আজ গ্রামের বাড়িতে আসছেন রাধাকান্ত বাবুর নাতি সতীকান্ত বাবু। গরুর গাড়িটা বেশ সুদৃশ্য। ছইটা বেশ সুন্দর, বলদগুলোও বেশ তাগড়া, বাবুর যাতে কোনও রকম কষ্ট না হয় তার জন্য বলদগুলোকে মাঝে মাঝেই চারা খেতে দিচ্ছে ঘটা আর মাস্টারমশাইকে ট্রেনের খবর জিজ্ঞেস করছে। দূর থেকে ট্রেনের হুইসল শোনা গেল , ঘটাও ব্যস্ত হয়ে উঠল গাড়ি সাজাতে। ছয়জন সাগরেদ নিয়ে এসেছে, চারজনের মাথায় ইয়া বড় পাগড়ি, হাতে তেলচুকচুকে লাঠি আর একটা লন্ঠন গাড়ির নীচে ঝোলানো আর দুজন সেরকম কিছু না হলেও হাতে আছে লাঠি এবং লন্ঠন। ট্রেন এসে থামতেই সতীকান্ত বাবু ও সহধর্মীনি হরিপ্রিয়া নামলেন। ঢুকুস ঢুকুস করে গড় হয়ে পেন্নামের পালা শেষ হলো। মাস্টারমশাই ও এসেহাতজোড় করে নমস্কার করলেন এবং কুশল বিনিময় সেরে এগোতে থাকলেন। মাস্টারমশাই বললেন একটু ওয়েটিং রুমে বসতে এবং একজনকে ইশারা করে কিছু বলতেই সে স্টেশন সংলগ্ন টালির চালার পানুর দোকান থেকে এক ঝুড়ি সন্দেশ নিয়ে এল। ঘটা এবং তার সাগরেদরা মালপত্র নিয়ে গাড়িতে সাজাতে থাকল আর সতীকান্ত বাবু এবং হরিপ্রিয়া মাস্টারমশায়ের সনির্বন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে সন্দেশ মুখে দিলেন এবং টিউব ওয়েলের ঠাণ্ডা জলে গলাটা ভিজিয়ে নিলেন। সন্দেশের ঝুড়ি উঠল গরুর গাড়িতে। তা, এবার কতদিন থাকছেন গ্রামে, জিজ্ঞেস করলেন মাস্টারমশাই ।
সতীকান্ত বাবু বললেন এবার কিছুদিন থাকব আর পারলে একদিন পরিবারকে নিয়ে আসুন। ট্রেন এবার সিগন্যাল পেয়ে হুইসল দিয়ে ছাড়ল আর ট্রেনের সমস্ত লোক চোখ বড় বড় করে দেখল কাণ্ডকারখানা । হরিপ্রিয়া প্রথমে এবং পরে সতীকান্ত বাবু উঠে আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে বসলেন এবং বলদ জোতা হলো গাড়িতে। সন্ধে হয়ে আসছে দেখে আগেই লন্ঠন জ্বালিয়ে নেওয়া হয়েছে আর দুজন লন্ঠন হাতে ফুরর করে বাঁশি বাজিয়ে চলতে শুরু করল। লাঠি হাতে আগে পিছে দুজন করে এগোতে থাকল। আকাশটা আস্তে আস্তে কালো হয়ে আসছে, মাঠের মাঝে নেমে আসা সন্ধের এক অপরূপ দৃশ্য। বলদগুলো চলছে দ্রুত পায়ে, ঘটারা তার সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রায় ছুটছে তারা কারণ অনেকটা রাস্তা যেতে হবে এবং বাড়ি পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যাবে। হলোও তাই। রাত্রি প্রায় সাড়ে নটা। এই সময় সমস্ত গ্রাম ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু আজ জমিদার বাবুরা আসছেন মুখ দেখাতেই হবে নাহলে আর আনুগত্য কোথায়? বারবার চোখ কচলাচ্ছে তারা, এই এসে পড়ল বলে । অবশেষে বাঁশির আওয়াজে সারা গ্রামের অন্ধকার ভেদ করে গ্রামবাসী যারা বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল তারা সবাই হৈ হৈ করে ফিরে এল, জমিদার বাড়ির সব আলো জ্বলে উঠল,ফুটেউঠল আলোর রোশনাই ।
সমস্ত গ্রামবাসীরা এসেছে, হরি সতীরা নামতেই পেন্নামের ঢল, তারপর নিজের নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়া। খাস যারা, তারা জমিদার বাড়িতেই থেকে গেল, হাজার হলেও নিরাপত্তার দিকটা তো ভাবতে হবে । পরের দিন সকাল থেকেই সারা গ্রামে তোলপাড়। যে পুকুরের মাছ মিষ্টি স্বাদের সেইখানে জাল ফেলা হচ্ছে , যেখানে যা ভাল জিনিস পাওয়া যায় তা মজুদ করা হচ্ছে কারণ বাবুরা কতদিন থাকবেন তা কেউ জানেনা। হরিপ্রিয়া কিন্তু সব ব্যাপারেই নাক উঁচু করে রেখেছে যেটা সতীকান্ত মোটেই পছন্দ করছেন না কারণ তিনি গ্রামের লোকদের নাড়িনক্ষত্র সব জানেন । এরা একবার যদি বিগড়ে যায় তাহলে এখানে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে যাবে । তিনি যত ই শান্ত করার চেষ্টা করেন ততটাই অসহিষ্ণুতা ফুটে ওঠে তাঁর ব্যবহারে। এরপর তো শুরু হলো হিন্দুস্থান পাকিস্তানের মতো আচরণ। ইনি যা বলেন উনি তার বিপরীত । শেষমেশ স্থির হলো যে হরিপ্রিয়া ফিরে যাবেন এবং গ্রামে আর এক মূহুর্ত ও থাকবেন না কিন্তু সতীকান্ত কে থাকতেই হবে কারণ গ্রামের সম্পত্তিকে একটু ছোট না করলে দেখাশোনার অভাবে সব বেদখল হয়ে যাবে । যথাসময়ে গিন্নী মা হরিপ্রিয়া ফিরে গেলেন আর সতীকান্ত বাবুর মন টিকছে না অথচ চলে গেলে সব পরিশ্রম বৃথা চলে যাবে । যাই হোক মানিয়ে নিতেই হবে । সমস্ত কাজ সমাধা না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থাই মেনে নিতে হবে।
প্রত্যেক সংসারে ই এই এক ই অবস্থা। যতক্ষণ দুজন পাশাপাশি রয়েছে ততক্ষণ ই হিন্দুস্থান পাকিস্তানের সম্পর্ক অথচ একটু দূরে গেলেই অনুপস্থিতিটা প্রকট হয়। হরি সতীনরা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ।
No comments:
Post a Comment