Monday, 23 August 2021

ITU 9 Bed No.2 of RTIICS

অনেকদিন ধরেই  ভাবছি জীবনের প্রথম হাসপাতালে থাকার  অভিজ্ঞতা একটু লিপিবদ্ধ করার কিন্তু শরীর টা জুৎসই  না থাকার জন্য কিছুতেই  তা হয়ে উঠছিল না। আজ শরীরটা একটু ফুরফুরে অনুভব করতেই বসে পড়তে ইচ্ছে হলো একটু দুচার কলম লিখে ফেলার ঘটনাক্রম ভুলে যাবার  আগেই। 
অনেকদিন  ধরেই হাঁটুর  ব্যথা একদম কাহিল করে দিয়েছে। বন্ধ সমস্ত  রকমের  কাজকর্ম  করা। গোদের ওপর বিষফোড়া করোনা। বাড়িতে যারা দেখা করতে আসত, তারাও  ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় না। সামাজিক  মেলামেশা একদম বন্ধ। বন্ধুবর  অমিত বাবু যাঁর সেলুনে  চুল কাটা ছাড়াও বাড়তি পাওনা ছিল  চা এবং অসাধারণ  ভক্তি গীতি। ভারী মিষ্টি গলা ছিল  তাঁর, যদিও  কস্মিনকালেও  তিনি গান  শেখেন নি। তাঁর চলে যাওয়াটা এক ভীষণ  আঘাত যদিও  বয়স মাত্র  পঞ্চান্ন। এই করোনার  মাঝে যখনই  সরকার নিয়মকানুন একটু  শিথিল  করেছেন  তখনই  বন্ধু আমার সকাল  বেলায় দোকান  খোলার আগেই  আমার  বাড়িতে  এসে আমাকে ভদ্রলোক  বানিয়ে গেছেন। সেইদিন ও তিনি এসেছিলেন এবং তাঁর গুরুদেবের আশ্রমে লোকনাথ বাবার জন্মতিথি  পালনের  জন্য চাঁদা নিয়ে গেলেন আর তার কয়েকদিন  বাদেই তাঁর  ছেলের  কাছথেকে  তাঁর  হঠাৎই  চলে যাওয়ার  খবর পেয়ে একদম বাকশূন্য  হয়ে গেলাম। এই অতিমারিতে অনেক আত্মীয়স্বজন,  বন্ধুবান্ধবদের হারিয়ে হাসপাতাল সম্বন্ধে এক অত্যন্ত  ভয়াবহ ধারণা হয়েছিল। হাঁটুর  অবস্থা দিনদিন  খারাপ  হচ্ছে কিন্তু অপারেশনের  কথা ভাবতেই  পারছিনা এই অতিমারি এবং হাসপাতালের  কথা ভেবে।এরপর  অনেক কিছু  সমস্যা এসে যাচ্ছে একের পর এক। সহধর্মিনী এসে পড়লেন বম্বে থেকে। ইতিমধ্যেই  বন্ধুবর  অমলবাবু একদিন  সার্জেনের  কাছে নিয়ে গেলেন এবং মোটামুটিভাবে স্থির হয়ে গেল অপারেশনের। আগে যাঁকে দেখিয়েছিলাম তিনি পিয়ারলেস হাসপাতাল  ছাড়া কোথাও  করেন না কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবহার ঠিক  মনঃপূত  না হওয়ায় একরকম  বাধ্য হয়েই  অন্য ডাক্তার এবং অন্য হাসপাতালের  খোঁজ  করতে হলো। আমার  ভাগ্নী এবং একজন  বন্ধুস্থানীয়  দাদা যাঁর  কাছে হাঁটু অপারেশন করিয়েছেন এবং খুব ভাল  আছেন তাঁর  সঙ্গেই  যোগাযোগ  করলাম এবং বলা যায় প্রথম দর্শনেই  প্রেম। 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসপাতালে ডাক্তার সৌম্য চক্রবর্তীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হল এবং সেটাও আমাদের  অর্জুন অমলবাবুর তত্ত্বাবধানে। স্থিতপ্রাজ্ঞ  অমলবাবুই ছিলেন  হোতা আমাদের  দাদাস্থানীয় বন্ধু বিমান দার অপারেশনের  সময় এবং সেই একই  ডাক্তার  সৌম্য চক্রবর্তীর কাছে। ওঁর প্রথম  হাঁটু আঠারই  ডিসেম্বর দুহাজার উনিশে এবং দ্বিতীয় হাঁটু বিশে  ডিসেম্বর  করা হয়েছিল এবং তিনি এখন  সম্পূর্ণ  সুস্থ।  তাঁর  সেই  প্রথম  অভিজ্ঞতার ফলের হিসাব আমি অপারেশনের  আগে যেসব  পরীক্ষা করানোর  দরকার  সেগুলো করিয়ে নিয়েছিলাম  এবং তাতে আমাদের পরিশ্রমের  সুরাহা হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে দিন স্থির হল যে উনিশে জুলাই  প্রথম  হাঁটু এবং একুশে জুলাই  দ্বিতীয় হাঁটুর অপারেশন  হবে। আঠারই  জুলাই  সমস্ত  বন্ধুবান্ধব  একরকম  প্রায় ব্যান্ডপার্টি  বাজিয়ে আমাকে ভর্তি করে দিল  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসপাতালে। আমার  মনে হচ্ছিল  সতীদাহের সময় ঢাকঢোল বাজিয়ে সতীকে যেমন স্বামীর চিন্তায় সহমরণে যেতে বাধ্য  করা হতো ঠিক সেরকমই  যেন খানিকটা। আবার  কোন কোন সময় এটাও  মনে হচ্ছিল  যে পাঁঠাকে  বলি দেবার  আগে স্নান  করিয়ে কপালে সিঁদুর পরিয়ে যূপকাষ্ঠের সামনে যখন আনা হয় তখন  পাঁঠার যেরকম  মনের  অবস্থা হয় আমারও  যেন সেই অবস্থা। কিন্তু যে কষ্ট এই কয়েকবছর  পেয়েছি সেটা যখন ভাবছিলাম  তখন  মনে মনে একটা বল ভরসা পাচ্ছিলাম  এবং পাঁঠার  থেকে মনের দিক সামান্য একটু হলেও ঘএগিয়েছিলাম। অবশ্য  পাঁঠার  মনে এই ভাবোদয় যদি কখনও  হয় যে আমার  জন্মই হয়েছে লোককে মাংস খাওয়ানোর  জন্য, তাহলে ভগবানের  সামনে যদি উৎসর্গ হতে পারি তাহলে  পুণ্য বই পাপ তো হবেনা। যাই হোক,  মনের  মধ্যে যে ঝড় চলছিল তা বাইরে কিছুতেই  আসতে দেওয়া যাবেনা। ভিজিটিং  আওয়ার্স শেষ  হবার  পরেই  সাজো সাজো  রব পড়ে গেল। একজন  মেল নার্স  এসে বাঁহাতে  চ্যানেল  করে গেলেন। তিনি হঠাৎই জিজ্ঞেস  করে বসলেন যে স্যার  এই অল্পবয়সে আপনি কেন  হাঁটুর অপারেশন করাচ্ছেন? আমি তো হতচকিত হয়ে গেলাম।  তার  মানে সত্তর  বছরের পরে অপারেশন  না করালে আবার  কবে করাব? তিনি উত্তর শুনে একটু ঘাবড়ে  গেলেন।  অ্যাঁ, আপনার  বয়স সত্তর? হ্যাঁ, এই দুদিন  আগেই  জন্মদিনে পায়েস খেয়ে, কেক কেটে বাংলিশ হয়ে তবেই  না এসেছি এখানে। না না স্যার, বিশ্বাস  করুন , আপনাকে দেখে  পঞ্চাশ বাহান্নর বেশি লাগছেই  না। উত্তরটা শুনে মনে মনে ভাবলাম হুঁহুঁ বাবা, গডরেজ  কালি মেহেন্দি কি কামাল।  জানিনা কতটা আমার  মনোবল বাড়ানোর  জন্য  আর কতটাই  বা সত্যতা  আছে তার  মধ্যে। কিন্তু মনে মনে একটা খুশির  আমেজ ছড়িয়ে গেল। ঠাঁই  হয়েছে কেবিন নম্বর  আঠারোয় । অপারেশনের  আগে যা যা করণীয় একে একে তা সমাপ্ত হচ্ছে কিন্তু মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। সকাল  বেলায় স্নান সেরে রেডি হয়ে বসে আছি ।অন্য একজন  নার্স  এসে অ্যাপ্রন পরিয়ে দিলেন এবং স্ট্রেচারে শুয়ে অপারেশন থিয়েটারের  দিকে যাত্রা শুরু হল। নিজেকে কেমন  যেন  একটা রাজা রাজা মনে হচ্ছিল।  ঐসময়  আমিই  তো আকর্ষণের  কেন্দ্রবিন্দু। ওটিতে  ঢোকার  আগের  মূহুর্তে দেখলাম ভাই  দেবাশিস, বন্ধু অমলবাবু ও  আমার  স্ত্রীকে। হাত নাড়িয়ে একটু হেসে সবার কাছে বিদায় নিয়ে যুদ্ধযাত্রায়  রওনা দিলাম। 
শুরু হল অ্যানেসথেসিয়ার কামাল। শিরদাঁড়ার  নীচের  দিকে পুটুশ  পুটুশ  করে গোটা চারেক  ইঞ্জেকশন দেওয়া হল এবং আমাকে বলা হল শুয়ে পড়ার জন্য। এর খানিকক্ষণ  পরে আমাকে বলা হল পা দুটো তোলার জন্য।  আমি বহু চেষ্টা করেও পা নড়াতেই  পারলাম  না। তখন  শুনতে পেলাম  যে ঠিক  আছে, অ্যানেসথেসিয়া সাকসেসফুল।  চোখের  উপর একটা কাপড় দিয়ে দেওয়া হল এবং মাথা ওঠাতে বারণ করা হল। ইতিমধ্যেই ডাক্তার  সৌম্য চক্রবর্তী এসে গেছেন  এবং আমাকে সকালের  শুভেচ্ছা  জানিয়ে তাঁদের  কাজ  শুরু করে দিলেন।  মাথা এবং শরীরের  মাঝে একটা পর্দা টেনে দেওয়া হল যাতে আমি  মাথা তুলে কি হচ্ছে তা দেখতে যেন  না পাই।
খানিকক্ষণ  পরে করাত চলার ভয়ানক  আওয়াজ  কানে আসছে কিন্তু টের পাচ্ছিনা কিছুই।  অবশ্য  টের পেলে যে কি হতো ভগবান  জানেন। এরপর  শুরু হল হাতুড়ির আওয়াজ। নতুন  হাঁটুর  প্রতিস্থাপন  চলছে কিন্তু আমার  মনে হচ্ছে কামারশালায়  কাস্তে,  কোদাল  তৈরী হচ্ছে। সবার কথাই  শুনতে পাচ্ছি কিন্তু স্পীকটি  নট। এর খানিকক্ষণ  পরে ডাক্তার সৌম্য চক্রবর্তীর  গলা, শ্যামল বাবু ,অপারেশন  হান্ড্রেড  পার্সেন্ট  সাকসেসফুল।  খুব ভাল  হয়েছে।  উনিতো বিদায় নিলেন  এবং এর কিছুক্ষণ  পরে আবার  রাজার মতো স্ট্রেচারে শুয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম এবং দেখা হল ঐ তিনজনের সঙ্গে। এবার  ঠাঁই  হল ছতলায়   নয় নম্বর আই টি ইউ এর দুনম্বর  বেডে।  সন্ধে বেলায় ডাক্তার সৌম্য চক্রবর্তী এলেন  এবং একটা ইন্টারভেনাস চালাতে বললেন  এবং হার্ট বিট পঞ্চাশ হলেই যেন  ওটা বন্ধ করে দেওয়া হয় কারণ ঐ ওষুধটা চালালে হার্ট বিট কম হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে  এটাও  বলে গেলেন  যে কোনরকম  অসুবিধে হলেই যেন  তাঁকে খবর দেওয়া হয়। শরীরের  বিভিন্ন  জায়গায় নানান জাতীয় নল লাগানো, ভিন্ন ধরণের  কাজ তাদের।  নড়াচড়া করার  উপায় নেই। মাঝরাতে হাতটা পায়ের  দিকে লাগল। চমকে উঠলাম। এটা কার শরীর? আমি কি শবদেহের স্তূপের  মধ্যে শুয়ে আছি , না কি? টিভিতে দেখেছিলাম  করোনার  সময় স্তূপীকৃত লাশের  মধ্যে থেকে  বড় লোহার  আঁকশি  দিয়ে একটা একটা লাশ কি করে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমারও  খানিকটা সেরকমই  মনে হচ্ছিল  কিন্তু উপায় নেই,  এখন  এই অবস্থায়ই  থাকতে হবে। মাঝে মাঝেই একজন  দুজন  আসছে এবং মনিটরের  দিকে নজর দিচ্ছে। কোনসময় নতুন  স্যালাইন চালাচ্ছে বা কোন সময় ওষুধ  দিচ্ছে চ্যানেল  দিয়ে। ইতিমধ্যে ডিউটি বদল হচ্ছে। বিভিন্ন  ধরনের  ইউনিফর্ম,  কারো সবুজ, কারও খয়েরি  আবার  কারও  বা নেভি ব্লু। যাদের  সবুজ  ড্রেস  তারা জুনিয়র  নার্স, খয়েরি রঙ পরিহিতরা  সিনিয়র  নার্স এবং নীল পোশাকধারীরা ডাক্তার। এসবগুলো  হয়তো সবাই  জানে কিন্তু  আমি যেহেতু হাসপাতালে প্রথম  এসেছি সেহেতু সবকিছুই  আমার  কাছে নতুন। বৃদ্ধ লোকের অ,আ,ক,খ শেখার  মতন। রাতের  ডিউটির রোস্টারের সঙ্গে মেলানো হচ্ছে কে কে এসেছে আর যারা নির্দিষ্ট  সময়ের  মধ্যে আসেনি তাদের  জায়গায় ডবল ডিউটি করতে বলা হচ্ছে কাউকে কাউকে। এটা কেউ কেউ  করতে চায় আবার  কারও কারও খুবই অনীহা। এইরকম  একজন ইচ্ছুক  ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম কেন  সে ডবল ডিউটি করতে চায়? উত্তরে জানলাম  যে এটাতে সে ওভারটাইম বাবদ পাঁচশো টাকা এবং ফ্রীতে  খাবার  পাবে। সত্যিই তো, গরীব ঘরের  ছেলে, মাইনে বাবদ আঠার হাজার  টাকা থেকে পি এফ বাবদ  কিছু টাকা কাটিয়ে, ঘর ভাড়া মাসে আট,নহাজার  টাকা দিয়ে, বাড়িতে কিছু টাকা পাঠিয়ে কিই বা তারা খাবে আর কিই বা জমাবে?  চারিদিকে এত সমস্যা কিন্তু সমাধানের  রাস্তা আমার  জানা নেই। শুনি আর কেবলই  কষ্ট  পাই। তবে একটা জিনিস  নজরে পড়ল যে এত কষ্ট  সত্ত্বেও মুখের হাসি কিন্তু মেলায় নি এবং সেবার যে আদর্শ  তার  থেকে এতটুকু ও বিচ্যুতি ঘটেনি। আমার  উল্টোদিকের  সারির বেড সাতনম্বরে একজন বর্ষীয়ান বিধবা ভদ্রমহিলা যাঁর  কোন সন্তান সন্ততি নেই কিন্তু পয়সার কোন অভাব  নেই কেবলই  অস্ফূট স্বরে বলে চলেছেন ঠাকুর  আমায় এবার  নিষ্কৃতি দাও আর দুই  চোখে বয়ে চলেছে অবিশ্রান্ত জলের  ধারা। একটি অল্পবয়সী মেয়ে( নার্স) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে আর বলছে দিদা, কাঁদছো কেন , তুমি ভাল  হয়ে যাবে আর আবার  আগের মতো সব কিছু ঠিক  হয়ে যাবে। কিন্তু অন্ধের  কি বা দিন  আর কিই বা রাত্রি। খুব  ইচ্ছে হচ্ছিল  তাঁর সঙ্গে কথা বলার  কিন্তু দূরত্বের জন্য সে আশা আর পূর্ণ  হল না। আর নয় নম্বর  বেডে একজন  রোগী কিন্তু সম্পূর্ণ  ভিন্ন  চরিত্রের।  কেবলই  চেঁচাচ্ছেন আর পয়সার  গরম দেখাচ্ছেন  আর নার্স,  ডাক্তার  সবাইকেই  গালিগালাজ  করে চলেছেন। সবাই  অতিষ্ঠ  হয়ে উঠেছে। হক, হক করে আওয়াজ আসছে আর ডাক্তার,  নার্সদের মুন্ডপাত হচ্ছে আর তার সাথেই ঐ ওয়ার্ডের  সমস্ত  রোগীদের দফারফা। কয়েকজন  ডাক্তার  এসে তাঁর  ভিতরের  কফটা  বের  করে দেবার পরেই শুরু হল জল জল বলে  তারস্বরে চিৎকার। জল দেওয়ার পরেই শুরু হল বাটি বাটি বলে চিৎকার  এবং যথারীতি গালাগালি  কিন্তু একজনের ও মুখ থেকে কোন খারাপ শব্দ বেরোল না। খুবই  ভাল লাগল তাদের  অসাধারণ  ট্রেনিং এর কথা ভেবে। এর  জন্য আমি নিশ্চয়ই  বাহবা দেব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এত কষ্টের  মধ্যেও  যে ছেলেমেয়েরা হাসিমুখে সেবা করে চলেছে তার  জন্য  কোন প্রশংসাই  যথেষ্ট  নয়। উনিশ তারিখ  রাতে একটি ছেলে এল আমাকে দেখাশোনা করার  জন্য।  নাম জিজ্ঞেস  করায় জানালো যে রাজেশ  দেবনাথ। চোখেমুখে  তার  ফুটে উঠছে সহৃদয়তা। এতটুকু চোখের  পাতা এক না করে শুধু আমাকেই  নয় সমস্ত  রোগীদের  যেভাবে দেখাশোনা করল তাতে মনটা শ্রদ্ধায় ভরে উঠল। সকাল  বেলায় তার রিলিভারকে  সমস্ত  কিছু বুঝিয়ে দিয়ে আঙ্কল আমি যাচ্ছি। এই মেয়েটি এখন  আপনাকে দেখবে। ইতিমধ্যেই  চলে এসেছে আমার পায়ের এক্সরে করতে, কেমন  হয়েছে অপারেশন  দেখার  জন্য। এরপর  দুজন এলেন পায়ে ব্রেস পরিয়ে হাঁটানোর  জন্য। আমার  দেখাশোনা করার জন্য যে মেয়েটি এসেছিল তার নাম দেবলীনা। একটু বেশিই  কষ্টের  মধ্যে থাকে সে, যেটা বোঝা যাচ্ছিল  তার  ব্যবহারে। সব কিছুই  করছে মেয়েটি কিন্তু চোখেমুখে  খুব  ক্লান্তির  ছাপ। এরমধ্যেই  আর একটি মেয়ে তাকে কিছু বলেছে সাহায্যের জন্য কিন্তু ও তার  আবেদনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিলনাএবং আমার ই পরিচর্যা করতে থাকল। আমি তাকে বললাম  দেবলীনা তুমি বরং ওকে গিয়ে একটু সাহায্য  কর। ও বেচারা ঠিক  বুঝতে পারছেনা কি করা উচিত।  তার উত্তরে সে বলল যে  একদিন  দেবলীনা  ওর কাছে সাহায্য  চাওয়ায়  সে করেনি। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম  যে ঠিক  আছে তুমি তাকে সাহায্য  করে বুঝিয়ে দাও  যে সেদিনের  ব্যবহার  তার  ঠিক ছিলনা। কিছুক্ষণ  পরেই  তাদের  দুজনের চোখেমুখে ফুটে ওঠা  আনন্দ  দেখে নিজের  মনটাই খুশিতে ভরেj উঠল।ইতিমধ্যেই  দিন গড়িয়ে সন্ধে হল, এল দীপা আমাকে দেখার  জন্য। সারারাত  আমার পায়ের  কাছে বসে মনিটর করছে।কখনও  চালাচ্ছে স্যালাইন  কখনও  অন্য  ওষুধ। পরের দিন  সকালেই  ডান হাঁটুর অপারেশন আর দীপা যেন  এক অতন্দ্র প্রহরী। যারাই  এসেছে আমার দেখাশোনা করতে তারা সবাই  নর্থ ইস্টের  ছেলেমেয়ে। কেউ ত্রিপুরার,  কেউ মেঘালয়ের,  কেউ বা নাগাল্যান্ডের আবার  কেউ  বা মণিপুরের। মনে মনে গেয়ে উঠলাম  বিবিধের  মাঝে দেখ মিলন মহান। ইতিমধ্যেই সেই গালাগাল দেওয়া ভদ্রলোক কে অন্য  কোথাও  পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আর বেশ শান্তির  পরিবেশ  তৈরী হয়ে গেছে ওয়ার্ডে। দ্বিতীয় অপারেশনটাও বেশ রাজকীয় ভাবেই  সম্পন্ন  হয়ে গেছে এবং সন্ধেবেলায় যার সান্নিধ্য  আমি পেলাম  তার নাম  পরমার্থ। পরমার্থ ভৌমিক,  ত্রিপুরার  ছেলে। রাত্রি পৌনে বারটায় সে আমার ড্রেস চেঞ্জ করে দিল।  রাত দেড়টায় দেখি  সে এদিক থেকে ওদিক করছে এবং প্রত্যেকটি রোগীদের  খেয়াল  রাখছে। মনটা অপূর্ব  কৃতজ্ঞতায়  ভরে উঠল।  ডেকে বললাম,  ভাই  আপনি একটু বসবেন  না? স্যার,  আমি যদি বসি তাহলে আপনাদের  কে দেখবে? এই উত্তরে আমি আশ্চর্য  হয়ে গেলাম  ছেলেটির  কমিটমেন্ট  দেখে। অনেক উচ্চপদে  আসীন  লোকদেরও  এই ধরণের  আচরণ  দেখা যায়না আবার  খুব  সাধারণ  লোকের ও এই ধরণের  আচরণ শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে  দেয়। ওর ফোন নম্বর নেবার  জন্য  মনটা হাঁকপাঁক করতে লাগল এবং অবশেষে নিলাম ও। আরও  কিছু ছেলেমেয়েদের  ব্যবহার খুবই মনে রাখার  মতন। অভিজিত, রণজিত,  স্বাতী এবং আরও  একজনের যার নামটা জিজ্ঞেস  করা হয়নি। আমি তার  নাম দিয়েছি ত্রিপুরেশ্বরী।  ছোট্ট খাট্টো সুন্দর মেয়েটি সকাল  বেলায় এসেই মিষ্টি সুরে জিজ্ঞেস  করত," দাদু ,কেমন  আছ?" মনটা আনন্দে ভরে যেত। কেউ ডাকে স্যার, কেউ ডাকে আঙ্কল আবার  কেউ বা ডাকে কাকু কিন্তু দাদু ডাকের একটা আলাদাই  মাহাত্ম্য।  আমার  ভাইপো, ভাগ্নী দের ছেলেমেয়েরা কেউ ডাকে দাদাভাই,কেউ বা বলে ছোড়দাভাই। আর নিজের  নাতনি ডাকে ভাই  বলে কিন্তু দাদু ডাকের একটা আলাদাই মজা। হঠাৎই  লাফিয়ে একটা জেনারেশন  উঠে পড়লাম  কিন্তু যে আনন্দ  পেলাম  তা ভাষায় বর্ণনা  করতে  পারব না। আজ বাইশ তারিখ,  আই টি ইউ থেকে আমার  বিদায় নেওয়ার পালা। তার আগে যথারীতি এক্সরে নেওয়া এবং হাঁটানোর  পালা শেষ।  লাঞ্চের পরে আমাকে চলে যেতে হবে। এদিকে একনম্বর  বেডে একজন রোগীনী  এলেন  অপারেশনের পর।  যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন  আর ব্রাত্য  ব্রাত্য  বলে ডাকছেন। মাঝে মাঝেই  মা মা বলে যন্ত্রণায় ডেকে উঠছেন। মনটা খুব খারাপ লাগতে শুরু করল কিন্তু আমার  তো কিছুই  করার নেই।  অবশেষে রণজিত  আমার  কষ্টের  অবসান  ঘটিয়ে আমাকে আটতলায়  কুড়ি নম্বর  কেবিনে স্থানান্তরিত  করল।
বাইশে  জুলাই বিকেল বেলায় বাড়ির লোকজন এসেছে। অনেকদিন পর তাদের  দেখে আইটিইউ ছাড়ার  দুঃখ খানিকটা কমলো।  কিন্তু করোনার থাবা আবার  নতুন  করে বসতে শুরু করায় বিধি নিষেধের  মাত্রাটাও  বেড়ে গেল।  একজনের  বেশি লোককে আসতে দিচ্ছেনা। অথচ বন্ধুবান্ধবদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয় কিন্তু স্বাস্থ্য বিধির কথা চিন্তা করে একরকম  বাধ্য হয়েই দেখতে আসা বন্ধ করতে হলো। এরই মধ্যে অতনু আরটি পিসিআর  টেস্ট করিয়ে ফেলেছে আমার  সঙ্গে থাকবে বলে কিন্তু শনিবার রাতে রিপোর্ট  আসায় কেবলমাত্র  রবিবারের  জন্য  ওর থাকাটা অনেকটাই  নিরর্থক  হয়ে যাবে বলে ওকে নিষেধ ই করলাম।  যদি ও থাকতো তাহলে ওকে কেবিনের মধ্যেই  বন্দি থাকতে হতো কারণ  ওরা কেবিনে থাকা লোকদের  বাইরে যেতে দিচ্ছেনা।আর আমাকে সোমবার  ছেড়ে দেবে বলেছে। পরমার্থ এখানে শেরউইন বলে একজনের নাম উল্লেখ করেছিল। ও আমার সঙ্গে এসে দেখাও করলো। এও খুব  ভাল  ছেলে। দীপক  দাস, গৌতম মাইতি প্রত্যেকে খুব ভাল  ছেলে। এত ভাল  লোকদের  সংস্পর্শে এসে বাড়ির  লোকের  না আসাটা যেন  কিছুই  মনে হচ্ছিল না। দেখতে দেখতেই  সোমবার  বা ছাব্বিশ  তারিখ  এসে গেল।  আমাকে আজ ছেড়ে দেবে। কিন্তু সকাল থেকেই  মনটা কেমন  একটা বিষণ্ণতায়  ভরে গেল। মজুমদার দা ও দোলা বৌদি আসতে চেয়েছিলেন  কিন্তু সেই একজন ছাড়া কাউকে যেতে না দেওয়ার জন্য  বারণ করলাম। এদিকে সমস্ত ফর্ম্যালিটি পূর্ণ করে আমাদের অর্জুন  বা ভট্টাচার্য  সাহেব এবং দেবাশিস নীচে অপেক্ষা করতে লাগল। এদিকে পিউ এবং আমার  সহধর্মিনী নীচে অপেক্ষারত।  সমস্ত  কাগজপত্র  গোছগাছ করে দীপক  দাস আমাকে বিদায় জানাল। আমি দেবাশিসকে বললাম  ওদের  কিছু দেবার  জন্য  কিন্তু কাউকেই  রাজি করাতে পারলাম না। এবার  আবার রাজার  মতন ফিরে আসার  পালা। স্ট্রেচারে শুয়ে আমি যখন  আসছি তখন  আমার  দুচোখে জলের  ধারা দেখে সিস্টার  দুজন জিজ্ঞেস  করলেন, " আঙ্কল, বাড়ি যাওয়ার  সময় তো লোকে খুব  উৎফুল্ল  থাকে, আর আপনার  চোখে জল?" না ভাই, এটা হচ্ছে আপনাদের  ভালবাসা ও সহযোগিতার  ফল।
পৃথিবীতে ভালবাসা খুবই  দুর্মূল্য। আমি কতজনকে ভালবাসতে পেরেছি জানিনা কিন্তু যে পরিমাণ  ভালবাসা সকলের  কাছ থেকে পেয়েছি  তার  জন্য  আমি ভগবানের  কাছে অশেষ  কৃতজ্ঞ। অজয় ভাই ও লালুবাবু  ছুটে এসেছেন  সমস্ত  কাজ ফেলে যদি রক্ত লাগে তবে তাঁরা দেবেন।  সুদীপ্ত ছুটে এসেছে যদি কোন ডকুমেন্টের দরকার  হয়। আমি সকলের কাছে কৃতজ্ঞ  তাদের  শুভেচ্ছার জন্য । ভগবান  সকলের  মঙ্গল  করুন। 

2 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. Khub sundor chikitsa holo Sobujbabu'r ar sob betha bhalobasa'r choyae hariye gelo. Eta bola ta o dorkar j bhalomanush' er sobsomaye bhalo jogajog hoye. Kosto besi khoner sathi thakena.Happy Health Sobujbabu😊

    ReplyDelete