Sunday, 11 April 2021

তুই, তুমি,আপনি

শমীক দা ছিলেন  রীতিমত  প্রেমিক মানুষ।  যেমন  দেখতে, তেমনই  পয়সাওয়ালা। প্রায়শই  লোকে তাঁকে প্রদীপ কুমার  বলেন ভাবতো। লাল টুকটুকে চেহারা আর পরতেন নিপাট করা ফিনফিনে ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি। ঐ হোস্টেলেই থাকা একজন অঙ্কের প্রফেসর তাঁর মাস মাইনের বেশিরভাগ  টাকাটাই  সংসার খরচা বাবদ মানি অর্ডার করে দিয়ে কোনরকমে নিজের  পিছনে খরচ করতেন। শমীক দা প্রথমে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়ে অঙ্কের ক্লাসে ঐ স্যারকে দেখে এমন কিছু মন্তব্য  করেছিলেন  যাতে তাঁর চামচা  কিছু ছেলেমেয়ে  খুব উল্লসিত  হলেও বেশ কিছু পড়াশোনা করতে আসা ছেলেদের চাপে তাঁকে গুটিয়ে যেতে হয়েছিল  কারণ  সময়টা ছিল  ষাটের  দশকের শেষ ভাগ। স্যার কিন্তু কোন কথা বলেন নি যদিও  মনে মনে খুবই  কষ্ট পেয়েছিলেন।  তখনকার  দিনে স্যারদের  সামনে সিগারেট  খাওয়ার   কথা কেউ ভাবতেও  পারতো না। কিন্তু বড়লোকের  আদরে বাঁদর হয়ে যাওয়া শমীক দা স্যারের  পাশ দিয়ে যাওয়ার  সময় স্যারের  মুখের  ওপরই  ধোঁয়া ছেড়ে দিতেন। স্যার  কিছুই  বলতেন না।একদিন  ঐ ক্লাসের ই একটি  মেয়ে রেখা সরাসরি শমীক দাকে চার্জ করল।" কি ভেবেছেন বলুন তো? অনেকদিন  ধরেই  দেখছি  আপনি স্যারকে সবসময়  অপমান  করার  চেষ্টা করেন কিন্তু উনি আপনাকে কিছুই  বলেন না। কিন্তু  তার মানে এই নয় যে উনি অপমানিত  হন না। আপনার  অনেক  টাকা থাকতে পারে কিন্তু আপনি ওঁর নখের ও যোগ্য  নন।" স্যার  কিছু না বললেও  মনে মনে খুব  খুশী হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই সব ছেলেগুলোও যারা রেখার একটু ঘনিষ্ঠ  হবার  চেষ্টা করতো কিন্তু শমীক দার পয়সায়  খাওয়া কিছু ছেলেদের জন্য  কাছে ঘেঁষতেও  সাহস করতো না।

শমীক দার সঙ্গে রেখার একটু কাছাকাছি আসার সম্ভাবনাটা  প্রায় এটাতেই শেষ। তখনকার  প্রেম  নিবেদন  একটা কিরকম যেন  ছিল। একটা ফিসফিসানি চুপিচুপি  কথা একান  সেকান  হতে হতে পাত্র এবং পাত্রীর  কানে পৌঁছে যেত, তারপর সেটা  টিকবে কি টিকবে না নির্ভর করতো পরিস্থিতির  উপর। যদি পাত্র শাঁসালো  হতো মানে বাবার  প্রচুর টাকা, বাড়ি গাড়ি জমিজমা  আছে তাহলে আপত্তির  তো কোন কারণ ই নেই। কত সুন্দরী মেয়েরা কতছেলেদের  বুক ভাসিয়ে চলে গেছে তার ইয়ত্তা  নেই। এইরকম ই এক ফিসফিসানি  রেখার কানে পৌঁছেছিল  কিন্তু ও ছিল  এক অন্যধাতের  মেয়ে।  ঐরকম  মাকাল  ফলকে  ও কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। সুতরাং সুযোগের  অপেক্ষায় থাকা রেখা  এর পুরোপুরি  সদ্ব্যবহার  করল এবং ফল যা হবার  তাই হলো। শমীক  দার আপনি থেকে তুমিতে  আসা আর হয়ে উঠল না। হঠাৎই  একদিন  দেখি একটা অ্যাম্বাসডার  গাড়ি এসে থামল  হোস্টেলের সামনে। এক সুপুরুষ ভদ্রলোক  নামলেন  গাড়ি থেকে এবং সরাসরি চলে গেলেন  স্যারের  ঘরের  দিকে। দেখি স্যারের  হাত  ধরে মাথা ঝুঁকিয়ে কিছু যেন বলছেন  আর স্যার  মাথা নাড়িয়ে একটু করুণ করুণ মুখে কিছু  বলছেন  যে না না কিছুই  হয়নি।
তখন একই  ক্লাসে পড়া ছেলেমেয়েরাও  আপনি আপনি করেই কথা  বলতো এবং বেশ  কিছুদিন  যাবার পর  আপনি থেকে তুমি বা তুই সম্বোধনে  আসত সম্পর্কের  গভীরতার  উপর। দুটো ছেলের মধ্যে সম্বোধন একধাপ বা দুই ধাপ নামতো। এখানে ধাপটা  এইরকম।  আপনি (এক), তুমি(দুই) এবং তুই( তিন)। কিন্তু একটা ছেলে এবং একটা মেয়ের সম্বোধন  এক থেকে তিনে নামলেও এক থেকে দুইয়ে  নামলেই ছেলেমেয়েদের  মধ্য  গুঞ্জন  শুরু হয়ে যেত। জানিস ,বলেই ফিসফিসানি শুরু হতো। কিন্তু সময়ের  সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েরা আজকাল  অনেক সহজভাবেই  মিশতে শুরু করেছে এবং তিন থেকে দুই বা এক যাবার  প্রশ্নই  নেই। বন্ধুত্বের পরিণতি  যদি বিয়ে অবধিও  গড়ায় তাহলেও তুই থেকে তুমি সম্বোধনে আসেনা। বয়স বাড়ার  সঙ্গে সঙ্গে শ্রুতিশক্তি কম হবার  উপকারিতাটা  বোঝা যায় কারণ  কানে আর খটকা লাগেনা।

No comments:

Post a Comment