কিন্তু ভগবানের হিসেবটা ছিল যেন অন্য রকম। সেই স্থির চোখের তারাগুলো যেন ঈষৎ নড়ে উঠল। নার্স একটু গভীর ভাবেই লক্ষ্য করতে থাকলেন এবং তারপর ডাক্তার বাবুকে খুব চাপা গলায় কিছু বললেন। ডাক্তার বাবু তৎক্ষণাৎ প্রায় দৌড়ে এসে পরীক্ষা করলেন এবং নার্সকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। ধীরে ধীরে তমালের জ্ঞান ফিরে আসতে লাগল এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ততোধিক বিরক্তি প্রকাশ পেতে লাগল কিন্তু আমরা তো সবাই এক একজন নায়ক, নায়িকা , সুতরাং মনের বিরক্তি মনেই রেখে মুখ হাসি হাসি করে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে এগোল।
তমালের মা কিছুদিন আগেই চলে গেছেন। বেশ ভারিক্কি চালের ভদ্রমহিলা কিন্তু ঠোঁট সামান্য ফাঁক করেই তাঁর প্রসন্নতা বা অপ্রসন্নতা বুঝিয়ে দিতেন। রজত ছিল তমালের অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু এবং তমালের মা ও তাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। রজত ও তমালের জন্য কয়েকটা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল কিন্তু তমালকে ভড়কানোর জন্য তার ভাইবোনেরা ছিল যথেষ্ট চতুর। যাই হোক, তমালের মা ছিলেন বয়সকালে যথেষ্ট সুন্দরী এবং তমালের বাবা বেঁচে থাকাকালীন কপালে একটা বড় সিঁদুরের টিপ পড়তেন যা তাঁকে একটা আলাদা সৌন্দর্য্য এনে দিত অনেকটাই সারদা মায়ের মতন। সারদা মায়ের ছবির দিকে তাকালে যেমন সমস্ত অন্তরটা জুড়িয়ে যায় ঠিক সেইরকম। রজত ছোটবেলায় তার মাকে হারিয়েছিল এবং তমালের মায়ের মধ্যেই সে যেন নিজের মাকে খুঁজে পেত। তমালের মা তো চলে গেছেন এখন রজত ই তার একমাত্র অভিন্ন হৃদয় বন্ধু যে সত্যি সত্যিই তমালের চলে যাওয়ার মূহুর্তে অত্যন্ত দুঃখী ছিল কারণ তার সঙ্গে তো কোন আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক ছিল না। ভিজিটিং আওয়ার্স প্রায় শেষ হয়ে আসছে, রজতের এখনও ভেতরে যাওয়া হয়নি কারণ স্বার্থাণ্বেষীদের আনাগোনা এখনও অব্যাহত। সবাই দেখা করে এসেছে বুড়োটা এখনও কি করে যমের দুয়োর থেকে ফিরে এল, সবার চোখে মুখে অপার বিস্ময়। কিন্তু এই কদিন রজত প্রায় সব সময়ই তার বন্ধুর জন্য হাসপাতালে পরে থেকেছে যা ডাক্তার বা নার্স কারও চোখ এড়ায় নি। তারাও তো রক্ত মাংসে গড়া মানুষ, তারাও বুঝতে পারে কে ধান্দাবাজ আর কে নয়। ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে যাবার পরে সে দেখল তমাল তখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। হঠাৎই মা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে আর ভিতরের জমা কার্বন ডাই অক্সিজেন যেন অনেকটাই বেরিয়ে এল এবং তার জায়গা নিল অক্সিজেন।
এই মা শব্দটা এমনই যে একবার ডাকলে শরীরে ও মনে একটা ইলেকট্রিক চার্জের মতন হয়ে যায় যেমন হয় ওম শব্দ উচ্চারণ করলে বা আল্লা হো আকবর উচ্চারণ করলে কারণ শরীরের ভেতরের কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে অক্সিজেনের প্রবেশ। অনেক সময়ই প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রনা হলে গভীর ভাবে শ্বাস নিলে এবং ছাড়লে তার উপশম হয় বা মা বলে এক গভীর শ্বাস ছাড়লেও সেই ফল পাওয়া যায়। কিন্তু মা যদি স্বল্পাবাসে পরিহিত হন তাঁকে কি সন্তানেরা মা বলে ততটাই ভক্তি করে? ছোটবেলায় সন্তানেরা মায়ের কাজের প্রতিবাদ করতে পারেনা কিন্তু যখনই তারা উপযুক্ত বয়স প্রাপ্ত হয় তখন মায়ের প্রতি যে শ্রদ্ধার আসন সেটা কেমন যেন টলোমলো হয়ে যায়।
তমাল এই যাত্রায় ফিরে এসেছে এবং আজ তার হাসপাতাল থেকে ছুটি হবে। আত্মীয়স্বজন ভাবছে এবার কার ঘাড়ে পড়বে এই বুড়ো, কেউ হ্যাপা সামলাতে রাজি নয়। সমস্ত ফর্ম্যালিটি সম্পূর্ণ, মেডিক্লেমের থেকে পয়সাকড়ি যা আসার ছিল তা এসে গেছে এবং বাড়তি পয়সা মিটিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। হঠাৎই তমাল রজতের হাত ধরে বলল , " চল তোর বাড়ি। "
No comments:
Post a Comment