Thursday, 25 July 2024

চুল, দাড়ি ও গোঁফ

নাম যদিও  আলাদা কিন্তু গোত্র সব এক। অ্যাপোলো হাসপাতালে ডাক্তার বাবুর অপেক্ষায় বসে থাকতে হচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা কারণ তিনি যথেষ্টই ওজনদার  এবং তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে বেশ কালঘাম ছুটে যায়। অবশ্য সমস্ত নামী ডাক্তারদের জন্যই এই অপেক্ষা করতেই হয় কারণ তাঁরা শুধু ভাল ছাত্র ই নন, বহু পরিশ্রম করে তাঁদের ঐ জায়গায় পৌঁছতে হয়েছে। সুতরাং তাঁদের দেখাতে গেলে তো এইটুকু কষ্ট করতেই হবে। কিন্তু সময় তো কাটতেই চায় না। সুতরাং নেই কাজ তো খই ভাজ, লোকজনের চুল, দাড়ি, গোঁফের দিকে নজর পড়ল। সঙ্গে কেউ থাকলে গল্পগুজব করে সময়টা কাটানো যেত।

চুল, দাড়ি, গোঁফের অগ্রজ হচ্ছে চুল। জন্মের সাথে সাথেই তিনি  সঙ্গের সাথি এবং দাড়ি বা গোঁফ তার তুলনায় বয়সে অনেক ছোট । একটা বয়সের পর তারা ধীরে ধীরে আসেন। এদের  প্রকারভেদ মানুষের চেহারাই পাল্টে দেয়। চাঁচরকেশী তো আজকাল  চোখে খুব কম পড়ে আমাদের দেশে কিন্তু আফ্রিকার লোকজনের মধ্যে এর আধিক্য। সেইরকম মেয়েদের মধ্যেও ঢেউ খেলানো চুল খুব কমই  চোখে পড়ে। যাদের  থাকে তারাও সেলুনে গিয়ে তাকে নানা পদ্ধতিতে পকেট থেকে বেশ ভাল পয়সা খরচ করে সোজা করে আসে। স্বাভাবিক চুলের  সৌন্দর্য্যটাই গায়েব।  তা কি আর করা যাবে। চুল তোমার,  পয়সা তোমার, চাহিদাও তোমার।  অতএব হাওয়া উঠলে হাওয়াতেই গা ভাসিয়ে দাও। আমাদের  আদিবাসীদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিকষ কালো কষ্টিপাথরের চেহারার মধ্যে উজ্জ্বল দুটো চোখ আর শ্বেতশুভ্র দাঁত লেপাঝোপা নাকের খামতিকে ছাপিয়ে চোখ টানে। অদ্ভূত এক সরলতা তাদের  ট্রেডমার্ক। কিন্তু শহর কলকাতায় তো সেই সৌন্দর্য তো চোখে পড়েনা। নানাধরণের লোকজন লাউঞ্জে  বসে আছে, আর আমার চোখ পরিক্রমা করে চলেছে এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। কারও টাক( টাকেরও প্রকারভেদ) আবার কারও সাদা চুলের মাথা তাঁদের  ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করছে আবার কারও চুলে কলপ করে বয়সটাকে প্রাণপণে ধরে রাখার  চেষ্টা আবার  কারও মাথায় রঙবেরঙের পাখি যেন বাসা বেঁধেছে। মেয়েদের মধ্যে বেশিরভাগের ই চুল ঘাড়ের কাছেই শেষ  হয়েছে ,একটা ক্লিপ কিংবা গার্ডার দিয়ে অনুশাসিত,  এদিক ওদিক  হবার  যো নেই। হাঁটু ছাড়িয়ে লম্বা চুলের  গোছা খুঁজতে গেলে বোধহয়  গ্লোবট্রটার হতে হবে অথচ কিছুদিন  আগেও অনেক মেয়েরাই এই অপরূপ  সৌন্দর্য্যের অধিকারিনী ছিলেন।  আজকাল মেয়েদের বাইরে বেরোতে  হয়, কেশবিন্যাসের  সময় কোথায়? আগে মা বা কাকিমারা চুল যত্ন করে বেঁধে দিতেন,  সুতরাং সেটা সম্ভব হতো কিন্তু আজকের দিনে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সেটা আকাশ কুসুম।  মাকে ও বেরোতে হচ্ছে, মেয়েকেও  বেরোতে হচ্ছে, অতএব বিদায় কর লম্বা চুলকে। বিউটি পার্লারে গিয়ে ছেঁটে এস। নিজেকে ঐ লম্বা চুলের কসরত করতে গেলে বালিশের  উপর চুল বিছিয়ে জট ছাড়াতে  হতো, তারপর তো খোঁপা বাঁধা। সময়ের সাশ্রয় করতে চল বিউটি পার্লার। তবু আজকের  দিনেও  দক্ষিণ ভারতের  রাজ্যগুলিতে মেয়েদের এইধরণের কবরীবিন্যাস দেখা যায়। যাই হোক ফিরে আসা যাক অ্যাপোলো হাসপাতালের লাউঞ্জে।

দাড়ি গোঁফ তো একচেটিয়া পুরুষদের অধিকার।  চাপ দাড়িওয়ালা বাঙালির খোঁজ  পাওয়া কঠিন  কারণ পেটরোগা গ্যাস অম্বলে ভোগা  খিঞ্জিবি শরীরে  একদমই  বেমানান যেটা পাঞ্জাবিদের মধ্যে একচেটিয়া।  লম্বা চওড়া শরীরে ওটা মানায়। আমাদের  বাঙালিদের মধ্যেও  যাঁরা ঐ ধরনের চেহারার অধিকারী তাঁরাও  কেউ ঐরকম  বীরত্ব ব্যাঞ্জক দাড়ি রাখেন না, রাখেন তাঁরা ইন্টেলেকচুয়াল  ফ্রেঞ্চকাট  দাড়ি যেখানে গোঁফ এবং দাড়ি ঠোঁটকে ঘিরে রেখে তাঁদের  ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। হাসলেও দাড়ি গোঁফের বৃত্তও  মাত্রা ছাড়ায় না। কারও  গোঁফ বাঙলার বাঘ স্যার আশুতোষের মত ঝোলানো আবার কারও সরু গোঁফ শেষ হবার মুখে একটু ঊর্ধগামী, কেমন যেন  একটু ঔদ্ধত্যপূর্ণ।  কারও গোঁফ  আবার সরু কিন্তু কথাই  বলুক আর না ই বলুক যেন মনে হয় সদাই হাসছে। চওড়া গালপাট্টা গোঁফ জুলফির সঙ্গে মিশে দীর্ঘদেহী চেহারাকে আরও পরাক্রান্ত করে তুলেছে সেইরকম  গোঁফ  আমাদের  বাংলায় বিরল। জয়পুরে বন্ধুর  ছেলের  বিয়েতে গিয়ে এইরকম এক বীরপুরুষের দেখা পেয়েছিলাম।  প্রায় সাতফুট লম্বা চেহারার সঙ্গে মানানসই গোঁফ দেখা একটা আলাদা অভিজ্ঞতা। বাঙালিসুলভ বা বাংলায় থাকা অন্য প্রদেশের লোকজন যাঁরা প্রায় বাঙালি হয়ে  গেছেন তাঁদেরও দেখলাম  বাঙালি ধাঁচের ই গোঁফদাড়ি। ইতিমধ্যেই  ডাক পড়ে গেল আমার,  প্রেসক্রিপসনের ফাইল নিয়ে বড় ডাক্তারবাবুর চেম্বারে ঢুকে পড়ায় আর চুল, দাড়ি গোঁফের বিচার  করা গেলনা কিন্তু নয় নয় করে ঘন্টা পাঁচেক সময় যে কি করে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।


Wednesday, 17 July 2024

হরি সতীনের গপ্পো

গরুর গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে ঘটা স্টেশনে। ট্রেনটা আসতে বেশ দেরী করছে। মাস্টারমশাইকে এসে বারবার জিজ্ঞেস করছে ঘটা, বাবু আর কত  দেরী আছে গো?  স্টেশনটা খুব বড় নয়,  আসা যাওয়ার পথে গুটিকতক মানুষ  ওঠে নামে। কিন্তু অনেক মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেন  থামে এখানে রাধাকান্ত বাবুর দৌলতে। রাধাকান্ত বাবু ছিলেন স্টেশন থেকে  চার ক্রোশ দূরে সায়র গ্রামের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার এবং তাঁর কথায় বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেত। স্বাধীনতার পরে তিনি মন্ত্রীও হয়েছিলেন । তবে দেশ পরাধীন থাকলেও তিনি সাহেবদের যথেষ্ট  আনুকূল্য পেয়েছেন এবং স্বাধীনোত্তর যুগে কংগ্রেস পার্টির। সুতরাং,  তাঁদের কোন রকম অসুবিধা যাতে না হয়ে সেটা সব সরকার ই দেখেছেন। রাধাকান্ত বাবু বহুদিন হলো দেহরক্ষা করেছেন কিন্তু  বাড়ির কাছাকাছি  স্টেশনের সুযোগ  উত্তরসূরী এবং  আশেপাশের গ্রামের লোক ভোগ করছেন।

আজ গ্রামের বাড়িতে আসছেন রাধাকান্ত বাবুর নাতি  সতীকান্ত বাবু। গরুর গাড়িটা বেশ সুদৃশ্য। ছইটা বেশ  সুন্দর, বলদগুলোও বেশ তাগড়া, বাবুর যাতে কোনও রকম কষ্ট না হয় তার জন্য  বলদগুলোকে মাঝে মাঝেই  চারা খেতে দিচ্ছে  ঘটা আর মাস্টারমশাইকে ট্রেনের খবর জিজ্ঞেস  করছে। দূর থেকে  ট্রেনের হুইসল  শোনা গেল , ঘটাও ব্যস্ত হয়ে উঠল গাড়ি সাজাতে। ছয়জন সাগরেদ নিয়ে এসেছে,  চারজনের মাথায় ইয়া  বড় পাগড়ি,  হাতে তেলচুকচুকে লাঠি  আর একটা লন্ঠন গাড়ির নীচে ঝোলানো  আর দুজন সেরকম  কিছু  না হলেও হাতে আছে লাঠি এবং  লন্ঠন। ট্রেন  এসে থামতেই সতীকান্ত বাবু ও সহধর্মীনি  হরিপ্রিয়া নামলেন। ঢুকুস ঢুকুস করে গড় হয়ে পেন্নামের পালা শেষ হলো। মাস্টারমশাই ও এসেহাতজোড়  করে নমস্কার করলেন  এবং  কুশল বিনিময়  সেরে এগোতে থাকলেন। মাস্টারমশাই বললেন একটু ওয়েটিং রুমে বসতে এবং একজনকে ইশারা করে কিছু  বলতেই সে স্টেশন সংলগ্ন টালির চালার পানুর দোকান থেকে এক ঝুড়ি সন্দেশ নিয়ে এল। ঘটা এবং  তার সাগরেদরা মালপত্র নিয়ে গাড়িতে সাজাতে থাকল আর সতীকান্ত বাবু  এবং  হরিপ্রিয়া  মাস্টারমশায়ের সনির্বন্ধ অনুরোধ  উপেক্ষা  করতে না পেরে সন্দেশ মুখে  দিলেন এবং টিউব ওয়েলের ঠাণ্ডা জলে গলাটা ভিজিয়ে নিলেন। সন্দেশের ঝুড়ি উঠল গরুর গাড়িতে। তা, এবার কতদিন থাকছেন গ্রামে, জিজ্ঞেস করলেন  মাস্টারমশাই । 
সতীকান্ত বাবু বললেন  এবার  কিছুদিন  থাকব আর পারলে একদিন  পরিবারকে নিয়ে আসুন। ট্রেন এবার  সিগন্যাল পেয়ে হুইসল দিয়ে ছাড়ল আর ট্রেনের  সমস্ত লোক  চোখ বড় বড় করে দেখল কাণ্ডকারখানা । হরিপ্রিয়া প্রথমে এবং  পরে সতীকান্ত বাবু উঠে আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে বসলেন এবং  বলদ জোতা হলো গাড়িতে।  সন্ধে হয়ে আসছে দেখে আগেই  লন্ঠন জ্বালিয়ে  নেওয়া হয়েছে আর দুজন লন্ঠন হাতে ফুরর করে বাঁশি বাজিয়ে চলতে শুরু  করল। লাঠি হাতে  আগে পিছে দুজন করে এগোতে  থাকল। আকাশটা আস্তে আস্তে  কালো হয়ে আসছে,  মাঠের মাঝে নেমে আসা সন্ধের  এক অপরূপ দৃশ্য। বলদগুলো চলছে দ্রুত পায়ে, ঘটারা তার সঙ্গে তাল মেলাতে  হিমশিম খাচ্ছে। প্রায়  ছুটছে তারা কারণ অনেকটা রাস্তা যেতে হবে এবং  বাড়ি পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যাবে।  হলোও তাই। রাত্রি প্রায় সাড়ে নটা। এই সময়  সমস্ত গ্রাম ঘুমিয়ে  পড়ে কিন্তু আজ জমিদার বাবুরা আসছেন মুখ দেখাতেই হবে নাহলে আর আনুগত্য কোথায়? বারবার  চোখ কচলাচ্ছে তারা, এই এসে পড়ল বলে । অবশেষে বাঁশির আওয়াজে সারা গ্রামের অন্ধকার ভেদ করে গ্রামবাসী যারা বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল তারা সবাই হৈ হৈ করে ফিরে এল, জমিদার বাড়ির সব আলো জ্বলে উঠল,ফুটেউঠল আলোর রোশনাই । 
সমস্ত গ্রামবাসীরা এসেছে, হরি সতীরা নামতেই পেন্নামের ঢল, তারপর নিজের নিজের  বাড়ি ফিরে যাওয়া। খাস যারা, তারা জমিদার বাড়িতেই থেকে গেল,  হাজার হলেও নিরাপত্তার  দিকটা তো  ভাবতে হবে । পরের দিন সকাল থেকেই সারা গ্রামে তোলপাড়।  যে পুকুরের মাছ মিষ্টি স্বাদের সেইখানে জাল ফেলা হচ্ছে  , যেখানে যা ভাল জিনিস  পাওয়া যায় তা মজুদ করা হচ্ছে  কারণ বাবুরা কতদিন  থাকবেন  তা কেউ জানেনা। হরিপ্রিয়া কিন্তু সব ব্যাপারেই নাক উঁচু করে রেখেছে  যেটা সতীকান্ত মোটেই পছন্দ করছেন না কারণ তিনি গ্রামের লোকদের  নাড়িনক্ষত্র সব জানেন । এরা একবার  যদি বিগড়ে যায়  তাহলে এখানে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে যাবে । তিনি যত ই শান্ত করার  চেষ্টা করেন ততটাই অসহিষ্ণুতা  ফুটে ওঠে তাঁর ব্যবহারে। এরপর তো শুরু হলো হিন্দুস্থান পাকিস্তানের মতো আচরণ। ইনি যা বলেন উনি তার বিপরীত । শেষমেশ স্থির হলো যে হরিপ্রিয়া ফিরে যাবেন এবং গ্রামে আর এক মূহুর্ত ও থাকবেন না কিন্তু সতীকান্ত কে থাকতেই হবে কারণ গ্রামের সম্পত্তিকে  একটু ছোট না করলে দেখাশোনার অভাবে সব বেদখল হয়ে যাবে । যথাসময়ে গিন্নী মা হরিপ্রিয়া ফিরে গেলেন  আর সতীকান্ত বাবুর  মন টিকছে না অথচ চলে গেলে সব পরিশ্রম বৃথা চলে যাবে । যাই হোক  মানিয়ে নিতেই হবে । সমস্ত কাজ সমাধা না হওয়া  পর্যন্ত এই অবস্থাই মেনে নিতে  হবে। 
প্রত্যেক  সংসারে ই এই  এক ই অবস্থা। যতক্ষণ  দুজন পাশাপাশি রয়েছে ততক্ষণ ই হিন্দুস্থান পাকিস্তানের সম্পর্ক অথচ একটু দূরে গেলেই অনুপস্থিতিটা প্রকট হয়। হরি সতীনরা  চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ।

Wednesday, 3 July 2024

পক্ষীরাজ ঘোড়া

শৈশবে বড়মার কাছে গল্প শুনতাম নানা ধরণের গল্প। বড়মার গল্প বলার ভঙ্গীটা ছিল ভীষণ সুন্দর। গল্প বলার মধ্য দিয়েই  নিয়ে যেতেন সেই কল্পলোকে । চোখ দুটো বড় বড় করে শুনতাম আমি আর ছোড়দি। বড়মা ছিলেন সদরপুর রাজবাড়ীর মেয়ে। তখনকার দিনে স্কুল কলেজে না গেলেও বাড়িতে মাস্টারমশাই আসতেন এবং  বাড়ির মেয়েদের শিক্ষা দিতেন এবং এইভাবেই হয়তো সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকতেন। সেই মুখে শোনা পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্র যেতেন দূরদূরান্তের গহন বনে থাকা রাক্ষস বা ডাইনির কাছে বন্দী রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে। ঘোর যুদ্ধে অবশ্যই জয়ী রাজকুমার রাজকন্যাকে উদ্ধার করে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে ফিরতেন নিজের রাজ্যে এবং  তারপর মহাসমারোহে তাদের বিয়ে হয়ে যেত। এই গল্পটাই বড়মার কাছে বারবার শুনতে চাইতাম আর ছোড়দির চাহিদা ছিল অন্য গল্পের । এ নিয়ে মাঝে মধ্যেই  খিটিমিটি লেগে যেত আমাদের মধ্যে কিন্তু বড়মা ঠিক বুঝিয়ে সুঝিয়ে দুজনকেই নিরস্ত করতেন। মাঝেমাঝেই গল্প শোনার মধ্যে জিজ্ঞেস করতাম এই পক্ষীরাজ ঘোড়া কি এবং আমরা এখন তাকে দেখতে পাইনা কেন? বড়মা বলতেন যে বহুদিন আগে গ্রীস দেশে পার্সিউস বলে একজন পরম শক্তিশালী রাজা ছিলেন এবং  তিনি মেডুসাকে গলা কেটে হত্যা করেন । ঐসময় মেডুসা ছিল সন্তান সম্ভবা। পসাইডন ছিল তার স্বামী । আরও  বলেছিলেন যে মেডুসার চোখ  যার দিকে পড়বে, সে  পাথর হয়ে যাবে। একটা হেলমেট পড়ে পার্সিউস ঘুমন্ত অবস্থায় মেডুসার গলা কেটে  দেয় এবং  তার মাথাটা একটা থলির মধ্যে ভরে নেয়। গলা কাটার সময়  ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে এবং  জন্ম হয় দুধ সাদা পক্ষীরাজ ঘোড়া  বা পেগাসাসের যার ছিল দুটো ডানা এবং  সে উড়তে পারত প্রচণ্ড বেগে। এরপর পার্সিউস উদ্ধার করে  রাজকুমারী অ্যান্ড্রোমিডাকে এবং  তাকে সঙ্গে নিয়ে আসে।

স্বপ্নালু চোখে সামনে দেখতাম দুধ সাদা পক্ষীরাজ ঘোড়া তার ডানা ঝটপটিয়ে আহ্বান করছে তার পিঠে চড়ার জন্য আর আমিও যখন ই সাড়া দিয়েছি, মায়ের হাতের চাপড় একটু জোরালো ভাবেই পড়েছে আর একটু ভারী গলায় আওয়াজ ঘুমিয়ে পড় শুনেছি । কখনোই  সেই স্বপ্ন সাকার হয়নি এবং আমারও  রাজপুত্র হয়ে ওঠা হয়নি,  রাজকন্যা উদ্ধার তো দূরস্থান । 
কিন্তু একটা কথা ঠিক যে মনে মনে কোন  বাসনা যদি থাকে তাহলে ভগবান কোন না কোন ভাবে সেই মনস্কামনা পূর্ণ করেন । আমারও ভাগ্যে সেই শিকে ছিঁড়ল।আমাদের  পঞ্চপাণ্ডবের জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের বাড়িতে অসুখ বিসুখ,  অর্জুন ও নকুল পাড়ি দিয়েছে সুদূর আমেরিকায়। রয়েছে কেবল ভীম ও সহদেব। ভাইজাগে থাকাকালীন পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে একটা জমাটে বাঙালি সমাজ গড়ে উঠেছিল এবং  এখনও  তা অক্ষুণ্ন । ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও অটুট রয়েছে তাদের  স্মৃতি এবং কোন অনুষ্ঠানে হয় সকলের দেখা সাক্ষাত আর রোমন্থন হয় পুরনো দিনের  স্মৃতি। এইরকম ই আমাদের  চোখের সামনে জন্ম নেওয়া একটা ছোট্ট মেয়ের বিয়ে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে  এক শহরতলীতে।বহুদিন আগে থাকা পঞ্চপাণ্ডবরা যৌবনকে ফেলে  এসে হয়েছেন প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ এবং কালের গতিতে সেই ছোট্ট শিশুকন্যা আজ যুবতী এবং  তারই বিয়ে । ভীমের কাছে থাকা এক পক্ষীরাজ ঘোড়া ই আজ ভীম, বলধরা ও সহদেব এবং বিজয়ার বাহন এবং  অবশ্যই সারথী সঞ্জয় । এই পক্ষীরাজের আছে চারটে পাখা এবং  পেটের তলায় ও রয়েছে  আরও একটি। বিকেল পাঁচটা নাগাদ রওনা দেবার  মুখেই একটা  পাখা একটু  দুর্বল মনে হতেই পেটের কাছে থাকা পাখনা লাগানো হলো। মিনিট কুড়ি হলো দেরী কিন্তু সঞ্জয়ের পরিচালনায়  পক্ষীরাজ  তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে, পিছনে পড়ে রয়েছে আরও  অনেক আধুনিক ও উন্নতমানের  পক্ষীরাজ । কথায় আছে পুরনো চাল ভাতে বাড়ে এই কথাটা ভীমের পক্ষীরাজ আবার  প্রমাণ করল। যাত্রাপথের শেষ লগ্নে শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি, সামনে প্রায় কিছুই  যায় না দেখা।  এই পক্ষীরাজের সামনে আবার জোড়া দুটো ছোট ছোট  হাত যা বৃষ্টির জলের ঝাপটা সামলাচ্ছে আর আওয়াজ হচ্ছে  ফটাস ফটাস। অজানা অচেনা জায়গায় ভীম একটু বেশি রকম ই বিচলিত, সহদেব এবং সঞ্জয়কে বারবার বলছে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে যে পক্ষীরাজ  ঠিকঠাক চলছে কি না কিন্তু  কে রহিবে এই ঘনঘোর বর্ষায় দিক নির্দেশের তরে? কিন্তু অবিচলিত  পক্ষীরাজ পৌঁছে গেল। গন্তব্যস্হলে  মসৃণগতিতে সারথি সঞ্জয়ের নির্দেশনায় ।
দেখা হতে থাকল সেই পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে, শুরু হল কুশল বিনিময় এবং আক্রমণ ট্রে হাতে কিশোরীদের । কারও  হাতে রয়েছে স্ন্যাকস,  কারও হাতে  কফি আবার কারও  হাতে সুস্বাদু জিলাপী । কেউ কেউ আক্রমণ প্রতিহত করছে তাদের  হাত থেকে নিয়ে আবার  কেউ বা উদাসীন, গল্পতেই মত্ত। ভীম সবাইকে খুশি করছে আর করবেনা এটা ভাবাই অমূলক। সহদেব কেমন একটু লাজুক, একবার একটু নিয়েই গুটিয়ে গেল। কিন্তু কফির অনুরোধ  উপেক্ষা করতে না পেরে দু কাপ নিয়ে নিল।
হাসি, ঠাট্টা, মশকরা চলছে সমানে অথচ বরের দেখা নাই রে , বরের দেখা নাই, আটকে আছে জ্যামে। আবার  অনেক দূরের রাস্তা, বৃষ্টিও হয়েছে,  ফিরতে হবে। তাই ডান হাতের  কাজটা ইতিমধ্যে  সেরে ফেলাটাই ভাল। আর তা করতে করতে পাত্র এসে গেলে দেখা হয়ে যাবে আমাদের  সেই ছোট্ট মেয়েটার জীবনসঙ্গী কে হতে চলেছে ।  তারপর এক ঝলক চোখে দেখেই নিজ গৃহে প্রত্যাগমন।
খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে ওপর তলায়। এখানে ব্যুফে সিস্টেম নয়, বসে খাওয়া, আজকাল যা প্রায়ই উঠেই গেছে। দুটো ব্যবস্থারই  সুবিধা অসুবিধা রয়েছে। ব্যুফেতে অনেক লোক একসঙ্গে নিজের পছন্দ মাফিক খেতে পারে এবং কোন  বিশেষ পদ ভাল হলে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেতে পারে  আর অন্য পদগুলো থেকে যেতে পারে। কিন্তু এখানে বসার জায়গা অপ্রতুল হলে কারও প্লেটের ঝোল জন্য  কারও জামাকাপড়  নষ্ট করে দিতে পারে। আর টেবিল চেয়ার ব্যবস্থায়  যারা খাবার  দিচ্ছে তারা ইচ্ছে করলে খাওয়ার বারোটা বাজিয়ে দিতেপারে। একটা জিনিস খাওয়া শেষ না হতেই আরও একটা জিনিস  দিয়ে পুরো স্বাদটাই বদলে দিতে পারে। কিন্তু তারা  যদি ভাল হয় তবে ধীরে সুস্থে লোকজন একটু আরামে খেতে পারে। তবে যদি মনে করা যায়  যে সব জিনিস তো একটাই জায়গায় পৌঁছে যাবে তাহলে আর কোন অসুবিধে নেই ।
খাওয়া শেষ । ব্যাণ্ডপার্টির আওয়াজে বোঝা গেল যে পাত্রপক্ষ হাজির। ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার বেশ খানিকক্ষণ আগেই এসে গিয়ে  একটু উসখুশ করছিলেন আর মাঝেমাঝেই বন্ধুকে জিজ্ঞেস করছিলেন পাত্রের আসা আর কতদূর। যাই হোক,  তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন । আর একটু সময় গেলেই  পকেটে আসবে মোটা টাকা এবং  বিশেষ  উপঢৌকন।
পক্ষীরাজ হাজির। সারথি সঞ্জয়ের খাওয়া হয়নি।তাকে একটা সুদৃশ্য থলিতে দেওয়া হয়েছে একটা ওজনদার বাক্স কিন্তু ফেরার তাগিদে সেটা আর খুলে উঠতে পারেনি বেচারা। বৃষ্টির তোড় বাড়তে থাকল কিন্তু  পক্ষীরাজের সামনে বৃষ্টি ও মানল  হার। তীরের গতিতে এগিয়ে চলেছে আমাদের পক্ষীরাজ । আবার ও বিপত্তি শেষ লগ্নে। আরও  একটা ডানা গেল ভেঙে । রাত সাড়ে এগারটা বেজে গেছে। ভীম পক্ষীরাজকে একা ছাড়তে রাজি নয় আবার সঞ্জয়ের  হাতেও ছাড়তে রাজি  নয় ।সহদেব কয়েকজন নগরপ্রহরীকে অনুরোধ  জানালো পক্ষীরাজকে একটু আস্তানা দিতে কিন্তু কেউ সেই অনুরোধ রাখল না। অতএব স্থির হলো যে সহদেব বলধরা এবং  বিজয়াকে নিয়ে অন্য  একটা বাহনে বাড়ি ফিরে আসবে এবং ভীম সঞ্জয় কে নিয়ে পক্ষীরাজের ভাঙা ডানা নিয়ে কোন ডাক্তার বাবুর কাছে নিয়ে যাবে। রাত্রি বারটা বেজে গেছে । বলধরা ইতিমধ্যে একটু অসুস্থ  হয়ে পড়েছে । সহদেব এবং বিজয়া বলধরাকে  বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে বাড়ি ফিরে যখন এল তখন  বাজে রাত একটা। এদিকে ভীমের ও  পক্ষীরাজের ডানা সারিয়ে ফিরতে রাত একটা বেজে গেছে । 
এবার আমাদের  পক্ষীরাজের পরিচয় করানো যাক। এখানে পক্ষীরাজের বা বা মারুতি হচ্ছে  পসাইডন এবং মা মেডুসা হচ্ছে সুজুকি।