Saturday, 12 December 2020

কোথা হে করুণা, হায় করোনা, আমি করোনাতে মরি

ইতিমধ্যে কোথা থেকে এক আপদ মারণরোগ এসে হাজির হলো আর সমস্ত পৃথিবীকে ওলটপালট করে দিল। বিভিন্ন দেশের কোণায় কোণায় বিজ্ঞানীদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতা কে আগে বার করতে পারে এই মারণ রোগের প্রতিষেধক। একে বধ করতেই হবে। প্রথমে এর উৎপত্তিস্থল কোথায় এবং অতি দ্রুত সারা পৃথিবীকে গ্রাস করতে উদ্যত এই মারণরোগকে প্রতিহত করতেই হবে যে কোন উপায়ে। ইতিমধ্যেই এই রোগ প্রায় ষোল লক্ষ লোকের প্রাণ নিয়েছে এবং শীর্ষে রয়েছে আমেরিকার মতো উন্নত দেশ এবং দ্বিতীয় স্থানে আমাদের দেশ ভারত। জনসংখ্যার বিচারে আমাদের দেশ এবং চীনের মতো দেশে মৃত্যুর হার বেশি হবার কথা থাকলেও যে কোন কারণেই হোক ছাড় দিয়েছে এই দুই জনবহুল দেশকে।
কত পরিচিত অপরিচিত লোক এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন এই মারণরোগের প্রকোপে। তাঁদের শবদেহ আত্মীয় স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি যাতে রোগ না ছড়ায়। প্রথমদিকে আমাদের প্রস্তুতির যথেষ্ট অভাব ছিল এবং এই রোগের কারণ জানা না থাকায় লকডাউনের আশ্রয় নিতে হয়। শুরুতে ভয়ানক কড়াকড়ি ছিল এবং ধীরে ধীরে আমাদের ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হয় একে রোধ করার জন্য। অনেকেই হয়তো এখনও বেপরোয়া ভাবে চলাফেরা করছেন, কেউ বাধ্য হয়ে আবার কেউ বা তাদের স্বভাবের জন্য। অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে কিন্তু এ সত্ত্বেও কিছু মানুষ এখনও অবিচলিত এবং তাদের ব্যবহারে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি কিন্তু মোটামুটি ভাবে জনগণের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। নাকমুখ ঢাকা পরিচিতজন ও অপরিচিত হয়ে যাচ্ছেন। বহুদিনের অদর্শন মানুষের ব্যবহারে এক আমূল পরিবর্তন এনেছে। অনেকেই মানসিক রোগের শিকার হয়েছেন। ডাক্তারবাবুরাও এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পাননি এবং তাঁরা ও চিকিৎসা সেবায় যুক্ত বহু মানুষ এই রোগের কবলে প্রাণ হারিয়েছেন।
প্রথমদিকে এই রোগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় রোগী বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা নানান ভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই আচরণে অমানবিকতা লক্ষ্য করা গেছে। শবদেহ পরিবারের হাতে না তুলে দিয়ে সরকারের তরফে সৎকারের ব্যবস্থা করা প্রশংসার দাবি করে কিন্তু কিছু মানুষের ঐ শবদেহ যেভাবে মৃত জন্তু জানোয়ারের মতো ব্যবহার পেয়েছে  সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং শীর্ষ আদালতকে এই বিষয়ে সরকারকে মৃতের প্রতি কি আচরণ হওয়া উচিত সেটা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। এখন মোটামুটিভাবে একটা আচরণবিধি তৈরী হয়েছে এবং অনেক সংযম লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু কিছুকিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে যার মধ্যে ডাক্তারবাবু বা হাসপাতালের আচরণও আছে। 
নাম উল্লেখ না করে একটা সত্যি ঘটনার কথা বলছি। এক অশীতিপর বৃদ্ধা হঠাৎ বিকেলের দিকে বুকে একটা যন্ত্রণা অনুভব করলেন এবং সঙ্গে শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। নিয়ে যাওয়া হলো বাড়ির কাছে এক নার্সিং হোমে কিন্তু তারা কোভিড টেস্ট না করে ভর্তি করবে না অথচ সেই দিন সকালেই আই সি এম আর স্বীকৃত এক প্রাইভেট সেন্টারে কোভিড টেস্ট করানো হয়েছে এবং সেখানে নেগেটিভ এসেছে কিন্তু তারা সেটা মানতে রাজি নয়। ইসিজি করানো হলে দেখা যায় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং বড় কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। শহরের এক নামী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে ও একই কথা। রাত্রি দেড়টা নাগাদ সেই নামী হাসপাতালে পৌঁছালেও পরের দিন সকাল সওয়া ছটা অবধি সেই বৃদ্ধাকে কোনরকম চিকিৎসা না করেই ফেলে রাখা হয়। ততক্ষণে সেই নামী হাসপাতালে করা কোভিড টেস্ট নেগেটিভ এসে গেছে। ভর্তি করার পর মূহুর্তে ই তাঁকে আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন তাঁর পালস্ রেট অস্বাভাবিক ভাবে কমে যাওয়ায় এবং অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় আবার করোনা টেস্ট করা হয় কিন্তু তার ফলাফল আসার আগেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরিবারের সদস্যরা মৃতদেহের সৎকারের জন্য বন্দোবস্ত করতে থাকেন কিন্তু ইতিমধ্যে নাইসেড থেকে রিপোর্ট আসে যে তাঁর করোনা পজিটিভ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডেথ সার্টিফিকেট লেখার আগের মূহূর্তে ঐ সার্টিফিকেট এসে যাওয়ায় পরিবারবর্গের হাতে শবদেহ তুলে না দিয়ে কর্পোরেশনকে ফোন করা হয়। খুব ভাল কাজ। কিন্তু স্বভাবতই প্রশ্নটা থেকে যায় এটা কোথা থেকে সংক্রমিত হলো আর আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে ঐ বৃদ্ধার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার কথা জেনেও তাঁকে কোনরকম চিকিৎসা না করে পৌনে পাঁচ ঘণ্টা কেন ফেলে রাখা হলো। ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে ই তাঁকে আই সি ইউতে ঢুকিয়ে ভেন্টিলেশনে দিয়ে দেওয়া হলো তখন কি তিনি সত্যিই বেঁচে ছিলেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের মুখ রক্ষার খাতিরে তাঁকে ভর্তি করলেন এবং প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করলেন? দ্বিতীয়বার কোভিড টেস্ট করে সেটা পজিটিভ এল এবং সঙ্গত কারণেই কর্পোরেশনকে খবর দেওয়া হলো। এই খানেই কিছু প্রশ্ন মনে আসে। কর্পোরেশন মৃতদেহ সৎকারের জন্য দশহাজার টাকা নেয় এবং বলে পরে তারা রসিদ দিয়ে দেবে। যেখানে মানুষটাই চলে গেলেন সেখানে রসিদ নেবার জন্য কে উৎসাহিত হবেন? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে একটাই প্রশ্ন যে এই অতিমারির সময় করোনা পরীক্ষার ফলাফল না আসা পর্যন্ত রোগীর কোন চিকিৎসা হবেনা? আরও একটা প্রশ্ন মনে আসে যে শবদেহের ঠিকঠাক সৎকার হয়েছে তো, না অন্য কোন অনৈতিক কাজে ঐ শরীরটা লাগানো হয়েছে? 
করোনায় মৃত শবদেহের সৎকারের ব্যাপারে আত্মীয় স্বজনদের কোন ভূমিকাই থাকবে না? এটা একটি ভেবে দেখার বিষয়।
গত শনিবার মানে পাঁচ ই ডিসেম্বর আমাদের কমপ্লেক্সে একজন বৃদ্ধা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এবং তাঁর প্রবাসীপুত্র তাঁর মায়ের মুখাগ্নি করার পর শবদেহ নিয়ে চলে যায় কর্পোরেশনের গাড়ি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ভদ্রমহিলা বাড়িতেই মারা যান। আমরা ভীষণ ভাবে বিচলিত যে প্রকৃত কি হওয়া উচিত। একটু সবাই ভাববেন?

No comments:

Post a Comment