এবার যাওয়া যাক আগের দিনের ভাই ফোঁটায় তারপর আসা যাবে এখনকার ভাইফোঁটায়। আগে তো প্রত্যেক সংসারেই পাঁচ সাতজন ছেলেমেয়ে ছিল এবং আশেপাশে মাসিমা বা পিসিমারা থাকতেন এবং তাঁদের সংসারেও ভাইবোনের সংখ্যাও ঐ একই রকম ছিল। সুতরাং ভাই ফোঁটা মানেই একবিরাট উৎসবমুখর দিন। লম্বা বারান্দায় আসন পেতে নিজের ভাইয়েরা, পিসতুতো মাসতুতো ভাইয়েরা একসঙ্গে বসে ফোঁটার অপেক্ষায় বসে থাকা এবং দিদিদের সিনিয়রিটি হিসেবে ফোঁটা দেওয়া এবং সবার ফোঁটা শেষ হলে সমস্ত দিদি বোনেরা হাত লাগিয়ে এক একজনের প্লেট ধরে ভাইদের হাতে তুলে দেওয়া। দিদি, বোনদের সংখ্যা বেশি হলে সবার হাত একটা প্লেটে লাগানো সম্ভব না হলে বলা হতো অন্তত গায়ে হাত লাগিয়ে রাখ। বসে বসে কিন্তু আড়চোখে কোন প্লেটে বেশি পড়েছে বা কোন প্লেটে কম এটা দেখা চলতো এবং মনে মনে যিনি দিয়েছেন তার মুন্ডপাত করা। কিন্তু এ সত্ত্বেও একটা বিপুল আনন্দ উপভোগ করা যেত। যে ভাইরা দূরে থাকার জন্য ফোঁটা নিতে আসতে পারেনি তার মঙ্গল কামনা করতে দরজার চৌকাঠে ফোঁটা দিত। ফোঁটা শেষ হতে হতে মেয়েদের জলখাবারের পালা এবং সেটাও মিটতে মিটতে বেলা গড়িয়ে যেত। এরপর দুপুরের খাওয়া এবং সেই পর্ব শেষ হতে প্রায় চা খাওয়ার সময়। কিন্তু এত কষ্ট সত্ত্বেও সব দিদিদের বা মা বোনদের মুখের হাসিটা মিলাতো না। তবে কতটা জোর করে হাসি বা কতটা স্বতঃস্ফূর্ত সেটা তখনই বোঝা যেত না। বোঝা যেত যখন মা বলতো একটু পা টা টিপে দেওয়ার জন্য। গৃহকর্তা কতটা চাপের মধ্যে থাকতেন সেটা তাঁর গম্ভীর মুখের অভিব্যক্তি থেকে বুঝতে হতো। তবুও তিনি এই উৎসবের আনন্দের অন্তরায় হতেন না। আজ আমরা যখন ঐ জায়গায় এসেছি তখন সেদিনের গৃহকর্তার গম্ভীর মুখের কারণ বুঝতে পারি।
এখন প্রত্যেক পরিবারেই ছেলেমেয়েদের সংখ্যা হয় এক বা বড় জোর দুই। যদি দুজনই ছেলে বা দুজনই মেয়ে হয় তাহলে এই উৎসবের আনন্দ উপভোগ করার জন্য মাসতুতো বা পিসতুতো ভাই বোনদের সাহায্য নিতে হয়। আর কাছাকাছি কেউ না থাকলে কমপ্লেক্সের ভাই বোনদের সাহায্য নিয়ে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে হয়। আগে পায়েস যেমন ভাইফোঁটার বা জন্মদিনের এক বিশেষ অঙ্গ ছিল এখন সেই জায়গায় এসে গেছে কেক। আনন্দ এখন কতটা ফিকে হয়ে গেছে সেটা যারা দুটো অবস্থারই সাক্ষী তারা বুঝতে পারে, অন্যরা নয়।
আজ জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে যখন মূল্যায়ন করতে যাই তখন ভাবতে চেষ্টা করি যে কোন অবস্থাটা ভাল ছিল। দুই অবস্থারই কিছু সদর্থক এবং নঞর্থক দিক আছে কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে কিছু পেতে গেলে কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়। গতবছর যা ছিল এবছরে তা নেই। গতবছর এইদিনে আমার বড়দি করোনার জন্য ফোঁটা দিতে না পারলেও দরজার চৌকাঠে ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ জানালো আর তার কিছুদিন পরেই তিনি করোনাক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তার আগের বছর চলে গেলেন আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় রামাইয়া সাহেব। জানিনা পরের বছর আবার সবাইকে পাব কিনা।
No comments:
Post a Comment