বাইপাস ধরে উল্টোডাঙা হয়ে সোজা পাইকপাড়ায় টালাপার্কে প্রত্যয়ের প্যাণ্ডেলে হাজির হলাম। বিরাট এলাকা জুড়ে এই প্যাণ্ডেল। একপ্রান্তে ঢোকা এবং অন্য প্রান্তে বেরোনোর রাস্তা। মহিলাদের প্রায় সকলের ই পায়ের সমস্যা, দুলকি চালে চলতে নেয় অনেক সময়।বাকি চার পাণ্ডবদের ও বয়স যথেষ্ট হয়েছে এবং যুধিষ্ঠির ও সহদেবের দুই হাঁটুই প্রতিস্থাপন হয়েছে কিন্তু অর্জুন ও নকুল এরই মধ্যে একটু বেশিই সক্ষম। চলছি তো চলছিই, এক রাজবাড়ির আদলে তৈরী হয়েছে প্যাণ্ডেল। কি অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই অসাধারণ শৈল্পিক প্যাণ্ডেল। ভাবছিলাম এই শিল্পকর্মের পিছনে কার মাথা রয়েছে? এই শিল্পীদের বেশিরভাগ ই বেশ গরীব কিন্তু দারিদ্র্য তাদের শিল্পীসত্ত্বাকে ধ্বংস করতে পারেনি। নামটা জানার ঔৎসুক্য ছিলই কিন্তু ঠাউরে উঠতে পারছিলাম না কার কাছে জানা যায়। কিন্তু উদ্যোক্তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে শিল্পীদের প্রতি এবং বাইরে বেরোনোর মুখে বড় বড় করে শিল্পীদের নাম লেখা আছে, " সুশান্ত শিবানী পাল।" খুব ভাল লাগল এই ধরণের ব্যবহারে। সাধারণত কাজের বেলায় কাজী আর কাজ ফুরালেই পাজী এটাকেই মান্যতা দেওয়া হয়, কিন্তু এখানে সেটা ব্যতিক্রম। শিল্পীদের মর্যাদা শুধু টাকাতেই নয়, সম্মান দেখানো খুবই প্রয়োজন। কতদিন ধরে তাঁরা কাজ করেছেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন এই রাজবাড়ির ছবিটিকে।
এক একসময় মনে হয় যে কি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে এই ক্ষণিকের অতিথির জন্য। সমস্ত কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এই বিশাল অর্থব্যয় কি কোন স্থায়ী শিল্পের পিছনে খরচ করা যেতনা যেখানে বহুলোকের সংবৎসর অন্নসংস্থান হয়। অবশ্য এই ক্ষণিকের শিল্পকে কেন্দ্র করেও বহু দরিদ্র মানুষের কিছুদিনের অন্নসংস্থান হয়। সবচেয়ে বড় অভিশাপ আজকের যুগের জমিদারেরা। সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে তাদের টাকায় নিজেদের আখের গোছান এই বর্তমানের জমিদাররা। শোষণ চিরকাল চলে আসছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। যে যখন সুযোগ পায় সেই তখন শোষণ করে। সবচেয়ে মজার কথা এই মহাচোররা খবরের কাগজে তাদের ছবি বা খবর বেরোনোয় তাদের মানসম্মান হানি হচ্ছে বলে আদালতে দরখাস্ত করেন এবং মহামান্য আদালত সংবাদ মাধ্যমকে এই খবর প্রকাশে নিরস্ত করেন। আমরা কোন সমাজে বাস করছি? যারা নিগ্রহ করবে তাদের সুরক্ষা দেব না যারা নিগৃহীত হচ্ছেন তাঁদের সহায়তা করব? মহামান্য আদালত, আপনারাও যদি চোখ বন্ধ করে থাকেন এবং সংবাদ মাধ্যমের মুখে কুলুপ এঁটে দেন তাহলে এই নিগৃহীত মানুষগুলো যাবে কোথায়? এদের কথা কে বলবে? শিক্ষিত পাশ করা ছেলেমেয়েদের জায়গায় টাকার বিনিময়ে চোরগুলো চাকরি পেয়েছে, আপনারা তাদের সপক্ষে রায় দিচ্ছেন? ধিক আপনাদের, নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করুন মহামান্য আদালত। আপনারা শুধু নিজেদের ই ছোট করছেন না আপনাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকেও ধিক্কারের শিকার করে তুলছেন। একবার শান্তভাবে ভাবুন , মহামান্য আদালত। কথায় আছে আইন সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে কি সত্যিই তাই? অর্থবলে বলীয়ান জমিদার রা যখন ইচ্ছা তাঁদের বক্তব্য শোনানোর জন্য আপনাদের দরজা খটখট করতে পারেন কিন্তু সাধারণ লোকেরা বছরের পর বছর তাদের বক্তব্য আপনাদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কি বলবেন আপনারা?
যাই হোক , ফিরে আসা যাক সেদিনের কথায়। টালা পার্কের প্রত্যয় ছেড়ে যাওয়া হল বাগবাজার সার্বজনীন পূজো মণ্ডপে। সামনের প্রবেশদ্বার বন্ধ। পাশের দরজা দিয়ে ঢুকে দেখলাম টুকটাক অনেক কাজ বাকি। কিন্তু মায়ের সেই সাবেকি মূর্তি মনের অন্তস্থলে ছাপ ফেলে দিল। বিস্ফারিত চোখে মায়ের সেই রূপ মনটাকে দূরে কোথাও নিয়ে গেল। মাঝখানে সেই বিশাল ঝাড়বাতি এই মণ্ডপের এক বিশেষ আকর্ষণ। মণ্ডপের বাইরে মাঠে তখন দোকান পাট ইতস্তত ভাবে খুলতে শুরু করেছে যেখানে টালাপার্কে দোকান গুলো বেশ গুছিয়ে বসেছে। আলু কাবলি, ঝালমুড়ি বা ঘুগনির সুন্দর গন্ধ নাকে ঢুকে মন মাতিয়ে দিয়েছিল কিন্তু অতটা হেলতে দুলতে হেঁটে এসে রথ কখন নিয়ে চলে আসবে সারথিরা এই ভেবে জিভে জল টেনেই চলে আসতে হল। ভাবলাম বাগবাজারের মাঠে হবে ঐসব আলুকাবলির উপর আক্রমণ। কিন্তু মনের আশা মনেই থেকে গেল। হলনা কিছুই খাওয়া কেবল লেবু চা ছাড়া। যাওয়া যাক, কুমারটুলির পূজো দেখতে। অনেক মেহনত করে এদিক সেদিক করে সারথিরা যখন পৌঁছলেন তখন গিয়ে শুনলাম যে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। মহিলারা অটো রিক্সা চড়ে বড় রাস্তায় এলেন যেখানে সারথিরা আমাদের ছেড়েছিলেন কিন্তু তারা সেখানে নেই এবং বহু লোক এসেছেন তাঁদের প্রতিমা নিতে। বিভিন্ন সাজের মাকে বৃদ্ধ ন্যুব্জ কুব্জ বাড়িগুলো লক্ষ্য করছে, হয়তো বা আমাদেরকেও। একদিন এই বাড়িগুলোই ছিল অসাধারণ সুন্দর। পাশাপাশি , বিপরীত দিকে সুবিশাল হর্ম্য প্রাসাদগুলো পরস্পর পরস্পরের প্রতি স্পর্ধা প্রকাশ করছে যেমন কর্ণ বা অর্জুন কিংবা দুর্যোধন বা ভীমের প্রতি। একমনে দেখছিলাম তাদের দিকে আর ভাবছিলাম যে বয়সকালে এঁরা কতই না সুন্দর ছিলেন। কিন্তু কালের গতিতে সবকিছুই হারিয়ে যায় যেমন গেছে এই সুন্দর প্রাসাদোপম বাড়িগুলো। চোখে কেমন যেন জল চলে এল।
আহিরীটোলা মণ্ডপে যাবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু লোকজন জানালো যে তাদের মণ্ডপ ও কুমারটুলির মতন। সুতরাং, এবার চাই পেট পূজো। শতাব্দী প্রাচীন মিত্র কাফেতে অভিযান চালাতে হবে। এটাও অর্জুনের ই পরিকল্পনা। অতএব চল মিত্র কাফে। অপরিসর জায়গা কিন্তু শতাব্দীপ্রাচীন রেস্তোরাঁয় ঢুঁ না মারলে কেমন একটা অপরিপূর্ণতা থেকে যায়। যেমন বলা তেমন কাজ। কিন্তু ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী। অতএব কর অপেক্ষা। বেশ দাঁড়িয়েছিলাম কিন্তু সিগারেটের গন্ধে গা টা কেমন ঘুলিয়ে উঠল। এই জীবনে ঐ স্বাদে আমি বঞ্চিত, সুতরাং এক অস্বস্তিকর অবস্থা। দেখি, আমার ই অনতিদূরে এক প্রতীক্ষারত যুগল কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার যে ভদ্রলোক পাঁশুটে মুখে দাঁড়িয়ে আর তাঁরই সঙ্গিনী একটা বেশ বড় মাপের সিগারেটে টান দিচ্ছে আর মনের সুখে ধোঁয়া ছেড়ে অন্য লোকের কাশি উঠিয়ে দিচ্ছেন। একটু বিরক্ত হয়েই হাত দিয়ে ধোঁয়াটাকে নাকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে নিজের ফুসফুসটার বারোটা তো বাজাচ্ছ ই, সঙ্গে সঙ্গে তোমার সঙ্গী এবং আমাদের ও। উনি বুঝতে পারলেন ব্যাপার টা এবং সঙ্গে সঙ্গে সরে গেলেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় যে ঐ চল্লিশোর্ধ মহিলা আমারই সামনে বসলেন। আমাদের নয়জনের অর্ডার দিতে ওদের একটু দেরী হচ্ছিল আর ওঁরা দুইজন থাকায় ওঁদের তাড়াতাড়ি দিয়ে দিল। আর তাঁরাও ফিস কবিরাজি যত তাড়াতাড়ি পারেন খেয়ে বিদায় নিতে পারলে বাঁচেন। ভদ্রমহিলার তিন আঙুলে একটাই আংটি মানে আংটি একটাই অথচ এমনভাবে তৈরী যে মাঝে একটা পাথর মধ্যমায় এবং দুইদিকে সোনা কিন্তু একটা ভয়ানক ছবি ঐ দুই পাশের আঙুলে মানে তর্জনী ও অনামিকায় যা রীতিমত ভয়ের বাতাবরণ তৈরী করে। কে জানে কোন জ্যোতিষীর পরামর্শে তিনি এটা ধারণ করেছেন। সে যারই পরামর্শে উনি ধারণ করে থাকুন না কেন উনি যে পড়াশোনায় সেরকম কিছু দরের নন সেটা তাঁর চোখেমুখেই প্রতিফলিত। যাই হোক, উনি চলে যাওয়াতে আমি কেমন একটা স্বস্তি পেলাম। এবার আসা যাক, একটু মিত্র কাফের কথায়। উনিশশো দশ সালে শ্রী গণেশ মিত্র এই কাফে খোলেন। কিন্তু উনি ঠিকঠাক চালাতে না পারায় বছর দুই বাদেই বাল্যবন্ধু শ্রী সুশীল রায়কে দিয়ে দেন। সুশীলবাবু ছিলেন একজন অত্যন্ত বাস্তব বোধ সম্পন্ন ব্যক্তি এবং একজন দক্ষ ব্যবসায়ী। সেই কারণেই মিত্র কাফেতে এই কয়টা পূর্তি লেখা আছে।
" মিত্র কাফে "
-------------------------
পেট ভরে খাবার আর প্রাণভরে আড্ডা
উনিশশো দশ সালে শোভাবাজারে শুরু যাত্রা
বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতেন সুশীল রায়
ভালভাবে বুঝতেন মানুষ কি চায়।
মিত্র কাফে নাম সেই বন্ধুত্বের স্বীকৃতি
আজ এই নাম মানেই খাবার আর খ্যাতি
এই রেস্তোরাঁর কথা আজ কে না জানে
কলকাতা ছাড়াও আছে আরও অনেক স্থানে।
এই মিত্র কাফেতেই আমরা ফিস কবিরাজি , চিংড়ির কবিরাজি, চিকেন কবিরাজি , ফিস কাটলেট এবং ডায়মন্ড কবিরাজি ধ্বংস করে ফিরে এলাম বাড়ি আর এইবার দুঃশলা ভগ্নী এই সমস্ত বিল মেটালেন। প্রথমে নকুল ও কারেনুমতি এবং পরে সহদেব ও বিজয়াকে রথ থেকে নামিয়ে যুধিষ্ঠির ও অর্জুন রথে বাড়ি ফিরে গেলেন।
একটা কথা বারবার মনে আসছে।কলকাতা তথা সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে এত মহান শিল্পী রয়েছেন যাঁদের শিল্পীসত্ত্বা এই বিশেষ সময়ে বিকশিত হবার সুযোগ পায়। আগে আঙুলে গোণা কতিপয় শিল্পীর ছবি আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শিত হতো কিন্তু এই শারদোৎসবে এই বৃহৎ আর্ট গ্যালারিতে সমস্ত ছোটবড় শিল্পীরা তাঁদের স্থান করে নেন।
No comments:
Post a Comment