আগে যখন যৌথ পরিবার ছিল তখন প্রত্যেক সংসারেই পাঁচ সাতটা ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের ও তাদের বাবা মায়েদের এবং অনেক ক্ষেত্রে বোন ভগ্নীপতিও তাদের সংসার এর মধ্যেই থেকে যেত। পুরোনো কলকাতায় বিশেষ করে উত্তর কলকাতায় এইরকম বড় বাড়িতে এক ছাদের তলায় বহু মানুষের বাস ছিল। মফস্বলেও এইরকম বাড়ির সংখ্যা নিতান্ত কম ছিলনা। এইসব যৌথ পরিবারকে ধরে রাখতো তাদের জমিদারি কিংবা পারিবারিক ব্যবসা। ব্যাঙ্কে যৌথ হিন্দু পরিবারের অ্যাকাউন্টে সংখ্যাও নিতান্ত কম ছিলনা। এখনও অবশ্য এইরকম অ্যাকাউন্ট আছে কিন্তু সেটা কি করে কম ট্যাক্স দেওয়া যায় সেই চিন্তা মাথার মধ্যে ঘোরার জন্য। পারিবারিক ব্যবসার তো অ্যাকাউন্ট রাখতেই হবে ,সেখানে দোষের কিছু নেই কিন্তু ট্যাক্স ফাঁকি দেবার উদ্দেশ্যে যখন সেটা ব্যবহৃত হয় তখন সেটা নিশ্চয়ই গর্হিত অপরাধ। অবশ্য এখানে ছোট বড় সবার মানসিকতাই এক। আইনের প্রাবধানে যেটা করা সম্ভব সেটা করেও রিটার্নে কিছু আয় না দেখানো এটা একটা স্বভাবে পরিণত হয়ে গেছে। গতবছর অর্থাৎ দুহাজার কুড়ি সালে সেপ্টেম্বর মাসে লোকসভায় জানানো এক তথ্য অনুযায়ী মাত্র এক শতাংশ লোক ইনকাম ট্যাক্স দেয়। কেউ কেউ বলেন, না এটা ঠিক নয়, এটা প্রায় এক দশমিক ছয় শতাংশ সাবালক লোকদের অর্থাৎ যাঁরা রোজগার করেন। এঁদের মধ্যেই রয়েছেন দরিদ্র এবং অতি দরিদ্র যাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাঁদের ট্যাক্স দেওয়ার প্রশ্ন তো আসেই না বরং তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য সরকারকে নানাধরণের সাহায্য করতে হয়। আর এই সাহায্য পাওয়ার জন্য তাঁদের রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারস্থ হতে হয় এবং এইখানেই চলে কেরামতি। আমরা তোমাদের জন্য চোখের জল ফেলব, তোমাদের কথা যথাযথ জায়গায় পৌঁছে দেব, সব ঠিক আছে কিন্তু তাতে আমাদের পেট চলবে কি করে? তোমরা আমাদের কিছু ভাগ দাও আর তোমরা ও বেঁচে থাকো আর আমাদেরও শাঁসালো করে রাখো। তোমাদের ভাগের টাকায় আমাদের ছেলেমেয়েরা ভাল স্কুলে পড়বে, বড় হয়ে বিদেশ যাবে, সেখান থেকে মেধা না থাকলেও একটা সার্টিফিকেট কিনে আনবে যার জোরে ভাল চাকরি না পেলেও নেতা হতে কোন আপত্তি নেই, তাদের দিকে তোমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে আর বলবে বাবুসাহেবকে জেতাতেই হবে, উনি তো আমাদের ঘরের ছেলে। এই খেলা চলতেই থাকবে ততদিন পর্যন্ত যতদিন এই সাধারণ মানুষের জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত না হয় এবং সেই আশা সুদূর পরাহত। তোমাদের ছেলেমেয়েরা মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পড়ুক, পড়াশোনা কিছু হোক না হোক ,দুপুর বেলায় কিছু খাবার খাক আর ফিরে এসে গুলতানি করুক আর একটু বড় হয়ে আমাদের পার্টিতে নাম লেখাক। যখন দরকার পড়বে তখন কারো বাড়িতে বোমা মেরে বা দরকার পড়লে প্রতিবাদী কন্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়ে আমাদের পার্টির পাকাপাকি সদস্য হয়ে যাবে। দরকার পড়লে আমরাই তোমাদের পুলিশের হাজতে পাঠিয়ে দিয়ে চিরতরে সরকারি চাকরির সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে আমাদের অঙ্গুলিহেলনে নাচতে বাধ্য করবো। তোমাদের জন্য মাঝেমধ্যেই চোখে গ্লিসারিন দিয়ে চোখের জল ফেলব, মাঝে মাঝেই কিছু শাঁসালো মানুষকে ঠান্ডা চোখে হুমকি দিয়ে টাকা তুলে তোমাদের খাওয়াব আর ফটোগ্রাফার আমাদের ফটো তুলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাড়বে আর লোকে ধন্য ধন্য করবে। এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর কোন রাস্তা নেই।
কিন্তু এতসব কিছু বলার সঙ্গে কুমড়োকাটা ভাসুরের কি সম্পর্ক? যে কোন যৌথ পরিবারেই এক আধটা ভাই থাকতো যারা বিয়ে থা না করে সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটি সব কাজ করতো এবং বাবা মায়েদের দেখাশোনা ,বাজার করা, ভাইদের বাচ্চাদের খেলতে মাঠে নিয়ে যাওয়া , ভাই ভাদ্দর বৌদের সিনেমার টিকিট কেটে আনা মায় যাবতীয় ফাই ফরমাস খাটা এইসব কাজ করা। এঁদের মধ্যে কেউ যদি সর্বজ্যেষ্ঠ হতেন তাহলে বৃদ্ধ বাবা মায়ের সমস্ত কিছু দায়দায়িত্ব সামলে সংসারের সব ঝামেলা মেটাতে গিয়ে আর বিয়েই করা হয়ে উঠতো না। এঁরা নিজের প্রয়োজনের কথা বলতেই পারতেন না এবং যদি বা কোন বিয়ের সম্বন্ধ এল সেটাকেও কিভাবে নাকচ করতে হয় তা এঁদের ওপর যারা নির্ভরশীল তাদের কাছে শিক্ষনীয় ছিল। কোন কোন বাবা মা বলতেন বা অন্যান্য ছেলে বা বৌমারা তাঁদের বলতে বাধ্য করতেন যে ও তো বিয়ে করবে না বলেছে। আর সেই বড় ভাই কি করে লজ্জ্বার মাথা খেয়ে বলেন যে আমি বিয়ে করব। সেটা বলাও হতো না আর তিনি অকৃতদার হয়ে সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করে একদিন পৃথিবীর মায়া ছাড়াতেন। অত বড় সংসারে সবার মুখে খাবার জোগাতে শস্তার তরকারি কুমড়ো আসত কিন্তু কোন ভাই বা ভাইয়ের বৌদের ঐ কুমড়ো কাটার ইচ্ছে না থাকায় সেই অগতির গতি বড়ভাসুরকে অনুরোধ কুমড়ো কেটে দেওয়ার জন্য। যুক্তি শুনলে মাথা ঘুরে যাবে। কুমড়ো কাটলে তাদের স্বামীদের জীবন হানির আশঙ্কা থাকে। এই কথা শোনার পর আর কোন ভদ্রলোক আর কুমড়ো না কেটে থাকতে পারেন। কে চান তার ভাইয়ের বৌ বিধবা হন।এই কারণেই তাঁদের কুমড়ো কাটা ভাসুর বলা হতো।
এবার আসি আমাদের দেশের নব্য যুগের কুমড়ো কাটা ভাসুর কে হতে পারেন? হয়তো এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুব কম হলেও এখনও আছেন এইসমস্ত বিরল প্রজাতির মানুষ যাঁরা নিজেদের স্বার্থ না দেখেই অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। নিশ্চয়ই একজনের কথা বিশেষ ভাবে মনে আসে আর তিনি হচ্ছেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার শ্রী রতন টাটা মহাশয়। দেশের প্রয়োজনে, দশের প্রয়োজনে তিনি যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাতে একনম্বর কুমড়োকাটা ভাসুর তিনিই হতে পারেন। ভারতের মতন এত বড় দেশে আরও অনেক ভাই রয়েছেন কিন্তু তাঁরা নিজেদের সম্পদ বাড়িয়েছেন এবং তুলনামূলক ভাবে দেশের জন্য সেরকম কিছু করেন নি। অবশ্য একেবারেই কিছু করেন নি বললে সত্যের অপলাপ হবে কারণ তাঁরা বহুলোকের অন্নসংস্থান করেছেন এবং দেশের অগ্রগতিতে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন কিন্তু তাঁরা কেউই এঁর সমগোত্রীয় নন। অকৃতদার এই ভদ্রলোক বিভিন্ন সময়ে যথেষ্ট অপমানিত হয়েছেন কিন্তু তিনি ন্যাড়া বেলতলায় একবার যান এই প্রবাদ বাক্যটিকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবন কামনা করি এবং ভগবানের কাছে অশেষ প্রার্থনা আরও অনেক রতন টাটা সৃষ্টি করুন তিনি যাতে আমাদের মতন স্বার্থপর লোকেরা যারা আমাদের কোন দায়িত্ব নেই এবং অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে আরও নিশ্চিন্তমনে ঘুমাতে পারি।
No comments:
Post a Comment