হঠাৎই একটা মেসেজ এল পাশের বাড়ির মেসোমশাই গতকাল রাতে অমৃতলোকে যাত্রা করেছেন। একাই থাকতেন তিনি স্ত্রী বিয়োগের পর। এক ছেলে ও এক মেয়ে বিদেশে থাকে, তারা তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে আসে তারা বাবা মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে । রবি বাবু ও তাঁর স্ত্রী সুকন্যা দেবী খুশীতে ডগমগ হয়ে উঠতেন, বিশাল বাড়িটা ঝলমলিয়ে উঠত বাচ্চাদের কলরবে। কয়েকটা দিন হৈচৈ, তারপরেই ঝিমিয়ে পড়ত গেট ওয়ালা বাড়িটা। কেউ এলে গেলে মাসিমা বলতেন, "বাবা, গেট টা লাগিয়ে দিয়ে যেও। "সেই মাসিমা ও চলে গেছেন গতবছর। তারপরেই রবি বাবুর একাকীত্ব শুরু। লোকজনের আসা যাওয়া কমে গেছে। একটু আধটু লেখাজোখা করে খানিকটা সময় কাটে কিন্তু দীর্ঘ সময় তো আর কাটতেই চায়না। বেশীক্ষণ লিখতেও আর ভাল লাগেনা। আগে যখন স্ত্রী বেঁচে ছিল তখন লেখার সময় অবধারিতভাবে বলত যে বাজারে যাও সকাল সকাল নাহলে ঐ ঝটতি পটতি জিনিসগুলো তোমার থলিতে ঢুকবে আর আমার প্রাণান্ত। খুবই বিরক্ত হয়ে কলমটা টেবিলের ওপর আছড়ে ফেলে থলিটা নিয়ে বেরিয়ে যেতেন। রাগের মাথায় জিনিস পত্র আনাতেও গণ্ডগোল হয়েযেত যার অবশ্যম্ভাবী ফল গিন্নীর গনগনানি। তখন বিরক্তির মাত্রা আরও বেড়ে যেত কিন্তু আজ কেউ পিছনে টিকটিক করার নেই, চোখা চোখা বাণে কেউ বিদ্ধ করার নেই, আছে শুধু নিস্তব্ধতা, তবু লিখতে মন আর চায়না। পিছন থেকে খানিকটা বিদ্রূপাত্মক শব্দ উড়ে না এলে কলম যেন আগে বাড়তেই চায়না। সেও যেন বুঝে গেছে ঝাঁকানি শেষ অতএব দাও ক্ষান্তি। রবিবাবু ও বুঝতে পারেন সুকন্যার অনুপস্থিতি তাঁকে নিরুৎসাহী করে তুলেছে। প্রকাশকের তাগাদাও তাঁকে আর উজ্জ্বীবিত করতে পারছে না। অথচ, না লিখলেও পয়সা আসবে না,সঞ্চিত পুঁজিতে পড়বে টান। জীবনের উপান্তে এসে ছেলেমেয়েদের কাছে নিজের কোন চাহিদার কথা বলতে খুব কুণ্ঠা বোধ হয় । সেই জন্য এক রকম বাধ্য হয়েই কলম খুলে বসতে হয়। কি যেন লিখছিলাম ভুলে গেছি, প্রথম থেকে একবার পড়ে নিয়ে খেই ধরতে হয়। তবু সেই তখনকার মনের অবস্থায় ফিরে যেতে যথেষ্ট অসুবিধা হচ্ছে। লেখক এক, বিষয় এক, কলম ও এক কিন্তু ভিন্ন মন । গল্পের গতি ভিন্নমুখী।রবি বাবু ভাবেন এটা নিশ্চয়ই সব লেখকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কারণ শয়ে শয়ে পাতার উপন্যাস তো আর একটা সিটিং এ লেখা সম্ভব নয়। সুতরাং ভিন্ন মানসিকতায় শেষ হয় এই দীর্ঘ উপন্যাস। যাঁরা সেই গতি প্রকৃতি এক ধারায় রাখতে পারেন তাঁরা সত্যিই নমস্য।
কদিন ধরেই শরীরটা বিশেষ ভাল যাচ্ছেনা। অল্প অল্প জ্বর, প্যারাসিটামল খেয়ে জ্বর নেমে যাচ্ছে আবার খানিকক্ষণ বাদেই যে কে সেই। বন্ধুবান্ধব আসছে দেখা করতে, নিয়েও যেতে চাইছে ডাক্তারের কাছে কিন্তু রবি বাবুর মন আর সরছে না। কেবল ই মনে পড়ছে শৈশবের কথা, ধোপঘাটির মাঠে ফুটবল খেলার কথা এবং খেলা শেষে বৈঁচি পাড়ার কথা, মণ্ডল বাড়ির বাতাপি লেবু বা ভাদুড়িদের বাড়ির নারকেল চুরির কথা । এক কথায় শৈশবের হাতছানি আর উপেক্ষা করতে পারছেন না রবি বাবু । কাজের মেয়ে রান্না করে যাবার সময় বলে গেল গরম গরম খাবার খেয়ে নিও, ঠাণ্ডা খাবার খেওনা, শরীরটা তোমার ভাল নেই । রবি বাবু কোন উত্তর দিলেননা। ল্যাচটা টেনে দিয়ে চলে গেল দীপা। রবি বাবু কিন্তু সেই শৈশবের দিনগুলোয় মত্ত, কোনরকম ভ্রূক্ষেপ করলেন না।
দীপা পরদিন সকালে এসে চাবি খুলে ঢুকে দেখে খাবার টেবিলে রাতের খাবার যেমনকার তেমন সাজানোই আছে। ঘরে ঢুকে দেখে রবিবাবু যেমনভাবে শুয়েছিলেন তেমন ভবেই শুয়ে আছেন, ঠোঁটের ফাঁকে একটু মুচকি হাসি কিন্তু শরীরটা যেন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশী রকম ই ঠাণ্ডা। কাকু,কাকু বলে অনেক ডাকার পরেও কোন উত্তর না পেয়ে চিৎকার করে উঠে সবাইকে ডেকে আনল। পাড়ার ডাক্তার বীরেন ভট্টাচার্য এসে পরীক্ষা করে দেখে বললেন, " নাহ্, সব শেষ । কিন্তু ছেলে মেয়ে কেউই নেই এখানে, খবর দিতে হবে দেহ সৎকারের জন্য। অতএব খবর দিতে হলো পীস হ্যাভেনে। গাড়ি এসে গেছে রবি বাবুর নিথর দেহটা নিয়ে যাওয়ার জন্য। দীপা সারাক্ষণ ই কাঁদছিল ।মুখে মৃদুহাসি নিয়ে রবি বাবু চললেন শৈশবের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে যেখানে রয়েছে নিমাই, দেবু, বাবু, মোহন, বিজয়রা ডাণ্ডা গুলি নিয়ে, রয়েছে ছোট বল পিট্টু খেলার জন্য, যেটা রবি বলবে সেটাই খেলবে কারণ আজ ওই হচ্ছে প্রধান অতিথি ।
No comments:
Post a Comment