তিলুর বাড়ি পুরোন শহর বন্দরের কাছাকাছি। পূর্ণ মার্কেটে বাজার করতে গিয়ে মাছ কেনার সময় হলো আলাপ। মাছ বিক্রেতা মহিলা( যাকে আমি দিদি বলে ডাকতাম) কোন এক সময় কলকাতায় থাকার দরুন বাঙলা বলতে পারত এবং কলকাতা থেকে দক্ষিণ দেশে গিয়ে ভাষার সমস্যার জন্য কেউ যদি বাঙলা বলতে পারে বা বুঝতে পারে এমন লোকের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে তবে তার মনে হয় যেন সে হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে। সুতরাং মেছুনি দিদি ও তিলুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার মানে যেন আকাশে ডানা মেলে ওড়া। মেছুনি দিদির এক বোন আবার আম বিক্রি করত। সুতরাং আম কিনতে হলে ঐ ছোড়দিদির কাছেই কেনা হতো। বাজারের কাছেই ছিল তিলুর এক ছোট্ট সেলুন( কাঠের তৈরী) যেখানে মাত্র দুজনই একসঙ্গে চুল কাটতে পারে। তিলু মোটামুটি ভাবে সারা সপ্তাহ একাই সামাল দেয় কিন্তু রবিবার বা ছুটির দিন ছেলে এসে বাবাকে সাহায্য করে। যাই হোক, বাজার করতে এসে চুল কেটে বাড়ি ফেরা একদম রথ দেখা কলা বেচার মতন। তিন বন্ধু আমরা একসঙ্গে বাজার যেতাম তিনটে স্কুটারে এবং মাসে একবার হতো তিলুর দোকানে লেবু দিয়ে সোডা খাওয়ার ধূম। ওখানে কলকাতার মতন যত্রতত্র চায়ের দোকান মেলেনা কিন্তু পাওয়া যায় লেবু সোডা বা ঘোল( বাটার মিল্ক)। যা রোদের তেজ নিম্বু সোডা বা বাটার মিল্ক ছাড়া চলাও যায় না।
সব সেলুনেই একই ছবি বিশেষ করে মফস্বল বা ছোট শহরে। বম্বেতে কারও দম ফেলার সময়ই নেই, সবাই যেন ছুটছে তো ছুটছেই। চার্চগেট স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে আর শয়ে শয়ে লোক সব রেডি হয়ে আছে ঐ ট্রেন থামার আগেই উঠে পড়বে একটু বসার জায়গা পাওয়ার জন্য। ঐ সময় কে ধাক্কা খেয়ে পড়ল বা পড়ে যাওয়া লোকটাকে পদপিষ্ট করে চলে গেল কিনা কারও ভ্রূক্ষেপ নেই। কলকাতায় ও বনগাঁ লোকালেও প্রচণ্ড ভিড় হয় কিন্তু বম্বের ভিড়ের কাছে কিছুই নয়। সুতরাং আমাদের মতন লোকের পক্ষে ঐরকম কিছু করা সম্ভব নয়। পড়ে যাওয়া লোকটাকে উঠিয়ে একটা বেঞ্চে বসিয়ে তার ছিটিয়ে পড়া কাগজ পত্রগুলো উঠিয়ে দিয়ে একটু ফার্স্ট এড দেওয়ার চেষ্টা থাকে। যাই হোক, পুরোন প্রসঙ্গেই ফিরে আসা যাক।
সমস্ত নরসুন্দরের মতন তিলুর ও স্টকে থাকা নানাধরণের গল্পের স্টক থেকে একটার পর একটা গল্প বেরোত চুল কাটার ফাঁকে ফাঁকে। নরসুন্দরদের এটা একটা বিরাট গুণ। অবাধ গতি ওদের নানান বিষয়ে সে শিল্পকলাই হোক বা রাজনীতিই হোক। অন্ধ্রপ্রদেশে অবশ্য রাজনীতি নিয়ে বিশেষ কেউ মাথা ঘামায় না যতটা আমাদের কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে হয়। ভোটের সময় স্কুটার বা মোটরসাইকেলের সামনে লাগানো পতাকা দেখেই বোঝা যায় সে কোন দলের। কিন্তু না, সেখানে না আছে কোন মারদাঙ্গা বা বুথ দখল বা রিগিং। ভোটের সময় শেষ তো সব দ্বিচক্রযান পতাকামুক্ত আর একঠেকেই আড্ডা বা পানভোজন। তিলুর কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভোট নিয়ে বিশেষ আগ্রহ। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম ওর কটা ছেলেমেয়ে? উত্তরে জানায় ওর পাঁচ ছেলে ও একটা মেয়ে।
অ্যাঁ, পাঁচটা ছেলে ও একটা মেয়ে মানে তোমাদের সংসারে আটজন সদস্য! একটু আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলাম তোমার বয়স কত এবং আজকের দিনে এত বড় সংসার! ও কিন্তু ভীষণ সপ্রতিভ ভাবেই উত্তর দিল যা শুনে তো আমরা তিনজনেই হাঁ।
ঐ যে ছেলেটাকে দেখছেন ও আমার সেজ ছেলে।
অ্যাঁ, সেজছেলে? আর বাকি রা কোথায়?
বড় দুই ছেলে ছোট দুজনকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আছে।
গ্রামের বাড়ি! কোথায় তোমাদের গ্রাম?
আর বলবেন না। বসিরহাটের কাছে আমাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি। বড় ছেলে শাসকদলের পঞ্চায়েত সদস্য। মেজ ছেলেকে কিন্তু বলেছি বিরোধীদলে থাকতে কারণ যতই পালাবদল হোক না কেন আমাদের বাড়িতে যেন কোন আঁচ না আসে। ছোট দুজন এখনও পড়াশোনা করছে। ওদেরকেও বলে দিয়েছি বাড়িকে সুরক্ষিত রাখতে গেলে যত পার্টি আছে সবজায়গায় যেন আমাদের বাড়ির কোন না কোন সদস্য থাকে।
কথায় আছে, জীবজন্তুর মধ্যে শিয়াল, পাখির মধ্যে কাক আর মানুষের মধ্যেএই নরসুন্দর অসম্ভব চতুর। বাজারের থলিগুলো স্কুটারেই আটকানো রোদেই শুকাচ্ছে। চুলকাটা শেষ করে তিনবন্ধুর বাড়ি ফিরে আসা এবং প্রত্যেক মাসেই নিজের নিজের বাড়িতে গঞ্জনা শোনা আর ভগবানের আশীর্বাদে এক কানে শোনা এবং অপর কান দিয়ে নির্গমনের ব্যবস্থা করা।