ব্যস্ত শহরে প্রায় সব পরিবারের চেহারাই মোটামুটি এক। ছিমছাম সংসার স্বামী, স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ভরপূর। স্বামী এবং স্ত্রী দুজনের ই বাবা ও মা জীবিত, সুতরাং বাচ্চারা দুই তরফের দাদু, দিদিমা ও ঠাকুর্দা, ঠাকুমার সাহচর্য পায় এবং বাচ্চারা ছুটির সময় আনন্দে টইটুম্বুর। একই শহরে হলে কিছুদিন এবাড়ি আর কিছুদিন ও বাড়ি আর ভিন্ন শহরে হলে গরমের ছুটি এখানে তো ক্রিসমাসে অন্যখানে। মাঝে মাঝে দুইপক্ষের দাদু, দিদাদের নিয়ে ছুটি কাটানো। কিন্তু এটা একটা আদর্শ কল্পনায় ভরপূর চিত্র। বেশীরভাগ সময়ই এই ছবি অনুপস্থিত বিভিন্ন কারণে। যাক ঐসব নিয়ে অন্য কোন সময় আলোচনা করা যাবে।
বড় শহরে স্বামী, স্ত্রী দুজনকেই চাকরি করতে হয় আজকাল সংসারে সচ্ছলতা বজায় রাখতে । আগের দিনের মতো একেবারে নিপাট গৃহকর্ত্রী পাওয়া খুবই মুশকিল । তবে একেবারে যে অমিল তা নয়। হয় স্বামীর বিরাট ব্যবসা কিংবা স্বামী খুবই নামজাদা ডাক্তার বা উকিল, সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে চাকরি নাও করতে হতে পারে তবে সেখানে স্ত্রীরা নানারকম সামাজিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন যার নীট ফল বাচ্চারা মানুষ হচ্ছে কাজের লোক বা একটু গম্ভীর ভাবে বললে বলতে হয় ন্যানির কাছে। যে যেরকম ওজনদার লোক তাদের ন্যানিরাও সেইরকম ই ওজনদার ।
বিভিন্ন ধরণের সংস্থা রয়েছেন যারা এই কাজের লোক ( আয়া) বা ন্যানি সরবরাহ করে এবং বহু লোক সাধারণ ভাবে বা রিটায়ার করার পরে এই রমরমা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত । এখানে বিনিয়োগ সাঙ্ঘাতিক কিছু বেশী নয় তবে পরিচিতি এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ । যার পরিচিতির ব্যাপ্তি যত বেশী সে তত ভালভাবে ব্যবসা করবে। আর একবার এই বাজারে ঢুকলে তার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে বাধ্য। এদের একটা ডেটা বেস তৈরী করতে হয় কারণ বিভিন্ন লোকের চাহিদা বিভিন্ন রকম। শুধু বড় শহর ই নয় সব জায়গায়ই এই ব্যবসা এখন রমরমিয়ে চলছে। ছোট শহরে রোজগারের পরিমাণ কম আর বড় শহরে সরকারী চাকরির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাদের মাসে চারদিন ছুটি, খাওয়া দাওয়া সমেত একমাসের বোনাস। যদি সে অন্য শহর থেকে আসা লোক হয়ে তবে তাকে বছরে এক বার/ দুবার ছুটি এবং যাতায়াত বাবদ এসিতে বাড়ি যাওয়া আসার খরচ দিতে হবে। মফস্বল বা ছোট শহরে আগে যেমন ঠিকে কাজের লোক থাকত এখনও তা আছে তবে তারা চারটে পাঁচটা বাড়িতে কাজ করে যে পরিমাণ টাকা রোজগার করে তা সিভিক ভলান্টিয়াররাও পায়না। সিভিক ভলান্টিয়ারদের পনের ঘন্টা ষোল ঘন্টা কাজ করার পর তাদের ঊর্ধতন কর্মচারীদের গালমন্দ ও শুনতে হয় এবং বিনিময়ে তারা পায় মাত্র নয় হাজার টাকা। সুতরাং, তারা সুযোগ পেলেই যে চুরি করবে তাতে আর আশ্চর্য কি? যারা আবার একটু চালাক চতুর তারা তাদের ওপরয়ালার হয়ে টাকা সংগ্রহ করে এবং সেখান থেকে একটা ভাল টাকা ভাগ হিসেবে পেয়ে থাকে। আর ভদ্রবেশী ওপর ওয়ালা সামনে সুন্দর মুখোশ পড়ে ঐ সিভিক ভলান্টিয়ারকে পিছনে লেলিয়ে দিয়ে সেখান থেকে দাঁও মারে। কিন্তু ঠিকে কাজের লোকেরা মোটামুটি সাত আট ঘন্টা কাজ করে পনের বিশ হাজার টাকা কামিয়ে নেয় । আসা যাওয়ার জন্য বিনে পয়সার ট্রেন এবং যেসমস্ত বাড়িতে কাজকর্ম করছে সেখানে চা, জলখাবার ও দিনের খাওয়া হয়ে যায়। এছাড়া সরকারী অনুদান তো আছেই । বড় শহরে আয়া সেন্টার রা বারঘন্টা বা চব্বিশ ঘন্টার লোক সরবরাহ করে এবং তাদের সাম্মানিক মূল্য একমাসের টাকা। আগে গ্রামের লোক গ্রামের বাইরে প্রায় আসতো ই না কিন্তু যানবাহনের সুযোগ বৃদ্ধি ঘটায় তাদের কাজের সন্ধানে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে এবং প্রত্যেক মানুষ ই চায় তাদের শ্রী বৃদ্ধি হোক। চাকুরীরত স্বামী স্ত্রীদের ও লোকজন ছাড়া চলবে না কারণ তাদের বাচ্চা না সামলালে তারা দুজনেই কাজে বেরোতে পারবেন না আর এই কাজের লোকেরা রোজগার করে তাদের ছেলেমেয়েদের ভাল খাওয়া দাওয়া এবং শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছে আর মাঝখানে এই আয়া সেন্টারের পরিচালকরা দুইপক্ষের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়ে টাকা রোজগার করছে অনেকটা উবের, ওলা বা এয়ার বি এন বির মতো।
এখন এই বাচ্চাগুলোর কি অবস্থা সেটা একটু দেখা যাক। এই কাজের লোক বা ন্যানিরা কাজ না পোষালে চলে যাচ্ছে এবং আয়া সরবরাহকারী সংস্থারা অন্য ন্যানিকে দিচ্ছে এবং নতুন ন্যানির সঙ্গে একটু মেলবন্ধন হতে না হতেই পুরনো ন্যানি আবার উপস্থিত কারণ নতুন জায়গায় ডাল না গলায় তিনি আবার পুরনো জায়গায় ফিরে এসেছেন এবং বাচ্চাটাও পুরনো ন্যানিকে ফিরে পেয়ে স্বাভাবিক হয়েছে কিন্তু নতুন ন্যানির দোষ টা কি? কিছুই নয়, কারণ যে কোন লোক নতুন জায়গায় এসে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময়ই নেবেই কিন্তু না বাচ্চার মা না বাচ্চাটি সেই সময় দিতে রাজী নয়। অতএব তাকে চোখের জল নিয়ে বিদায় নিতে ই হবে যদিও তার সেরকম দোষ হয়তো নাই। তাকে ছলছলে চোখ নিয়েই বিদায় নিতে হবে কারণ তার সবচেয়ে বড় শত্রু সময়।