ্যেস কারণ তাঁরা হয়তো সেই দারিদ্র্যকে খুবই কাছ থেকে দেখেছেন কিম্বা তাঁদের যে শিক্ষা প্রাপ্তি ঘটেছে তা সত্যিই খুব সুন্দর। যে কারণেই হোক না কেন সাধারণ মানুষের কষ্ট দেখলে তাঁরা স্থির থাকতে পারেন না এবং তাঁরা সাধ্যমতন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। বহু সংস্থাই আছে যারা বিপদে আপদে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান এবং এদের মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশন এবং ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের নাম প্রথমেই মনে পড়ে। এঁরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী এবং কোনরকম নাম কামানোর জন্য এঁরা কিছু করেন না, এঁদের কর্মযজ্ঞ বিশাল। এঁরা ছাড়াও কিছু সংস্থা আছে যারা বিভিন্ন সময়ে সাধারণ জনগণের পাশে এসে দাঁড়ান। কিন্তু এদের মধ্যে কতজন নিঃস্বার্থ ভাবে আসেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। এঁরা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত এবং তাঁদের পেশার প্রসারের জন্যই এগিয়ে আসেন। তাঁদের দরকার একটা প্ল্যাটফর্ম এবং একবার সেই উঁচুতলার সোপানে উঠতে পারলে আর পায় কে? দুই থেকে চার, চার থেকে আট, এঁদের খ্যাতি দিনদিন বেড়ে ওঠে এবং তার সঙ্গেই বেড়ে ওঠে তাদের ব্যবসায়িক দিক। একটা প্ল্যাটফর্ম পেলেই সেটা ভাঙিয়ে নানান কায়দায় লোকের ঘাড় ভাঙা এবং কেষ্টবিষ্টুদের সঙ্গে ওঠাবসার সুবাদে সরকারী, বেসরকারি সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন এঁরা এবং অধিকাংশ লোক ই এই জাতীয় মতলববাজ। আর কুম্ভীরাশ্রু বহানোয় এঁদের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এঁরা নিজের গাঁটের কড়ি থোড়াই খরচ করেন? না, সেই সব হয়ে গেছে প্ল্যাটফর্ম পাওয়ার আগে। এখন ধীরে ধীরে সূতোটানার পালা এবং যা খরচ হয়েছে তা সুদে আসলে উঠিয়ে আনা। এঁরা ফটোশুটে খুবই পারদর্শী এবং এঁদের বাহন এই গরীব জনগণ। সুতরাং, গরীব খোঁজ। আর এই গরীব খোঁজার প্রতিযোগিতায় সামিল হন এই জাতীয় বহুলোক। আর এই তথাকথিত গরীবদের ও পোয়াবারো। এরা একবার এই সংস্থা আর একবার ওই সংস্থায় মুখ দেখায় এবং তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সামগ্রী বাজারে বেচে দেয়। শীতের সময় যদি একই মানুষ চারটে কম্বল পায় তারা কি চারটে কম্বল গায়ে দেবে না একটা রেখে বাকি তিনটে বিক্রি করবে? আর এই বিতরণের সময় পেটোয়া ফটোগ্রাফার ফটাফট ছবি তুলে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেয় এবং কেল্লা ফতে।এই প্রক্রিয়ায় সামিল হয়েছে বহু ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো সংস্থা এবং বহু গজুদারা। আর এই তথাকথিত গরীবরাও আছে খোশ মেজাজে। বহু সংস্থা আবার এই তথাকথিত গরীবদের উন্নয়নের জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা পায় এবং তার বহুলাংশই নিজেদের বিলাস ব্যসনে ব্যয় করে এবং নামমাত্র কিছু গরীবদের জন্য বরাদ্দ করে। ব্যানার লাগানো, ফেস্টুন লাগানো খান চারেক গাড়ি থেকে কিছু তথাকথিত গরীব দরদী লোক নেমে, " অ্যাই এখানে তোরা কজন আছিস? জামাটা খুলে একটা নোংরা বা ছেঁড়া গেঞ্জি পড়ে এখানে এসে লাইন দিয়ে দাঁড়া।" কেউ বা ছেঁড়া লুঙ্গি বা গেঞ্জি আবার কেউ বা আদুর গায়েই খালি পায়ে এসে লাইনে দাঁড়ালো এবং একটা দামী গাড়ি থেকে একটু হিরো গোছের লোক, চোখে দামী সানগ্লাস, পায়ে হেব্বি জুতো নেমে এলেন এবং একজন পার্শ্বচর একটা বড় গোছের সাদা বাক্স এবং একটা মিনি বোতল তাঁর হাতে দিতে থাকল এবং তিনি সেই লাইনে দাঁড়ানো গরীবদের হাতে দিতে থাকলেন এবং ফটাফট ছবি উঠতে থাকল। সবাইকে দেওয়া হলে এক আত্মতৃপ্তির হাসি ও ঢেকুর তুলে তিনি গাড়িতে উঠে পড়লেন। সম্প্রচারের গাড়িটাও তাঁর গাড়ির পিছু পিছু চলে গেল এবং এই সঙ্গেই সাঙ্গ হল' গরীবদের উন্নয়নের পালা ।
সিরিয়ালের শুটিং না সত্যি সত্যিই কোন জনহিতকারি সংস্থার দান সেটা বোঝা গেলনা কিন্তু একটা জিনিস প্রকট হলো যে সবটাই মেকি, লাভের মধ্যে ঐ কয়েক জন গরীবদের অন্তত একদিন ভাল মন্দ খাওয়া দাওয়া। কবে বন্ধ হবে এইরকম চটজলদি দারিদ্র্য দূর করার কৌশল? যদি সত্যিই কিছু জনহিতকর কর্ম করতে হয়, তবে এমন কিছু করা দরকার যাতে লোকজন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং তাদের ভিক্ষার আশ্রয় না নিতে হয়। ভিক্ষার দান নিতে নিতে তাদের কর্মক্ষমতা একদম শূন্যে এসে ঠেকে এবং কোন কাজই তাদের করতে ইচ্ছা করেনা। কায়িক পরিশ্রমের ফসল একবার উঠতে শুরু করলে হাত পাততে তার লজ্জ্বা বোধ হবে এবং আমরা সেইদিনের প্রতীক্ষায় থাকব। যেদিন এরা মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখবে সেইদিন এই ভেকধারী সমাজসেবীও উধাও হয়ে যাবে। আমরা কি একটু চেষ্টা করতে পারিনা?