পরের পর্যায়টা খুব একটা সুখকর ছিল না তার পক্ষে। অন্য সমবয়সী ছেলেরা যখন পাশ করে চাকরি বাকরিতে ঢুকে গেছে, কারও কারও বিয়েও হয়ে গেছে এবং বাবাও হয়ে গেছে তখনও সে দাঁড়াতে পারেনি নিজের পায়ে। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর এর তার যার যেমন প্রয়োজন সেখানেই সে ছাতা ধরে দাঁড়াচ্ছে। ইতিমধ্যেই তার বাবা চলে গেলেন এবং বিশেষ কিছু না রেখে যাওয়ার জন্য অল্পদিনের মধ্যেই প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। যা কিছু ছিল তা দিয়ে ভজা ও তার মায়ের কোনরকমে দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বসে খেলে রাজার ধনও শেষ হয়ে যায়, এই আপ্তবাক্য তো অস্বীকার করার নয়। কিন্তু পেটে গামছা বেঁধে তো পরোপকার করা যায় না। কিন্তু এর মধ্যেও ভজার হাসিমুখে সবার কাজ করতে কোনরকম দ্বিধা ছিলনা। কিন্তু বেশিরভাগ লোকই নিজের কাজটা হয়ে গেলেই একটু চা জলখাবার খাইয়ে বিদায় দিত। এরই মধ্যে পাড়ায় ভাড়া নিয়ে এলেন সুধীর বাবু। তিনি ছিলেন পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ অফিসার। ভজার এই নিঃস্বার্থ ভাবে সকলের উপকার করা তাঁর চোখ এড়াল না। ঐ সময় তাঁরই ডিপার্টমেন্টে কিছু পিওনের পদ ভর্তি হবে। তিনি ভজাকে একদিন রাস্তায় দেখতে পেয়ে তাকে তাঁর বাড়িতে আসতে বললেন। ভজা ভাবলো যে পাড়ায় আসা নতুন ভদ্রলোকের কোন প্রয়োজন আছে, আর সেকারণেই উনি ডাকছেন। হাসিমুখে সম্মতি জানালো আসার কথা।
সন্ধ্যে বেলায় ভজা খেয়াল রাখছে কখন সুধীর বাবু অফিস থেকে ফেরেন। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে চা জলখাবার খাবার পরে ও যাবে মনস্থ করেছে। সাড়ে সাতটা নাগাদ দরজায় কড়া নাড়ল সে। সুধীর বাবু ওকে দেখেই ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঘরে বসালেন এবং একটু চা করার কথা বললেন। ভজা তো অবাক। এতদিন সবার কাজ করার পর লোকে তাকে চা খাওয়ার কথা বলেছে আর এই ভদ্রলোক কোন কাজ না করিয়েই চা খেতে বলছেন এইটা ভেবেই সে তাঁর সম্বন্ধে একটু উঁচু ধারণাই পোষণ করলো। চা বিস্কুট খাওয়া হলে সুধীর বাবু সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করলেন যে সে কোন কাজ করে কিনা এবং বাড়িতে তার কে কে আছেন। ভজা ঘাবড়ে গেল, হঠাৎই এরকম কথা কেন। যাই হোক জানালো যে সে বেকার এবং বাড়িতে তার মা রয়েছেন।
সংসার চলে কি করে?
মানে বাবা যেটুকু টাকা জমা রেখেছিলেন তাই দিয়ে আর লোকের এটা সেটা করে যদি কেউ কিছু দেন, তাই দিয়ে।
পড়াশোনা কতদূর করেছো?
মানে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছি কিন্তু তার পর আর পড়াশোনার সুযোগ হয়নি।
চাকরি করবে? তোমার যা কোয়ালিফিকেশন, তাতেই হবে। আমাদের অফিসে পিওন নেওয়া হবে, তুমি চাইলে করতে পার। ভেবে আমাকে জানিও।
ভজা তো নিজের চোখ, কান কে বিশ্বাস ই করতে পারছিল না। এতদিন লোকে সবাই তার কাছ থেকে কাজ নিয়েছে এবং পরে কিছু চাইতে পারে ভেবে এড়িয়ে গেছে আর এই ভদ্রলোককে নিশ্চয়ই ভগবান পাঠিয়েছেন। আমাকে কি করতে হবে স্যার? হঠাৎই স্যার শব্দ টা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি কাল একটা ফর্ম এনে দেব, তুমি তোমার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার মার্কশিট ও সার্টিফিকেট আমার কাছে এনে দিও আর দুজন ভদ্রলোকের কাছ থেকে ক্যারাক্টার সার্টিফিকেট আনতে হবে।
ঠিক আছে স্যার। আমি এখন আসি।
মুহুর্তের মধ্যেই একটা দারুণ আনন্দ তাকে গ্রাস করল। বাড়িতে গিয়ে মাকে বলল, " মা, এতদিন পর ভগবান আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। " এরপর সব ঘটনা মায়ের কাছে খুলে বলল। মা দুর্গা দুর্গা বলে কপালে হাতজোড় করে প্রণাম করলেন এবং তারপর ভজার বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাঁধভাঙা চোখের জল গাল বেয়ে নামতে থাকল। এরপর চলল সে তার প্রিয় বন্ধু নন্তুর বাড়ি সবকিছু খুলে বলতে। নন্তু যদিও চাকরি করত কিন্তু তবুও ভজার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল ভীষণ গভীর কারণ ভজা ছিল সবার সুহৃদ। পড়াশোনায় একটু কমতি হলেও মনটা ছিল বিশাল।
যাই হোক, সুধীর বাবুর কল্যাণে সে পোস্টম্যানের চাকরি করতে লাগল। খুব খুশী সে, হৃদয়টা হয়েছে আরও বড়। কিন্তু এরই মাঝে সে বিএ পাশ করে ফেলেছে, তাও সুধীর বাবুর উৎসাহে। হয়েছে প্রমোশন এবং যথারীতি বদলি। অবশ্য বেশি দূরে নয়, পাশের শহরেই, মাত্র পনের কিলোমিটার দূরত্বে। ভজার মা দেহরাখার আগে ছেলের বিয়ে দিতে পেরেছেন এবং ছোট ছোট দুই নাতি নাতনিকে দেখে ও যেতে পেরেছেন।
ভজা রিটায়ার করলেন। ছেলেমেয়েদের সাধ্যমত ভাল স্কুলে পড়িয়েছেন এবং প্রাণপাত করে মাস্টার মশাইদের কাছে প্রাইভেট পড়িয়েছেন এবং তারা ও জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের পথে। মেয়ের বিয়ের পরে এবং ছেলেও চাকরির সূত্রে বাইরে থাকায় বাড়িতে কেবল বৃদ্ধ ভজা ও তার স্ত্রী। কাজ এখন অনেক কম। স্বামী , স্ত্রী দুজনেই মোবাইল ফোনে ব্যস্ত, মাঝে মধ্যে একটু কথা বার্তা। ভজা হঠাৎই স্বগতোক্তি করল, " আমি হরকরাই থেকে গেলাম গো। আগে বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করতাম আর এখন সকাল থেকেই একজনের পাঠানো ভাল মেসেজ অন্যদের কাছে পাঠিয়ে দিই। এটাও কি হরকরার কাজ নয়?"