চুল, দাড়ি, গোঁফের অগ্রজ হচ্ছে চুল। জন্মের সাথে সাথেই তিনি সঙ্গের সাথি এবং দাড়ি বা গোঁফ তার তুলনায় বয়সে অনেক ছোট । একটা বয়সের পর তারা ধীরে ধীরে আসেন। এদের প্রকারভেদ মানুষের চেহারাই পাল্টে দেয়। চাঁচরকেশী তো আজকাল চোখে খুব কম পড়ে আমাদের দেশে কিন্তু আফ্রিকার লোকজনের মধ্যে এর আধিক্য। সেইরকম মেয়েদের মধ্যেও ঢেউ খেলানো চুল খুব কমই চোখে পড়ে। যাদের থাকে তারাও সেলুনে গিয়ে তাকে নানা পদ্ধতিতে পকেট থেকে বেশ ভাল পয়সা খরচ করে সোজা করে আসে। স্বাভাবিক চুলের সৌন্দর্য্যটাই গায়েব। তা কি আর করা যাবে। চুল তোমার, পয়সা তোমার, চাহিদাও তোমার। অতএব হাওয়া উঠলে হাওয়াতেই গা ভাসিয়ে দাও। আমাদের আদিবাসীদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিকষ কালো কষ্টিপাথরের চেহারার মধ্যে উজ্জ্বল দুটো চোখ আর শ্বেতশুভ্র দাঁত লেপাঝোপা নাকের খামতিকে ছাপিয়ে চোখ টানে। অদ্ভূত এক সরলতা তাদের ট্রেডমার্ক। কিন্তু শহর কলকাতায় তো সেই সৌন্দর্য তো চোখে পড়েনা। নানাধরণের লোকজন লাউঞ্জে বসে আছে, আর আমার চোখ পরিক্রমা করে চলেছে এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। কারও টাক( টাকেরও প্রকারভেদ) আবার কারও সাদা চুলের মাথা তাঁদের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করছে আবার কারও চুলে কলপ করে বয়সটাকে প্রাণপণে ধরে রাখার চেষ্টা আবার কারও মাথায় রঙবেরঙের পাখি যেন বাসা বেঁধেছে। মেয়েদের মধ্যে বেশিরভাগের ই চুল ঘাড়ের কাছেই শেষ হয়েছে ,একটা ক্লিপ কিংবা গার্ডার দিয়ে অনুশাসিত, এদিক ওদিক হবার যো নেই। হাঁটু ছাড়িয়ে লম্বা চুলের গোছা খুঁজতে গেলে বোধহয় গ্লোবট্রটার হতে হবে অথচ কিছুদিন আগেও অনেক মেয়েরাই এই অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারিনী ছিলেন। আজকাল মেয়েদের বাইরে বেরোতে হয়, কেশবিন্যাসের সময় কোথায়? আগে মা বা কাকিমারা চুল যত্ন করে বেঁধে দিতেন, সুতরাং সেটা সম্ভব হতো কিন্তু আজকের দিনে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সেটা আকাশ কুসুম। মাকে ও বেরোতে হচ্ছে, মেয়েকেও বেরোতে হচ্ছে, অতএব বিদায় কর লম্বা চুলকে। বিউটি পার্লারে গিয়ে ছেঁটে এস। নিজেকে ঐ লম্বা চুলের কসরত করতে গেলে বালিশের উপর চুল বিছিয়ে জট ছাড়াতে হতো, তারপর তো খোঁপা বাঁধা। সময়ের সাশ্রয় করতে চল বিউটি পার্লার। তবু আজকের দিনেও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে মেয়েদের এইধরণের কবরীবিন্যাস দেখা যায়। যাই হোক ফিরে আসা যাক অ্যাপোলো হাসপাতালের লাউঞ্জে।
দাড়ি গোঁফ তো একচেটিয়া পুরুষদের অধিকার। চাপ দাড়িওয়ালা বাঙালির খোঁজ পাওয়া কঠিন কারণ পেটরোগা গ্যাস অম্বলে ভোগা খিঞ্জিবি শরীরে একদমই বেমানান যেটা পাঞ্জাবিদের মধ্যে একচেটিয়া। লম্বা চওড়া শরীরে ওটা মানায়। আমাদের বাঙালিদের মধ্যেও যাঁরা ঐ ধরনের চেহারার অধিকারী তাঁরাও কেউ ঐরকম বীরত্ব ব্যাঞ্জক দাড়ি রাখেন না, রাখেন তাঁরা ইন্টেলেকচুয়াল ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি যেখানে গোঁফ এবং দাড়ি ঠোঁটকে ঘিরে রেখে তাঁদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। হাসলেও দাড়ি গোঁফের বৃত্তও মাত্রা ছাড়ায় না। কারও গোঁফ বাঙলার বাঘ স্যার আশুতোষের মত ঝোলানো আবার কারও সরু গোঁফ শেষ হবার মুখে একটু ঊর্ধগামী, কেমন যেন একটু ঔদ্ধত্যপূর্ণ। কারও গোঁফ আবার সরু কিন্তু কথাই বলুক আর না ই বলুক যেন মনে হয় সদাই হাসছে। চওড়া গালপাট্টা গোঁফ জুলফির সঙ্গে মিশে দীর্ঘদেহী চেহারাকে আরও পরাক্রান্ত করে তুলেছে সেইরকম গোঁফ আমাদের বাংলায় বিরল। জয়পুরে বন্ধুর ছেলের বিয়েতে গিয়ে এইরকম এক বীরপুরুষের দেখা পেয়েছিলাম। প্রায় সাতফুট লম্বা চেহারার সঙ্গে মানানসই গোঁফ দেখা একটা আলাদা অভিজ্ঞতা। বাঙালিসুলভ বা বাংলায় থাকা অন্য প্রদেশের লোকজন যাঁরা প্রায় বাঙালি হয়ে গেছেন তাঁদেরও দেখলাম বাঙালি ধাঁচের ই গোঁফদাড়ি। ইতিমধ্যেই ডাক পড়ে গেল আমার, প্রেসক্রিপসনের ফাইল নিয়ে বড় ডাক্তারবাবুর চেম্বারে ঢুকে পড়ায় আর চুল, দাড়ি গোঁফের বিচার করা গেলনা কিন্তু নয় নয় করে ঘন্টা পাঁচেক সময় যে কি করে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।