Monday, 18 September 2023

শ্রদ্ধার্ঘ্য

আমরা সাধারণত মনীষীদের জন্মদিন  বা মৃত্যু দিন শ্রদ্ধার  সঙ্গে পালন করি এবং কোন  সাধারণ মানুষ  মারা গেলে আমাদের  প্রতিক্রিয়া হয় তাৎক্ষণিক। ভাল  মানুষ  হলে সবাই বলতে থাকে, " আহা, মানুষটা খুব  ভাল  ছিল আর খারাপ  হলে বলে, গেছে, আপদ গেছে চুকে।" কিন্তু ঐ কয়েকদিন  লোকে একটু আধটু হা হুতাশ করে তারপর পৃথিবীর চলার  সঙ্গে তাল  মিলিয়ে লোকে ভুলে যায়। অবশ্য  লোকজন তো পরে, নিজের আপনজন ই শুরু করে দেয় এটা আমার,  ওইটা তোমার ( যদি একাধিক  সন্তান  থাকে)। কিন্তু কিছু কিছু লোক সাধারণ  হয়েও এমন কিছু কাজ করে যায় যেটা কিছু লোক জীবনের  শেষ দিন পর্যন্ত মনে রাখে( অবশ্যই  কৃতার্থবোধ  যদি একান্তই থাকে)। 

এইরকমই  একজন গণপতরাও কদম। কদমজী ছিলেন  আমাদের অফিসার্স কোয়ার্টারের  সিকিউরিটি গার্ড। অফিস  বেরোনোর সময় এবং অফিস  থেকে ফেরার  সময় দেখা হতো যদি তার ডিউটি থাকত। একটু  নাদুস নুদুস গোলগাল চেহারা, মাঝারি উচ্চতা কিন্তু সদা হাস্যময়। আমি যেহেতু একা থাকতাম সেইকারণে টুকটাক  কিছু কথাবার্তা আমার  সঙ্গে সবসময়ই  হতো। রিটায়ার করার  কিছুদিন আগে আমার ছেলে ট্রান্সফার  হয়ে এল এবং আমার সঙ্গেই  থাকল। রিটায়ার করার  পরেও  কিছুদিন ছিলাম অফিসের  কোয়ার্টারে এবং সেই সুবাদে সমস্ত  স্টাফদের  সঙ্গে সখ্যতা আরও  নিবিড় হয়েছিল। টুকটাক কাজ এই কদমজী বা শেলকে জী বা পাটিলজীরাই করে দিত। অফিস  থেকে ফেরার পথে প্রায়ই জিলাপি বা সিঙারা বা কোন খাবার কিনে আনতাম শুধু নিজের জন্যই নয় এই সিকিউরিটি গার্ড  বা সুইপারের জন্য ও আনতাম। প্রথম প্রথম একটু কুণ্ঠিত হয়ে নিত কিন্তু পরে তারাও খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছিল।  এরই মধ্যে কিছু কাজের  জন্য কলকাতায় আসতে হয়েছিল  ছেলের  বিয়ের ব্যাপারে। রান্নার জন্য  শোভা দিদি আসত, সুতরাং খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে হচ্ছিল না। একদিন সন্ধে বেলায় হঠাৎই  মোবাইলটা বেজে উঠল। দেখি কদমজীর ফোন।  কি ব্যাপার,  কদমজী? ওর উত্তর  শুনে মাথা ঘুরে গেল। ছেলের ভীষণ জ্বর, চোখ খুলতেই পারছে না তো কথা বলা তো দূরস্থান। সেদিন  ছিল রবিবার,  কোন ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। আমি কতকগুলো জ্বরের  ওষুধ বলে দিলাম এবং খাওয়াতে বললাম।  কিন্তু কদমজী তাঁর পরিচিত  এক ডাক্তারের  বাড়ি নিয়ে গেল ছেলেকে এবং অনেক অনুরোধ  করে তাঁকে দেখতে রাজি করালেন। উনি তাঁর পরিচিত  এক ডায়গনস্টিক ক্লিনিকে ফোন করে রক্ত পরীক্ষার  ব্যবস্থাও  করলেন এবং কদমজী সমস্ত  পরীক্ষা করিয়ে ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনলেন এবং ডিউটির রোস্টার বদল করে সারারাত ছেলের  পাশেই থাকলেন । পরে আমার  অনুরোধ মতন প্যারেল থেকে বম্বে এয়ারপোর্টে  ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে এবং বিমান কর্মীদের  সমস্ত  কিছু অবগত করালেন।  আমরা কলকাতা এয়ারপোর্ট ওকে নিয়ে সোজা হাসপাতালে  ভর্তি করে দিলাম।  আবার  রক্ত পরীক্ষার পরে ডেঙ্গি ধরা পড়ল এবং প্ল্যাটিলেট কাউন্ট বিপদসীমার  অনেক নীচে। সবাই  খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম।  তিনদিন  বাদে ছেলের  বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হবে অথচ প্ল্যাটিলেট সংখ্যার  সেরকম  কোন  উল্লেখযোগ্য  বৃদ্ধি হচ্ছে না । মেয়েদের বাড়িও ভীষণ  উদ্বিগ্ন,  আমরা তো বটেই। রেজিস্ট্রেশনের  আগের  দিন  আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু ডাক্তার ছাড়তে রাজি নন। শেষ পর্যন্ত বণ্ড সই করে ওকে বাড়ি নিয়ে এলাম  কিন্তু একটা ভয় শেষ পর্যন্ত থেকেই  গেল। ভগবানের আশীর্বাদে সবকিছুই  নির্বিঘ্নে মিটে গেল কিন্তু আমার  ঙ কদমজীর কথা মনেই থেকে গেল।

কদমজীর  অ্যাকাউন্ট নম্বর  নিয়ে ছেলের জন্য  যা খরচ করেছিল তা পাঠিয়ে দিলাম  এবং ছেলের  জীবন  ফিরে পাবার জন্য মনে মনে ভগবানকে এবং তাঁর ই প্রতিনিধি কদমজীকে অনেক ধন্যবাদ  জানালাম।  এরপর অনেকবার  বম্বে এসেছি এবং কদমজীর  সঙ্গে দেখাও করতে গিয়েছি কিন্তু দেখা হয়নি কোন না কোন কারণে। কোন  সময় ওঁর ডিউটি রাত্রিবেলায় নয়তো ডিউটি করে চলে গেছে বা নিজের  গ্রামে গেছে। বছর চারেক আগে  ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস থেকে আসার  সময় প্যারেল  হয়ে এসেছি কিন্তু কদমজী ছাড়া বাকি সকলের  সঙ্গেই  দেখা হয়েছে। ওদের  চীফ সিকিউরিটি অফিসার শেলকেজীর হাতে মিষ্টির  বাক্সটা দিয়ে কদমজীর কথা জিজ্ঞেস করায় উনি জানালেন যে কদমজী চাকরিতে ইস্তফা  দিয়ে পাকাপাকি ভাবে নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে  গেছে। সুতরাং সেবারও  দেখা হলো না। গতকাল  একটু হাতে সময় নিয়ে পুরোন  বন্ধুদের  সঙ্গে যোগাযোগ  করতে লাগলাম। ধূমলজী,  ব্যাভারেজী,  কদমজী, শেলকেজী সবাইকেই  ফোন  করলাম  এবং শেলকেজী ছাড়া আর কারও  কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে একটু বেশ ঘাবড়ে গেলাম। শেলকেজীর  মুখে জানলাম যে কদমজী করোনার  করাল গ্রাসে নিমজ্জিত  হয়েছেন  এবং  পরে ব্যাআরেজীর ফোনে জানলাম যে আমার অত্যন্ত  ঘনিষ্ঠ সহযোগী  ধূমল ও করোনার শিকার  হয়েছে। মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত  হয়ে গেল। রক্তের  সম্পর্ক  না থাকলেও এদের  কাছ থেকে যা পেয়েছি তা অমূল্য  এবং ভগবানের  কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি এই মহাত্মাদের তাঁর চরণে স্থান দেন।