তখনকার যুবকরা আজ প্রায় বৃদ্ধ। যাঁরা প্রৌঢ় ছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ সেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন কিন্তু যাবার আগে তাঁদের অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে দিয়ে গেছেন এবং আজকের এই মোটামুটি মধ্যবিত্ত ও বিত্তবানদের জন্য একটা বাসযোগ্য সংস্কৃতি মনোভাবাপন্ন সোসাইটি গড়ে তুলতে পেরেছেন। তাঁদের জানাই সশ্রদ্ধ নমস্কার। প্রত্যেক বাড়িতেই তখন একটা দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে ছিল এবং সকাল বেলায় স্কুলের বাসের জন্য বাবা বা মায়ের হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এবং জলের বোতল হাতে নিয়ে বাসকাকুর অপেক্ষায় থাকত। বিভিন্ন স্কুলের বিভিন্ন বাস, তাদের কাকুও ভিন্ন কিন্তু বাসে উঠাতে আসা মা বাবাদের মধ্যে এক বন্ধুত্বের বাঁধন গড়ে উঠতে থাকল ঐ বাচ্চাদের বাসে তুলতে আসার সুবাদে। কোন বাচ্চার জন্মদিনে চেনাজানা বাচ্চাদের সঙ্গে বাবামায়েরাও আসতেন এবং ধীরে ধীরে প্রীতির বাঁধন ও বেশ মজবুত হতে লাগল। স্কুলফেরত বাচ্চারা বাড়ি ফিরেই একটু খাওয়া দাওয়ার পর বিকেল হতেই হৈ হৈ করে বেড়িয়ে পড়ত খেলার জন্য এবং সমস্ত জায়গাটা তাদের কলকলানিতে ভরে উঠত। সমাজ বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছিল এবংএকটা খুব সুন্দর পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে এই বাচ্চারা বড় হতে লাগল এবং তাদের অনেকেই আজ শহরের বাইরে এবং কেউ কেউ দেশের ও বাইরে।কিন্তু তাদের ছোট থেকে বড় হওয়ার সময়টা মানে মাঝের পনের বিশ বছর অত্যন্ত আনন্দ মুখর ছিল এই গল্ফগ্রীন এবং এই সময়টা তুলে ধরাটাই আমার উদ্দেশ্য।
বাচ্চাদের খেলার সঙ্গে সঙ্গে একটু উঁচু ক্লাসে পড়া ছেলেদের সন্ধের পরেও বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা চলত এবং খেলার চেয়ে বেশী খেলার সমালোচনা চলত। সৌরভ তখন ছিল ওদের আইডল এবং ও বেশী রান করলে এরা এত খুশী, যে উচ্চগ্রামে আলোচনা হতো , দেখেছিস, দাদা স্টেপ আউট করে বাপি বাড়ি যা বলে কি সুন্দর স্ট্রেট ড্রাইভ করে ছক্কা লাগাল। কিন্তু অল্প রানে আউট হলেই বলতে থাকত যে ওর ব্যাটটা অতটা অ্যাঙ্গেলে স্লাইস না করে একটু শরীরের কাছে রাখলে ঐরকম বাজে আউট হতো না। এইসব সমালোচনা বেশ মুখরোচক হতো এবং কেউ পক্ষে বা বিপক্ষে বলে আলোচনাটাকে একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিত। চুপ করে একবার এ বক্তা আরেকবার অন্য বক্তার দিকে তাকাতো যেন কত বোঝে কিন্তু কোনরকম বক্তব্য রাখত না সে। ও ছিল ভোম্বল, সবার প্রিয়। যখন তার অন্য সঙ্গী সাথীরা ঐসব আলোচনার মধ্যে না গিয়ে নিজেদের মধ্যেই খেলা বা ঝগড়া করত, ভোম্বল কিন্তু ওদের দিকে ফিরেও তাকাতো না, কেবল আলোচনা শুনত কোনরকম মন্তব্য ছাড়াই। রাস্তার পাশেই ছিল একটা টিউবওয়েল এবং আলোচনার কেন্দ্রস্থল ছিল ওটা। সবাই চলে গেলে ও খানিকক্ষণ একাই থাকত কারণ ওর বন্ধুবান্ধবরা তখন অন্য কোথাও চলে গেছে। অফিস থেকে কাউকে ফিরে আসতে দেখলে ও তাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিত এবং যথাস্থানে ফিরে আসত। খাওয়ার কথা কখনোই তাকে মনে করতে হয়নি কারণ সে সবার প্রিয় ছিল। অন্য পাড়া থেকে আসা তাদেরই সমগোত্রীয়দের প্রতি সে পুরোমাত্রায় সহানুভূতিশীল ছিল এবং তার সাঙ্গপাঙ্গোদের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল যেন কোনরকম অভদ্রতামূলক আচরণ না করা হয়। তার বন্ধুবান্ধবরাও তাকে খুব মানত এবং ভোম্বল ছিল তাদের অবিসম্বাদিত নেতা। একটা দারুণ ম্যাজেস্টিক ভাব ভঙ্গি ছিল তার। দীর্ঘদিন পর ছুটিতে বাড়ি এসেছি এবং যথারীতি দোকান বাজার করছি কিন্তু সেই লালচে শরীর ও মুখের কাছটা একটু কালো এবং সুন্দর পাকানো লেজের সাদা ডগাটা নাড়িয়ে আর পিছু পিছু বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে না দিতে দেখায় ভেতরটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল এবং বাড়ি ফিরে এসে ওর খোঁজ নিতেই আমার আশঙ্কাটা ঠিক হলো। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রকৃতির নিয়মে ম্যাজেস্টিক ভোম্বল আমাদের সবাইকে ছেড়ে ফিরে গেছে তাঁর কাছে।