Friday, 24 November 2023

হলুদ বসন্ত

জীবন সায়াহ্নে পৌঁছানো মধুকর বাবু ও তাঁর  স্ত্রীর বেশিরভাগ সময়ই কাটে গাড়ি বারান্দার ওপরের ছাদে। দুই বুড়োবুড়ির কথোপকথন সেই একই ব্যাপারে সীমিত। কেউ না কেউ তো একজন হয়ে যাবে, তখন কি করে সময় কাটাবে অন্যজন। সবাই  তো আর  বিপিন রাওয়াতের মতো ভাগ্যবান নন যে একইসঙ্গে দুজনে বিদায় নিলেন  এই সুন্দর পৃথিবী থেকে। আরও অনেক ভাগ্যবান  আছেন যাঁরা কোন না কোন ভাবে একইসঙ্গে বিদায় নিয়েছেন যাঁদের কথা আমরা জানিনা। 
মধুকরের স্ত্রী রীনা খুবই  চিন্তিত  যে উনি যদি আগে চলে যান তাহলে মধুকরের কি হবে। মধুকর খুবই জেদি ধরণের মানুষ, কোনভাবে কারো সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন না। ভীষণ একবগ্গা টাইপের মানুষ প্রথম থেকেই। কেবলই নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়েই ছিল  তাঁর আনন্দ।  সুতরাং বুঝতে কোন অসুবিধা হবার কথাই নয়। মেয়েরা তো সর্বংসহা, জলের  মতো, যে পাত্রেই রাখা যাক না কেন  সেই জায়গাতেই মানিয়ে নেয় কিন্তু যাঁরা একটুও  নমনীয় নন তাঁদের  তো মহা বিপদ। সেইজন্য রীনা রোজ পূজোর  সময় ঠাকুরের কাছে তাঁর মনের কথা ভক্তিভরে বলেন। কিন্তু নিয়তির লিখন অন্যরকম। হঠাৎই একদিন সবাইকে ভাসিয়ে রীনা চলে গেলেন। মধুকরের চোখের জল কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। নিথর হয়ে বসে আছেন  তাঁর নিজের  জায়গায়, একদৃষ্টে চেয়ে আছেন  রীনার চেয়ারের দিকে। শববাহী গাড়ি এসে গেছে রীনার নিথর দেহটাকে নিয়ে যেতে। ছেলে মেয়ে বৌমা ও জামাই সবাই  বলছে মধুকরকে একবার  আসার জন্য  কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই মধুকরের।  কারো দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না তিনি। সবাই খুব  অস্বস্তিতে পড়ে গেছে, অন্তত একবারের জন্য  তো তাঁর  আসা দরকার। নাতি, নাতনিরা কেউ আসতে পারেনি রীনার  হঠাত প্রয়াণে। সুতরাং তাদের  আবদারেও  অন্তত  সাড়া দেবার অবকাশ  নেই।

মধুকর ছিলেন  অত্যন্ত  ছাপোষা মানুষ,  বিরাট চাহিদা তাঁর কোনদিনই  ছিলনা। শৈশবের কঠিন  সংগ্রাম এবং দায়িত্ব বোধ তাঁকে কোনদিনই বিরাট স্বাচ্ছল্যের হাতছানি দেয়নি আর পাঁচজনের মতন। জীবনে  চাহিদা যাদের  কম তাদের কষ্ট ও কম। কারও  কাছে হাত পাতার দরকার হয়না, নিজের কষ্ট নিজেই   হজম করতে শেখে তারা। সুতরাং একরোখা হবার এটা একটা কারণ হতে পারে। কি ছেলে, কি মেয়ে বা বন্ধুবান্ধব কারও  কাছেই  মাথা নোয়াতে  রাজি নয় তারা। মাঝেমধ্যেই  মনে হয়  যেন  একটু বেশিই অসামাজিক।  কিন্তু কে কি ভাবে তাতে তাদের  বিন্দুমাত্র  আগ্রহ  নেই। অনেকটা সেই আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ , আপনারই আবরণ এর মতো। রিটায়ার করার পর পাওয়া টাকা দিয়ে একটা বড় ফ্রিজ ও ওয়াশিং মেশিন কিনেছেন যাতে  রোজ বাজার যাওয়ার ঝামেলা না থাকে বা কাপড়চোপড় কাচার  ঝামেলাও  বেশি না থাকে। আজকাল  কাজের  লোকের কথায় কথায় কামাই যাতে খুব  অসুবিধার সৃষ্টি না করে। কিন্তু ওয়াশিং মেশিন খুব  কম সময়ই ব্যবহার  হয়। ফ্রিজ কিন্তু বেশ ভালোই চলছে মধুকরের অবস্থার  কথা ভেবে অবশ্য মাঝে মধ্যে তেল সাবানের দরকার তো হয়ই।  এইভাবেই  বেশ চলছিল কিন্তু বাদ সাধল  মেয়ের আবদার। ঐ বুড়ো ফ্রিজটাকে এবার বাতিল  না করলেই  নয়। বুড়ো হলেই তো তার কদর কমে যায় সে মানুষ ই হোক  আর অন্য  যে কোন  জিনিস  হোক  না কেন। একদিন  ছিলে তুমি ঝকঝকে , ছিল তোমার কদর, কত প্রশংসাই না হতো তোমার কিন্তু আজ তুমি তোমার গ্ল্যামার হারিয়েছ,  জায়গা ছেড়ে দাও নতুনকে।  এটাই  তো জগতের  নিয়ম। অতএব প্রকৃতির নিয়মে তোমার জায়গায় এসে যাবে নতুন।  পুরোন চেহারাটাকে নিয়ে বদলে দেবে নতুন চেহারা। কিন্তু এই পৃথিবীতে অনেক লোক আছে যারা পুরোন কে ফেলতে ইতস্তত  করে, তাদেরই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় কারণ তাদের বদ্ধমূল  ধারণা এদের  এখনও  অনেক কিছুই  দেবার  আছে। কিন্তু না, তারা অত্যন্ত  সংখ্যালঘু, অতএব ফেলে দাও সেই পুরাতনে। 
অনেক  সময় চলে গেছে।  শববাহী যানের  লোকজন  একটু বেশিই  অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তাদের  আবার  অন্য জায়গায় যেতে হবে। ছেলে এসে মধুকরের পাশে এসে বলল, " বাবা, একবার  এস, মাকে শেষবারের  মতন বিদায় দাও।" কিন্তু কোন  সাড়া নেই । গায়ে হাত দিয়ে একটু ধাক্কা দিতেই চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন  মধুকর,  নিথর নিস্তব্ধ  দেহ। রীনার  প্রার্থনা শেষমেশ ভগবান মঞ্জুর করলেন। 

No comments:

Post a Comment