মূহুর্তের মধ্যে দিদির মুখটা ভেসে উঠল। বহুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে । দেখতে দেখতে বত্রিশ বছর কি ভাবে কেটে গেছে কেউ বুঝতেই পারিনি । তখন আমাদের ও বয়স কম, দিদিও ছিল যথেষ্ট ছোট, চরকির মতো ঘুরে ঘুরে কাজ করতো এবং বয়স কম থাকায় একাই সমস্ত কাজ সামলে দিত মায় দূরে পার্কের পাশে থাকা টিউব ওয়েল থেকে খাবার জল আনা পর্যন্ত। বাড়িতে সব সময়ই কোন না কোন লোক আসতো কিন্তু দিদির মুখ কখনও ভার দেখিনি। ভীষণ বিশ্বাসী যেটা আজকের দিনে অত্যন্ত বিরল। আমি তো পরিবারকে এখানে রেখে এখানে সেখানে ট্রান্সফার হতাম কিন্তু ভরসা ছিল ঐ বিশ্বাসী ও কর্মঠ দিদির উপর। অনেক সময় নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েছি এবং মিসেস কে আমার কাছে আসতে হয়েছে কিন্তু দিদি সামলে দিয়েছে ঐ বিপদের দিনে। শুধু দিদিই নয়, তার স্বামী গোকুল ও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । মানে এক কথায় পরিবারের একজন হয়েই পাশে থেকেছে। কখনও সখনও ওর স্বামী বাড়ির বাইরের কাজ করে দিয়েছে। একদম জানতেই পারিনি যে কখন আমাদের পরিবারের একজন সদস্য তারা হয়ে গেছে । আজ আমার এক সহকর্মীর শ্রাদ্ধ ছিল আর এই দিনেই আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন চলে গেল । মাঝখানে কয়েকটা মাস করোনার জন্য ও আমাদের সঙ্গে ছিলনা কিন্তু সেই সময়েও আমাদের আর্থিক সাহায্য অব্যাহত ছিল একজন পরিবারের সদস্য হিসেবে যতখানি করা সম্ভব ততটাই করেছি। বত্রিশ বছরে দিদিও একটু কাহিল হয়ে গেছে এবং তাকে সাহায্য করতে আরও একজন এসে গেছে নয় নয় করে বছর বারো। গোকুলকে আমাদের এলাকায় কিছু কিছু কাজ জুটিয়ে দিতে পেরেছিলাম কিন্তু সেই দূর প্রান্ত থেকে এসে কাজ তার ধরে রাখতে পারেনি।
দিদি একটু চুপচাপ ধরণের ছিল। অন্য বাড়িতে কাজ করলেও কখনও কথা চালাচালির মধ্যে তাকে থাকতে দেখিনি । ওদের মধ্যে এইধরণের চরিত্র মেলা ভার । সব সময়ই একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসতো এবং চেহারায় একটা লক্ষ্মী শ্রী ছিল। একটু আগেই ওরা গোকুলের সৎকার করে ফিরল। দিদির পুত্রবধূ ফোন করে দিদিকে দিল কথা বলার জন্য আর দিদি হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল , " বৌদি, আমি তোমাদের বাড়ির কাজটা করব আর কোনও বাড়িতে না করলেও।" তোমাকে কাজ ছাড়তে হবেনা, যতদিন তুমি পারবে আমাদের পরিবারের একজন হয়ে থেকো আর মনটাকে শান্ত কর এই ভেবে যে তোমার স্বামী অনেকদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছিল , সেটা দেখেই ভগবান তাকে তাঁর কাছে টেনে নিয়েছেন। কিছু দরকার হলে আমাদের জানিও।
কিছু মানুষ আছে যারা হাজার কষ্ট হলেও সততার পথ ছাড়েনা এবং তাদের মর্যাদা বোধ এতটাই বেশি যে তারা বিনা শ্রমে কারও কাছে বিন্দুমাত্র সাহায্য নেবেনা। এঁদের অবশ্যই সম্মান করা উচিত এবং অনেক পয়সাওয়ালা লোকদের চেয়ে হাজার গুণ ভাল। আমাদের রাজনীতিবিদদের দেখলে ঘৃণা বোধ হয় কিন্তু হাজার অসৎ হলেও তাদেরই দ্বারস্থ হতে হয়। সততার সম্মান আমরা খুব কম ই দিই। আমরা ঐ অসৎ ব্যক্তিদের মাথায় তুলে রাখি , খানিকটা ভয়ে ভক্তির মতন। গোকুল চলে গেল আর দিদিকে বেশ খানিকটা ধাক্কা দিয়ে গেল। এদের অল্প বয়সে বিয়ে হয় এবং এই দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের আজ শেষ হলো।
No comments:
Post a Comment