Thursday, 30 January 2025

অথ বিবাহ কথা

বহুদিন পর এক ধমাকাদার বিয়ের সাক্ষী হতে পারলাম । বড় শিল্পপতিদের ছেলেমেয়ের বিয়েতে আমাদের মতন উলুখাগড়াদের ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকা ছাড়া আর খবরের কাগজ বা দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলের প্রতিযোগিতামূলক প্রদর্শনের কল্যাণে খুঁটিনাটি খবরের বিশদ বিবরণ জানা ছাড়া আর কিছুই করার  থাকেনা। যে যেমন ওজনদার, তার তেমন সমারোহ। রাজারাজড়ার ঘরের বিয়ে আমাদের মতন আমজনতার মধ্যেও একটা আনন্দের রেশ জাগিয়ে তোলে যদিও  তা সাময়িক। একজন শিল্পপতির ছেলের সঙ্গে আর এক শিল্পপতির মেয়ের  বিয়ে হলো, সারা পৃথিবীর তাবড় তাবড় নেতা মন্ত্রীর সমাগম হলো, কোটি কোটি টাকা কেমন ভুস করে উড়ে‌গেল-- অবশ্যই এক পকেট থেকে আর এক পকেটে আর আমজনতা বলতে লাগল, " কেয়া বাত হ্যায়,  শাদী হো তো অ্যায়সা''। আমরা আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবরে কি দরকার?  না, তা ঠিক নয়, ছোটখাটো ব্যাবসাদার যদি নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যাবসা করতে পারে তাহলে তার ভাগ্যেও শিকে ছিঁড়তে পারে। যেমন  যে পান বানায় খুব  সুন্দর,  সে পানের‌ বরাত পেতে পারে বা কেউ ভাল ঢোল বাজালে সেও ডাক পেতে পারে।

বিয়ে মানে তো একটা ছেলের  সঙ্গে  একটা মেয়ের  বিয়ে নয়, একটা পরিবারের সঙ্গে আর একটা পরিবারের মেলবন্ধন। বিয়ের ব্যাপারটা আজকাল বেশ আধুনিক  হয়ে গেছে। আগে ঘটকদের মাধ্যমে বিয়ের যোগাযোগ হতো। অমুক ঘটকের খুব নাম ডাক, ওর কাছে গেলেই বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের বিয়ে হবেই হবে। তখন কম্পিউটার না থাকলেও জাবদা খাতায়  ঠিকুজি কুলজি সব থাকত এবং  ঐ ঘটক মশাইরা যেন এক একজন জীবন্ত কম্পিউটার । তাঁর দক্ষিণা তো নাম রেজিস্ট্রেশনের সময় দিতেই হতো , এছাড়া বিয়ে হলে তাঁর  সাম্মানিক দক্ষিনাও বেশ ভাল রকম হতো যার নাম ছিল  ঘটকবিদায়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে  ঘটকমশাইএর জায়গা নিয়েছে বিভিন্ন ম্যাট্রিমোনিয়াল । সেখানেও নাম রেজিস্ট্রি করতে হয় একটা বাঁধা সময়ের জন্য এবং এই ব্যবসাও বেশ রমরমিয়ে চলছে। আত্মীয় স্বজনের সূত্রে সম্বন্ধ এলে পাত্র পাত্রীদের সম্বন্ধে অনেক  খবর জানা যেত। চলতি কথা ছিল  উঠতি ঘরের ছেলে এবং পড়তি ঘরের মেয়ের সম্বন্ধে খোঁজ পড়ত বেশী, বড় জোর সমানে সমানে । পুরুষ শাসিত সমাজে ছেলের বাড়ির  কথাই বেশী  প্রাধান্য পাবে কিন্তু সেটা বিয়ে হওয়া ইস্তক, তার পরেই ছেলের বাবা মা বা কাকা, পিসিরা সব ব্রাত্য, তার জায়গা নেয় মেয়ের বাড়ির লোকজন  মানে মেয়ের বাবা, মা এবং মাসি বা মামারা। সুতরাং,  ঘটের বুদ্ধি একটু খরচ করলেই  সম্পর্কটা বেশ টিকিয়ে রাখা যায়।  বেশী বেগড়বাঁই করলে সম্পর্ক ফুটুস। ম্যাট্রিমোনিয়ালের মাধ্যমে যে সম্পর্কগুলো আসে সেগুলো যথেষ্ট  সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করতে হয় নাহলে পরে ম্যাট্রিমনি সংস্থাকে দোষ. দিয়েও বিশেষ লাভ হবেনা আর তা ছাড়া তারা দায়িত্ব নেবেই বা কেন? ওরা সমস্ত‌ দেওয়া তথ্য পরীক্ষা করে কিনা জানা নেই । তথ্য পরীক্ষা করার জন্য আলাদা সংস্থা আছে এবং তাদের সার্ভিস পেতে গেলে গাঁটের কড়ি খরচ করতে হবে । বাবা মায়ের অনেক কষ্ট লাঘব হয়ে যায় যদি ছেলে মেয়েরা নিজেদের জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী বেছে নেয়। তারা অনেক দিন ধরে মেলামেশা করার ফলে বুঝতে পারে যে নিজের পছন্দের সঙ্গে কতটা মিলছে এবং  সেই হিসাবে নিজেদের জীবন সঙ্গী  বা সঙ্গিনী বেছে  নেয় । কিন্তু এ সত্ত্বেও কি সব কিছু ঠিকঠাক চলছে? না, এতেও মাঝে মধ্যে চলার পথে কিছু বাধা আসে যার অনিবার্য পরিণতি বিচ্ছেদ । খুবই দুঃখের কথা, কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ও তাই। ছেলে, মেয়ে দুজনেই যথেষ্ট  শিক্ষিত এবং  তাদের  দুজনের  ক্যারিয়ারের গ্রাফ ই ঊর্ধমুখী কিন্তু কোন  কারণে তাদের  একই শহরে পোস্টিং না হলে দীর্ঘদিন আলাদা থাকতে হয় যার ফলে মানসিক অবসাদে ভুগতে হয় এবং  একটা স্টেজ পরে সেটা বিচ্ছিন্নতার পথে ঠেলে দেয়। এই সময় কাউকে না কাউকে একটু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আজকাল সবার ই নিউক্লিয়ার  ফ্যামিলি । সুতরাং  ছেলে বা মেয়েরা তাদের  বাবা মায়ের  সাধ্যানুযায়ী যত্নে বেড়ে ওঠে এবং  বিয়ের  পর সেই মানে একটু ঘাটতি হলেই অসন্তোষ  ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে এবং বিস্ফোরক অবস্থার দিকে এগোতে থাকে। এইসময় বাবামায়ের ভূমিকা  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে মায়েদের। এইসময়  কাউন্সেলিং ভয়ানক ভাবে দরকার। কাউন্সেলিং এর পরেও যদি মানিয়ে নেওয়ার অবস্থায় না যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি  বিচ্ছেদ । এমন ও ঘটনা চোখে পড়ে যেখানে সন্তান হওয়ার  পরেও  বিচ্ছেদ  ঘটে যায় । অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা কিন্তু এর সাক্ষীও হতে হয়। আজকাল  যে কোন বিয়েই ভীষণ ব্যয়সাপেক্ষ । এত খরচ করেও যদি তার স্থায়িত্বে সন্দেহ থাকে তাহলে তাও রীতিমতো  বেদনাদায়ক ।
বিয়ে স্বভাবতঃই এক গাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠান । এই অনুষ্ঠানে  একটু হালকা মেজাজ আনার জন্য  ঠাকুমা দিদিমাদের এক বিরাট দায়িত্ব ছিল। নানারকম ছড়া বা কবিতা তাঁরা লিখতেন এবং পুস্তিকার আকারে তা প্রকাশ করা হতো।আইবুড়ো ভাত(অনূঢ় বা অনূঢ়া অবস্থায় ভাত খাওয়া) একটা খুব বড়সড় অনুষ্ঠান ছিল ।বিয়ের দিন সকাল বেলায় পাত্রর গায়ে হলুদ  হতো এবং  সেই  হলুদ বীর মুটের কড়ি সমেত পাত্রীর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হতো এবং  তারপর পাত্রীর গায়ে হলুদ  হতো। এরপর আর পাত্র বা পাত্রীর কোন খাবার জুটত না একটু আধটু সরবত ছাড়া ।এখন আর এত কষ্ট ছেলে মেয়েদের  দেওয়া হয়না। বিয়ের দিন দিদিমা ঠাকুমারা কিন্তু রীতিমতো নাচতেন,  এখন যেটা সঙ্গীতে হয়। এছাড়া নানারকম ছোটখাটো খেলাধূলোর মাধ্যমে এই গম্ভীর অনুষ্ঠান কে আরও কত প্রাণবন্ত করা যায় তার দিকে  খেয়াল রাখতেন। হোম এবং সপ্তপদী হিন্দুশাস্ত্রমতে বিয়ের  এক অঙ্গাঙ্গী অনুষ্ঠান  এবং  আজও তা পালন করা হয়।

সাম্প্রতিক কালে কয়েকটা বিয়েতে যোগ দিয়ে ভীষণ ভাল লাগল। দিল্লীতে তাজ হোটেলে দুই পরিবারের  একসঙ্গে থেকে বিয়ে বা জয়পুরের রাজবাড়িতে  বন্ধুর  ছেলের বিয়েতে চুটিয়ে আনন্দ করার প্রায় একবছর বাদে একটা ধমাকাদার বিয়ে হলো যেখানে আশপাশের লোকজন  সবাই মিলিতভাবে এত আনন্দ করলো যে কার বাড়ির বিয়ে প্রায় ভুলে যাবার ই দশা। ছেলের বাবা মায়ের তরফ থেকে  সমস্ত আত্মীয়স্বজনদের আগমন এবং পাড়া প্রতিবেশীদের সবার আন্তরিক  যোগদান একটা দারুণ আনন্দময় পরিস্থিতির  সৃষ্টি করেছিল ।  দিল্লী বা জয়পুরের  ডেস্টিনেশন ম্যারেজের মতন এবার ও চুটিয়ে আনন্দ করা হলো। আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে পাড়া প্রতিবেশীদের এই যোগদান একটা বিরল আনন্দের সৃষ্টি করেছে। সবার আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা  নিয়ে দাম্পত্য  জীবন শুরু হোক এই আমাদের  সবার প্রার্থনা। 

No comments:

Post a Comment