Thursday, 10 August 2023

তিলু নাপিতের বাড্ডি

তেলুগু ভাষায় বাড্ডি শব্দর অর্থ ছোট দোকান।  তিলু পরামাণিক যে কি করে অন্ধ্রপ্রদেশের ভাইজাগ শহরে এসে জুটেছিল সেটা কেউ জানেনা। হয়তো তার বাপ ঠাকুর্দা বন্দর শহর ওয়ালটেয়ারে ( ভাইজাগের  পুরোন নাম) কাজের সূত্রে এসেছিল এবং তারপর সেখানেই থেকে গেছে বংশানুক্রমে। তিলু পরামাণিক নামেই বাঙালি, কিন্তু ওখানে থাকতে থাকতে তাদের  ভাষা, চলন বলে সবই রপ্ত করে ফেলেছে তাদের মতন। তিলুর ছেলেমেয়েরা সবাই  তেলুগু মাধ্যমেই  পড়াশোনা করে এবং তার বৌ ও তেলুগু।  এসব  সত্ত্বেও তিলু  নিজেকে  বাঙালি  বলেই পরিচয় দেয় এবং বাঙালিদের অনুষ্ঠানে নিজেদের  সামিল  করে।

তিলুর বাড়ি পুরোন শহর বন্দরের  কাছাকাছি।  পূর্ণ মার্কেটে বাজার  করতে গিয়ে মাছ কেনার  সময় হলো আলাপ। মাছ বিক্রেতা  মহিলা( যাকে আমি দিদি বলে ডাকতাম) কোন  এক সময়  কলকাতায় থাকার দরুন  বাঙলা বলতে পারত এবং কলকাতা থেকে দক্ষিণ দেশে গিয়ে ভাষার  সমস্যার জন্য কেউ যদি বাঙলা বলতে পারে বা বুঝতে পারে এমন লোকের সঙ্গে পরিচিত  হতে পারে তবে তার মনে হয় যেন সে হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে।  সুতরাং মেছুনি দিদি ও তিলুর সঙ্গে আলাপ  হওয়ার মানে  যেন আকাশে ডানা মেলে ওড়া। মেছুনি দিদির এক বোন আবার  আম বিক্রি করত। সুতরাং আম কিনতে হলে ঐ ছোড়দিদির কাছেই  কেনা হতো। বাজারের  কাছেই  ছিল তিলুর এক ছোট্ট  সেলুন( কাঠের তৈরী) যেখানে মাত্র  দুজনই একসঙ্গে চুল কাটতে পারে।  তিলু মোটামুটি ভাবে সারা সপ্তাহ  একাই সামাল দেয় কিন্তু রবিবার বা ছুটির  দিন ছেলে এসে বাবাকে সাহায্য  করে। যাই হোক, বাজার  করতে এসে চুল কেটে বাড়ি ফেরা একদম রথ দেখা কলা বেচার মতন। তিন বন্ধু আমরা একসঙ্গে বাজার  যেতাম তিনটে  স্কুটারে এবং  মাসে একবার  হতো তিলুর দোকানে লেবু দিয়ে সোডা খাওয়ার ধূম। ওখানে কলকাতার  মতন যত্রতত্র চায়ের দোকান  মেলেনা কিন্তু পাওয়া যায় লেবু সোডা বা ঘোল( বাটার মিল্ক)। যা রোদের  তেজ নিম্বু সোডা  বা বাটার মিল্ক ছাড়া চলাও  যায় না।

সব সেলুনেই একই ছবি বিশেষ করে মফস্বল বা ছোট  শহরে। বম্বেতে কারও দম ফেলার সময়ই  নেই,  সবাই যেন  ছুটছে তো ছুটছেই।  চার্চগেট  স্টেশনে  ট্রেন  ঢুকছে আর শয়ে শয়ে  লোক সব রেডি হয়ে আছে ঐ ট্রেন  থামার আগেই উঠে পড়বে একটু  বসার জায়গা পাওয়ার জন্য। ঐ সময় কে ধাক্কা  খেয়ে পড়ল বা পড়ে যাওয়া লোকটাকে পদপিষ্ট করে চলে গেল কিনা কারও  ভ্রূক্ষেপ নেই। কলকাতায় ও বনগাঁ লোকালেও প্রচণ্ড  ভিড়  হয়  কিন্তু বম্বের  ভিড়ের  কাছে  কিছুই  নয়। সুতরাং আমাদের মতন লোকের পক্ষে ঐরকম  কিছু করা সম্ভব  নয়। পড়ে  যাওয়া লোকটাকে উঠিয়ে একটা বেঞ্চে বসিয়ে তার  ছিটিয়ে পড়া কাগজ পত্রগুলো উঠিয়ে দিয়ে একটু ফার্স্ট এড দেওয়ার  চেষ্টা থাকে। যাই হোক, পুরোন  প্রসঙ্গেই  ফিরে আসা যাক। 
সমস্ত  নরসুন্দরের মতন তিলুর ও স্টকে  থাকা নানাধরণের গল্পের  স্টক থেকে  একটার পর একটা  গল্প বেরোত চুল কাটার  ফাঁকে ফাঁকে।  নরসুন্দরদের এটা একটা বিরাট গুণ। অবাধ গতি ওদের নানান বিষয়ে সে শিল্পকলাই  হোক বা রাজনীতিই  হোক। অন্ধ্রপ্রদেশে অবশ্য  রাজনীতি নিয়ে বিশেষ  কেউ মাথা ঘামায় না যতটা আমাদের কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে হয়। ভোটের  সময়  স্কুটার বা মোটরসাইকেলের সামনে লাগানো পতাকা  দেখেই বোঝা যায় সে কোন দলের।  কিন্তু না, সেখানে না আছে কোন  মারদাঙ্গা বা বুথ দখল বা রিগিং।  ভোটের  সময় শেষ তো সব দ্বিচক্রযান পতাকামুক্ত আর একঠেকেই আড্ডা বা পানভোজন। তিলুর কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের  ভোট নিয়ে বিশেষ আগ্রহ।  কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম  ওর কটা ছেলেমেয়ে? উত্তরে জানায় ওর পাঁচ ছেলে ও একটা মেয়ে।  
অ্যাঁ, পাঁচটা ছেলে ও একটা মেয়ে মানে তোমাদের  সংসারে আটজন সদস্য! একটু আশ্চর্য  হয়েই জিজ্ঞেস  করলাম তোমার  বয়স কত এবং  আজকের  দিনে এত বড় সংসার!  ও কিন্তু ভীষণ  সপ্রতিভ ভাবেই উত্তর  দিল যা শুনে তো আমরা তিনজনেই  হাঁ। 
ঐ যে ছেলেটাকে দেখছেন ও আমার  সেজ ছেলে। 
অ্যাঁ, সেজছেলে? আর বাকি রা কোথায়?
বড় দুই ছেলে ছোট  দুজনকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আছে।
গ্রামের  বাড়ি! কোথায় তোমাদের  গ্রাম?
আর বলবেন না। বসিরহাটের কাছে আমাদের  পূর্বপুরুষের  বাড়ি। বড় ছেলে শাসকদলের পঞ্চায়েত সদস্য।  মেজ ছেলেকে কিন্তু বলেছি বিরোধীদলে থাকতে কারণ যতই  পালাবদল  হোক না কেন আমাদের  বাড়িতে যেন কোন আঁচ না আসে।  ছোট  দুজন এখনও  পড়াশোনা করছে। ওদেরকেও  বলে দিয়েছি বাড়িকে  সুরক্ষিত রাখতে গেলে যত পার্টি আছে সবজায়গায় যেন  আমাদের  বাড়ির  কোন  না কোন সদস্য  থাকে। 
কথায় আছে, জীবজন্তুর  মধ্যে শিয়াল,  পাখির মধ্যে কাক আর মানুষের  মধ্যেএই নরসুন্দর  অসম্ভব  চতুর। বাজারের  থলিগুলো  স্কুটারেই  আটকানো রোদেই  শুকাচ্ছে।  চুলকাটা শেষ করে তিনবন্ধুর বাড়ি ফিরে আসা এবং  প্রত্যেক  মাসেই  নিজের  নিজের  বাড়িতে গঞ্জনা শোনা আর ভগবানের  আশীর্বাদে এক কানে শোনা এবং অপর কান দিয়ে নির্গমনের ব্যবস্থা করা।

Thursday, 3 August 2023

ছোট্ট পৃথিবী

সোমবাবুর রোজ একবার  বাজারে যাওয়া চাই। কিছু লাগুক বা না লাগুক প্রত্যেক দিন  অভ্যেস বশত একবার  চক্কর না দিলে সোমবাবুর দিনটা যেন কেমন  পানসে হয়ে যায়। আর যাওয়া মানেই প্রয়োজন  না থাকলেও কিছু না কিছু উনি আনবেনই আর গিন্নীর কাছে অবধারিত ভাবে বকুনিও খাবেন। মাঝে মাঝেই বকুনির  মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেলে সোমবাবুর বাইরে বেরিয়ে যাওয়া এবং সেটাও  ঐ বাজারমুখী কিন্তু এবার  আর কোন জিনিস  আনা নয়, ওঁর মনটাকে একটু শান্ত করা। বন্ধুরা বলেন  আপনার  ঐ বাজারে কি আছে বলুন তো? রোজ ঐদিকে না গিয়ে একটু আধটু অন্য দিকে কি যেতে পারেন  না? গিন্নীর বকুনি আর বন্ধুদের শ্লেষ প্রায় একই রকম মনে হয় তাঁর কাছে। আসলে উনি যান এক বিশেষ টানে। কত রকমের লোক জন আসে বাজারে, তাদের  মানসিকতা তাদের  কেনাকাটার মাধ্যমে বোঝা যায়। কেউ এমন দরদস্তুর করে যে বিক্রেতা তাদের  আসতে দেখলেই ভাল জিনিস টা প্লাস্টিকের থলিতে ভরে রেখে দিয়ে বলে ওটা বিক্রি হয়ে গেছে। আবার  কিছু লোক এসে দাঁড়াতেই তারা বুঝে যায় যে কি জিনিস নেবেন  এবং কতটা নেবেন এবং সেই মতো বেছে বেছে ভাল জিনিসটা তাঁদের  জন্য  রেডি করে রাখে। এঁরা কোন দর দাম করেন না এবং টাকার  হিসেবটাও  করেন না। ওঁরা ভাল করেই জানেন  যে এইলোকটা তাঁর কাছে বেশি দাম নেবেনা এবং অবশ্যই ভাল জিনিসটাই  দেবে। কিন্তু সব মানুষ  তো সমান হয়না এবং বিক্রেতাদের ও সেই অনুযায়ী স্ট্র্যাটেজি নিতে হয়।

পচা মাছওয়ালা কিন্তু একেবারেই  পচা মাছ বিক্রি করেনা বরঞ্চ তার মাছটাই বাজারের  সেরা মাছ। কিন্তু সেই ছোট বয়সেই তার বাবা মায়েরা তার নামটা পচা দেওয়ায় এবং ভাগ্যের দোষে বা গুণে তাকে মাছ বিক্রি করতে হওয়ায় তাকে সবাই  পচা মাছওয়ালা বলেই ডাকে। মাঝেমধ্যে যে একটু মন খারাপ  হয়না তা নয় তবে তার যা বিক্রি তাতে বেশিক্ষণ  মন খারাপ করার  মতো সময় তার থাকেনা। পচার পাশে পানুবাবু অন্য রকম মাছ রাখেন এবং তাঁর খরিদ্দার ও সব বাঁধা। আর মাছ কিনতে গেলে চেনা লোকের কাছেই কেনা উচিত  নাহলে ঠকে যাওয়ার  সম্ভাবনা প্রবল। সোমবাবু আবার  মাছের  ভীষণ  ভক্ত নন কিন্তু কিনলে হয় পচা নাহলে পানুবাবুর কাছেই কেনেন। সমস্ত মাছবিক্রেতাই  কর্পোরেশনের তৈরী উঁচু দাওয়াতে  বসে এবং প্রত্যেকের বিক্রি করার জায়গার  নীচে একটা ছোট্ট  গোডাউন মতো আছে যেখানে অবিক্রিত মাছগুলো নুন আর বরফ মেশানো ক্রেটের মধ্যে থাকে এবং বাইরে থেকে তালা দেবার  ব্যবস্থাও  রয়েছে। সেইরকম  মাংস বিক্রেতাদের ছোট্ট গোডাউনে ছাগল  ভরা থাকে। তবে দাওয়ার  ওপর বসে বিক্রি করতে হলে কর্পোরেশনকে টাকা দিতে হয় এবং স্থানীয় নেতাদের  চাহিদাও  মাঝেমধ্যেই পূরণ  করতে হয়। বাজারের  ভেতর  যারা মাটিতে বসে তাদের  দক্ষিণার মাত্রা কম হয় এবং বাজারের  বাইরে রাস্তার  দুধারে বসা বিক্রেতারা  কেউই এই কুচো নেতাদের হাত থেকে রেহাই  পায়না। আগে যারা সাইকেল  চালিয়ে আসত, এখন তারা আসে মোটর সাইকেলে।  চোখদুটো লাল ভাঁটার মতো, মনে হয় ক্লিপ দিয়ে চোখের  পাতাটা আটকে রেখে চোখটা খোলা রেখেছে। কাশীনাথের কাছে মোটরসাইকেল থামিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বলে ওঠে দাদা," শোন্ এইসবগুলো বাড়িতে দিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।" কাশীনাথ তার খরিদ্দারদের দাঁড় করিয়ে রেখে ভয়ে আগে তার ফরমায়েশ মতো জিনিসগুলো দিয়ে আসে। ওর দেরী হলে পরদিন  থেকে ওর বাজারে  আসা বন্ধ এবং রোজগার পাতিও বন্ধ। সোমবাবুর ইচ্ছে করে টেনে দুই চড় লাগাতে কিন্তু সেই দাদার  ভয়ে সবাই  তটস্থ কারণ ও সেখানকার  কাউন্সিলরের ডানহাত, প্রোমোটারি করে, দালালি করে এবং নানাউপায়ে নিজের ও কাউন্সিলরের পকেট ভরে। সুতরাং তাকে ঘাঁটানো  মানে সাপের  লেজে পা দেওয়া। অত সাহস কার আছে? সবচেয়ে মজার  ব্যাপার  যে যদি কোন  পটপরিবর্তন হয় তাহলেও  এরা কিন্তু সেই একই জায়গায় থাকবে কারণ এরা হচ্ছে বাহুবলী কেবল মনিবটা  রামের  জায়গায় শ্যাম হবে।

পচা মাছওয়ালার উল্টোদিকে মহাদেব  বসে সামান্য  কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা হলুদ, ধনেপাতা আর কারিপাতা  নিয়ে। সামান্য পুঁজি, সামান্য ই মালপত্র,  কিই বা বিক্রি করবে আর কিই বা লাভ হবে আর পেটটাই  বা কিভাবে চলবে? সোমবাবুর কোন  দরকার  না থাকলেও  ঐ মহাদেবের  দর্শন চাইই চাই। রোজ বাজারে গিয়ে দশ কুড়ি টাকা ওকে দেওয়া চাই। নামটাই মহাদেব,  শীর্ণকায় হাড় জিরজিরে চেহারাটার  দিকে চোখ পড়লে চোখে জল এসে যায়। সোমবাবুর ঐ সামান্য সাহায্য ওকে খুব অল্প  হলেও  সাহায্য করে। ঐ মায়াময় চেহারাটার দিকে নজর পড়লেই সোমবাবুর আর মাথার  ঠিক থাকেনা। মহাদেব  লজ্জ্বার খাতিরে সামান্য  হলেও  কিছু জিনিস  দিতে চায় যেটার দরকার নেই আদৌ এবং আনলেও বাড়িতে অশান্তি। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই  চলে সোমবাবুর  আনাগোনা।
এরই মাঝে এসে গেল করোনার  মহামারী। বাজারের সব ঝাঁপ বন্ধ। লোকজন  ঠেলায় করে তরকারিপাতি বাড়ির সামনে নিয়ে আসছে। আবাসনের  বাসিন্দারা থলি ঝুলিয়ে মালপত্র  তুলে নিচ্ছে এবং টাকাপয়সা দিয়ে দিচ্ছে এবং বাকি টাকাও ঐ থলির মাধ্যমেই  ওঠানামা করছে। ঐ সবজিগুলো স্যানিটাইজার দিয়ে একপ্রস্থ মাখামাখি হবার পরে আবার  যতটা সাবধানে সম্ভব  ধোওয়া হচ্ছে এবং তার ব্যবহার হচ্ছে। ধীরে ধীরে করোনার প্রকোপ কমে এসেছে। লোকজন বাজারে প্রায় নিয়মিত  হয়ে এসেছে। পচা মাছওয়ালা, পানুবাবু, কাশীনাথরা সবাই আছে কিন্তু মহাদেবের জায়গাটা খালি। সোমবাবু কয়েকদিন গিয়েছেন এবং মহাদেবের  খোঁজ করেছেন  কিন্তু কেউ কোন  খবর দিতে পারেনি। হঠাৎই  যেন  মহাদেব  উধাও  হয়ে গেল  বাজার থেকে, জানিনা করোনার  প্রকোপে  না খিদের জ্বালায়? বাজারে আসার  তাগিদটাই যেন  হারিয়ে গেছে সোমবাবুর কাছ থেকে।