Wednesday, 27 July 2022

ভোম্বল

বছর তিরিশ আগেও  মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত দক্ষিণ কলকাতার  এই উপনগরী আজকের বৃদ্ধাবাসে পরিণত হয়নি। বিভিন্ন বয়সের  নানাধরণের ছেলেমেয়েদের কলকলানিতে গমগম করতো এই উপনগরী। আশির দশকের প্রথমভাগে যখন এই উপনগরী সরকারী প্রকল্পে গড়ে ওঠে তখন এক ঝাঁক বিশিষ্ট  বিদ্বজ্জন ও নানা পেশার কলাকুশলীরা এখানে আসেন এবং তাঁদের  মিলিত প্রচেষ্টায় এই উপনগরী সংস্কৃতির  এক প্রাণকেন্দ্র  হয়ে ওঠে। এঁরা সবাই  শহরের  বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন জায়গায় থাকা পাড়া কালচারে অভ্যস্ত ছিলেন এবং ফ্ল্যাট কালচার আত্মস্থ করতে বেশ খানিকটা সময় নিয়েছিলেন। বাসের রুট তখন এদিকে বিশেষ না থাকায় লোকদের  যাতায়াত করা বেশ সমস্যার মধ্যেই ছিল। ধীরে ধীরে লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল  এবং শহরের অন্যান্য প্রাণ কেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্তি বাড়তে লাগল  বাস, মিনিবাস ও ট্যাক্সির  কল্যাণে। জমজমাট  হয়ে উঠল এখনকার  অন্যতম বৃহৎ বানপ্রস্থাবাস গল্ফগ্রীন।

তখনকার  যুবকরা  আজ প্রায় বৃদ্ধ। যাঁরা প্রৌঢ় ছিলেন তাঁদের অনেকেই  আজ সেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন কিন্তু যাবার  আগে তাঁদের অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে দিয়ে গেছেন  এবং আজকের এই মোটামুটি মধ্যবিত্ত ও বিত্তবানদের জন্য  একটা বাসযোগ্য সংস্কৃতি মনোভাবাপন্ন সোসাইটি  গড়ে তুলতে পেরেছেন। তাঁদের জানাই সশ্রদ্ধ নমস্কার। প্রত্যেক  বাড়িতেই তখন একটা দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে ছিল এবং  সকাল বেলায় স্কুলের বাসের জন্য  বাবা বা মায়ের  হাত ধরে গুটিগুটি  পায়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এবং জলের বোতল হাতে নিয়ে বাসকাকুর অপেক্ষায় থাকত। বিভিন্ন  স্কুলের  বিভিন্ন বাস,  তাদের  কাকুও  ভিন্ন কিন্তু বাসে উঠাতে আসা মা বাবাদের মধ্যে এক বন্ধুত্বের বাঁধন গড়ে উঠতে থাকল ঐ বাচ্চাদের বাসে তুলতে আসার সুবাদে। কোন বাচ্চার জন্মদিনে চেনাজানা বাচ্চাদের  সঙ্গে বাবামায়েরাও আসতেন এবং ধীরে ধীরে প্রীতির বাঁধন ও বেশ  মজবুত  হতে লাগল। স্কুলফেরত বাচ্চারা বাড়ি ফিরেই একটু খাওয়া দাওয়ার পর বিকেল  হতেই হৈ হৈ করে বেড়িয়ে পড়ত খেলার  জন্য এবং সমস্ত  জায়গাটা তাদের  কলকলানিতে  ভরে উঠত। সমাজ বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছিল এবংএকটা খুব  সুন্দর  পরিবেশ  গড়ে উঠেছিল।  ধীরে ধীরে এই বাচ্চারা বড় হতে লাগল এবং তাদের  অনেকেই  আজ শহরের  বাইরে এবং কেউ কেউ দেশের ও বাইরে।কিন্তু তাদের  ছোট থেকে বড় হওয়ার  সময়টা মানে মাঝের পনের বিশ বছর অত্যন্ত আনন্দ মুখর ছিল  এই গল্ফগ্রীন এবং এই সময়টা তুলে ধরাটাই আমার  উদ্দেশ্য। 
বাচ্চাদের  খেলার  সঙ্গে সঙ্গে একটু উঁচু ক্লাসে পড়া ছেলেদের সন্ধের  পরেও বেশ  খানিকক্ষণ  আড্ডা চলত এবং খেলার  চেয়ে বেশী  খেলার  সমালোচনা চলত। সৌরভ তখন ছিল  ওদের আইডল এবং ও বেশী রান করলে এরা এত খুশী,  যে উচ্চগ্রামে আলোচনা হতো , দেখেছিস, দাদা স্টেপ আউট করে বাপি বাড়ি যা বলে কি সুন্দর  স্ট্রেট ড্রাইভ করে ছক্কা লাগাল। কিন্তু অল্প  রানে আউট হলেই বলতে থাকত যে ওর ব্যাটটা  অতটা অ্যাঙ্গেলে স্লাইস না করে একটু শরীরের  কাছে রাখলে ঐরকম  বাজে আউট হতো না। এইসব সমালোচনা বেশ মুখরোচক  হতো এবং কেউ পক্ষে বা বিপক্ষে বলে আলোচনাটাকে  একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিত।  চুপ করে একবার  এ বক্তা আরেকবার অন্য বক্তার দিকে তাকাতো  যেন কত বোঝে কিন্তু কোনরকম  বক্তব্য রাখত না সে। ও ছিল  ভোম্বল, সবার প্রিয়। যখন  তার অন্য  সঙ্গী সাথীরা ঐসব আলোচনার মধ্যে না গিয়ে নিজেদের  মধ্যেই  খেলা বা ঝগড়া করত, ভোম্বল কিন্তু ওদের  দিকে ফিরেও তাকাতো না, কেবল আলোচনা শুনত কোনরকম  মন্তব্য  ছাড়াই। রাস্তার  পাশেই  ছিল  একটা টিউবওয়েল এবং আলোচনার কেন্দ্রস্থল  ছিল ওটা। সবাই  চলে গেলে ও খানিকক্ষণ  একাই থাকত কারণ ওর বন্ধুবান্ধবরা তখন  অন্য কোথাও  চলে গেছে। অফিস থেকে  কাউকে ফিরে আসতে দেখলে ও তাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিত এবং যথাস্থানে ফিরে আসত। খাওয়ার  কথা কখনোই তাকে মনে করতে হয়নি কারণ সে সবার  প্রিয় ছিল।  অন্য  পাড়া  থেকে আসা তাদেরই  সমগোত্রীয়দের প্রতি  সে পুরোমাত্রায় সহানুভূতিশীল  ছিল  এবং তার সাঙ্গপাঙ্গোদের প্রতি কড়া নির্দেশ  ছিল  যেন  কোনরকম  অভদ্রতামূলক  আচরণ  না করা হয়। তার বন্ধুবান্ধবরাও  তাকে খুব  মানত এবং ভোম্বল  ছিল তাদের  অবিসম্বাদিত নেতা। একটা দারুণ  ম্যাজেস্টিক  ভাব ভঙ্গি  ছিল তার। দীর্ঘদিন  পর ছুটিতে  বাড়ি এসেছি এবং যথারীতি দোকান বাজার  করছি কিন্তু সেই লালচে শরীর ও মুখের কাছটা একটু কালো এবং সুন্দর পাকানো  লেজের সাদা ডগাটা নাড়িয়ে আর পিছু পিছু বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে না দিতে দেখায় ভেতরটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল এবং বাড়ি ফিরে এসে ওর খোঁজ নিতেই আমার  আশঙ্কাটা  ঠিক হলো। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রকৃতির  নিয়মে ম্যাজেস্টিক ভোম্বল   আমাদের  সবাইকে ছেড়ে  ফিরে গেছে তাঁর কাছে।

Tuesday, 19 July 2022

সব্যসাচী

সব্যসাচী মানে যার দুহাত একসঙ্গে চলে। মহাভারতে অর্জুনের  সম্বন্ধে জানতে পারি যে তিনি দুইহাতেই তীর চালাতে পারতেন এবং সেই কারণেই  তাঁর অপর এক নাম সব্যসাচী। ছোটবেলায় ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না যে দুটো হাতেই একসঙ্গে কি করে তীর চালানো সম্ভব। স্যারদের  জিজ্ঞেস  করলে শুনতাম  বোস।পাশে বসা বন্ধুরা জামা টেনে বসিয়ে দিত। কিছুতেই প্রশ্নের  উত্তর  পেতাম  না। নিজের  মনে মনেই বলতাম  যে একহাত দিয়ে ধনুকটা ধরে অন্য হাতে তীরটা  ধনুকের  ছিলায় লাগিয়ে টেনে ধরার  পর ছাড়তে হবে। তা সেখানে অর্জুনের  হাতের টিপ বা নিশানা অন্যদের  তুলনায় অনেক নিখুঁত।  ছোটবেলায়  বাঁহাতে ধনুকটা ধরে ডানহাতে পাটকাঠি ভেঙ্গে  বানানো তীর  ধনুকের ছিলায় লাগিয়ে টেনে ধরে ছেড়ে দিয়ে আম পাড়ার  চেষ্টা করেছি কিন্তু আম পড়া তো দূর অস্ত , পাতাও এক আধটা পড়েনি বরঞ্চ আমার তীরটাই গাছে আটকে গেছে এবং দাদাকে বলে লম্বা লাঠি দিয়ে গাছ থেকে তীর নামাতে হয়েছে। এহেন  আমারও  অর্জুনের  মতো সব্যসাচী হবার  বাসনায়  উল্টো হাতে মানে ডান হাতে ধনুক  ধরে বাঁহাত দিয়ে তীর চালাবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি, হঠাৎই  বড়দির  গলার  আওয়াজ, "অ্যাই ছোটু, হোম টাস্ক করিস নি কেন? আয় এদিকে বলছি " শুনে হকচকিয়ে গেলাম  আর তীর গিয়ে লাগল কলতলায় থাকা  আমাদের  বাড়ির কাজের  লোক সুরধ্বনি মাসির গায়ে। ওরে বাবা রে, মা রে এই দত্যিটার জ্বালায় এবার  মলুম।  যাই হোক, যতটা না লেগেছে  তার চেয়ে বেশী ঢং করে কাজটা সেদিনের  মতো যাতে না করতে হয়  তার জন্য  বিত্তেমি  করতে লাগল। সুরধ্বনি মাসির মোটা হাতে অনেকটা মলম লাগিয়ে দিয়ে কম কাজ করতে বলে মা রান্নাঘরে রাখা উনুনে  হাওয়া দেওয়ার  ডাঁটিওলা  পাখাটার  উল্টোদিক  ধরে পটাপট দুচার ঘা লাগিয়ে দিল আর বলল যা, হোমটাস্ক  না করে খালি খেলে খেলে বেড়ানো, যা পড়তে বোস গিয়ে। মাসির ওপর সমস্ত  রাগ গিয়ে  পড়ল আর বড়দির  ওপরেও।  হঠাৎই  ঐ সময় না ডাকলে হয়তো সেদিন  বাঁহাতেও  তীর চালাতে পারতাম  আর নিজেকে খুদে সব্যসাচী বলে ভাবতে পারতাম। 
এরপর অনেকদিন  কেটে গেছে। দাদার সঙ্গে  বিবেকানন্দ ব্যায়াম সমিতি ক্লাবে গিয়েছি। ওখানে একটা সুন্দর  বক্সিং রিং ছিল। শহরে দুটো রিং ছিল,  একটা এখানে আরও  একটা ছিল গোরাবাজারের শক্তিমন্দিরে।  কিন্তু এখানে ছিল  বিরাট  জায়গা এবং শহরের  মাঝখানে। সেইকারণে এখানে ভিড় হতো অনেক বেশী। হাঁ করে দেখছি দুজন হাতে গ্লাভস পরে বক্সিং লড়ছে আর রেফারি হিসেবে রয়েছেন  দুলুদা। পরে শুনেছিলাম  দুলুদা বেঙ্গল  চ্যাম্পিয়ন  বক্সার  ছিলেন।  আরও  অনেককেই দেখেছি বক্সিং লড়তে যাদের  মধ্যে চঞ্চল দা, রবি দা, শক্তি দা , দোদা  দা, মোহন দা, বীরেন দা, দিলীপ দা,অভয় দারা ছিলেন  এবং প্রত্যেকেই  খুব ভাল  বক্সার  ছিলেন। বীরেন দা, দিলীপ দা খুবই  ভাল ছাত্র  ছিলেন  এবং দুজনেই  ফিজিক্সের  অধ্যাপক  ছিলেন।  বীরেন দা রানাঘাট  কলেজের  হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ছিলেন  এবং দিলীপ দা বহরমপুর  গার্লস কলেজে  পড়াতেন।  ঐ ক্লাবের  প্রতিষ্ঠাতা  প্রণব দা( পিনু দা) পরে পণ্ডিচেরি চলে যান এবং অরবিন্দ  আশ্রমে শরীর চর্চার অধ্যক্ষ  ছিলেন। পরে তিনি তাঁর জমানো টাকার  একটা বিরাট  অংশ  এই ক্লাবকে দান  করেন। বক্সিং রিংয়ের  দিকে হাঁ করে চেয়ে দেখতাম যে দুজনেই  কেমন ডান হাত, বাঁহাত  একসঙ্গে  চালিয়ে লড়ছে। তখন  ভাবতাম  এরাও  তো তাহলে সব্যসাচী।

বক্সিং এর প্রতি আমার  একটা আলাদাই  আকর্ষণ ছিল। নিজেও লড়তাম এবং শেখাতাম ও বাচ্চাদের। দীর্ঘদিন  বক্সিং কম্পিটিশন  বন্ধ ছিল। ক্লাবের  প্রধান  কর্ণধার  দুলুদা বললেন  যে এবার  কিন্তু বক্সিং কম্পিটিশনটা চালু করতেই হবে। সবচেয়ে উপভোগ্য হবে মলয় এবং দিলীপের লড়াই এবং তারপরেই হবে জয়দেব এবং শ্যামলের  লড়াই। সব মনে মনে ছকে নেওয়া  হচ্ছে কে কার সঙ্গে লড়বে এবং কাকে কি দায়িত্ব  দেওয়া হবে। কিন্তু মানুষ  ভাবে এক, ভগবান করেন  আর এক এবং তাঁর  কথাই  শেষ  কথা। পরের দিন  শো , সব কিছুই  ঠিক ঠাক চলছে, হঠাৎ বাড়ি থেকে খবর এল আগামীকাল  শিলিগুড়িতে জরুরী কাজে যেতেই হবে এবং এগারোটার মধ্যেই  পৌঁছাতে হবে।সুতরাং ঐদিন  রাতেই  কামরূপ এক্সপ্রেস  রাধারঘাট থেকে ধরতেই হবে। রাতে কামরার  দরজা কেউ খুলতেই  চায়না, ভাবে বোধহয় ডাকাত উঠছে। যাই হোক,  অনেক  অনুনয় বিনয় করার পর কেউ একজন খুলে দিলেন। গিজগিজ করছে ভিড়, তিলধারনের স্থান নেই। কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ, কোনরকমে একটা  বই বের করে ইন্টারভিউ এর জন্য  প্রস্তুতি নিচ্ছি। পা টনটন করছে, যখন  একদম পারছি না তখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, ঐ জায়গাতেই সোজা হয়ে বসছি আবার  উঠে পড়ছি। এক ভদ্রলোক  তখন  একটু দয়াপরবশ হয়ে অন্যদের চেপে আমাকে একটু  বসার  জায়গা  করে দিলেন। ঐ ভাবেই  সকালে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে বাসে শিলিগুড়ি পৌঁছলাম  এবং একজন পরিচিতের বাড়ি গিয়ে স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম  গন্তব্যস্থলে। সব কিছু  সেরে ফিরতে ফিরতে বিকেল  গড়িয়ে গেল এবং শিলিগুড়ির  আশ্রম রোডে  সেই পরিচিতের বাড়ি খাওয়া দাওয়ার পর আবার ফেরার পালা। কিন্তু আমার ভাগ্য ই খারাপ  ছিল,  ট্রেন লেট করায় বক্সিং কম্পিটিশনের  দ্বিতীয় এবং শেষ দিনেও এসে পৌঁছতে পারলাম না আর, আরও  একবার  সব্যসাচী হওয়া হয়ে উঠলনা।  দ্বিতীয় দিনে ঠিক  সময়ে না পৌঁছানোর জন্য  আমার  সঙ্গে যার লড়ার  কথা ছিল  তাকে ওয়াক ওভার দেওয়া হলো আর শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। 
এরপর কর্মসূত্রে বিভিন্ন  জায়গায়  ঘোরা শুরু হলো। কোন জায়গায় বেশীদিন  থাকতে ইচ্ছে করেনা। বিভিন্ন জায়গায় যাব, সেখানকার  লোকদের  সঙ্গে মিশব  এবং তাদের  সংস্কৃতির  সঙ্গে  পরিচিত হয়ে নিজেকে একটু বেশীরকম অভিজ্ঞ করব এটাই ছিল  মনোগত  বাসনা। তিনবছরের  মেয়াদ  ফুরোবার আগেই নতুন  কোন জায়গায় যাবার  বাসনা মনের মধ্যে চাগিয়ে উঠত।  পোস্টিং হলো বিশাখাপটনম শহরের  দ্বারকানগর শাখায়। ওখানে একজন  বিচিত্র  ধরণের ভদ্রলোকের  সঙ্গে কাজ করবার  সুযোগ  ঘটল। ভদ্রলোকের নাম পাস্তুলা সূর্যনারায়ণ ঐ ব্রাঞ্চের  অ্যাকাউন্টান্ট।  মাঝারি লম্বা, ছিপছিপে চেহারার ভদ্রলোকের  মাথাভর্তি চুল এবং ব্যাকব্রাশ করা। সদাহাস্যময়  ভদ্রলোক কখনও  কাউকে না করতেন  না, যতক্ষণ  সম্ভব  হতো সকলকে  খুশী রাখার চেষ্টা করতেন  । তাঁর পাশে বসে কাজ করতে করতে হঠাৎই  আমার  চোখ পড়ে গেল  তাঁর  দিকে। বিশ্বাস করতেই পারছিনা নিজের  চোখকে।  বারবার  চোখ কচলাচ্ছি আর ভাবছি ঠিক দেখছি তো। উনি বাঁহাতে নিজের  স্ক্রোল যোগ  করছেন  এবং ডান হাতে একটা  চিঠি লিখছেন। আমি নিজের  চোখে না দেখলে, অন্য  কারও কাছে শুনলে কিছুতেই  বিশ্বাস  করতাম  না। আমি অন্য  স্টাফদের  যখন  বলছি তখন  কেউই আশ্চর্য হলনা। মানে  সবাই জানে তাঁর  এই বিশেষ  গুণের  কথা। এই পিংলে চেহারার  ভদ্রলোকের ও এক ভীষণ  নেশা বক্সিং। তখন  এম ভি পি কলোনিতে থাকি। একটা রবিবার  দুপুর  বেলায় ওয়ার্ল্ড  হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই হবে, সবেমাত্র  খাওয়াদাওয়া সেরে টিভি খুলে বসেছি, হঠাৎ গেট খোলার  আওয়াজে বাইরে এসে দেখি সূর্যনারায়ণকে। আসুন আসুন বলে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালাম।  উনি বললেন  টিভি চালু করতে কারণ  উনি বক্সিং লড়াই দেখতে এসেছেন ঋষিকোণ্ডায় চলতে থাকা পিকনিক  ছেড়ে।  আমার  দেখা প্রকৃত  সব্যসাচীর  এই আশ্চর্য রকম  ঝোঁক  দেখে আমি সত্যিই  বিস্ময়ে  হতবাক হয়ে গেলাম।  অনেকেই  হয়তো  দুইহাতেই  লিখতে পারেন  বা কাজ করতে পারেন  কিন্তু একই সঙ্গে দুটো ভিন্ন ধরণের কাজ করতে কাউকেই  দেখিনি। হয়তো এইরকম  প্রতিভাশালী  অনেকেই  আছেন  কিন্তু আমার  দেখা একজনই  সব্যসাচী যাঁর নাম পাস্তুলা সূর্যনারায়ণ। 

Tuesday, 5 July 2022

অর্জুনের অ্যালেন অভিযান

বহুদিন  কোন অভিযান না হওয়ায় সমস্ত পাণ্ডব এবং তাঁদের সহধর্মিনীরা ভীষণ বিষণ্ণ। এযাবত  জানা আছে যে যুদ্ধে যোদ্ধাদের  স্ত্রীরা সাধারণত সহগামী হন না, তাহলে এখানে তার ব্যতিক্রম  কেন? না না, এ সেইরকম অভিযান  নয় এটা হলো ভোজনরসিকের অভিযান,  সুতরাং স্ত্রীরা  সেখানে পিছিয়ে থাকবেন! ঐ চিন্তা ভুলেও  মাথায় এলে পরের কয়েকদিন  অন্তত মুখ শুকিয়ে থাকতে হবে এবং শুকনো পাঁউরুটি চিবিয়ে থাকতে হবে নতুবা বিস্কুট মুখে দিয়ে জল খেতে হবে। অতএব,  ভুলেও  ঐ চিন্তা মাথায় না এনে তাদের ই পরিচালনের ভার দেওয়া ভাল।

হতচ্ছাড়া করোনার  জ্বালায় সেই দুহাজার উনিশের  নভেম্বর মাসের  পর আর কোন বড় অভিযান  হয়নি। সর্বজ্যেষ্ঠ  পাণ্ডব  যুধিষ্ঠিরের  দুই হাঁটু প্রতিস্থাপনের  পরপরই এল কুঁতকুঁতে চোখের  দেশ চীন  থেকে করোনা এবং সমস্ত  পৃথিবীকে ব্যতিব্যস্ত  করে তুলল। এল বহির্বিশ্বের জীবের মুখ ঢাকার মাস্ক, স্যানিটাইজার এবং নভোচারীদের মত পোষাক যার গালভরা নাম পি পি ই কিট। সমস্ত  পৃথিবী জুড়ে এই তিন ব্যবসার  রমরমা আর তার  সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হলো কিছু অসাধু নার্সিং হোমের ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যবসার। চাচা, আপন প্রাণ  বাঁচা বলে লোকের  ঘটি বাটি বিক্রি করেও যদি আরও  কিছুদিন  এই মায়াবি  পৃথিবীতে থাকা যায় তার জন্য আকুল ব্যাকুলতা। চারিদিকে বহু লোক বেকার হলো কিন্তু নেতা, মন্ত্রী এবং তাদের  সান্ত্রীদের  কিছু কম হলোনা, তারা যথেষ্ট  সুযোগ সন্ধানী এবং কি করলে তাদের  পাঁচ পুরুষ  বসে খেতে পারে তার ঘাঁতঘুঁত সব নখদর্পণে। মাঝখানে একটা ছোট্ট বিরতি হয়েছিল টিভিতে সিরিয়াল  চলার  মাঝে যেমন বিজ্ঞাপনের  বিরতি হয়। আর সেই  ফাঁকেই  স্ট্র্যাটেজিস্ট  অর্জুন অভিযান  চালালেন টোকু সাহেবের  বাগান বাড়িতে এবং তাঁর অভিযান চালানো মানেই সাফল্য।  সেখানে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম না থাকলেও  অভিযান  অত্যন্ত  সফল। করোনার প্রকোপ যখন  একটু পড়তির মুখে তখন  আবার  সহদেবের হাঁটু প্রতিস্থাপন এবং সেখানেও অর্জুনের  উপস্থিতি মানে এক কথায় যেমন  কানু বিনা গীত হয়না তেমনই  অর্জুন বিনা পাণ্ডব অকল্পনীয়। শরীর থাকলেই যেমন  অসুস্থতা  থাকবে তেমন  অর্জুন ও কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার  পূর্ণোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নতুন  অভিযানে।

উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ি  কাছে সেন্ট্রাল  অ্যাভিনিউ ( যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত অ্যাভিনিউ) এর চল্লিশ  নম্বর বাড়ির  একতলায় স্বল্প পরিসরে এই অ্যালেন কিচেন।  একশ ত্রিশ বছর  আগে স্কটিশ  সাহেব  অ্যালেন  তাঁর নামানুসারেএই কিচেনের স্থাপন  করেন। পরে তাঁরই কর্মী  জীবন কৃষ্ণ সাহাকে তিনি এটা দিয়ে দেন। এটা এক ঐতিহ্যবাহী দোকান  এবং এখানকার  চিংড়ির  কাটলেট  ও চিকেন কাটলেটের প্রসিদ্ধি সর্বজনবিদিত। সিংহের  বয়স হলেও  সে সিংহই  থাকে এবং তার তেজের  বিন্দুমাত্র  ঘাটতি হয়না। মধ্যম পাণ্ডব  অর্জুনের  ক্ষেত্রেও  তা ব্যতিক্রম  নয় । তিনি অভিযানের  আগে সমস্ত  সুবিধা অসুবিধার  কথা চিন্তা করে গতকাল অর্থাৎ  পাঁচই জুলাই দিন স্থির  করলেন। যুধিষ্ঠির এবং তাঁর  স্ত্রী দেবিকা,  বোন দুঃশলা, অর্জুন  এবং তাঁর  স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা, এবং সহদেব ও তাঁর  স্ত্রী বিজয়া এই অভিযানে অংশগ্রহণ করলেন। ভীম এবং তাঁর স্ত্রী জলন্ধরা দীর্ঘদিন  প্রবাসে থাকায় অভিযানে অংশ নিতে পারেন নি এবং নকুল ও তাঁর সহধর্মিনী কারেনুমতী ইউরোপ ও আমেরিকা পরিভ্রমণে ব্যাপৃত থাকায় তাঁরাও অনুপস্থিত।  কিন্তু নকুলজায়া  কারেনুমতীর ঘ্রাণ শক্তি স্নিফার ডগকেও  হার মানাবে।  তিনি ঠিক  ঐ সময়েই ভিডিও  কল করেছেন এবং তিনি সমস্ত  অভিযানেই  অর্জুনের ই মতন  উৎসাহী হওয়ার জন্য একটু মনে দুঃখ  পেলেন তাঁরা না থাকার জন্য।  তাঁদের  প্রত্যাবর্তনের  পর আরও  একবার  অভিযান  চালানো হবে এই প্রতিশ্রুতির পর তিনি একটু শান্ত হলেন। কিন্তু তাঁর  চোখেমুখে  ফুটে ওঠা যন্ত্রণার অভিব্যক্তি  কারও  নজর এড়ায়নি।

ছোট্ট  দোকান  এই অ্যালেন।  কাঠের  কড়ি বর্গায় ইতিহাস  যেন মিলে মিশে আছে।সামনের  ভাগে রিসেপশন এবং রান্নার  জায়গা এবং ভিতরের  দিকে চারটে টেবিল  সম্বলিত  ষোল জনের  বসার ব্যবস্থা। এর মধ্যে ভিতরের ঘরে ঢুকতেই  বাঁদিকের টেবিলে দুজনের  বসার জায়গা এবং ঐ টেবিলের সামনের দুটো চেয়ার স্থান  পেয়েছে  ভিতরের  দিকে পাশাপাশি রাখা টেবিল  দুটোর  মাঝখানের  pরাজবাড়ির দুটো দেয়াল আলমারি যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র থাকে। গাঁটগোঁট  চেহারার চেয়ারগুলোও দামী কাঠের,  নজর পড়লেই বোঝা যায়। সঙ্গে মানানসই টেবিলগুলোও তাই কিন্তু মার্বেল টপ ইতিহাসের হাজার বাহক। মেনু কার্ড চারটে টেবিলে চারটে রাখা,  রকম  আইটেম  নেই কিন্তু যেটাতে ওদের  বৈশিষ্ট্য  তার নীচে কালি দিয়ে দাগ দেওয়া। অর্জুন  তো এই বিষয়ে আগেই রিসার্চ  করে ফেলেছেন  এবং অ্যালেনের বিখ্যাত  চিংড়ির কাটলেট  এবং যারা চিংড়ি খান না বিভিন্ন  কারণে, তাঁরা চিকেন কাটলেটের  অর্ডার  দিলেন। খাঁটি ঘিয়ে  ভাজা দুই কাটলেটই  অনন্য, এ বলে আমাকে দেখ  ও বলে আমাকে দেখ। অসাধারণ অনুভূতি।  সহদেবের আরও  একটু  খেতে ইচ্ছে হওয়ায় দুটো চিকেন  কবিরাজি  চারজন ভাগ করে খেলেন।  যুধিষ্ঠির,  অর্জুন এবং দুঃশলা কাটলেটেই নিবৃত্ত  থাকলেন। এবার  ওঠার  পালা, বাইরে নেমেছে ঝিরঝির করে বৃষ্টি। গাড়িতে উঠতেই  নামল ঝমঝম করে।  স্বল্প পরিসর হওয়ায় বাইরে চওড়া ফুটপাতে রাখা গোটা  আটেক প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে থাকা ছেলেমেয়েরা আমরা গাড়িতে ওঠায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এবং তাড়াতাড়ি অ্যালেনে ঢুকে পড়ায় বোঝা গেল  যে এই ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ সব বয়সী লোকদের কাছেই  সমান আকর্ষণীয়। অভিযান  কিন্তু এখানেই সমাপ্ত  নয়। আক্রমণ  শানানো  হলো চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লার দিকে। কিন্তু তারা তাদের  ঐতিহ্যমতো ঠিক সাড়ে ছটায় দোকান  বন্ধ করে দেওয়ার ফলে রক্ষা পেল কিন্তু অভিযানের  সমাপ্তি কি এখানেই  হয় যেখানে রয়েছেন  অগ্রগণ্য  অর্জুন।  অতএব পরের আক্রমণ গিরীশ দে ও নকুড় নন্দীর সন্দেশ।  সেখানে আত্মতৃপ্ত  হয়ে খাওয়া এবং সঙ্গে লুন্ঠন ( অবশ্যই  নগদ নারায়ণের সহযোগিতায়)  করে ফিরে আসা  এক দারুণ  অভিজ্ঞতা।