Sunday, 22 December 2024

"লৌকিকতার পরিবর্তে আশীর্বাদ প্রার্থনীয়"

কোন কোন  লোক থাকেন যাঁরা দাদা ডাকেই খুব আনন্দ পান, তা সে ব্যক্তির বয়স যাই হোক না কেন। এইরকম ই একজন ব্যক্তি বিশুদা।আপামর জনতার বিশুদা, সে আমার বাবার ও বিশু দা, আমার ও বিশুদা, আমার ছেলের ও বিশুদা, আবার তার ছেলেও হয়তো বিশুদা ই বলবে যদি তিনি ততদিন বেঁচে থাকেন । এই সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশুদা তাঁর বিশাল দশাসই চেহারা নিয়ে নতুন বাজার যেতে যে উঁচু ধাপিওয়ালা বাড়িটা পড়ে সেখানে বসে থাকেন এবং বাজারগামী  বা বাজার করে ফিরে আসা সমস্ত লোকজন একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টা সামান্য প্রসারিত করে কোন শব্দ উচ্চারন না করেও ভাল আছেন জিজ্ঞেস করেন এবং প্রত্যুত্তরে বিশুদা ও মাথা নাড়িয়ে কোন কথা না বলেও ভাল থাকার কথা বলেন । কোন কোন সময় হাত তুলেও ভাল থাকার কথা‌ জানান । বিশুদা কে বেশিরভাগ সময়ই আদুর‌ গায়ে দেখা যায়, হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় একটা স্যান্ডো গেঞ্জি, ‌বড়জোর একটা হাতকাটা সোয়েটার বা একটা চাদর । তাঁর  ঠাণ্ডা না লাগার কারণ জিজ্ঞেস করলেই লুঙ্গির ট্যাঁকে গোঁজা একটা তামার পয়সা  বের করে দেখাতেন আর বলতেন বুঝলি পয়সার গরম কাকে বলে? প্রকাণ্ড শরীরের মালিক এই বিশুদা কোথায়  থাকেন,  কে ই বা তাঁর খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন কিছুই  জানা ছিলনা । কাজকর্মহীন বিশুদা কে দেখা যেত ফুটবলের মাঠে। কোন  বিশেষ দলের সমর্থক ছিলেন বলে মনে হয়না কারণ যে দল ভাল খেলত  তাকেই উৎসাহ  যোগাতেন।হয়তো যে  দলের সমর্থক আমি তার বিরুদ্ধে একটা গোল হয়ে গেল আমার মন খারাপ  হয়ে গেল কিন্তু পাশে বসে থাকা বিশুদা দুহাত তুলে আনন্দ প্রকাশ করলেন এবং আমার মন দ্বিগুণ খারাপ হয়ে গেলেও বিশুদার প্রতি রাগ করতে পারতামনা।শুধু আমি কেন,  কেউই রাগ  করতে পারতনা। এমনই ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা। 
খেতে খুব  ভালবাসতেন বিশুদা আর চেনা অচেনা সব লোকই তাঁকে  নিমন্ত্রণ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করতেন। বিশুদা কে নেমন্তন্ন করা মানে দশটা লোককে নেমন্তন্ন করা কিন্তু  তা সত্ত্বেও বিশুদা কে লোকে নিমন্ত্রণ করত।উপহার‌ বিশুদার একগাল হাসি সমেত আশীর্বাদ । এ ছাড়া বিশুদার কাছ থকে কেউ কোন উপহার আশা করতনা। তারাশঙ্কর দা ছিলেন একটা স্কুলের  মাস্টারমশাই । তখন স্কুলের  মাস্টারমশাইদের  মাইনে তিন চার মাস  অন্তর হতো। মাইনে পেতেই প্রায় সবটাই চলে যেত ধার শোধকরতে। তবু ও মাইনে পাবার মাসে কোন নিমন্ত্রণ হলে খুব  একটা অসুবিধা হতোনা উপহার দিতে কিন্তু সেই নেমন্তন্ন যদি মাইনে পাওয়ার প্রায় শেষ অবস্থায় পাওয়া যায় তা হলে ধার করা ছাড়া আর কোন রাস্তাই থাকেনা। এইরকম একসময়  তারাশঙ্কর দার বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে তারাদার নেমন্তন্ন হলো, সঙ্গে বিশুদার ও। আর ঐ বন্ধুই হচ্ছে তারাদার মুশকিল আসান । নানা সময় তারা দা তারই শরণাপন্ন হন টাকার দরকারে কিন্তু তাঁর ই মেয়ের বিয়েতে উপহার  দেওয়ার জন্য তাঁর ই কাছে টাকা চাইতে ভীষণ লজ্জ্বা  হচ্ছিল তারাদার। না, কিছুতেই ওর কাছে নেওয়া যাবেনা। অনেক  চিন্তা ভাবনা করে বিডিও অফিসের হেডক্লার্ক মুকুদার শরণাপন্ন হলো। মুকুদা বলল আসতে তারাদাকে তার অফিসে, যদি কোন ব্যবস্থা করাযায়  ধারের। সেদিন ছিল শনিবার শেষ দুটো পিরিয়ড ছিল কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল । আমার ও ছিল প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস । হেডমাস্টার মশাইকে বলে ম্যানেজ করে আমার ওপর দুটো ক্লাসের  ভার দিয়ে উনি তো মুকুদার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন । মুকুদার সমস্ত চেষ্টা বিফল, কারও কাছে  বাড়তি টাকা নেই  ধার দেওয়ার মতো । তারাদাও খুবই বিমর্ষ । না,বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে  কোন  উপহার  না নিয়ে কিছুতেই  যাবেনা সে। হঠাৎই  মনে পড়ে গেল  বিশুদার ও নিমন্ত্রিত হওয়ার কথা। বিডিও অফিসে অনেক লিফলেট পড়ে ছিল। উই প্ল্যান ফর প্রসপারিটি, রুরাল ডেভেলপমেন্ট,  ফাইভ ইয়ার প্ল্যান এই জাতীয় যত লিফলেট ছিল সবকটা থলি ভর্তি করে নিয়ে এল। স্টেশনারি দোকান থেকে মলাট দেবার লাল, কমলা রঙের অনেক গুলো কাগজ কিনে নিয়ে  এল।  সেলোফেন পেপার দিয়ে  ভাল করে মুড়িয়ে ঐ পুস্তিকাগুলো একটা দেখনদার গিফট প্যাক করে বিশুদার পাশাপাশি বন্ধুর মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেল। বন্ধু তারাদার হাতে সুদৃশ্য প্যাকেট  দেখে একটু আশ্চর্য ই হলো, ভাবল তারা ধারদেনা করে কেন এইরকম একটা দামী উপহার  কিনতে গেল। যাই হোক,  মুখ্য আকর্ষণ বিশুদার আশীর্বাদের পাশে অন্য যে কোন  লোকের উপহার কেমন ম্যাড়মেড়ে। তারা দা তো একেবারে লেপটে রয়েছে বিশুদার সঙ্গে । বিশালদেহী বিশুদার আশীর্বাদের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তারাদার গিফট প্যাকেট দিয়েই তারাদার খাওয়ার জায়গায় প্রস্থান বিশুদা কে নিয়ে। খাওয়া দাওয়ার পরেই যত তাড়াতাড়ি  সম্ভব বাড়ি ফিরে  আসা।
বিয়ে বাড়িতে কনের পাশে কোন বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়রা থাকে যারা কে কি উপহার  দিল তা একটা লম্বা কাগজে লিখে রাখে। মোটামুটি সব গিফটের উপহারদাতার নাম পাওয়া গেলেও  ঐ বিশেষ  প্যাকেট কে দিয়েছেন তা জানা গেল না। আর প্যাকেটটা এত মজবুত ভাবে মোড়ানো  হয়েছে  তাকে ঐ মূহুর্তে  খোলা গেলনা। পরদিন কন্যা বিদায়ের সময় অনেক  উপহারের সঙ্গে সেই মজবুত প্যাকেট ও চলে গেল । শ্বশুরবাড়িতে বিয়ের ঘনঘটা থিতিয়ে যেতেই ছুরি, কাঁচি দিয়ে সেই প্যাকেট খুলতেই পঞ্চবার্ষিকী প্ল্যান,গ্রামীন উন্নয়নের সরকারী ইস্তেহার সব ছড়িয়ে  ছিটিয়ে  পড়ল। সবাই ছিছি করতে লাগল আর মধুমিতার লজ্জ্বায়, দুঃখে কান্না পেয়ে গেল। অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে মা কে বলল এই উপহারের কথা। মা তো হাঁ করে চেয়ে রইল কিছুই আঁচ করতেই পারলনা কিন্ত ওর বাবা অর্থাৎ  তারাদার বন্ধু কিন্তু বুঝতে পেরেছে যে এটা তারার কাজ। বিয়ের  পর বেশ কিছুদিন  কেটে গেছে । তারাদার মাইনে হয়েছে এবং  ধার শোধের পালা। বন্ধুর  কাছে  এসেছে টাকা ফেরত দিতে  কিন্তু  বন্ধু বলল, " তারা, পঞ্চাশ টাকা  বাড়তি দিবি এবার।" হকচকিয়ে গেল তারা দা। " কেন রে পঞ্চাশ টাকা বাড়তি কেন, তুই কি আজকাল  সুদের  ব্যবসা করছিস না কি?"
"না, সুদের  ব্যবসা নয়, তিরিশ টাকা  মেয়ের  বিয়ের  উপহার  আর কুড়িটাকা মেয়ের  শ্বশুরবাড়িতে  আমার সম্মান  নষ্ট করার জন্য।"
তারা দা যত ই অনুনয় বিনয় করে কিন্তু বন্ধু অনড় এই পেনাল্টিতে । "তোর কাছে টাকা ছিলনা তো তুই  এইসব ছাইপাঁশ এখানে আনলি কেন?"
তারা দা বলল, " দেখ , সবসময়ই টাকা তোর কাছেই নিই কিন্তু  তোর  মেয়ের  বিয়েতে  উপহারের জন্য তোর কাছে  টাকা নেওয়া  কি উচিত? "
" তোকে উপহার দিতেই হবে, এমন কোন  বাধ্যবাধকতা তো নেই ঐ তো বিশুদার মতন তুই ও আশীর্বাদ করতে পারতিস।"
 যাই হোক তারাদাকে বড্ড লজ্জায় ফেলে দিল তার বন্ধু। 
পরে আর কোনদিন  তারা দা ঐ বন্ধুর কাছে টাকা  ধার নিয়েছিল কিনা জানা যায়নি।

No comments:

Post a Comment