Wednesday, 12 February 2025

বাড়ির নাম "ওয়েলকাম"

বলরামপুর  স্টেশন টা তখনো পুরোপুরি স্টেশনের মর্যাদা পায়নি। আশপাশের অনেক গ্রাম থেকে লোকজন এখানকার হাটে আসত। বেশ বড় মাপের হাট, আনাজপত্র থেকে গরু ছাগল ও এই হাটে আসত বেচাকেনার জন্য।  তখন অতশত লরি, ভ্যানের চল ছিলনা,  ভরসা ছিল গরুর গাড়ি ও সাইকেল রিক্সা এবং  রিক্সা ভ্যান। তবে এঁটেল মাটি বৃষ্টিতে এত কাদা হতো যে রিক্সা ভ্যানের কম্মো ছিলনা বর্ষায়  চলা। অতএব তাগড়া বলদ বা মোষ জুতে চলতে হতো বেশী জিনিসপত্র আনার হলে। কিন্তু হাটের দিন  ছিল জমজমাট । সপ্তাহে দুদিন বসে হাট,  দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন আসত এই হাটে, সুতরাং লোকজনের অনেকদিনের দাবি ছিল এখানে ট্রেন থামুক। তখন তো এত গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদ ছিলনা , ছিলেন বিধানসভার সদস্য এবং  লোকসভার সদস্য যাঁদের দেখা পাওয়া প্রায় ভগবানের দেখা পাওয়ার সামিল। এঁরা নিজেরা কোন অসুবিধায় না পড়লে বা নিজেদের কোন প্রয়োজন না থাকলে ভুলেও  এই পথ মাড়াতেন না। একবার ভোটের প্রচারে এসে গাড়ি নিয়ে গাঁয়ের কাদা রাস্তায় আটকে পড়ে বাধ্য হয়েছিলেন আশ্রয় নিতে গ্রামের ই এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে। তাঁরা কিন্তু যথেষ্ট সমাদর করেছিলেন এবং  আলাপচারিতায় গ্রামের ও আশপাশের গ্রামের  লোকের অসুবিধার কথা জানিয়েছিলেন । আর সেই জনপ্রতিনিধির উদ্যোগে হলো বলরামপুর  হল্ট।হাওড়া থেকে ধুলিয়ানগামী ট্রেনের পথে পড়ে এই বলরামপুর । প্যাসেঞ্জার ট্রেন  এখানে থামত। ধীরে ধীরে লোকজন ওঠানামা বেড়ে যাওয়ায় ইনি পেলেন স্টেশনের  মর্যাদা । পর্যায়ক্রমে গ্রামের কাঁচা রাস্তা  হলো পাকা,এখন সেখানে বাস ও মিনিবাস চলছে আর চলছে একটু উঠতি বয়সের ছেলেদের মোটরসাইকেল নিয়ে  দাপাদাপি । স্টেশন থেকে রিক্সায় তিন মাইল দূরে  সেই "ওয়েলকাম"বাড়ি। তখন এদিকে ওদিকে শয়ে শয়ে কাঁচা বাড়ির  মধ্যে ঐ বাড়িটা ছিল জমাটবাঁধা অন্ধকারে লাইট জ্বলা বাড়ি।সুন্দর পাঁচিল দেওয়া গেট ওয়ালা বাড়ি, গেট থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় একশ ফুট এবং গেটের দুই পাশেও প্রায় একশ ফুট করে সুন্দর পাঁচিল। মাঠ ছেড়ে বাড়িতে ঢুকতে গেলে চড়তে হয় চারটে সিঁড়ি  যার দৈর্ঘ্য পনের ফুট এবং  সি়ঁড়ির দুই প্রান্তে দুটো রোয়াক যেখানে একজন লোক মোটামুটি ভাবে শুতে পারে। বাড়ির মালিক বুড়োবাবু ঐ রকে  আধশোয়া হয়ে  চুরুট খেতেন এবং মাঝে মাঝে শেক্সপিয়ার, মিল্টন বা কীটস বা শেলীর  কবিতা আবৃত্তি করতেন। বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করা লোকজন তত শিক্ষিত  না হওয়ায় হাঁ করে অবাক হয়ে চলে যেত  এবং পারতপক্ষে বুড়োবাবুর মুখোমুখি  হতো না। কেমন যেন  একটা দূরত্ব বজায়  থাকলেই বেশ খানিকটা  নিশ্চিন্তে থাকতো তারা । এই বাড়ি কিন্তু কোন জমিদার বা ছোটখাটো রাজার বাড়ি নয় তবে বুড়ো বাবু ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং  তাঁর বাবা ছিলেন জজসাহেব । এখন যদিও জজদের সম্মান বহুলাংশেই ক্ষয়িষ্ণু ( ওঁরা নিজেরাই অনেকখানি দায়ী) কিন্তু সেই  সময়ে জজসাহেব বা সরকারী কর্মচারীদের ছিল প্রভূত সম্মান । তাঁরা সর্বসমক্ষে আসতেন ভীষণ কম এবং তাঁদের কাজ কর্ম বেশীরভাগ সময়ে চাপরাশিরা করত এবং গেটে থাকা দারোয়ান কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিত না কোন সদুত্তর না পেলে।বাড়ির বারান্দায় ছিল জাফরি এবং  তার মধ্যেই  লেখা শব্দ ই ইংরেজিতে" ওয়েলকাম ।" বারান্দার আলোটা জ্বললেই সেই আলো জাফরির ছিদ্র দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করত। কিন্তু সেই বাড়িতে তো সাধারণ মানুষ আসতো ই না, তাহলে কাদের জন্য এই "ওয়েলকাম?" মনে হয় যে সমস্ত হোমরা চোমরা লোকজন আসতেন তাঁদের ই অভ্যর্থনা জানানো হতো। বাঁদিকে ছিল বড় বৈঠকখানা যা পরবর্তীকালে বাইরের ঘর বলে‌ পরিচিত ছিল। এক সময় ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় আলোকময় হয়ে উঠত সেই  বৈঠকখানা কিন্তু কালের গতিতে বিদায় নিয়েছে ঝাড়লণ্ঠন, এসেছে ইলেকট্রিক বালব কিন্তু বালবের শেডগুলো ছিল দারুণ সুন্দর যা এক সুন্দর রুচির বাহক । তবে ঐ সময়েও গ্রামের  বেশীরভাগ জায়গা যখন অন্ধকারে ডুবে থাকত সেই সময়ে ঐ বাড়িতে বিদ্যুতের আলো যেন দম্ভ প্রকাশ করত। বড় বাড়ি, একান্নবর্তী পরিবার , সবার ছেলেমেয়ে নিয়ে  যেন একটা ছোট খাটো গ্রাম । বৈঠকখানা হয়েছে বাইরের ঘর যেখানে সমস্ত ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা,  নানারকম পড়ার আওয়াজে কিরকম একটা অনুরণন হতো আর দূর থেকে  অচেনা লোকদের  একটা পাঠশালা বলেই ভ্রম হতো। একসময়  বাড়ির দুর্গাপূজো কখন যেন বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু বাড়ির পূজো ধীরে ধীরে বারোয়ারি পূজোয় পরিণত হলো। প্রতিমার আদল ও পাল্টে গেল ।বুড়োবাবুর বংশধররা  কাজের সূত্রে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল এবং তাঁর উত্তরাধিকারীরা অত বড় সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে অসমর্থ হয়ে বাড়ি বিক্রি করে দিল ।

দীর্ঘ দিন পর বুড়ো বাবুর নাতি এসেছেন সুদূর আমেরিকা থেকে,  থাকবেন কিছুদিন । হঠাৎই মনে হলো পরিবারকে নিয়ে বলরামপুর যাবেন এবং দেখবেন  তাঁর  শৈশবকাল  যেখানে কেটেছে সেটা কেমন আছে এবং স্ত্রীও ছেলেমেয়েদের দেখাবেন। যেমন মনে করা, তেমনই কাজ। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বলরামপুরের উদ্দেশ্যে । মাঝপথে একবার নবদ্বীপে থেমে চা খেয়ে রওনা দিলেন তাঁর ছোটবেলার শহরের দিকে। কিছুই  চিনতে পারছেন না জায়গা এতটাই বদলে গেছে। একে তাকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছলেন তাঁদের বাড়ির কাছে। প্রোমোটারের থাবা পড়েছে এখানে। বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে । অনেকটাই ভাঙা হয়ে গেছে । সুদৃশ্য গাড়ি এবং তার আরোহীদের  দেখে প্রোমোটারের লোকজন ছুটে  এল নতুন কোন কাস্টমার ভেবে। উনি এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছেন। সুপারভাইজার মোবাইলে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে তার মালিককে এবং  তিনিও এসে পড়েছেন নতুন বুকিং এর আশায়। খুব নম্র ও বিনীতভাবে  তাঁদের আমন্ত্রণ জানালেন  অফিসঘরে বসার জন্য।  ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী একটু অধৈর্য‌্য হয়ে পড়েছে ফিরে যাওয়ার জন্য। ভদ্রতার খাতিরে একবার অফিস ঘরে বসলেন যেটা আগে ছিল বৈঠকখানা বা বাইরের  ঘর, কেবল একটাই তফাত এটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং  অনেক  ঝকঝকে। অফিস ঘরের বাইরে একটা জায়গায় জাফরিতে লেখা "ওয়েলকাম" টা চোখে পড়ল। একটু বিস্মিত  হয়েই জিজ্ঞেস করলেন  এটা এখানে কেন? স্যার,  আমাদের এই প্রজেক্টের নাম দিয়েছি "ওয়েলকাম" আর এই বলে একটা ব্রোশিওর ধরিয়ে দিল। এই বাড়ির মাঠে আমরা বহু খেলাধূলো করেছি আর পূজো ও করেছি, এর স্মৃতি আমার মনে এখন ও জ্বলজ্বল করছে। "ওয়েলকাম" নামটা আমার বড় ই প্রিয়, তাই আমার এই প্রজেক্টের নাম ওইরকম দিয়েছি স্যার । কানে যেন কেউ গরম সীসা ঢেলে দিল, মাথাটা হেঁট হয়ে গেল এই ভেবে যে একটা অনেক উচ্চতায় উঠেও যারা পূর্বস্মৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা ও করেনা অথচ এই অল্পশিক্ষিত প্রোমোটার তার শৈশবের  স্মৃতিকে সম্মান দিয়ে আমার প্রপিতামহের  সেন্টিমেন্টের দাম দিচ্ছে। চোখের পাতাটা ভিজে আসছে, কোনরকমে তা সামাল দিয়ে গাড়ির দিকে রওনা দিল।

Monday, 10 February 2025

যেথা যাহা পাও কুড়াইয়া লও সুখের তরে

"যেথা যাহা পাও কুড়াইয়া লও সুখের তরে" কথাটা শুনতে বেশ লাগে কিন্তু যদি কিছু আসে অনৈতিক উপায়ে এবং সেটা যদি সুখ আনে, সেটাও কি নেওয়া উচিত ? এই বিষয়ে মতামত ভিন্ন রকমের। কিছু লোক আছেন যাঁরা সামান্যতম অনৈতিক রাস্তাকে এড়িয়ে চলেন তাঁরা এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করবেন কিন্তু বহু লোক আছেন যাঁরা সুখের সন্ধানে যে কোনরকম কাজ করতে প্রস্তুত। প্রথম পক্ষ সংখ্যায় খুবই নগণ্য এবং  দ্বিতীয় পক্ষ দলে বেশ ভারী এবং  অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে  পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত  নেওয়া  উচিত কারণ একবার অনৈতিক  পথে গেলে  একেবারে কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়ার সামিল, ফেরার রাস্তা বন্ধ।

সুখ কি, কত রকমের সুখ আছে এইসব নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে আকাশে কটা তারা আছে এই নিয়ে কেউ যেন প্রশ্ন করছে।সুখ কি এটা বলা ভীষণ কঠিন । বিরাট বড়লোক, অনেক টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ি চাকর বাকর,  দারোয়ান ঢুকতে বেরোতে সেলাম ঠোকে কিন্তু নরম গদিতে শুয়েও তার দুটো চোখের পাতা এক করতে পারেনা অথচ ফুটপাতে থাকা অভুক্ত, অর্ধভুক্ত লোকেরা তার সম্বলের ছেঁড়া মাদুরের ওপর শুয়েই মরার মতন ঘুমায়। সুতরাং টাকা পয়সাই সুখের মানদণ্ড হতে পারেনা। কেউ জ্ঞান পিপাসু, বইয়ের মধ্যে ডুবে থেকেই ঘোর মগ্ন হয়ে থাকেন বা কেউ চিত্রকর তাঁর শিল্পকীর্তির মধ্যেই ডুবে থাকেন বা কোন সঙ্গীত  শিল্পী তাঁর সুরের সাগরে নিমজ্জিত থাকেন।কেউ ভগবানের চিন্তায় মগ্ন থাকতে ভালবাসেন আবার কেউবা পরোপকারে নিজেকে ব্যস্ত রেখে সুখ পান আবার কেউ চৌর্য্য বৃত্তিতে খুশী থাকেন । সুতরাং,  এক একজনের কাছে সুখের সংজ্ঞা এক একরকম। সুতরাং কিসে যে সুখ মিলবে একথা কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না। একই বই সবাই পড়লেও বিভিন্ন জনের উপলব্ধি বিভিন্ন রকম ।
জন্ম ইস্তক আমরা সবাই ছুটছি কিন্তু দিশা সবার ভিন্ন। তবে সুখ পাওয়ার একটা মোটামুটি শর্টকাট রাস্তা হচ্ছে যে জ্ঞানত কারও কোন ক্ষতি করা বা ক্ষতির চিন্তা করায় বিরত থাকলে অনেকটাই আনন্দ পাওয়া যায়। পরনিন্দা বা পরশ্রীকাতরতা থেকে যদি নিজেকে দূরে রাখা যায় তাহলেও  অনেক মানসিক শান্তি বজায় থাকে। মানুষের বড় হওয়ার উপর অনেকটাই নির্ভর করে মানসিক গঠন এবং  সে কিভাবে সুখের সন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত করবে তা ও নির্ভর করে সেই মানসিক গঠনের উপর।

কেউ একাকীত্ব পছন্দ করে আবার কেউ লোকজনের সংসর্গ ভালবাসে। অনেকেই বলে যে ও একদম লোকের সঙ্গে মিশতে পারেনা। মনের দরজা খুলে বাইরে না বেরোলে একাকীত্ব কাটবে কি করে? গতকাল কয়েকটা সত্তরোর্ধ্ব একই স্কুলে পড়া  বুড়ো(কিন্তু মনে মনে যুবক) তাদের বুড়িদের নিয়ে যেরকম হৈচৈ করল তাতে আশপাশের  লোকজন একটু শঙ্কিত ই হয়ে উঠেছিল আর ভাবছিল এরা সবাই প্রকৃতিস্থ আছে তো? বুড়োগুলো সবাই স্বকীয়তায় মহীয়ান কিন্তু তারা ফিরে গেছিল তাদের স্কুল জীবনে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণায়। কোন স্যার কিভাবে পড়াতেন, তাঁদের মুদ্রাদোষ নিয়ে আলোচনা, বেঞ্চের উপর দাঁড়ানো, টিফিন চুরি, অন্যের ব্যাগ দিয়ে চেয়ার মুছে নেওয়া, লিখতে লিখতে ফাউন্টেন পেনের কালি শেষ হয়ে গেলে পাশের বন্ধুর কাছ থেকে দুফোঁটা কালি নিয়ে আবার  লেখা শুরু করা, পরীক্ষার  সময়ে বাথরুম গিয়ে কারো কাছ থেকে কোন অজানা প্রশ্নের  উত্তর জেনে নেওয়া  বা ট্যারা স্যারের পরীক্ষায় গার্ড দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে হাসাহাসিতে ওই বন্ধুরাই শুধু নয়,তাদের বুড়িরা এবং  আশপাশের লোকজন সবাই হাঁ করে শুনছিল তাদের কথা। আরও একজন তাদের স্কুলের সহপাঠী শুনেই বলল তোরা লাঞ্চ টা শুরু কর ঘন্টা দুয়েক বাদে কারণ ও তখন তার স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করছিল,  পরদিন তার অপারেশন হওয়ার কথা । এইরকম অনাবিল আনন্দের স্বাদ কজন নিতে পারে? স্ট্যাম্প কালেকশন এবং বদলা বদলি করা বা স্কুলের  টিফিনের সময় পাশেই থাকা মেয়েদের স্কুলের দিকে একটা চক্কর মেরে আসা বা লরি বোঝাই আখের মধ্যে থেকে একটা আখ টেনে বার করার কি টেকনিক তা নিয়ে ও যথেষ্ট আলোচনায় সবাই  মশগুল ।হয়তো আশপাশের লোকজন ভাবছিল যে খুশীতে  বুড়োগুলো পাগল হয়ে গেছে । বেঙ্গল হাটারিতে লাঞ্চ সেরে এবং  সেখানকার কর্ণধার  পার্থ ঘোষাল এবং  তাঁর পুরো টিমের সহযোগীতায় এই বুড়োবুড়িদের দল তাঁদের শৈশবে ফিরে গেছিল । সেখানে একপ্রস্থ হৈচৈ করে পরের গন্তব্যস্থল যতীন দাস রোডের উদিপীতে কফি খাওয়া। ওখানকার কফি একটা আলাদা মাত্রা আনে স্বাদে।ওখানকার একটা বিশেষ  জায়গা ছয়টি সরু দেবদারু গাছের একটা শেড যেখানে সচরাচর জায়গাই মেলেনা সেইখানে ভগবানের বিশেষ দয়ায় মিলল ঠাঁই এবং  সেখানেও  ঘন্টা দুয়েক আড্ডা বুড়োবুড়িদের একটু বাড়তি অক্সিজেন যোগাল। সবাই এই জায়গায় বসার অপেক্ষায় থাকে এবং এই বুড়ো খোকাখুকিরা গাড়িতে ওঠামাত্র জায়গাটা ভরে গেল নতুন  দলের দ্বারা ।
এই ধরণের আনন্দ বা খুশী খু়ঁজতে কোন অনৈতিক কাজের প্রয়োজন পড়েনা এবং বন্ধুদের সাহচর্য জীবনে এক আলাদা মাত্রা যোগ করে। মানুষ হয়ে যখন জন্ম হয়েছে তখন একদিন তার পরিসমাপ্তি হবেই কিন্তু এই স্বল্প দিনের মেয়াদে কে কতটা সুখের  ঝুলি ভরতে পারে সেটাই দেখার ।

Tuesday, 4 February 2025

বিদায় গোকুল বিদায়

বেশ কাক ভোরে মোবাইল বেজে ওঠায় একটু ভয় পেয়েই গেলাম। কি রে বাবা, এত সকালে কে ডাকে আমায়। একটু ভয় ভয় করেই মোবাইলটা ধরতেই একটা চাপা কান্নায় বুঝলাম কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। ঘুম জড়ানো চোখে হ্যালো বলে জিজ্ঞেস করতেই একটা অচেনা মেয়েলি কণ্ঠে কান্নামিশ্রিত গলার আওয়াজ পেলাম এবং গিন্নিকে সঁপে দিলাম । দু মিনিট বাদেই জানলাম যে আমাদের কাজের দিদির স্বামী দেহ রেখেছেন।

মূহুর্তের মধ্যে দিদির মুখটা ভেসে উঠল। বহুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে । দেখতে দেখতে  বত্রিশ বছর কি ভাবে কেটে গেছে কেউ বুঝতেই পারিনি । তখন আমাদের ও বয়স কম, দিদিও ছিল যথেষ্ট ছোট,  চরকির মতো ঘুরে ঘুরে কাজ করতো এবং বয়স কম থাকায়  একাই সমস্ত কাজ সামলে দিত মায় দূরে পার্কের পাশে থাকা টিউব ওয়েল থেকে খাবার জল আনা পর্যন্ত। বাড়িতে সব সময়ই কোন না কোন লোক আসতো কিন্তু দিদির মুখ কখনও ভার দেখিনি। ভীষণ বিশ্বাসী যেটা আজকের দিনে অত্যন্ত বিরল। আমি তো পরিবারকে এখানে রেখে এখানে সেখানে ট্রান্সফার হতাম কিন্তু ভরসা ছিল ঐ বিশ্বাসী ও কর্মঠ দিদির উপর। অনেক সময় নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েছি এবং মিসেস কে আমার কাছে  আসতে হয়েছে কিন্তু  দিদি সামলে দিয়েছে ঐ বিপদের দিনে। শুধু দিদিই নয়, তার স্বামী গোকুল ও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । মানে এক কথায়  পরিবারের একজন হয়েই পাশে থেকেছে।  কখনও সখনও ওর স্বামী বাড়ির বাইরের কাজ করে দিয়েছে। একদম জানতেই পারিনি যে কখন আমাদের পরিবারের একজন সদস্য তারা হয়ে গেছে । আজ আমার এক সহকর্মীর শ্রাদ্ধ ছিল আর এই দিনেই আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন চলে গেল । মাঝখানে কয়েকটা মাস করোনার জন্য ও আমাদের সঙ্গে  ছিলনা কিন্তু  সেই  সময়েও আমাদের আর্থিক সাহায্য অব্যাহত ছিল একজন পরিবারের সদস্য হিসেবে যতখানি করা সম্ভব ততটাই করেছি। বত্রিশ বছরে দিদিও একটু কাহিল হয়ে গেছে এবং তাকে সাহায্য করতে আরও একজন এসে গেছে  নয় নয় করে বছর বারো। গোকুলকে আমাদের এলাকায় কিছু কিছু কাজ জুটিয়ে দিতে পেরেছিলাম কিন্তু সেই দূর প্রান্ত থেকে  এসে কাজ তার ধরে রাখতে পারেনি। 

দিদি একটু চুপচাপ ধরণের ছিল। অন্য বাড়িতে কাজ করলেও কখনও কথা চালাচালির মধ্যে তাকে থাকতে দেখিনি । ওদের মধ্যে এইধরণের চরিত্র মেলা ভার । সব সময়ই একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসতো এবং চেহারায় একটা লক্ষ্মী শ্রী ছিল। একটু আগেই ওরা গোকুলের সৎকার করে ফিরল। দিদির পুত্রবধূ ফোন করে দিদিকে দিল কথা বলার জন্য আর দিদি হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল , " বৌদি, আমি তোমাদের বাড়ির কাজটা করব আর কোনও বাড়িতে না করলেও।" তোমাকে কাজ ছাড়তে হবেনা, যতদিন তুমি পারবে আমাদের পরিবারের একজন হয়ে থেকো  আর মনটাকে শান্ত কর এই ভেবে যে তোমার স্বামী অনেকদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছিল , সেটা দেখেই ভগবান তাকে তাঁর কাছে টেনে নিয়েছেন। কিছু দরকার হলে আমাদের  জানিও। 
কিছু মানুষ আছে যারা হাজার  কষ্ট হলেও সততার পথ ছাড়েনা এবং তাদের মর্যাদা বোধ এতটাই বেশি  যে তারা বিনা শ্রমে কারও কাছে  বিন্দুমাত্র সাহায্য নেবেনা। এঁদের অবশ্যই সম্মান করা উচিত এবং  অনেক পয়সাওয়ালা লোকদের চেয়ে হাজার গুণ ভাল। আমাদের রাজনীতিবিদদের দেখলে ঘৃণা বোধ হয় কিন্তু হাজার  অসৎ হলেও তাদেরই দ্বারস্থ হতে হয়। সততার সম্মান  আমরা খুব  কম ই দিই। আমরা ঐ অসৎ ব্যক্তিদের মাথায় তুলে রাখি , খানিকটা ভয়ে ভক্তির মতন। গোকুল চলে গেল আর দিদিকে বেশ খানিকটা ধাক্কা দিয়ে গেল। এদের অল্প বয়সে বিয়ে হয় এবং এই দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের আজ শেষ হলো।