ভীম বেশ কিছুদিন যাবত ই অন্য পাণ্ডবদের থেকে আলাদা থাকতে বাধ্য হয়েছে নানান কারণে। এর আগে জানাই এর রাজবাড়ির পূজোতেও ভীম ও ভালান্দ্রা অন্যত্র ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেনি। অর্জুনের পরিকল্পিত জয়নগরের কাছে বহড়ু গ্রামে এক পারিবারিক পূজোয় যাওয়ার কথা হলো। অর্জুনের ই এক প্রাক্তন সহকর্মী মাণিক ব্যানার্জি তার সমস্ত বন্দোবস্ত করলেন মানে অষ্টমী পূজোয় অঞ্জলি দেওয়া থেকে ভোগ খাওয়া এবং সেই বিখ্যাত বহড়ু গ্রাম পরিদর্শন করানো।
বহড়ু গ্রাম সম্বন্ধে একটু ছোট্ট পরিচয় করানো দরকার। এটি জয়নগরের একটু আগে অবস্থিত এবং খুবই বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এইখানেই প্রখ্যাত গায়ক হেমন্ত মুখার্জির পূর্বপুরুষেরা থাকতেন। যাওয়া আসা ছিল তাঁরও। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে নিজের গ্রামে এসেছিলেন এবং শুধু হারমোনিয়ম নিয়ে একটিই গান করেছিলেন, " দিনের শেষে, ঘুমের দেশে ঘোমটা পড়া ঐ ছায়া" আর তার পরেই ফিরে এসে চিরতরে ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়া। বিরাট বাড়ির আর কিছুই অবশিষ্ট নেই সবই হয়ে গেছে বেদখল কিন্তু দখলকারীদের একটা বিষয়ে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে। তাঁরা প্রয়াত শিল্পীর একটা স্ট্যাচু বানিয়ে দিয়েছে এবং গলায় আছে অবশ্যই একটা টাটকা গাঁদা ফুলের মালা। এটুকু না করলে তো মান সম্মান কিছুই থাকেনা। যাই হোক, অনতিদূরে প্রয়াত শিল্পী সমিত ভঞ্জদের পৈতৃক বাড়ি। তাঁদের একটা নাটমন্দির ছিল যেখানে এক অষ্টধাতুর মূর্তি ছিল। মানুষের লোভের তো শেষ নেই, সেই অষ্টধাতুর মূর্তি তিন তিনবার চুরি হয় এবং ভগবানের আশীর্বাদে তিনবার ই তা উদ্ধার হয় কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত তাঁকে খণ্ডিত বিখণ্ডিত অবস্থায় পাওয়া যায়। এখন ভগবান তো ভাল মানুষের বাবা/ মা ,আবার দুর্বৃত্তের ও বাবা/ মা। সুতরাং সবই তাঁর কৃপা। তাঁরই ইচ্ছেতে লোকে তাঁকে চুরি করেছে এবং খণ্ড বিখণ্ড করেছে আবার তাঁরই ইচ্ছেতে তিনি ফিরে এসেছেন। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন শমিত ভঞ্জের পূর্বপুরুষ দ্বারকানাথ ভঞ্জ প্রায় দেড়শো বছর আগে। আরও একটি বিখ্যাত জায়গা শ্যামসুন্দরের মন্দির। তদানীন্তন জমিদার ( যাঁকে সাতমহলার জমিদার বলা হতো) বৃন্দাবনে গিয়ে এতটাই মোহিত হয়ে পড়লেন যে ঐ মূর্তিটিকে তিনি এই গ্রামে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করবেন কিন্তু তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে জানতে পারলেন যে ঐরকম ই একটি মূর্তি তাঁর গ্রামের নাটমন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কি অপূর্ব সেই মূর্তি। সেই জমিদারের উত্তর পুরুষ পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে তিন একর জমি দান করেন এই আশ্বাসে যে তাঁদের পরিবারের কয়েকজনকে সরকারি চাকরি দেওয়া হবে কিন্তু এই আশ্বাস মৌখিক হবার কারণে তাঁরা কেউই চাকরি পাননি কিন্তু তাঁরা কাগজপত্রের মাধ্যমে সরকারকে তিন একর জমি দান করেন। এই কথা তাঁদের উত্তর পুরুষের মুখ থেকে শোনা, সত্যতা যাচাই করার কোন অবকাশ হয়নি। সেই জমিতেই অবস্থিত আজকের বিডিও অফিস। সেই শ্যামসুন্দরের নামানুসারেই শ্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার যিনি মাণিক বাবুর সৌজন্যে আমাদের ছোলার ডালের বরফি খাওয়ালেন কিন্তু কোনরকম পয়সাকড়ি নিলেন না। এই দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রী গোপাল চন্দ্র ঘোষ এবং এখন পরিচালনার দায়িত্বে দুই ভাই শ্রী রঞ্জিত কুমার ঘোষ এবং বাবলু কুমার ঘোষ। রঞ্জিত বাবু তখন দোকানে ছিলেন না, বাবলু বাবু সন্দেশ তৈরীতে ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু অত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সবাইকে উনি ছোলার ডালের বরফি খাওয়ালেন এবং বললেন নভেম্বর মাসের শেষ দিক থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত তাঁর দোকানের মোয়া যেন আমরা অবশ্যই খাই। শীতের আমেজে খেজুরের রস হয় মিষ্টি এবং এক বিশেষ ধানের খই তাঁদের হাতের যাদুস্পর্শে হয়ে ওঠে জয়নগরের মোয়া। এই মোয়া নিয়ে বহড়ু ও জয়নগরের মধ্যে যথেষ্ট রেষারেষি আছে। একজন বলে আমিই সেরা তো আরেকজন বুক বাজিয়ে বলে , " না আমি।" আপাতত মুলতুবি থাক তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা। আমরা নিজেরা আসব, পরখ করব এবং তারপর সিদ্ধান্ত নেব কে সেরা। এরপর আরও এক বিস্ময়ের পালা যা হচ্ছে বহড়ু হাই স্কুল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ও আগে এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা এই গ্রামের বিদ্যানুরাগের কথা বহন করে। এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র প্রখ্যাত ডাক্তার শ্রী নীলরতন সরকারের নামে একটি ব্লক আছে এবং শ্রী জ্ঞান ঘোষের ও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এরপরেই আসতে হবে সেই পণ্ডিতালয়ের দুর্গা পূজো। এই পূজার প্রতিষ্ঠা হয় শ্রী কৃষ্ণগোপাল পণ্ডিতের হাত ধরে। স্বপ্নাদিষ্ট কৃষ্ণগোপাল আদেশ পান মায়ের পূজো শুরু করার। কিন্তু নবমীর রাতে তিনি আদেশ পান তাঁকে যেন বিসর্জন না দেওয়া হয়। সেই থেকে মানে নিরানব্বই বছর আগে শুরু হওয়া সেই মায়ের প্রতিমা আজও সেই এক, কেবল প্রতিবছর মায়ের রঙ ও শাড়ি পাল্টানো হয়। তাঁর ই নাতি শ্রী উমাপদ চক্রবর্তীর এখনও পালাক্রমে চালিয়ে আসছেন এই মায়ের পূজো। যেহেতু প্রতিমার বিসর্জন হয়না, সেইকারণে প্রতিদিন দুবেলা মায়ের পূজো হয়। এটা যে কত কঠিন কাজ তা যাঁরা এটা চালান তাঁরাই জানেন। অঞ্জলি দিয়ে , প্রসাদ খেয়ে আবার মাণিক বাবুর পৈতৃক বাড়িতে যাওয়া হলো এবং তাঁদের বাড়িতেও প্রতিষ্ঠিত মা শীতলার মন্দির দর্শন করলাম। মানিকবাবুর বাবা তিরানব্বই বছরের বৃদ্ধ কিন্তু তাঁর অসাধারণ স্মৃতি এবং আমাদের দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন। মাণিক বাবুর নানান দিকে আগ্রহ। তাঁর বাড়ির সামনে বিশাল পুকুরে ছিপ ফেললাম কিন্তু আমার তিনবারের প্রচেষ্টা বিফল করে দিয়ে মাছ চারা খেয়ে চলে গেল কিন্তু অর্জুনের একবারের প্রচেষ্টাতেই একটা বেশ বড় মাছ ধরা পড়ল এবং মাণিক বাবুর কয়েকবারের প্রচেষ্টায় একটা মাছ ধরা পড়ল। মাছধরার একটা আলাদাই আনন্দ। কারেনুমতি বৌদির প্রচেষ্টাও সফল হলনা। ভোগ খাওয়ার এক আলাদা আনন্দ। ঐ সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও চক্রবর্তীবাবুদের যা আতিথেয়তা তা হৃদয়স্পর্শ করে গেল। আবার আসতে হবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঐতিহাসিক বহড়ু গ্রাম থেকে বিদায় নিলাম।