গল্প নয় আর লেখক নই। কিছু পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা।।
বয়স তখন খুবই কম। লোকে গান করতে বললে লাজ লজ্জাহীন হয়েই গান শুরু করে দিতাম। সুতরাং, বয়সটা সহজেই অনুমেয়।
পাড়ার দুর্গাপুজো আমাদের বাড়ীর মাঠেই হতো অন্তত জন্ম ইশতক দেখছি। বাইরের বারান্দায় আমাদের ঠাকুর বানাতো ধীরেন পাল। পাড়ার লোকের চাঁদা দিয়েই হতো পূজো ছিলনা কোনো স্পন্সরশিপ বা বিজ্ঞাপন। ধীরেন কাকার প্রায় হাতে খড়ি আমাদের পাড়ার দুর্গা প্রতিমা দিয়ে। সুতরাং যত কম পয়সা দিয়ে করিয়ে নেয়া যায় আর কি। সব যুগেই একটা শোষণের পন্থা চলে এসেছে। মাত্র চল্লিশ টাকা দিয়ে তাকে দিয়ে দুর্গা ঠাকুর বানানো হতো। ছিল অনেক বড় বড় শিল্পী কিন্তু তারা আমাদের ধরা ছোয়াঁর বাইরে। সব চেয়ে দামী ছিলেন যামিনী পাল, তার পরে বিমল পাল, শীতল দাস এবং বাঙাল রা। লোকে বলতো বাঙাল নাকি যামিনী পালের ছাঁচ চুরি করেছে। কি করে? যামিনী পালের ঠাকুর বিসর্জনের পরে বাঙাল নাকি তার লোকজন দিয়ে মায়ের মূর্তির মাথাটা ভেঙে নিয়ে এসেছিল এবং যামিনী পালের মতনই মায়ের মুখ বানাতো ওই ছাঁচ দিয়ে। সত্যি বাঙাল সেটা করেছিল কিনা কারো জানা নেই কিন্তু লোকমুখে প্রচার হয়ে গিয়েছিল চোর বাঙাল। বাঙাল কে এভাবে বলাটা এখন মনে হয় তার শিল্পকীর্তিকে নিচে দেখানো। যাই হোক বাকিদের নিজস্বতা ছিল কিন্তু যামিনী পালের নাম উঠলেই বাঙাল এর নামটা উঠে আসতো।
এবার আসি ধীরেন কাকার কথায়। আমাকে খুব ভাল বাসতো কারণ সবাইকে ধীরেন কাকাকে বকতে শুনতাম। যে লোকটার শিল্প সম্বন্ধে জ্ঞান শূন্য সেও এসে জ্ঞান দিত। মাঝে মাঝে ধীরেন কাকাকে নীরবে চোখ মুছতে দেখতাম। আমি ছোট হলেও ধীরেন কাকার সমব্যথী ছিলাম। ঠাকুর তৈরীর কয়েকটা ধাপ আছে। শুকনো খড় দিয়ে প্রথমে শরীরটা মোটামুটি ভালো ভাবে বেঁধে তারপর একমাটির প্রলেপ পড়তো। তারপর দুমাটির প্রলেপ। তারপর রোদে শুকানো এবং সাদা রং হতো এবং তারপর যে রঙে প্রতিমাকে রাঙানো হবে সেটা হতো। এরপর চোখ আঁকা এবং সবশেষে চালি বসানো হতো। ধীরেন কাকা বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে আমাদের বাড়ীর বাইরের বারান্দায় সব কাজটাই করতো এবং নিজের বাড়ী ফিরে যাবার আগে সব জায়গাটা পরিষ্কার করে যেত। ধীরেন কাকার চ্যালা হিসেবে আমিও খুব গর্ব অনুভব করতাম মনে মনে। কাকা মাঝে জল খেতে চাইলে আমি চুরি করে দু চারটে নারকেলের নাড়ু নিয়ে দিতাম। কাকা জিজ্ঞেস করতো মাকে বলেছ তো? আমি থাকতাম চুপ করে। একদিন মা কি কারণে বাইরে আসলে ধীরেন কাকা বলে উঠলো " বৌদি নারকেলের নারুটা খুব ভালো হয়েছে। মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কোনোরকমে সামলে নিলো । পরে আমাকে বললো তুমি আমাকে না বলে কেন এই কাজ করেছ? আমি কেঁদে ফেললাম বললাম মা কাকার খুব খিদে পেয়েছিল কিন্তু কিছু বলছিল না।রোজ যে মুড়ির একটা ছোট্ট পুঁটলি আনে আজ তাও ছিলোনা। মা বললো আছছা ঠিক আছে কিন্তু এবার থেকে আমায় জিজ্ঞেস করে দেবে। আমি কেবল মাথাটা নাড়ালাম। অসুরের চেহারাটা কি রকম হবে কাকা আমায় জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম মদন দার মতন করতে হবে। মদনদা জুনিয়র ভারতশ্রী হয়েছে আর চেহারাটাও ছিল গ্রীক দের মতন। মদনদাকে নকল করার মতো আমার চেহারা কোনোদিন ছিলোনা কিন্তু মদন দা যেভাবে দেখাত সেইভাবে দেখাতে পাটকাঠির মতন চেহারায় যখন দেখালাম তখন সবাই হাসতে থাকলো কেবল ধীরেন কাকা ছাড়া। কাকা সেইমতন খড় বেঁধে ,যেখানে যেমন মাসল হবে প্রয়োজনীয় খড় বাঁধল। আমার না আছে পড়াশুনো না আছে অন্য কিছু । বুঁদ হয়ে দেখতাম ধীরেন কাকার কাজ আর অন্যান্য শিল্পীদের কাজ দেখে এসে কাকাকে বলতাম। জানিনা ধীরেন কাকা তার থেকে কোন কিছু নিয়েছিলেন কিনা। প্রায় বছর পাঁচেক কাকা আমাদের দুর্গা, কালী ,লক্ষ্মী এবং সরস্বতী ঠাকুর করেছিলেন। তারপর দীর্ঘদিন কেটে গেছে কাকার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। এখন ধীরেন কাকা নিশ্চয়ই বেঁচে নেই কিন্তু হঠাৎ এক ঝলক দমকা হাওয়ায় স্মৃতির পুরোনো পাতাটা উল্টে গেল আর এদিক ওদিক থেকে উড়ে যাওয়া পাতাগুলো যথাসম্ভব একত্রিত করে লিপিবদ্ধ করে ফেললাম।