হতচ্ছাড়া করোনার জ্বালায় সেই দুহাজার উনিশের নভেম্বর মাসের পর আর কোন বড় অভিযান হয়নি। সর্বজ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের দুই হাঁটু প্রতিস্থাপনের পরপরই এল কুঁতকুঁতে চোখের দেশ চীন থেকে করোনা এবং সমস্ত পৃথিবীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। এল বহির্বিশ্বের জীবের মুখ ঢাকার মাস্ক, স্যানিটাইজার এবং নভোচারীদের মত পোষাক যার গালভরা নাম পি পি ই কিট। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে এই তিন ব্যবসার রমরমা আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হলো কিছু অসাধু নার্সিং হোমের ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যবসার। চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা বলে লোকের ঘটি বাটি বিক্রি করেও যদি আরও কিছুদিন এই মায়াবি পৃথিবীতে থাকা যায় তার জন্য আকুল ব্যাকুলতা। চারিদিকে বহু লোক বেকার হলো কিন্তু নেতা, মন্ত্রী এবং তাদের সান্ত্রীদের কিছু কম হলোনা, তারা যথেষ্ট সুযোগ সন্ধানী এবং কি করলে তাদের পাঁচ পুরুষ বসে খেতে পারে তার ঘাঁতঘুঁত সব নখদর্পণে। মাঝখানে একটা ছোট্ট বিরতি হয়েছিল টিভিতে সিরিয়াল চলার মাঝে যেমন বিজ্ঞাপনের বিরতি হয়। আর সেই ফাঁকেই স্ট্র্যাটেজিস্ট অর্জুন অভিযান চালালেন টোকু সাহেবের বাগান বাড়িতে এবং তাঁর অভিযান চালানো মানেই সাফল্য। সেখানে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম না থাকলেও অভিযান অত্যন্ত সফল। করোনার প্রকোপ যখন একটু পড়তির মুখে তখন আবার সহদেবের হাঁটু প্রতিস্থাপন এবং সেখানেও অর্জুনের উপস্থিতি মানে এক কথায় যেমন কানু বিনা গীত হয়না তেমনই অর্জুন বিনা পাণ্ডব অকল্পনীয়। শরীর থাকলেই যেমন অসুস্থতা থাকবে তেমন অর্জুন ও কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার পূর্ণোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নতুন অভিযানে।
উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ি কাছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ( যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত অ্যাভিনিউ) এর চল্লিশ নম্বর বাড়ির একতলায় স্বল্প পরিসরে এই অ্যালেন কিচেন। একশ ত্রিশ বছর আগে স্কটিশ সাহেব অ্যালেন তাঁর নামানুসারেএই কিচেনের স্থাপন করেন। পরে তাঁরই কর্মী জীবন কৃষ্ণ সাহাকে তিনি এটা দিয়ে দেন। এটা এক ঐতিহ্যবাহী দোকান এবং এখানকার চিংড়ির কাটলেট ও চিকেন কাটলেটের প্রসিদ্ধি সর্বজনবিদিত। সিংহের বয়স হলেও সে সিংহই থাকে এবং তার তেজের বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়না। মধ্যম পাণ্ডব অর্জুনের ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয় । তিনি অভিযানের আগে সমস্ত সুবিধা অসুবিধার কথা চিন্তা করে গতকাল অর্থাৎ পাঁচই জুলাই দিন স্থির করলেন। যুধিষ্ঠির এবং তাঁর স্ত্রী দেবিকা, বোন দুঃশলা, অর্জুন এবং তাঁর স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা, এবং সহদেব ও তাঁর স্ত্রী বিজয়া এই অভিযানে অংশগ্রহণ করলেন। ভীম এবং তাঁর স্ত্রী জলন্ধরা দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকায় অভিযানে অংশ নিতে পারেন নি এবং নকুল ও তাঁর সহধর্মিনী কারেনুমতী ইউরোপ ও আমেরিকা পরিভ্রমণে ব্যাপৃত থাকায় তাঁরাও অনুপস্থিত। কিন্তু নকুলজায়া কারেনুমতীর ঘ্রাণ শক্তি স্নিফার ডগকেও হার মানাবে। তিনি ঠিক ঐ সময়েই ভিডিও কল করেছেন এবং তিনি সমস্ত অভিযানেই অর্জুনের ই মতন উৎসাহী হওয়ার জন্য একটু মনে দুঃখ পেলেন তাঁরা না থাকার জন্য। তাঁদের প্রত্যাবর্তনের পর আরও একবার অভিযান চালানো হবে এই প্রতিশ্রুতির পর তিনি একটু শান্ত হলেন। কিন্তু তাঁর চোখেমুখে ফুটে ওঠা যন্ত্রণার অভিব্যক্তি কারও নজর এড়ায়নি।
ছোট্ট দোকান এই অ্যালেন। কাঠের কড়ি বর্গায় ইতিহাস যেন মিলে মিশে আছে।সামনের ভাগে রিসেপশন এবং রান্নার জায়গা এবং ভিতরের দিকে চারটে টেবিল সম্বলিত ষোল জনের বসার ব্যবস্থা। এর মধ্যে ভিতরের ঘরে ঢুকতেই বাঁদিকের টেবিলে দুজনের বসার জায়গা এবং ঐ টেবিলের সামনের দুটো চেয়ার স্থান পেয়েছে ভিতরের দিকে পাশাপাশি রাখা টেবিল দুটোর মাঝখানের pরাজবাড়ির দুটো দেয়াল আলমারি যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র থাকে। গাঁটগোঁট চেহারার চেয়ারগুলোও দামী কাঠের, নজর পড়লেই বোঝা যায়। সঙ্গে মানানসই টেবিলগুলোও তাই কিন্তু মার্বেল টপ ইতিহাসের হাজার বাহক। মেনু কার্ড চারটে টেবিলে চারটে রাখা, রকম আইটেম নেই কিন্তু যেটাতে ওদের বৈশিষ্ট্য তার নীচে কালি দিয়ে দাগ দেওয়া। অর্জুন তো এই বিষয়ে আগেই রিসার্চ করে ফেলেছেন এবং অ্যালেনের বিখ্যাত চিংড়ির কাটলেট এবং যারা চিংড়ি খান না বিভিন্ন কারণে, তাঁরা চিকেন কাটলেটের অর্ডার দিলেন। খাঁটি ঘিয়ে ভাজা দুই কাটলেটই অনন্য, এ বলে আমাকে দেখ ও বলে আমাকে দেখ। অসাধারণ অনুভূতি। সহদেবের আরও একটু খেতে ইচ্ছে হওয়ায় দুটো চিকেন কবিরাজি চারজন ভাগ করে খেলেন। যুধিষ্ঠির, অর্জুন এবং দুঃশলা কাটলেটেই নিবৃত্ত থাকলেন। এবার ওঠার পালা, বাইরে নেমেছে ঝিরঝির করে বৃষ্টি। গাড়িতে উঠতেই নামল ঝমঝম করে। স্বল্প পরিসর হওয়ায় বাইরে চওড়া ফুটপাতে রাখা গোটা আটেক প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে থাকা ছেলেমেয়েরা আমরা গাড়িতে ওঠায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এবং তাড়াতাড়ি অ্যালেনে ঢুকে পড়ায় বোঝা গেল যে এই ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ সব বয়সী লোকদের কাছেই সমান আকর্ষণীয়। অভিযান কিন্তু এখানেই সমাপ্ত নয়। আক্রমণ শানানো হলো চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লার দিকে। কিন্তু তারা তাদের ঐতিহ্যমতো ঠিক সাড়ে ছটায় দোকান বন্ধ করে দেওয়ার ফলে রক্ষা পেল কিন্তু অভিযানের সমাপ্তি কি এখানেই হয় যেখানে রয়েছেন অগ্রগণ্য অর্জুন। অতএব পরের আক্রমণ গিরীশ দে ও নকুড় নন্দীর সন্দেশ। সেখানে আত্মতৃপ্ত হয়ে খাওয়া এবং সঙ্গে লুন্ঠন ( অবশ্যই নগদ নারায়ণের সহযোগিতায়) করে ফিরে আসা এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
No comments:
Post a Comment