Tuesday, 16 May 2023

হরকরা

ভজাটা বরাবরই একটু ডানপিটে ধরণের। সেই ছোট্ট থেকেই একটু সবার উপর খবরদারি করা ওর যেন স্বভাবেই পরিণত হয়েছিল। অবশ্য  সেটার একটা কারণ ও ছিল। বয়সের  তুলনায় ও ছিল একটু হাঁফালো আর সেইটাই ওর ছোট থেকেই দাদাগিরি করার  অভ্যাস হয়ে গেছিল। কথায় কথায় বন্ধুদের হাতটা একটু মুচড়ে  দেওয়া  বা মাথায় টকাম করে একটা চাঁটি বা আচমকা কারও  পিঠে গুম করে একটা কিল মেরে দেওয়া ওর যেন  মজ্জাগত  হয়ে গেছিল। বন্ধুরা ওর এই ধরণের  আচরণে যে স্বভাবতই নারাজ থাকবে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তখন ও ফ্ল্যাট কালচার  আসেনি, পাড়ার অস্তিত্বর বেশ রমরমা।  সবাই সবাইকে চিনত , বাড়ির হাঁড়ির খবর ও মুখে মুখে প্রচারে তিল থেকে তালের পর্যায়েও চলে যেত। কোন বাড়ির  মেয়েকে ঐ পাড়ার কোন ছেলের  সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে এজাতীয়  মুখরোচক  ঘটনা যে কি সাঙ্ঘাতিক  পর্যায়ে চলে যেত এক কথায় তা অভাবনীয়। সুতরাং খুব বুঝে সুঝে পা ফেলো বাবা। ভজা যেহেতু একটু লীডার গোছের ছিল, অনেক সময়ই  মেয়ের দাদা বা মা ভজাকে ডেকে  একটু অনুরোধ  করত যাতে বেপাড়ার ছেলের থেকে বাড়ির  মেয়েটার বেইজ্জতি  না হয়। একদম ভজার  মনের  মতো কাজ। সুযোগ  বুঝে ছেলেটাকে একটু কড়কে দেওয়া না পর্যন্ত ওর পেটের  ভাত ই হজম  হতো না। আর এইসব করতে গিয়ে পড়াশোনায় একদম লবডঙ্কা। প্রত্যেক  ক্লাসেই  দুবছর  তিনবছর করে থেকে নিজেকে একদম পোক্ত করে তুলেছিল  যার ফলস্বরূপ  তার ছোট ভাইয়ের থেকেও  ছোট ছেলেদের সঙ্গে পাশ করা। কিন্তু যেভাবেই  হোক না কেন সে স্কুলের  গণ্ডি পার করতে সক্ষম হয়েছিল। 
পরের  পর্যায়টা  খুব একটা সুখকর ছিল না তার পক্ষে। অন্য সমবয়সী ছেলেরা যখন  পাশ করে  চাকরি বাকরিতে ঢুকে গেছে, কারও  কারও  বিয়েও  হয়ে গেছে এবং বাবাও হয়ে গেছে তখনও সে দাঁড়াতে পারেনি নিজের  পায়ে। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর এর তার যার যেমন  প্রয়োজন সেখানেই  সে ছাতা ধরে দাঁড়াচ্ছে। ইতিমধ্যেই  তার বাবা চলে গেলেন এবং বিশেষ  কিছু না রেখে যাওয়ার জন্য অল্পদিনের মধ্যেই  প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার  জোগাড়। যা কিছু ছিল  তা দিয়ে ভজা ও তার  মায়ের কোনরকমে দিন চলে যাচ্ছিল।  কিন্তু বসে খেলে রাজার ধনও শেষ হয়ে যায়, এই আপ্তবাক্য তো অস্বীকার  করার  নয়। কিন্তু পেটে গামছা বেঁধে তো পরোপকার করা যায় না। কিন্তু এর মধ্যেও ভজার হাসিমুখে সবার কাজ করতে কোনরকম  দ্বিধা ছিলনা। কিন্তু বেশিরভাগ লোকই নিজের  কাজটা হয়ে গেলেই একটু চা জলখাবার খাইয়ে বিদায় দিত।  এরই মধ্যে পাড়ায় ভাড়া নিয়ে এলেন  সুধীর বাবু।  তিনি ছিলেন পোস্টাল  ডিপার্টমেন্টের  উচ্চপদস্থ  অফিসার।  ভজার  এই নিঃস্বার্থ ভাবে সকলের  উপকার  করা তাঁর  চোখ এড়াল না। ঐ সময় তাঁরই  ডিপার্টমেন্টে কিছু পিওনের পদ ভর্তি হবে। তিনি ভজাকে একদিন  রাস্তায় দেখতে পেয়ে তাকে তাঁর  বাড়িতে আসতে বললেন। ভজা ভাবলো যে পাড়ায় আসা নতুন  ভদ্রলোকের  কোন  প্রয়োজন  আছে, আর সেকারণেই  উনি ডাকছেন। হাসিমুখে সম্মতি জানালো আসার কথা।
সন্ধ্যে বেলায় ভজা খেয়াল  রাখছে কখন সুধীর বাবু অফিস থেকে ফেরেন। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে চা জলখাবার খাবার পরে ও যাবে মনস্থ  করেছে। সাড়ে সাতটা নাগাদ  দরজায় কড়া নাড়ল সে। সুধীর বাবু ওকে দেখেই ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঘরে বসালেন এবং একটু চা করার  কথা বললেন।  ভজা তো অবাক। এতদিন  সবার  কাজ করার পর লোকে তাকে  চা খাওয়ার কথা বলেছে আর এই ভদ্রলোক কোন  কাজ  না করিয়েই চা খেতে বলছেন  এইটা ভেবেই  সে তাঁর  সম্বন্ধে একটু উঁচু ধারণাই  পোষণ করলো। চা বিস্কুট খাওয়া হলে সুধীর বাবু সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করলেন  যে সে কোন কাজ  করে কিনা এবং বাড়িতে তার কে কে আছেন।  ভজা ঘাবড়ে গেল, হঠাৎই  এরকম কথা কেন। যাই  হোক  জানালো যে সে বেকার এবং বাড়িতে তার মা রয়েছেন। 
 সংসার  চলে কি করে?
মানে বাবা যেটুকু টাকা জমা রেখেছিলেন  তাই  দিয়ে আর লোকের  এটা সেটা করে যদি কেউ কিছু দেন, তাই দিয়ে।
পড়াশোনা কতদূর  করেছো?
মানে স্কুলের  গণ্ডি পেরিয়েছি  কিন্তু তার পর আর পড়াশোনার সুযোগ  হয়নি।
চাকরি করবে? তোমার  যা কোয়ালিফিকেশন,  তাতেই হবে। আমাদের  অফিসে পিওন  নেওয়া হবে, তুমি চাইলে করতে পার। ভেবে আমাকে জানিও।
ভজা তো নিজের  চোখ, কান কে বিশ্বাস ই করতে পারছিল না। এতদিন  লোকে সবাই তার কাছ থেকে কাজ নিয়েছে এবং পরে  কিছু চাইতে পারে ভেবে  এড়িয়ে গেছে আর এই ভদ্রলোককে নিশ্চয়ই  ভগবান  পাঠিয়েছেন।  আমাকে কি করতে হবে স্যার? হঠাৎই  স্যার  শব্দ টা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। 
আমি কাল একটা ফর্ম  এনে দেব,  তুমি তোমার  স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার  মার্কশিট ও সার্টিফিকেট আমার  কাছে এনে দিও আর দুজন ভদ্রলোকের  কাছ থেকে ক্যারাক্টার সার্টিফিকেট  আনতে হবে।
ঠিক আছে স্যার।  আমি এখন আসি।
মুহুর্তের মধ্যেই  একটা দারুণ  আনন্দ  তাকে গ্রাস করল। বাড়িতে গিয়ে মাকে বলল, " মা, এতদিন  পর ভগবান  আমাদের  দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। " এরপর  সব ঘটনা মায়ের কাছে খুলে বলল। মা দুর্গা দুর্গা বলে  কপালে হাতজোড় করে প্রণাম  করলেন এবং তারপর ভজার  বাবার  ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাঁধভাঙা  চোখের  জল  গাল বেয়ে নামতে থাকল। এরপর চলল সে তার প্রিয় বন্ধু নন্তুর বাড়ি সবকিছু খুলে বলতে।  নন্তু যদিও  চাকরি করত কিন্তু তবুও  ভজার  সঙ্গে তার  বন্ধুত্ব ছিল  ভীষণ  গভীর কারণ ভজা ছিল  সবার  সুহৃদ। পড়াশোনায় একটু কমতি হলেও  মনটা ছিল  বিশাল। 
যাই হোক, সুধীর বাবুর কল্যাণে সে পোস্টম্যানের চাকরি করতে লাগল।  খুব খুশী সে, হৃদয়টা হয়েছে আরও  বড়।  কিন্তু এরই মাঝে সে বিএ পাশ  করে ফেলেছে, তাও সুধীর বাবুর  উৎসাহে। হয়েছে প্রমোশন এবং যথারীতি বদলি। অবশ্য  বেশি দূরে নয়,  পাশের   শহরেই,  মাত্র পনের  কিলোমিটার দূরত্বে। ভজার  মা দেহরাখার আগে ছেলের  বিয়ে দিতে পেরেছেন  এবং ছোট ছোট  দুই নাতি নাতনিকে দেখে ও যেতে পেরেছেন।  
ভজা রিটায়ার করলেন।  ছেলেমেয়েদের সাধ্যমত ভাল স্কুলে পড়িয়েছেন এবং প্রাণপাত করে মাস্টার মশাইদের  কাছে প্রাইভেট  পড়িয়েছেন এবং তারা ও জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের  পথে। মেয়ের বিয়ের পরে এবং ছেলেও চাকরির  সূত্রে বাইরে থাকায় বাড়িতে কেবল বৃদ্ধ  ভজা ও তার স্ত্রী। কাজ এখন অনেক কম। স্বামী , স্ত্রী দুজনেই  মোবাইল ফোনে ব্যস্ত, মাঝে মধ্যে একটু কথা বার্তা। ভজা হঠাৎই  স্বগতোক্তি  করল, " আমি হরকরাই  থেকে  গেলাম  গো। আগে বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করতাম আর এখন সকাল থেকেই একজনের  পাঠানো ভাল  মেসেজ অন্যদের  কাছে পাঠিয়ে দিই। এটাও কি হরকরার কাজ নয়?"

Saturday, 13 May 2023

বিবর্ণ স্মৃতি

অনেক দাম দিয়ে কেনা কত ঝলমলে কাপড় জামাও  কালের  গতিতে কেমন বিবর্ণ হয়ে যায় সেখানে স্মৃতির  জোয়ারে যে ভাটা পড়বে তাতে আর কি সন্দেহ আছে? ফেলে আসা দিনগুলোর  দিকে পিছন ফিরে তাকালেই মনে পড়ে অনেক ঘটনা, সবগুলোই  যে প্রয়োজনীয় তা নয় ,অনেক হাব্জি গুব্জি ও মনে আসে আবার  অনেক  কথাই হাজার  মনে করার  চেষ্টা করা সত্ত্বেও  মনে পড়েনা  তখনই।  বয়স নিশ্চয়ই  একটা ব্যাপার,  সেটাকে অস্বীকার ও করা যায় না। কিন্তু কোন এক সময় হঠাৎই  তিনি উদয় হন মনের  মধ্যে এবং আবার ও ভুলে যাবার  আগে যদি তাকে শব্দবদ্ধ না করা যায় তাহলে তা চিরতরেই  বিস্মৃতির আড়ালে চলে যেতে পারে।

এইরকমই আমার  কিছু পুরোনো বন্ধুর  কথা মনে পড়ছে যারা আমাকে ছেড়ে দিয়ে পাড়ি জমিয়েছে  না ফেরার দেশে। খুবই অন্তরঙ্গ, আমার খুশীতে তাদের ও খুশী , দুঃখে পিঠে হাত রেখে বলতো," এত ভেঙে পড়ার  কিছু নেই, আমরা তো পাশে আছি; আবার  ফিনিক্স  পাখির মতো উড়ে যাবি  আকাশে আর সঙ্গে সঙ্গে আমরাও  উড়ব  তোর সাথে।" চাকরির সূত্রে একঝাঁক পায়রা এসে হাজির  হলো কলকাতার  বুকে সুদূর দক্ষিণ  দেশ হতে। নক্ষত্রের  সমাবেশ  বলা যেতে পারে। কেউ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  উদীয়মান নক্ষত্র,  কেউ বা বিখ্যাত  লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের ঝলমলে ছাত্রী আবার  কেউ বা অসুস্থতার কারণে স্কুল ফাইনাল  পরীক্ষার  উজ্জ্বলতম ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও  পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অসমর্থ।  কিন্তু আগুন  তো চিরদিন ছাই চাপা পড়ে থাকতে পারেনা, তা কোন না কোন  সময় প্রতিভাত  হবেই। তাদের  কাজের  মাধ্যমেই সেই প্রতিভার বিচ্ছুরণ হতে লাগল যার অবশ্যম্ভাবী প্রতিফলন সেই অফিসের কাজের মধ্যে। তার নাম যশ বাংলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল  দাক্ষিণাত্যে এবং ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের  বিভিন্ন  প্রান্তে। অফিসের  উত্তরণের  সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গতকারীদের ও উত্তরণ  হলো এবং ভারতবর্ষের  বিভিন্ন  প্রান্তে তারা পতাকা বহন করতে লাগল। কিন্তু কর্মসূত্রে গেঁথে ওঠা মালার পুঁতিগুলো  এদিক সেদিক  ছড়িয়ে পড়লেও মনে মনে সর্বক্ষণ ই একটা আশা যে আবার আসিব ফিরে, মিলিব সবার সাথে সেই পুরাতন ঝিলের ধারে। হাসিব, খেলিব  গাহিব সবাই সেই পুরাতন গান।  হয়তো  সবটাই  হয়ে ওঠেনি কিন্তু পুরোন সেই স্মৃতির  রেশ আজও ঝলমলে হয়ে আছে। খোলা আকাশের  নীচে  বসে গান, তর্ক বিতর্ক,  মান অভিমান  সবই মনে পড়ছে, মনে পড়ছে সেই ছুটির দিন সবাই মিলে পুরোন কলকাতা পরিক্রমার  কথা। সবাই মিলে তারামহলে টিফিন  খেতে যাওয়া বা অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে  নাটক  দেখতে যাওয়া বা রবীন্দ্র সদনে স্বনামধন্য  শিল্পীদের  অনুষ্ঠান  শুনতে যাওয়া সবকিছুই  মনে পড়ছে  আর আবার  ভুলে যাবার  আগে তাকে স্মৃতির  মণিকোঠায় সাজিয়ে রাখতে চাই।

সেদিনের তরুণরা আজ প্রায় বৃদ্ধ, অনেকেই  আজ এই সুন্দর  পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে আবার  কেউ কেউ অপেক্ষারত জিনিসপত্র  গোছগাছ করে । ডাক এলেই চলে যাবে। যারা এই মূহুর্তে রয়েছে তারা ব্যস্ত   স্মৃতি রোমন্থনে। কখনও সখনো মিটিং হলে বা পিকনিক  হলে তারা একত্রিত  হয় কিন্তু ঐ আনন্দের  মধ্যেও চোখদুটো খোঁজে  সেই পুরোন বন্ধুদের  আর সবার অলক্ষ্যে রুমাল দিয়ে চোখটা মোছে এবং চশমার  কাচটা পরিষ্কার  করে নেয়। চৌধুরীর  হাতটা ছিল ভারী মিষ্টি। তবলার  বোলগুলো যেন প্রাণ  পেত তার আলতো আঙ্গুলের  টোকায়। স্বভাবটাও ছিল বড় মিষ্টি তার সদাহাস্য  মুখের  মতন। কত ছেলেমেয়েদের  সে উৎসাহ যুগিয়েছে গান  বাজনা করার  জন্য  এবং পরবর্তীকালে তারা যথেষ্ট  ভাল  গান করেছে। সুজিতের ছিল প্রাণখোলা গলা এবং কি শ্যামাসঙ্গীত বা ভক্তিগীতি বা রবীন্দ্র সঙ্গীত বা অতুলপ্রসাদী বা রজনীকান্তের  গান যা কিছুই গাইত  তা একটা আলাদা মাত্রা পেত। মাধবিকা গাইত  প্রধানত নজরুল গীতি এবং পুরোদস্তুর  প্রশিক্ষণের  ছাপ তার গলায় ছিল।  প্রিয়রমা, কণিকা সবাই অফিসের  ফাংশনে রীতিমত অংশ গ্রহণ করতো এবং অনুষ্ঠানকে  প্রাণবন্ত করে তুলত। ম্যানেজমেন্ট বললে জয়ন্তর  কথা সবচেয়ে আগে আসবে। ও ছিল  মেরুদন্ড,  কথা কম কাজ বেশি। তৃপ্তিদার  কথা অবশ্যই  বলতে হবে। হঠাৎই  একটা কাগজ  নিয়ে খসখস করে গান লিখে, তার সুর ও দিয়ে দিত এবং চৌধুরী  ও আমাকে দুই হাতে শক্ত  করে ধরে লাঞ্চরুমে দরজা বন্ধ  করে গান শুনতে বাধ্য  করতো। দরজা বন্ধ করে তার পিছনে চেয়ার টেনে বসে( যাতে আমরা বাইরে পালিয়ে যেতে না পারি) হারমোনিয়ম টেনে নিয়ে স্বরচিত  এবং সুরারোপিত গান আমাদের  শুনতে বাধ্য  করতো। তবলায়  চৌধুরীর হাজার  চেষ্টাও গানকে তালে রাখতে পারত না। একদিকে গলা আর অন্যদিকে  হারমোনিয়মের সুর, সে যে কি ভয়ানক অভিজ্ঞতা তা বলে বোঝানো যায়না। গান শেষ  হলে মতামত  জানতে চাইলে কি যে বলা  উচিত  ভেবে পেতাম  না। অনেক ভেবে চিন্তে একটা জুতসই উত্তর  খুঁজে পেয়েছিলাম  এবং সেটা হলো যে ঠিকই  আছে তবে একটু স্কেলটা  চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে যার চটজলদি  সমাধান ছিল  ও একটা স্কেলচেঞ্জ  হারমোনিয়ম কিনে ফেলবে। আর চৌধুরীর  উত্তর  ছিল, তালটা কেটে যাচ্ছে তো, একটু ডেটল লাগাতে হবে। এহেন  তৃপ্তিদা রবীন্দ্র সদনে অফিসের  অনুষ্ঠানে সোলো  গাইবেই  গাইবে যেখানে গাইবেন শ্রদ্ধেয় সাগর সেন এবং ফিরোজা  বেগম।  ত্রাতা  সেই একজন, সুজিত  ব্যানার্জি। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুজিয়ে কোরাস গানে অংশগ্রহণ  এবং তাকে একেবারে পিছনের  দিকে রাখা যাতে তার গলা মাইক্রোফোনে ধরা না পড়ে। এইসব আনন্দের মুহুর্ত গুলো যদি না বলা হয় তবে সমস্ত প্রচেষ্টাই  একেবারে পানসে  হয়ে যাবে এবং ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে। সবচেয়ে গ্ল্যামারাস ছিলেন আমাদের  অফিসের  প্রধান  শ্যামল ধর। ছিলেন  অমরনাথ  মিত্র মুস্তাফি এবং ব্রেবোর্ন রোড শাখার প্রধান শচীন  দাশগুপ্ত এবং সুব্রত রায়চৌধুরী।  ছিল শিবু ,সুশান্ত, মোহন, তরুণ,  শচী, নির্মল এবং অবনী। ছায়াদির উপস্থিতি ছিল একদম নির্বাক কিন্তু প্রয়োজনীয় যা কিছু করা দরকার  তা উনি নিঃশব্দেই  করতেন।

আজ আমরা অনেককেই হারিয়েছি। স্যার ( শ্যামল ধর), অমরনাথ মিত্র মুস্তাফি,  শচীন  দাশগুপ্ত,  সুব্রত রায়চৌধুরী, মোহন,  শুভ সবাই একে একে চলে গেছেন এবং হৃদয়ে এক একটা মোক্ষম  আঘাত  হেনে গেছেন। বিনয় দা, কান্তি দা, মধু( পাল), বাড়ারি, সবিতা, বিভাস এবং সাহা সর্দার আমাদের  কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। বিদায় নিয়েছে সমীর,পার্থ ও স্বপন, খলিল ও ভগীরথ কিন্তু চৌধুরীর চলে যাওয়া মন থেকে কিছুতেই  মেনে নিতে পারিনি, সেইরকম  মানতে পারিনি অসীম  ধৈর্য্যশীলা সবিতার  চলে যাওয়াকেও। কিন্তু গতবছর উপর্যুপরি  দুই দিনে চৌঠা জুন এবং পাঁচই জুন সুজিত  এবং শঙ্খপাণির প্রয়াণ এক মহা ধাক্কা। দুজনেই  ছিল একাধারে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী।  আজ তাদের  চলে যাওয়া প্রায়  বছর গড়াতে চলল কিন্তু যে রেশ তারা  মনের মাঝে রেখে গেছে  তা ভোলা কঠিন। তাদের  সকলের  প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিবর্ণ স্মৃতিকে  একটু ঝাড়পোঁছ করে চাগিয়ে তোলার অক্ষম  প্রচেষ্টা। 

Sunday, 7 May 2023

জীবন যে রকম

হাসপাতালের  বেডে শুয়ে আছেন তমাল। আত্মীয়স্বজন  যারা এসেছে  তারা আছে শেষের  প্রতীক্ষায় কারণ ডাক্তারবাবু জবাব  দিয়ে দিয়েছেন। তমাল অকৃতদার,  কয়েকজন  ভাগ্নে, ভাগ্নী, ভাইপো ভাইঝি ছাড়া রয়েছে দাদা, বৌদি ও বোন, ভগ্নীপতিরা। যথেষ্ট  উচ্চপদেই  আসীন ছিলেন তমাল  সুতরাং সেবা নিবৃত্ত হবার পর পয়সাকড়ির কোন অভাব ছিলনা তাঁর। একাই থাকতেন  তমাল  কারণ  কোনদিন অন্যের  সংসারে বোঝা হবার  মানসিকতা তার ছিলনা। ভাইবোনদের  সংসার  গড়ে দেওয়ার  পিছনেও ছিল তার যথেষ্ট  অবদান আর এটা করতে করতেই  কখন যে নিজের  বেলা গড়িয়ে গেছে খেয়াল  করতেও  পারেন নি। বাবা তো অনেকদিন  আগেই চলে গেছেন,  মা অনেকবার  বন্ধু বান্ধবদের  বলেছেন  একটা ভাল মেয়ে দেখে দেওয়ার জন্য  কিন্তু কোন কোন সম্বন্ধ  এলেও নানাধরণের বাগড়ায়  তা বিয়ে অবধি আর এগোয় নি। এহেন  পরিস্থিতিতে তমাল  যে সুস্থ  হয়ে ফিরে আসেন  তা কেউ ই চায়না। ডাক্তার  জবাব  দেয়ার পর যেন সবার চোখগুলোই যেন চকচক করে উঠছিল আর মনে মনে সবাই  হিসেব  কষছিল  ভাগে কত আসবে।
কিন্তু ভগবানের  হিসেবটা ছিল যেন  অন্য রকম। সেই স্থির  চোখের  তারাগুলো যেন ঈষৎ নড়ে উঠল। নার্স একটু গভীর ভাবেই লক্ষ্য  করতে থাকলেন এবং তারপর ডাক্তার বাবুকে খুব  চাপা গলায় কিছু বললেন।  ডাক্তার বাবু তৎক্ষণাৎ প্রায় দৌড়ে এসে পরীক্ষা করলেন  এবং নার্সকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ  দিলেন।  ধীরে ধীরে তমালের  জ্ঞান  ফিরে আসতে লাগল  এবং আত্মীয়স্বজনের  মধ্যে ততোধিক  বিরক্তি প্রকাশ  পেতে লাগল  কিন্তু আমরা তো সবাই  এক একজন  নায়ক, নায়িকা , সুতরাং মনের  বিরক্তি মনেই রেখে মুখ হাসি হাসি করে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে এগোল।
তমালের  মা কিছুদিন  আগেই চলে গেছেন।  বেশ ভারিক্কি চালের ভদ্রমহিলা কিন্তু ঠোঁট সামান্য  ফাঁক করেই তাঁর প্রসন্নতা  বা অপ্রসন্নতা বুঝিয়ে দিতেন। রজত  ছিল তমালের  অত্যন্ত  প্রিয় বন্ধু এবং তমালের  মা ও তাকে বিশেষ  স্নেহ করতেন।  রজত ও তমালের  জন্য  কয়েকটা সম্বন্ধ  নিয়ে এসেছিল  কিন্তু তমালকে  ভড়কানোর জন্য  তার ভাইবোনেরা ছিল যথেষ্ট  চতুর। যাই হোক, তমালের  মা ছিলেন  বয়সকালে যথেষ্ট  সুন্দরী এবং তমালের  বাবা বেঁচে থাকাকালীন কপালে একটা বড় সিঁদুরের  টিপ পড়তেন যা তাঁকে একটা আলাদা সৌন্দর্য্য এনে দিত অনেকটাই সারদা মায়ের মতন। সারদা মায়ের  ছবির  দিকে তাকালে যেমন সমস্ত অন্তরটা  জুড়িয়ে যায় ঠিক সেইরকম। রজত ছোটবেলায় তার মাকে হারিয়েছিল এবং তমালের  মায়ের  মধ্যেই  সে যেন  নিজের মাকে খুঁজে পেত। তমালের  মা তো চলে গেছেন  এখন রজত ই তার একমাত্র  অভিন্ন  হৃদয় বন্ধু  যে সত্যি সত্যিই তমালের  চলে যাওয়ার  মূহুর্তে অত্যন্ত  দুঃখী ছিল কারণ  তার  সঙ্গে তো  কোন আর্থিক  লেনদেনের  সম্পর্ক  ছিল না।  ভিজিটিং আওয়ার্স  প্রায় শেষ  হয়ে  আসছে, রজতের এখনও  ভেতরে যাওয়া হয়নি কারণ স্বার্থাণ্বেষীদের  আনাগোনা এখনও  অব্যাহত।  সবাই  দেখা করে এসেছে বুড়োটা এখনও  কি করে যমের  দুয়োর থেকে ফিরে এল, সবার চোখে মুখে অপার বিস্ময়। কিন্তু  এই কদিন  রজত  প্রায় সব সময়ই  তার বন্ধুর জন্য  হাসপাতালে পরে থেকেছে যা ডাক্তার  বা নার্স কারও  চোখ এড়ায় নি। তারাও  তো রক্ত মাংসে গড়া মানুষ,  তারাও  বুঝতে পারে কে ধান্দাবাজ  আর কে নয়। ভিজিটিং  আওয়ার্স  শেষ হয়ে যাবার  পরে সে দেখল তমাল  তখন  অনেকটাই স্বাভাবিক  হয়ে এসেছে। হঠাৎই  মা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস  ছাড়ল  সে আর ভিতরের  জমা কার্বন ডাই অক্সিজেন যেন অনেকটাই  বেরিয়ে এল এবং তার জায়গা নিল অক্সিজেন। 
এই মা শব্দটা এমনই  যে একবার  ডাকলে শরীরে  ও মনে একটা ইলেকট্রিক  চার্জের মতন হয়ে যায় যেমন  হয় ওম শব্দ  উচ্চারণ  করলে বা আল্লা হো আকবর  উচ্চারণ  করলে কারণ  শরীরের  ভেতরের  কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে অক্সিজেনের  প্রবেশ। অনেক সময়ই প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রনা  হলে গভীর ভাবে শ্বাস নিলে এবং ছাড়লে তার উপশম  হয় বা মা বলে এক গভীর শ্বাস ছাড়লেও সেই ফল পাওয়া যায়। কিন্তু মা যদি স্বল্পাবাসে পরিহিত  হন তাঁকে কি সন্তানেরা  মা বলে ততটাই ভক্তি করে? ছোটবেলায় সন্তানেরা  মায়ের  কাজের  প্রতিবাদ  করতে পারেনা কিন্তু যখনই  তারা উপযুক্ত  বয়স প্রাপ্ত হয় তখন  মায়ের প্রতি যে শ্রদ্ধার  আসন সেটা কেমন যেন  টলোমলো  হয়ে যায়।
তমাল  এই যাত্রায়  ফিরে এসেছে এবং  আজ তার হাসপাতাল  থেকে ছুটি হবে। আত্মীয়স্বজন  ভাবছে এবার কার ঘাড়ে পড়বে এই বুড়ো, কেউ হ্যাপা সামলাতে রাজি নয়। সমস্ত ফর্ম্যালিটি  সম্পূর্ণ,  মেডিক্লেমের  থেকে  পয়সাকড়ি যা আসার  ছিল তা এসে গেছে এবং বাড়তি পয়সা মিটিয়ে  দেওয়া হয়ে গেছে। হঠাৎই  তমাল  রজতের  হাত ধরে বলল , " চল তোর বাড়ি। "