দুপুর বেলায় খাওয়া দাওয়া সেরে এয়ারপোর্ট পৌঁছলাম । এসে গেল হুইল চেয়ার । একটু বেচারা বেচারা মুখ করে চেয়ারে বসতেই একটা লজ্জ্বা চারদিক থেকে ঘিরে এল। দিব্যি হেঁটে চলে হিল্লি দিল্লি করে বেড়াচ্ছি অথচ এয়ারপোর্টে এসেই যেন ঠুঁটো জগন্নাথ । তবু চেষ্টা করি এই হুইল চেয়ার বাহকদের কষ্টটা একটু প্রশমিত করার তাদের পকেটে কিছু গুঁজে দিয়ে একটু লোকচোখের নজর এড়িয়ে কারণ এদের কর্মকর্তাদের নজরে এলে এদের চাকরি চলে যেতে পারে। আমরা অনেক সময়েই অনেক ভুল কাজ জেনে শুনেই করি। এর বদলে যদি এয়ারলাইন্স আমাদের কাছ থেকে এই সেবার জন্য কিছু মূল্য ধার্য করে তাহলে এই মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে হয়না। যাই হোক, সিকিউরিটি চেক হয়ে যাওয়ার পর বোর্ডিং ও হয়ে গেছে, এয়ারোব্রিজ দিয়ে তারা এদিক ওদিক করে প্লেনে ঢোকার আগে বেল্ট বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে বসে আছি কিন্তু প্রতীক্ষার অবসান আর হয়না। প্রায় ঘন্টাখানেক ঐ অবস্থায় থাকার পর জানা গেল যে যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য প্লেন ছাড়তে দেরী হবে । বেচারা হুইল চেয়ার বাহকদের আরও দুর্ভোগ বাড়ল, ফের আশি কেজির এই শরীরটাকে টেনে নিয়ে আবার এক তলায় নিয়ে এল, ফের নতুন করে আবার সিকিউরিটি চেক আর এর ই মাঝে যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে নেওয়া। দুটো ঘন্টা কেমন করে যে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।কিন্তু যাদের যাওয়ার তাড়া আছে তারা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে কারণ তাদের তো অনেক কিছু সামলাতে হবে, সবাই তো আমাদের মতো বেকার নয়। যাই হোক, এয়ারোব্রিজ থেকে মুক্তি পেয়ে রানওয়েতে এসেও আবার অপেক্ষা এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের ক্লিয়ারেন্সের জন্য। এরপর আস্তে আস্তে গড়াতে শুরু কথায় বুঝতে পারলাম যে নির্দেশ এসে গেছে।
এতক্ষণ যারা হৈচৈ করছিল প্লেন ঠিক সময়ে না ছাড়ার জন্য তারাই বেশ কলরবে মেতে উঠল নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় । কোন কোন সময়ে ডেসিবেল একটু বেশি ই হয়ে যাচ্ছিল । আমাদের দুজনের টিকিট এক জায়গায় হয়নি, পাশে একজন অল্প বয়সী মেয়ে মোবাইলে ভিডিও দেখেই চলেছে আর মাঝে মাঝেই নিজের মনে খিলখিলিয়ে হাসছে। পিছনে একটা যুগল(বন্ধু ও হতে পরে বা সদ্য প্রেমে পড়া ছেলেমেয়েও হতে পারে) যেখানে ছেলেটি হিন্দি, ইংরেজিতে মিশিয়ে প্রচণ্ডভাবে ইম্প্রেস করে চলেছে। খারাপ লাগছিল না বিশেষ করে স্ত্রী পাশে না থাকায় ধমক খাওয়ার ভয় ই ছিলনা। সুতরাং লোকজনের কথাবার্তাতেই নিজেকে খুশী রাখার চেষ্টা করছিলাম । সামনের সারিতে এক মুসলিম পরিবার কিন্তু তাদের তিনজনের সিট ও একসাথে হয়নি। কি বেআক্কেলে এয়ারলাইন্সের লোকজন । বাচ্চাটা জানলার ধারে ছাড়া বসবেই না।অল্প বয়সী স্ত্রীর পাশে অন্যান্য লোক বসে থাকবে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বেচারা। 'আইল' সিটে বসে থাকা ভদ্রলোক বেশ জুত করে বসে সীটবেল্ট বেঁধে ফেলেছেন আর অল্প বয়সী স্বামী তাকে কাতর অনুনয় বিনয় করে চলেছে সীট বদলানোর জন্য । কিন্তু লোকটার মন ভিজল না। অগত্যা বাধ্য হয়েই জানলার ধারে বসে থাকা সীটে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে উদাসী দৃষ্টিতে পেঁজা তুলোর মতন ভেসে থাকা মেঘের দিকে মনমরা হয়ে তাকিয়ে থাকল। সে আবার আমার ই সারির জানলাতে থাকায় তাকে দেখে একটু কষ্ট ই লাগছিল। পাষাণ হৃদয় লোকটার মন কিন্তু বিন্দুমাত্র টলল না । আমার ও অবস্থা বিশেষ সুবিধার নয়। কিন্তু আমার বয়স হয়েছে এবং এইরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা মাঝে মাঝেই আমাকে করতে হয়েছে । কিন্তু খিদেটা বেশ চাগিয়ে উঠেছে আর খাবারগুলো সব তার কাছে থাকা ব্যাগে, সুতরাং, আমার অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। মাথাটা তার বেশ বড়সড় এবং দাড়ি নিয়ে সমস্ত জানলাটা প্রায় বন্ধ ই হয়ে গেছে। সেই কারণে আমার দিকের ডান দিকের জানলা দিয়ে যতটা দেখা সম্ভব তাই দেখেই মনের স্বাদ মেটাচ্ছি। প্লেন চলেছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, অন্ধকার তাড়া করে চলেছে আলোকে কখন ধরবে বলে। মনে হচ্ছে অ্যানিম্যাল কিংডমে চিতা তাড়া করছে হরিণের পিছনে আর হরিণ প্রাণভয়ে ছুটে চলেছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। দৃশ্য অপূর্ব কিন্ত দেখার বিষয়ে কখন চিতা হরিণকে ধরে। অবশেষে দৌড়ের সমাপ্তি, লাফিয়ে পড়ে অন্ধকার ধরে ফেলল ক্লান্ত আলোর শিখাকে। আমাদের চারপাশে এত সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে আছে আমরা তার দিকে না তাকিয়ে সামান্য বিষয়ে নিয়েই তুলকালাম করি। প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ প্লেনের চাকা মাটিতে আলতোভাবে চুমু খাওয়ার জায়গায় সিনেমার ভিলেনের মতো নায়িকার সঙ্গে জবরদস্তি করার মতো ল্যাণ্ড করল এবং প্রমাণ করল ক্যাপ্টেনের অনভিজ্ঞতা। উবের বুক করে গেস্ট হাউস পৌঁছতে প্রায় নটা বেজে গেল। খাওয়া দাওয়া সারতে বেজে গেল দশটা।কাল গাড়িতে আসবে ছেলে বৌমারা।পাঁচ শ কিলোমিটারের কিছু বেশী রাস্তা আসতে দশ ঘন্টা তো লাগবেই, এ ছাড়া রয়েছে ট্র্যাফিক জ্যাম, কতক্ষণে এসে পৌঁছাতে পারে নির্ভর করছে কত তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরোতে পারে তার উপর।
আমেদাবাদ শহরটা খুব অপরিচিত নয়। তবে যে ভাবে শহরটা দৈর্ঘে প্রস্থে বেড়েছে এবং দেশের দুই শীর্ষস্থানীয় নেতার বাসস্থান হবার কারণে সৌন্দর্য্য আরও ত্বরান্বিত হয়েছে । ওদের না আসা পর্যন্ত আমাদের আর কোন কাজ নেই, এদিক ওদিক ঘোরা ছাড়া। চারদিকে ফ্লাইওভারের ছড়াছড়ি, চেনা শহরটাও যেন বিদ্রূপ করে বলছে আমি কে বল তো? সত্যিই তো ,চিনতে পারছিনা । তবে ভাগ্য ভাল উবেরের কল্যাণে গাঁঠগচ্ছা বেশী গেলনা। আগে শহর কে দুইভাগে ভাগ করা সাবরমতী নদী ছিল শীর্ণকায়, এখানে সেখানে ইতস্ততঃ জলরাশি নদীর বুকে জমে থাকা পাথরে ধাক্কা খেয়ে ছোট ছোট তরঙ্গ সৃষ্টি করছে এটা চোখে পড়ত। কিন্তু দুই পাড়েই বেশ খানিকটা জায়গা ভরাট করে সেখানে হয়েছে রিভার ফ্রন্ট এবং নানারকম আলোয় সজ্জিত হয়ে এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন বয়সী লোকজন এসে পার্কে বসে আছে এবং আলোকমালার সৌন্দর্য্য উপভোগ করছে। দেখে ভাল লাগল যে এতকর্মব্যস্ততার মধ্যেও লোকজন একটু সময় বের করে নিতে পেরেছে । হারিয়ে যাওয়া যৌবনের কথা মনে পড়ল যে শেষ কবে সবাই একসঙ্গে এসে এইভাবে আনন্দ উপভোগ করেছি। কাজ, কাজ আর কাজ। কাজের মধ্যেই হারিয়ে গেছে যৌবন, চোখের জ্যোতি কমেছে, দাঁতের ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে তাকে বিদায় জানাতে হয়েছে, পাক ধরা চুলে কলপ লাগিয়ে নিজের বয়স কমানোর চেষ্টা হয়তো হয়েছে কিন্তু চটপটে ভাবটা তো বয়সের সঙ্গে ব্যস্তানুপাতি, তা যেন ভয়ানক ভাবে কমে গেছে। মনটাই কেমন যেন বুড়িয়ে গেছে। কর্মজীবন এবং পারিবারিক জীবনের মধ্যে একটা ব্যালেন্স যারা রাখতে পারেনা তাদের ই এই দশা হয়। যাই হোক ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে ব্যথা আনন্দের এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। এক সময় মন যখন ছিল চাঙ্গা তখন কর্মব্যস্ততায় জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে পারিনি আর আজ যখন অখণ্ড অবসর তখন শরীর ও মন বিদ্রোহ করে।
প্রায় এগারটা বেজে গেল গাড়ী এসে থামল গেস্ট হাউসের সামনে । ওদের ঘর ঠিক করাই ছিল । রাস্তায় খেয়ে নেওয়ায় ঐ হাঙ্গামা হলো না। অল্পবিস্তর কথার মাঝে জানতে পারলাম যে নাতনির পা মচকে গেছে এবং নাতির ও গায়ে বেশ জ্বর। সঙ্গে থাকা ওষুধ দেওয়া হলো কিন্তু মানসিকভাবে একটু ধাক্কা খেলাম, আদৌ যাওয়া হবে তো? ছেলে বৌমার জন্য খারাপ লাগছিল, ওদের ও সেই আমাদের মতন দুর্ভাগ্য দেখে। দেখা যাক, কি হয় আগামী কাল । পরদিন ভোর বেলায় উঠে স্নান করে তৈরী হয়ে আছি। সামনের জৈন মন্দিরে এক বিবাহ সম্পন্ন হচ্ছে। মন্দির দর্শন এবং বিবাহ দর্শন, রথ দেখা কলা বেচা দুইই হলো। ফিরে এসে দেখি তখনও ঘুম ভাঙেনি ওদের। দরজায় টোকা দিয়ে জানতে পারলাম যে নাতির জ্বর বা নাতনির পায়ের ব্যথার উপশম হয়নি। সুতরাং, মাউন্ট আবু যাওয়া আপাতত হচ্ছেনা। আমাদের কষ্ট এতটা হলোনা যতটা আমার বৌমার বা বাচ্চাদের হলো ।আমি নিজের শরীর সম্বন্ধেও যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম । কিন্তু দুঃখ যে একেবারেই হয়নি তা নয়, কারণ প্রজাপিতা ব্রহ্মকুমারীর ওই মেডিটেশন হলটা আমাকে বারবার কেমন যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। কোনরকম রিস্ক না নিয়ে আমার পুরনো শহরটাকেই নতুন ভাবে দেখলাম এবং বাচ্চারাও যথাসম্ভব গাড়ি থেকে না নেমে শহরটাকে দেখল। দুপুরের খাওয়া স্যাটিলাইটে অবস্থিত নৈবেদ্যম রেস্তোরাঁয় সেরে গেস্ট হাউসে ফিরে আসা এবং পরদিন সকাল বেলায় বম্বের উদ্দেশ্যে যাত্রা ।
ঠিক কথাই যে মাউন্ট আবু যাওয়া হলো না কিন্তু ছেলে, বৌমা, নাতি,নাতনিদের সঙ্গে একসাথে সময় কাটানো তো আজকাল এক দুর্লভ ব্যাপার।
No comments:
Post a Comment