Monday, 23 December 2019

স্মৃতির অতল থেকে

কলকাতা থেকে অনতি দূরে এক রেল কলোনি লিলুয়ায়।  জি টি রোড থেকে শুরু করে প্রায় আধ কিলোমিটার বিস্তৃত গার্ডেনার রোড যেখানে রেলের বড় অফিসাররা থাকেন ।ব্রিটিশদের বানানো এই কোয়ার্টারগুলো যেমন সুন্দর, তেমনই সুন্দর রাস্তার দুই ধারে বিন্যস্ত কৃষ্ণচূড়া  ও রাধাচূড়ার গাছ। দুই চূড়োই  পাল্লা দিচ্ছে তাদের সৌন্দর্যের সমাহার নিয়ে। কে বেশী সুন্দর তা নিয়ে হয়তো একটা রেষারেষি থাকলেও থাকতে পারে। 

নিরপেক্ষ থেকেও  দুজনের সৌন্দর্যের প্রশংসা না করে পারা যায়না।  লাল হলুদের মিলনে গোটা রাস্তা এই সময়ে এক দারুণ রূপ ধারণ করে। ভোর বেলায় অজস্র ফুল রাস্তাটাকে ঢেকে দিয়ে বলে তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা। কিন্তু ঝাড়ুদারের ঝাঁটার স্পর্শে রাস্তা আবার বুকচিতিয়ে উঠে পড়ে বলে "এত দুঃসাহস তোদের, আমায় দিবি সমাধি?" ওরা হেসে বলে ,"তোমার সমাধি তোমার থেকে অনেক বেশী সুন্দর। জিজ্ঞেস করো  লোককে?"
এটা সব সময়ই সত্যি যে আমরা জীবিত অবস্থায় লোককে যতটা সমাদর করি, তার থেকে ঢের বেশী সম্মান দিই তার অবর্তমানে।

স্মৃতিখানি ফিরে আসে

স্মৃতিখানি ফিরে আসে

বহরমপুর শহরে কেটেছে আমার শৈশব ।ঘিরে ধরে বহু ঘটনা। কাকে বাদ দিয়ে কাকে নিই? কিন্তু স্বল্প পরিসরে সবাইকে একসঙ্গে তুলে ধরা আমার কম্ম তো নয়ই। যাই হোক,তুলে নিয়ে আসা যাক বহরমপুর শহরের যাত্রাপালা নিয়ে।

যাত্রা মানেই হচ্ছে চার দিক খোলা মঞ্চ ।লোক বসে থাকে মঞ্চের চার পাশে কিন্তু সব দিকেই থাকে মঞ্চে ওঠার জন্য খানিকটা জায়গা যেখান দিয়ে অভিনেতা অভিনেত্রীরা মঞ্চে ওঠা নামা করতে পারেন। একটা দিক নির্দিষ্ট থাকে মিউজিশিয়ান ও অধিকারী মশায়ের জন্য যেখান থেকে প্রম্পট করা হয়।  লালুদা ছিলেন খুবই হুজুকে এবং আমুদে। তখন বর্স্টাল স্কুলেরমাঠে এই যাত্রাগুলো হতো এবং কলকাতা ও অন্যান্য জায়গা থেকে বিভিন্ন দল আসত এবং শো করত। তখন তো টিভি আসেনি, বিনোদনের এক মস্ত উপদানছিল এই যাত্রাগুলো।  সোনাই দীঘি, ফেরারি ফৌজ, চাঁদের মেয়ে,  আরও কত নামী দামী দলের কত পালা। খাওয়া দাওয়ার পর মাকে বলতাম যাত্রা দেখতে যাওয়ার কথা। যদি বা কষ্টে মাকে মানানো গেল, বাবাকে কে বোঝাবে। ওঁর একটাই কথা উচ্ছন্নে যাচ্ছে এই ছেলে মেয়েরা। পরে লালুদা এলে  একটু জল গলতো । কি আনন্দ আমাদের তখন, বাবা রাজি হয়েছে। কোনরকম টেনশন ছাড়াই তারিয়ে তারিয়ে যাত্রাকে উপভোগ করা।

সোনাই দীঘির সেই ডায়ালগ,      "ভাবনা কাজী কাউকে ভয় করেনা" বা " ওরে কে আছিস" মাঝে মাঝে আউরে ফেলি আনন্দের আতিশয্যে কিন্তু পর মুহুর্তেই মনে পরে যায় যে বাজারের থলিটা নিয়ে বৌ যা যা বলেছে সে সব জিনিসগুলো না এলে সব কাজীই পগার পার আর কেউ আমার উদ্ধারে আসবেনা। তবুও এত সুন্দর অভিনয় আর বাচনভঙ্গী কি সহজে ভোলা যায়?

চাঁদের মেয়ে পালা চলছে। চাঁদ রায়, কেদার রায় দুই ভাই এবং বারো ভূঁইয়ার একজন এবং ঈশা খাঁ আরেকজন। চাঁদের মেয়ে ছিল যথেষ্ট সুন্দরী এবং তার রূপের মহিমা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অতএব, ঈশা খাঁ যে তাকে বিয়ে করতে চাইবে এটা তো কোন নতুন কথা নয়। প্রস্তাব পাঠালেন খাঁ সাহেব চাঁদ রায়ের কাছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? হেঁদুর মেয়ে করবে বিয়ে মোছলমানকে? চাঁদ রায় গণলেন প্রমাদ কারণ ঈশা খাঁ ছিলেন প্রবল প্রতাপশালী। উনি একটু আমতা আমতা করছেন দেখে ওঁর অনুজ কেদার রায় হুঙ্কার ছেড়ে বললেন," দূত, তুমি এই মুহুর্তে সভাগৃহ ছেড়ে চলে যাও  নাহলে তুমিই আমার রোষ বহ্নির শিকার হবে। যাও , গিয়ে তোমার খাঁ সাহেবকে গিয়ে বল, এই প্রস্তাব অত্যন্ত অবমাননাকর আর এই ধৃষ্টতার সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। দূত গেল ফিরে আর ফল যা হবার তাই হলো।

আক্রমণ করলেন ঈশা খাঁ তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে চাঁদ রায়ের রাজ্য। এই যুদ্ধের ফল নিয়ে কারও কোন সন্দেহ ছিলনা কিন্তু কতক্ষণ যুঝতে পারে সেটাই দেখার।

তখনকার দিনে  মেয়েরা যাত্রা বা থিয়েটারে অংশ নিত না। এক আধ জন নিলেও তাঁরা প্রচুর পয়সা নিতেন যেটা ছোট দলের পক্ষে মেটানো সম্ভব ছিলনা। অতএব, চট জলদি সমাধান, ছেলেরা মেয়ে সাজে। মেয়েদের অবয়ব ছেলেদের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা কিন্তু সেই খামতিটা তারা যথাযথ সাজগোজের মাধ্যমে পূরণ করে নিত। গোপাল ছিল মাকুনদ এবং চেহারার মধ্যেও খানিকটা মেয়েলিপনা ছিল । কথা বার্তাও খানিকটা মেয়েদের মতো। হয়তো মেয়েদের অভিনয় করতে করতে ঐ রকম অভ্যেস হয়ে গেছিল। আমরা তাঁকে গোপাল দাই বলতাম কারণ অত বড় মানুষটাকে তো নামধরে ডাকা যায়না সে যতই মেয়েদের অভিনয় করুন না কেন। 

গোপালদা এই পালায় হয়েছে চাঁদ রায়ের মেয়ে। ও আর তার কাকা কেদার রায় দুজনে মিলে মনের সুখে বিড়ি টানছে।এদিকে ঈশা খাঁ প্রাসাদের বাইরে অবরোধ করে আছে। দরজা ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে আর এদিকে অধিকারী সাহেবের ইঙ্গিতে কাকা ভাইঝি পুরো বিড়ি না টেনেই উঠে পড়েছে ঝন করে আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে। চাঁদের মেয়ে মানে গোপালদা তার কাকার বুকে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে ," আমি কিছুতেই মোছলমানকে বিয়ে করব না আর কাকা কেদার রায় ভাইঝির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলছে,"  কে রে সেই বাপের ব্যাটা তুকে বিয়া কুরবে বুলছে, এত্ত সহজ, উয়ার জীবভাটাই কাটি দিব। তু একদম ভাবিস না মা আর এদিকে দুজনের নাকমুখ দিয়ে বেড়ানো বিড়ির ধোঁয়ায় আমরা যারা কাছে বসে আছি তাদের কাশতে কাশতে প্রাণ বেরিয়ে যাবার যোগাড়।  এদিকে ঈশা খাঁ তাঁর খোলা তলোয়ার নিয়ে উঠে পড়েছে মঞ্চে আর বলছে কেয়া হাসিন একদম ফরিস্তা। কেয়া খুশ নসীব হুঁ ম্যায়। তো রায় জী আপ হি উনকি হাথ মেরা হাথমে দেনগে না ম্যায় উনকো জবরদস্তি লেকে জায়েঙ্গে? 

নারে, মুছলমানের বাচ্চা, তুকে এমন শাস্তি দিব যে আমার ভাইঝিকে শাদি করার ইচ্ছা মিটে যাবে।
আর কোন রাস্তা নেই। ঈশা খাঁ তখন বললেন," এ হাসিন ফরিস্তা ,তুম বিচ মে মাত আও ,ম্যায় তুমহারা চাচাযান কো এক সবক শিখাউনগা ।" কেদার রায়ের গলার শিরা ফুলে উঠেছে, অধিকারীর ইশারায় ঝন ঝনাত আওয়াজ চলছে আর খানিকক্ষণ পরেই কেদার রায় কুপোকাত। খোলা তলোয়ার বুকের কাছে এমন সময় গোপালদা মানে চাঁদ রায়ের মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঈশা খাঁ কে বলছে উকে মেইরোনা গো, ও আমার কাকা হয় আর আমাকে খুব ভালবাসে। উকে মেরোনা। আমি তুমায় বিয়া করব।

বাজতে লাগলো ঝন ঝনাত ঝন ঝনাত।
পালা শেষ আর আমরাও অনেক রাত্রে এলাম ফিরে বাড়ি।