যুগল কাকা ছিলেন আমাদের স্কুলের অশিক্ষক কর্মী। মাথায় বেশি লম্বা নন কিন্তু বয়সকালে যে শরীরটা বেশ মজবুত ছিল তা দেখলেই বোঝা যেত। আর তাঁর মাথাটা ছিল বেশ বড় মাপের। হাঁটুর ওপর ধুতি আর হাফ হাতা প্রায় লাল হয়ে যাওয়া সাদা শার্ট থাকত পরনে আর খালি পা বেশিরভাগ সময়েই। কখনো সখনো বাইরে বেরোতে হলে পায়ে গলাতো টায়ার কেটে তৈরী করা চটি যা অনেকদিন চলত কারণ সেইসময় ছিলনা হাওয়াই চটি। বেশিরভাগ গরীব মানুষ ই খালি পায়ে হাঁটত আর কোন বিশেষ জায়গায় যেতে হলে সম্বল ছিল তাদের টায়ার কেটে তৈরি করা চটি।
প্রাইমারি স্কুল হতো সকালবেলায়। সাতসকালে দেখতাম যুগলকাকাকে স্কুলের সামনে থাকা বাগানে নানাধরণের ফুলগাছের পরিচর্যা করতে। রাজবাড়ি সদৃশ ছয়টি বিশাল থামওয়ালা স্কুলের বাগানের বাঁদিকে ছিল একটা বিশাল ইউক্যালিপটাস গাছ আর ডানদিকে ছিল একটা রাধাচূড়া ও কৃষ্ণচূড়া গাছ যা স্কুলের সৌন্দর্য্য আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। বৃত্তাকার বাগানে যুগল কাকার যত্নে লালিত হরেক ফুলের সমাহার। কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা সেই বাগানের কোন ফুল ছেঁড়া প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। হেডমাস্টারমশাইএর বাড়ি ছিল স্কুলের পরিধির মধ্যে এবং তাঁর বাড়ির পাশেই ছিল যুগল কাকার চালাবাড়ি। হেড মাস্টার মশাই এর বাড়ির দোকান বাজার ও যুগল কাকাই করে দিতেন কারণ আমরা কোনদিন হেড মাস্টার মশাইকে বা তাঁর ছেলেকে বাজার করতে দেখিনি এবং যুগল কাকাকেই দেখতাম বাজারের থলি হাতে নিয়ে। খুবই কম কথা উনি বলতেন মানে স্যারের কাছাকাছি থেকে উনিও চোখ উঠিয়ে একবার দেখে নিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতেন এবং প্রয়োজন মতো হেডমাস্টার মশাইএর কানে তুলে দিতেন। তখন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না আমাদের করা দুষ্টুমি কি করে হেডমাস্টার মশাই এর কানে চলে যায়। হেডমাস্টার মশাইএর ঘরের সংলগ্ন ছিল অফিস ঘর এবং দীর্ঘ বারান্দার পরের ঘরটাই ছিল স্যারদের বসার ঘর। লম্বা টেবিলের দুই পাশে সারি সারি পাতা চেয়ারে ঘর আলো করা সমস্ত দিকপাল মাস্টার মশাইরা বসতেন। দেখে মনে হতো যেন এক ঝাঁক তারা, কেউ দ্যুতিময় আবার কেউ বা সামান্য নিষ্প্রভ। জেলার সবচেয়ে নাম করা স্কুল, ছাত্র এবং মাস্টার মশাইরা সবাই যেন একটা চাপা অহঙ্কারে ভুগতাম।
সকাল সাড়ে দশটায় পিতলের ঘন্টায় কাঠের হাতুড়ির ঘা পড়ে শুরু হতো স্কুল আর বন্ধ হয়ে যেত গেট। দেরী করে এলে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকানো যুগল কাকাকে বোঝানো প্রায় একটা ভয়ানক ব্যাপার ছিল। শিক্ষা দীক্ষা বিশেষ না থাকলেও স্কুলের ডিসিপ্লিনের প্রথম পাঠ কিন্তু তাঁর ই কাছে। সমস্ত ক্লাশে নোটিশ নিয়ে যাওয়া ঐ অতবড় স্কুলের চত্বরে একা যুগল কাকার পক্ষে আর সামাল দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছিল না। আর তাছাড়া দিন দিন তো বয়স বাড়া বই কম তো হচ্ছিল না। সুতরাং তাঁর জায়গায় অন্য লোক নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কিন্তু তখন তো এত শত বুঝতাম না। গরমের ছুটির পর আর সেই পরিচিত মুখ যুগল কাকা কে দেখতে পাচ্ছিনা, আমাদের পাড়ারই বাদাম বিক্রি করা কাঁদনকে(ভাল নাম সুষেন) দেখছি নোটিশ নিয়ে আসতে। প্রথম প্রথম ভাবলাম যে ও হয়তো কিছুদিন সামাল দিতে এসেছে যুগলকাকার জায়গায় কিন্তু তা নয়, যুগল কাকা যে সবার অলক্ষ্যে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন সেটা জানতে পারলাম কাঁদনের একদিন বিনা পয়সায় বাদাম খাওয়ানোর মাধ্যমে।
ব্যালকনিতে বসে আজ হঠাৎই যুগল কাকা আমার মনে উদয় হলেন বুঝতে পারছি না কিন্তু একটা জিনিস ঠিক যে মনের মধ্যে কেউ গভীর ছাপ না ফেললে ষাট বছর পরেও সে মনের দালানে উঁকিঝুঁকি মারতে পারেনা।