Thursday, 5 June 2025

পোষ্য

অনেক দূরের পাড়ি, সুতরাং গোটা তিনেক বাস ছেড়ে জানলার ধারে একটা সিট নিয়ে বসে আছি । বাস টার্মিনাসের পাশেই এক অনুষ্ঠান বাড়ি যা সব সময়ই ভর্তি থাকে কারণ বাড়িটার অবস্থান। আগের দিন রাতেই একটা বড়মাপের অনুষ্ঠান  হয়ে গেছে। অনেক বাড়তি উচ্ছিষ্ট খাবার পাশের ভ্যাটে পড়েছে যেখান থেকে ফুটপাতে থাকা কিছু  গরীব মানুষ এবং রাস্তার একদল কুকুর প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কতটা খাবার জোগাড় করতে পারে । মানুষগুলো মাঝে মাঝেই  রাস্তায় পড়ে থাকা ইঁট কুড়িয়ে কুকুরগুলোর দিকে তাক করছে এবং  এরই মধ্যে কুকুরগুলোও কিছু কিছু খাবার নিয়ে  পালাচ্ছে এবং নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করছে। মানুষ এবং কুকুরের প্রতিযোগীতা দেখতে দেখতেই সময়টা কেটে যাচ্ছে কিন্তু বাস ছাড়তে এখনও বেশ খানিকটা দেরী আছে। হঠাৎই জানলার উল্টোদিকে একটা সুন্দর ল্যাব্রাডর কুকুরের দিকে চোখ পড়ল। কুকুরটা আমার ই মতো সেই খাবার কাড়াকাড়ি দেখছে একদৃষ্টে কিন্তু কোথায়  যেন তার সম্মানে বাধছে সেই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে । দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু কিছুতেই সে ঐদিকে যাচ্ছেনা । অথচ গেলেই ওর চেহারা দেখে কি মানুষ বা কি কুকুরের দল ভয়ে পালাবে। কিন্তু সে ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত। একদিকে তার খিদে আর অন্যদিকে তার সম্মান । 
ভাবতে চেষ্টা করলাম  এইরকম সুন্দর একটা কুকুরকে কে ছেড়ে যেতে পারে?  কিছু লোক আছে যারা বাড়িতে দারুণ একটা কুকুর  পুষবে এবং তাদের নাম ও কোন ছেলের বা মেয়ের নামে রাখবে কুকুরের লিঙ্গ অনুসারে। বাইরের  কোনও লোক তাকে কুকুর বললে তারা খুব রাগ করে এবং তাকে তখন নিজের ছেলে বা মেয়ে বলে মনে করে।  ভালবাসা তো সত্যিই ভাল জিনিস । হৃদয়ের কোমল দিক থাকা তো সত্যিই প্রশংসনীয় কিন্তু কুকুরটা যখন বুড়ো হয়ে যাবে বা নিজেরা যখন বদলি হয়ে যাবে অন্যত্র তখন পোষ্যকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে তাকে তার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া এক ভীষণ অমানবিক কাজ। অনেক লোকই আছেন যাঁরা  পোষ্যকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যান বা তাঁর ঘনিষ্ট কোনও বন্ধুর কাছে জিম্মা করে দিয়ে যান। এতে তাঁদের মনেও একটা শান্তি থাকে এবং পোষ্য ও ভাল থাকে। 
যাই হোক,  কুকুরটার ঐ অবস্থা দেখে এক প্যাকেট বিস্কুট  কিনে দুটো বিস্কুট দূর থেকে  ছুঁড়ে দিলাম কারণ বেশ ভয় লাগছিল  ঐ বড়সড় কুকুরটাকে দেখে। কিন্তু কুকুরটা একবার বিস্কুটের দিকে তাকিয়ে  মুখটা ফিরিয়ে  নিল কারণ খিদে লাগলেও সে অভ্যস্ত নয়  এরকমভাবে খেতে। মনে একটু সাহস সঞ্চয়  করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে, বিস্কুটের প্যাকেট থেকে  একটা বের করে ওর মুখে দিলাম , ও আমার দিকে  একবার তাকালো, কি মনে হলো ওর যেন ওর পুরনো মনিব ই ওকে খেতে দিচ্ছে। একদৃষ্টে চেয়ে রইল আমার পানে, লক্ষ্য  করলাম ওর চোখের কোণে একটু জল।সন্দেহ করছে যে আমার মনিবের চেহারাটা কেমন করে এতটা বদলে গেল । অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে করে আমার হাত থেকে বিস্কুট সে নিয়ে চিবোতে লাগল। আমিও সাহস পেয়ে প্যাকেট থেকে একটা একটা করে বিস্কুট নিয়ে ওকে খাওয়াতে থাকলাম আর ও ধীরে ধীরে লেজ নাড়াতে নাড়াতে খেতে থাকল। ইতিমধ্যে বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেল বুঝতে পারলাম কণ্ডাক্টরের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে উঠতে দেখে। মাথায় বার বার করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বাসে উঠলাম । জানলা দিয়ে দেখি সে আবার ও তার মনিবকে হারিয়ে ফেলল ভেবে অপলক দৃষ্টিতে অপসৃয়মান বাসের দিকে চেয়ে আছে। মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল । ফিরে আসলাম কয়েকদিন পরে এবং  ফিরে এসে খুঁজতে থাকলাম সেই সুন্দর ল্যাব্রাডর কুকুরটাকে কিন্তু কেউ কোন হদিস দিতে পারল না। কোথায় যে উধাও হয়ে গেল কেউ জানেনা ।

Monday, 2 June 2025

শুধু যাওয়া আসা

ব্যস্ত শহরে প্রায় সব পরিবারের চেহারাই মোটামুটি এক। ছিমছাম সংসার স্বামী, স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ভরপূর। স্বামী এবং  স্ত্রী দুজনের ই বাবা ও মা জীবিত, সুতরাং বাচ্চারা দুই তরফের দাদু, দিদিমা ও ঠাকুর্দা, ঠাকুমার সাহচর্য পায় এবং বাচ্চারা ছুটির সময় আনন্দে  টইটুম্বুর। একই শহরে হলে কিছুদিন এবাড়ি আর কিছুদিন ও বাড়ি আর ভিন্ন শহরে হলে গরমের ছুটি এখানে তো ক্রিসমাসে অন্যখানে। মাঝে মাঝে  দুইপক্ষের দাদু, দিদাদের নিয়ে ছুটি কাটানো। কিন্তু এটা একটা আদর্শ কল্পনায় ভরপূর চিত্র। বেশীরভাগ সময়ই এই ছবি অনুপস্থিত  বিভিন্ন কারণে। যাক ঐসব নিয়ে অন্য কোন সময়‌ আলোচনা করা যাবে।
বড় শহরে স্বামী, স্ত্রী দুজনকেই চাকরি করতে হয় আজকাল  সংসারে  সচ্ছলতা বজায় রাখতে । আগের দিনের মতো একেবারে নিপাট গৃহকর্ত্রী পাওয়া খুবই মুশকিল । তবে একেবারে  যে অমিল তা নয়। হয় স্বামীর বিরাট ব্যবসা কিংবা স্বামী খুবই নামজাদা ডাক্তার বা উকিল,  সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে চাকরি নাও করতে হতে পারে তবে সেখানে স্ত্রীরা নানারকম সামাজিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন যার নীট ফল বাচ্চারা মানুষ  হচ্ছে কাজের লোক বা একটু গম্ভীর ভাবে বললে বলতে হয় ন্যানির কাছে। যে যেরকম ওজনদার লোক তাদের ন্যানিরাও সেইরকম ই ওজনদার ।
বিভিন্ন ধরণের সংস্থা রয়েছেন যারা  এই কাজের লোক ( আয়া) বা ন্যানি সরবরাহ করে এবং  বহু লোক সাধারণ ভাবে  বা রিটায়ার করার  পরে এই রমরমা ব্যবসার সঙ্গে  যুক্ত । এখানে বিনিয়োগ সাঙ্ঘাতিক কিছু বেশী নয় তবে পরিচিতি এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ । যার পরিচিতির ব্যাপ্তি যত বেশী সে তত ভালভাবে  ব্যবসা করবে। আর একবার এই বাজারে ঢুকলে তার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে বাধ্য।  এদের একটা ডেটা বেস তৈরী করতে হয় কারণ বিভিন্ন লোকের চাহিদা বিভিন্ন রকম। শুধু বড় শহর ই নয় সব জায়গায়ই এই ব্যবসা এখন রমরমিয়ে চলছে। ছোট শহরে রোজগারের পরিমাণ কম আর বড় শহরে সরকারী  চাকরির  চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাদের মাসে চারদিন ছুটি, খাওয়া দাওয়া সমেত একমাসের বোনাস। যদি সে অন্য  শহর থেকে  আসা লোক হয়ে তবে তাকে বছরে  এক বার/ দুবার ছুটি এবং  যাতায়াত বাবদ এসিতে বাড়ি যাওয়া আসার খরচ দিতে হবে। মফস্বল বা ছোট শহরে আগে যেমন ঠিকে কাজের লোক থাকত এখনও  তা আছে তবে তারা চারটে পাঁচটা বাড়িতে কাজ করে যে পরিমাণ টাকা রোজগার করে তা সিভিক ভলান্টিয়াররাও পায়না। সিভিক ভলান্টিয়ারদের পনের ঘন্টা ষোল ঘন্টা কাজ করার পর তাদের ঊর্ধতন কর্মচারীদের গালমন্দ ও শুনতে হয় এবং  বিনিময়ে তারা পায় মাত্র নয়  হাজার টাকা। সুতরাং,  তারা সুযোগ  পেলেই যে চুরি করবে তাতে আর আশ্চর্য কি?  যারা আবার একটু চালাক চতুর তারা তাদের ওপরয়ালার হয়ে টাকা সংগ্রহ করে এবং সেখান থেকে  একটা ভাল টাকা ভাগ হিসেবে পেয়ে থাকে। আর ভদ্রবেশী ওপর ওয়ালা  সামনে সুন্দর  মুখোশ পড়ে ঐ সিভিক ভলান্টিয়ারকে পিছনে লেলিয়ে দিয়ে সেখান থেকে  দাঁও মারে। কিন্তু ঠিকে কাজের লোকেরা মোটামুটি  সাত আট ঘন্টা কাজ করে পনের  বিশ হাজার টাকা কামিয়ে নেয় । আসা যাওয়ার জন্য‌ বিনে পয়সার ট্রেন এবং যেসমস্ত বাড়িতে কাজকর্ম করছে সেখানে চা, জলখাবার ও দিনের  খাওয়া হয়ে যায়। এছাড়া সরকারী  অনুদান তো আছেই । বড় শহরে আয়া সেন্টার রা বারঘন্টা বা চব্বিশ ঘন্টার লোক সরবরাহ করে এবং তাদের সাম্মানিক মূল্য একমাসের টাকা। আগে গ্রামের লোক গ্রামের  বাইরে প্রায়‌ আসতো ই না কিন্তু যানবাহনের সুযোগ বৃদ্ধি ঘটায় তাদের কাজের সন্ধানে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে এবং প্রত্যেক  মানুষ ই চায় তাদের শ্রী বৃদ্ধি  হোক। চাকুরীরত স্বামী স্ত্রীদের ও লোকজন ছাড়া চলবে না কারণ তাদের বাচ্চা না সামলালে তারা দুজনেই  কাজে বেরোতে পারবেন না আর এই কাজের লোকেরা রোজগার করে তাদের ছেলেমেয়েদের ভাল খাওয়া দাওয়া এবং শিক্ষার  ব্যবস্থা করতে পারছে আর মাঝখানে এই আয়া সেন্টারের পরিচালকরা দুইপক্ষের  যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়ে টাকা রোজগার করছে অনেকটা উবের, ওলা বা এয়ার বি এন বির মতো।
এখন এই বাচ্চাগুলোর কি অবস্থা সেটা একটু দেখা যাক। এই কাজের লোক বা ন্যানিরা কাজ না পোষালে চলে যাচ্ছে এবং  আয়া সরবরাহকারী সংস্থারা অন্য  ন্যানিকে দিচ্ছে এবং  নতুন  ন্যানির সঙ্গে একটু মেলবন্ধন হতে না হতেই পুরনো ন্যানি আবার উপস্থিত কারণ নতুন  জায়গায় ডাল না গলায় তিনি আবার  পুরনো জায়গায়  ফিরে এসেছেন এবং  বাচ্চাটাও পুরনো ন্যানিকে ফিরে পেয়ে স্বাভাবিক  হয়েছে  কিন্তু নতুন ন্যানির দোষ টা কি? কিছুই নয়, কারণ যে কোন লোক  নতুন  জায়গায়  এসে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময়ই নেবেই কিন্তু না বাচ্চার মা না বাচ্চাটি সেই সময় দিতে রাজী নয়। অতএব  তাকে চোখের  জল নিয়ে বিদায় নিতে ই হবে যদিও তার সেরকম দোষ হয়তো  নাই। তাকে ছলছলে চোখ নিয়েই বিদায় নিতে হবে কারণ তার  সবচেয়ে  বড় শত্রু সময়।

Thursday, 29 May 2025

তারা রা আজ কোথায় গেল

ছোট বেলায় সূর্য অস্ত যেতে না যেতেই অন্ধকার এসে গ্রাস করত পৃথিবীকে আর নীল আকাশে একটা একটা করে হঠাৎ লক্ষ লক্ষ তারা আকাশটাকে ভরিয়ে দিত তাদের ঝিকিমিকি আলো দিয়ে। কৃষ্ণ পক্ষে চাঁদ যখন ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশে ব্যস্ত তখন পৃথিবীর নিকষ কালো অন্ধকার মহিমাণ্বিত হয়ে উঠত এই ছোট ছোট  তারাদের ঝিকিমিকি আলোতে।  খানিকক্ষণের মধ্যেই গোটা আকাশ জুড়ে তারাদের ভিড়, একদৃষ্টে চেয়ে দেখতাম সপ্তর্ষি মণ্ডল, কালপুরুষ ও ধ্রুবতারা এবং অন্ধকার আকাশের অপূর্ব রূপ । বড়মা বলতেন দাদুও আমাদের ছেড়ে তারাদের মধ্যে মিশে  গেছেন । খুঁজতাম দাদুকে ঐ তারাদের ভিড়ে। কখনো মনে হতো এই তারাটাই আমার দাদু,  আমাকে দেখে হাসছেন আর বলছেন বড় হয়ে ভাল করে পড়াশোনা করলে আমিও একদিন দাদুর মতো তারা  হয়ে যাব। খুব আনন্দ হতো দাদুর কাছে  যেতে পারব বলে কারণ দাদু ই তো আমার সঙ্গে খেলতেন আর বলতেন,"ছুটকু আমার সিগারটা নিয়ে আয় তো।" ঐ মোটা সিগার লাইটার জ্বালিয়ে ধরিয়ে সুখটান দিয়েই মিলটনের লিসিডাস বা শেক্সপিয়ারের কোন অংশ আবৃত্তি করতেন। দাদু ছিলেন আমার আইডল এবং খেলার সাথি । সেইদাদু চলে যাওয়ার পর আমাকে বলা হলো দাদু আকাশের তারাদের মধ্যে মিশে গেছেন এবং আমিও তা কখনোই অবিশ্বাস করিনি। স্কুলে স্যারেরা বলতেন উপগ্রহের আলো স্থির আর তারাদের ঝিকিমিকি আর এটাই তাদের পার্থক্য চেনার জন্য‌ । সময়‌ গড়িয়েছে , আমরাও বড় হয়ে জীবনের উপান্তে এসে গেছি,  বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে, জীবন যাপন ও অনেক সহজ হয়েছে, আমাদের কষ্ট করার ক্ষমতাও অনেক কমে গেছে এবং ব্যস্ততার মধ্যে প্রকৃতির সেই অপূর্ব রূপ দেখার চোখ  ও আমরা হারিয়ে ফেলেছি এবং প্রকৃতিও যেন কেমন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে । 
আমরা সাজি অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। গ্রামের মেয়ের সাজ একরকম, শহরের তা থেকে অনেক আলাদা। অবশ্য বিশ্বায়নের দৌলতে গ্রামের মেয়েরাও আর পিছিয়ে নেই, এমন কি কোন কোন সময় তারা শহরের মেয়েদের ও হার মানিয়ে দেয়। শুক্লপক্ষে চাঁদ ধীরে ধীরে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় এবং  সারা আকাশ একটা অপূর্ব স্নিগ্ধতায় ভরে যায় এবং ঝলমলে আকাশ চাঁদের আলোয় মন ভরিয়ে দেয় কিন্তু  পরদিন ই চাঁদের ম্লান রূপ দেখে মনটা একটু বিষণ্ণ হলেও তার রূপ ও ভোলার নয়। রঙটা একটু চাপা কিন্তু তার গরিমা এতটুকুও কম নয় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধেই কি লিখেছিলেন, " কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের  লোক, মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে, কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ।" কালো মেয়ের কালো রূপ ও যে অসাধারণ হতে পারে তা তাঁর কবিতায় ও গানে প্রকাশ হয়েছে । আদিবাসীদের মধ্যেও কালো ছেলেমেয়েদের চুল, দাঁত ও চোখ দারুণ সুন্দর দেখা যায়।। সুতরাং,  এই ছেলেমেয়েদের মতোই কৃষ্ণপক্ষের আকাশভরা সূর্য তারার রূপ কিসে কম? শুধু দেখবার মতো চোখ চাই।
কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়নের ও অগ্রগতি হয়েছে  আর প্রকৃতিও হারিয়েছে তার নিজস্ব সত্ত্বা ও রূপ। সন্ধে হলেই আগে যেমন আকাশে ফুটে উঠত তারার মেলা, এখন তা আর দেখা যায়না দূষণের জন্য । এই দূষণ ছড়িয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামেও, সেখানেও আর তারারা দূষণের স্তর ভেদ করে প্রকাশ হয়না যেমন আগের দিনের প্রতিভাবান ব্যক্তিরা ( কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবিরা)  সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন কিন্তু বর্তমানে অন্যায়টাই যখন ন্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে  তখন এই তথাকথিত পণ্ডিত বা বুদ্ধিজীবিরা প্রতিবাদে মুখর হন না। তাঁরাও আজ তারাদের মতোই লুকিয়ে পড়েছেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ স্বরূপ নাইটহুড খেতাব ত্যাগ করেছিলেন, আজকের পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাঁদের  ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধে উঠে একটুও কি  প্রতিবাদ মুখর হতে পারেননা? তাঁরাও কি সেই সপ্তর্ষি মণ্ডল, ধ্রুবতারা  বা কালপুরুষ,  নীহারিকাদের মতন হারিয়ে যাবেন ? 

বৃষ্টিস্নাত মধ্যাহ্নে পাখিদের কলতান

মাঝে মাঝেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে আর রাস্তাটা একটু শুকনো হতে না হতেই আবার ভিজিয়ে দিচ্ছে। আকাশ মুখ ভার করে রয়েছে সবসময়ই কিন্তু এর ফাঁকেই যেই না রোদের ঝলক দেখা দিচ্ছে অমনি পাখিগুলো এসে খেতে চাইছে। ওরা রোজ ই আসে খাবার খেতে এবং ওদের আসার সময় ও ভিন্ন । সাতসকালেই পায়রা আসবে ছোলা খেতে এবং এক প্রস্থ খাওয়া হয়ে গেলেও কাকেরা যখন আসে বিস্কুট খেতে  তখন ও তারা আসবে এবং কাকগুলোকে রীতিমতো সুমো কুস্তিগিরের মতো তেড়ে গিয়ে তাড়িয়ে দিয়ে বিস্কুট খেয়ে নেবে। কাকের অত বড় ঠোঁট থাকা সত্ত্বেও কেন জানিনা ওরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। শালিক যেন চশমা পড়া পণ্ডিত মশাই কিন্তু ঝগড়া করার সময় ওর কাছাকাছি কেউ আসতে পারেনা। বুলবুলিরা আসে এবং ডাকতে যখন থাকে তখন  যেন মনে হয় পায়ে ঝুমুর বেঁধে কেউ আসছে। কাঠঠোকরা মাঝে মধ্যে আসে এবং পড়ে থাকা বিস্কুটের গুঁড়োগুলো যখন খায় তখন তার সারা শরীরটা কার্নিশের নীচে ঝুলতে থাকে এবং তার ঝুঁটিওলা মাথা দেখে বোঝা যায় যে তারা এসেছে এবং  সুন্দরভাবে গুঁড়োবিস্কুটগুলো খেয়ে নিয়ে তির তির তির তির  করে ডাকতে ডাকতে উড়ে যায়। সাদা কালোয় মনোমুগ্ধকর গাঙ শালিকের দেখাও মাঝে মাঝে মেলে যারা আসে খাবার খেতে কিংবা জল খেতে। আসে ধূসর রঙের ডানায় সবুজ সবুজের ছিটেওলা ঘুঘু যার চোখ দুটো পায়রার চেয়ে ছোট কিন্তু তাদের মতোই গোল গোল চোখ নিয়ে  কিন্তু তারা প্লাস্টিকের ছোট গামলায় রাখা জল খেতে পারেনা, তারা টবের নীচে রাখা চ্যাপ্টা থালার মধ্যে রাখা  জল যায়। অনেকে বলে ঘুঘু আসা নাকি খুব অলক্ষুণে কিন্তু আমার কিন্তু খুব ভাল লাগে ওরা এলে। আসে ছাতারে পাখি, অনেকটা চড়াই পাখির মতো কিন্তু আকারে বড়, দল বেঁধে এবং কর্কশ গলায় হৈচৈ করে খেয়েদেয়ে জল খেয়ে চলে যায়। চড়াই পাখি ভীষণ ভীতু এবং লাজুক, চোখাচোখি হলেই ফুরুৎ করে পালায়। হলুদ শরীরে বাদামী ডানার বসন্তবাউড়ি বা বসন্তবাহারি আসে শীতে কিন্তু অন্য সময়ে যে কোথায় তারা থাকে তার দিশে পাইনে।
বৃষ্টি এখন ধরেছে। রোদ না উঠলেও আলোর আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । কাকগুলো ভিজে একশা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই ডানা ঝেড়ে জলটা ফেলে শরীর শুকানোর চেষ্টা করছে। হঠাৎই কা কা শব্দে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক কাক একটা এমার্জেন্সি মিটিং করতে পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশের উপর বসল এবং মিনিট পাঁচেক পরেই কি সিদ্ধান্ত হলো কে জানে আবার যে যেখান থেকে  এসেছিল ফিরে গেল। একটু দূরে সেগুন গাছের মগডালে একটা খুবই সরু ডালের উপর ছোট্ট একটা কালো পাখি কিন্তু গলার আওয়াজ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ  ডেকে চলেছে  চুঁ চুঁ চুঁ-----চুঁ উ চুঁ। কি যে বার্তা তার বুঝে উঠতে পারিনা। এই পাখিটার ডাক ই শুনতে পাই রাত্রি দুটো আড়াইটায়। এত যে কি কাজের তাড়া বুঝিনা কিন্তু সর্বপ্রথম এই সবাইকে সচকিত করে দেয় ভোর হয়েছে, উঠে পড়।
পার্কের বাদামগাছের পাতাগুলো হয়েছে ঘন সবুজ, আঁশফলের গাছেও এসেছে ফল, কাঁঠাল গাছে আসা এঁচোড় পেড়ে নেওয়া হয়েছে চোরের উপদ্রবে। সেই  তুলনায় সেগুন গাছের  পাতাগুলো এখনও হাল্কা সবুজ রয়েছে । এই সেগুন গাছের একটা বিশেষত্ব রয়েছে যে নীচের দিকের পাতাগুলো  বেজায়  বড় কিন্তু উপরের দিকে পাতাগুলো  ধীরে ধীরে ছোট হয়ে গেছে। একটু দূরে রাধাচূড়া গাছের হলুদ ফুল শুকিয়ে বাদামী রঙের ফল হয়েছে  কিন্তু নীচের দিকে এখনও কিছু ফুল অবশিষ্ট আছে এবং জাহির করছে যে আমরা এখনও শেষ হয়ে যাইনি। ঠাণ্ডা একটা আমেজ, দুটো টিয়া পাখি সেগুন গাছের ডালে এসে বসল কিন্তু কি মনে হলো ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডাকতে ডাকতে কোথায় উধাও হয়ে গেল । একটা চিল উড়তে উড়তে হয়তো ক্লান্ত বোধ করায় একটু বসতে না বসতেই কোথা থেকে ছুটে এল একদল কাক কা কা করতে করতে এবং  তাড়া করল সেই ক্লান্ত চিলটাকে। খানিকক্ষণ উপেক্ষা করলেও বেশীক্ষণ টিকতে পারলনা সে , উড়ে চলে গেল দিগন্তের পানে,  হদিশ পেলনা কাকের দল।
আবার শুরু হলো বৃষ্টি, এবার ঝিরঝিরানিটা একটু জোরে। এত যে পাখির দল এখানে সেখানে কলতানে মত্ত ছিল কোথায় উধাও  হলো‌ কে জানে? 

Friday, 23 May 2025

আমফানের পাঁচ বছরের জন্মদিন

দেখতে দেখতে  আমফান পাঁচ বছরে পা দিল। ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা মনে এখনও  দগদগে ঘায়ের মতো রয়েছে ।ছেলেমেয়েদের পাঁচ বছরের জন্মদিন আজকাল খুব ঘটা করে পালন করা হয়। বাচ্চাদের জন্মদিন মানে সে এক ঘনঘটা। আগে বাড়িতে মা কাকিমারা একটু পায়েস করে দিত, সঙ্গে একটু দু চার রকমের ভাজা আর একটু মাংস। তখন খুব কম বাড়িতে মুরগীর মাংস ঢুকত। যৌথ পরিবারে এর বেশী সম্ভব হতো না। এখন পরিবার  হয়েছে ছোট,  বলা যায় সংক্ষিপ্ততম( যদি হয় একটা বাচ্চা) আর যদি একের থেকে দুই হয়। তাহলে পরিবার সম্পূর্ণ। কাকা, কাকিমা , জ্যাঠামশাই, জেঠিমা নামগুলো কেমন যেন  অচেনা শব্দ শোনায়। ঠাকু্র্দা, ঠাকুমাও যেন শোনা শোনা মনে হয়। তবু মন্দের ভাল মাসিমা ও মেসোমশাই যেটা তার মেদ বর্জন করে হয়েছে মাসি ও মেসো এবং দাদু ও দিদু( দিদিমাও ফিগার নিয়ে সচেতন)একটু চেনা চেনা মনে হয় এবং ইংরেজিতে কাজিন বললে মাসতুতো ও মামাতো ভাইবোনদের বোঝায়, পিসতুতো,  খুড়তুতো ও জ্যাঠতুতো ভাইবোনদের  একটা আলাদা  ইংরেজি প্রতিশব্দের খোঁজে আছেন অভিধান প্রণয়িতারা। যাই হোক  বাচ্চাদের জন্মদিনে এখন কেক কাটা আবশ্যিক, পায়েস হলেও সেটা এক চামচ বা বড়জোর দুচামচ । বাচ্চারা আজকাল  মিষ্টি এড়িয়ে চলে মোটা হয়ে যাবার ভয়ে। সারাদিন  স্কুল,  টিউশন করে খেলাধূলোর সময় নেই,  তাহলে গোলগাল লাল্লু লাল্লু হবে না তো কি হবে?  তাদের মিষ্টি বর্জন তো স্বাভাবিক । এখন বাচ্চাদের বন্ধুবান্ধব এবং  তারা একা আসতে পারবে না বলে তাদের বাবা, মাকে( নিদেন পক্ষে মা) বলতেই হয় আর তা ও সম্ভব না হলে বাচ্চাদের ন্যানিকে নিয়ে আসতে হয়। জন্মদিনের এই ঘনঘটা পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সে এক মহাসমারোহ।

আমফান এর পাঁচবছর পূর্তি আমরা কেউ সেইভাবে মানাতে পারিনি কারণ তার দাপাদাপির ভয়ানক নির্ঘোষ আজও  মনে আছে ভীষণভাবে । গোঁ গোঁ শব্দে ১৫০/১৬০ কিলোমিটার বেগে উত্তর পূর্ব দিক থেকে ধেয়ে আসা ঝড়ের গতি যে কি ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরী করে তা যারা না দেখেছেন তাঁরা কিছুতেই বুঝতে পারবেন না। কলকাতা শহর তো সমুদ্র থেকে প্রায়‌ দুশো কিলোমিটার দূরে  কিন্তু তা সত্ত্বেও তার যা প্রকোপ পড়েছে তাহলে সমুদ্রের ধারে  যে কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয় । কংক্রিটের  বিরাটজঙ্গলে ভরা কলকাতা শহরের গল্ফগ্রীন তো সবুজে সবুজময় গাছপালার আধিক্য এখানে অনেক বেশী অন্য জায়গার তুলনায় । সবুজ গল্ফগ্রীনে তাই ঝড়ের মাতন আলাদা। গাছগুলো প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে কিন্তু নাছোড়বান্দা ঝড়ের সঙ্গে কতক্ষণ যুঝতে পারে সেটাই  দেখার বিষয় । দক্ষিণ দিকে একটা বিরাট দারুণ সুন্দরী ইউক্যালিপটাস গাছ ঝড়ের কাছে হাত জোড় করে মিনতি করছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু নির্দয় আমফানের হৃদয় গলে না কিন্তু তাকে একেবারে মেরে না ফেলে তার অঙ্গ ছেদন করে ছেড়ে দিল । সুন্দরী ইউক্যালিপটাস মনের দুঃখে অন্নজল ত্যাগ করে মৃত্যু বরণ করল। এদিকে ওদিকে যারা বড় যোদ্ধা বলে নিজেদের উপস্থিতি জাহির করত তাদের  একে একে সমূলে উৎপাটিত করে ফেলল আমফান ।  ফেজ থ্রি অ্যাসোসিয়েশন হলের বাঁ দিকে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ও ডানদিকে একটা রাধাচূড়া গাছ পরস্পর পরস্পরের সম্পূরক ছিল। কৃষ্ণচূড়ার লাল রং আমফানের সহ্য হলো না, তাকে সমূলে উৎপাটিত করে ফেলল আর অনেক কাকুতি মিনতি করায় রাধাচূড়োর ঝুঁটি ছেঁটে দিয়ে তাকে অব্যাহতি দিল। পিছনের হিলহিলে সুপুরী গাছ আমফান যা বলে তাই করে, সুতরাং সে একেবারই ছাড় পেয়ে গেল কিন্তু সে তার পাঁচ বছরের জন্মদিন পালন করতে পারল না, অসুস্থতার কারণে  কর্পোরেশনের লোকজন তাকে কেটে ফেলল। একটা ছোট্ট তিন কোণা পার্কে দুটো কাঠবাদামের গাছ তারাও একদম ছাড় পেলনা কিন্তু তাদের গোস্তাখি সেবারের মতো মাফ করে দিল কিন্তু অবশ‌্য ই তাদের হাত পা ভেঙে দিয়ে।
হাজার হলেও  আমফান তো নিছক ঝড় নয়, সে প্রবল সামুদ্রিক ঝড়। তাকে তো সম্মান জানাতেই হয়। তার জন্মদিনে আমরা ফেজ থ্রির অধিবাসীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের গানের রিহার্সাল দিচ্ছিলাম। যেই না শেষ হলো রিহার্সাল,  অমনি শুরু হলো গোঁ গোঁ আওয়াজে আমফানের পদধ্বনি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে জানলা, দরজা বন্ধ করে তাকে স্বাগত জানালাম । আমফান  মোটামুটি খুশী যে আমরা তাকে ভুলে যাইনি এবং একটা সাময়িক ঝলকে আমাদের  গা হাত পা জ্বলে যাওয়া গরম থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে তার আমাদের  প্রতি খুশীর বার্তা দিয়ে বলে গেল," ভুলিও না মোরে কভু, ছিলেম আমি, আছি আমি, থাকব সদাই তবু।"

Thursday, 22 May 2025

শিল্পী ও শিল্প

হারু বাবু বা হারান বন্দোপাধ্যায় একজন নামী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত  শিল্পী বালির খটখটিবাগানে থাকতেন । শ্রদ্ধেয় সঙ্গীত শিল্পী তারাপদ চক্রবর্তীর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে তের বছর সঙ্গীত সাধনা  করেছেন এবং তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রী।  কোন‌‌ বাঁধা চাকরি বাকরি করেন নি কোনদিন তিনি , একটাই ভয়ে যে বাঁধাধরা চাকরিতে‌‌‌ তাঁর শিল্প সাধনা ব্যাহত হবে। অল্প বয়স তখন, মনের সুখে সাধনা করে চলেছেন একনিষ্ঠ ভাবে, নাম ছড়িয়ে পড়ছেএই শহর থেকে  ওই শহরে আর খুশীর জোয়ারে ভেসে চলেছেন তিনি । শ্রদ্ধেয় শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর  অগ্রজ প্রতিম এবং  তাঁর ভাই পান্নালাল ভট্টাচার্য তাঁর বন্ধু। তাঁরা তিনজনই আকাশবাণীর  নিয়মিত শিল্পী। হারু বাবু গান ক্ল্যাসিক্যাল  এবং ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ও পান্নালাল ভট্টাচার্য গান ভক্তিগীতি এবং তিনজনই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সমুজ্জ্বল । তখন বালি, বেলুড় ও উত্তরপাড়া অঞ্চল সঙ্গীত সাধনায় খুবই অগ্রণী ছিল। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই সকাল সন্ধ্যায় কিছু না কিছু সঙ্গীত চর্চা শোনা যেত এবং সঙ্গীত শিক্ষকদের ছিল রমরমা বাজার। সুতরাং কেন তাঁরা বাঁধাধরা চাকরিতে‌‌‌  যাবেন? 
কিন্তু পরিবর্তন এল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে । এখন সকাল সন্ধে বেলুড়, বালি, উত্তরপাড়ার ঘরে ঘরে হারমোনিয়াম বা সেতার, সরোদের আওয়াজ বা তার সঙ্গে তবলা সঙ্গতের আওয়াজ শোনা যায়না। হারমোনিয়াম বা তানপুরা বিক্রি ভয়ানকভাবে কমে গেছে । এখন এসেছে টেকনোলজির যুগ। কি বোর্ড এবং  সিনথেজাইজারের সঙ্গে  আরও অনেক যন্ত্রের মিশ্রণে গাওয়া গানে গলার উৎকর্ষতা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কে ভাল আর কে একটু কম ভাল তা বিচার করা খুবই কঠিন এবং  বিচারকের আসনে যাঁরা বসেন তাঁদের পছন্দ অপছন্দ ই শেষ কথা এবং  সেইখানেও  যাঁরা শ্রোতা তাঁরাও হতভম্ব হয়ে যান। অবশ্য সব যুগেই এটা ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই যুগে আগের মতন আর দারুণ অনুশীলনে খুব কম জনকেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় কারণ পড়াশোনার চাপ এবং  প্রত্যেক শিশুকেই তার বাবা মায়েরা নানা বিষয়ে সেরার সেরা হিসেবে দেখতে চায় যার অবশ্যম্ভাবী ফল সব জিনিস  তারা অল্পবিস্তর জানে কিন্তু কোনটাই তারা ভালভাবে জানেনা। একটু শিখতে শিখতেই বাবামায়েরা তাদের নানাধরণের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করাতে নিয়ে যান। বনিয়াদ একটু মজবুত না হওয়ায় এদের  বেশীরভাগ ছেলেমেয়েই বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায় । এ ছাড়া এদিক সেদিকে নানারকম স্কুল  ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠায় বাবামায়েদের ও বিভ্রান্তির একশেষ। কিন্তু এদের মধ্যেই যারা একনিষ্ঠভাবে এগিয়ে যায় তারা এই প্রতিযোগিতায় টিকে যায়।
হারুবাবু ও এই পরিবর্তন একদম বুঝতে পারেন নি তাঁর ই মতো অন্যান্য অনেক শিল্পীদের মতন। চাকরি বাকরি ও নেই,  নেই কোন বাঁধা আয়ের ব্যবস্থা, ছেলেমেয়েদের মধ্যেও কমে গেছে ক্ল্যাসিক্যাল গান শেখার ইচ্ছা এবং বেড়েছে চটুল‌ গান শিখে টিভি ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে পাদপ্রদীপের আলোয় আসা। এক সময় চারদিক আলো করে থাকা শিল্পী যাঁর চারপাশে থাকত‌ চামচার দল তারা এখন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে । ছাত্রের জন্য‌ একে তাকে অনুরোধ করা এবং শুকনো কথায় চিঁড়ে না ভেজায় উনি বুঝতে পেরে গেছেন যে এইসব স্তাবকের‌ দল তাঁকে এড়িয়ে‌ যাচ্ছে‌ এবং আজকাল আর কাউকে বলেন না। তবে খুবই ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের বলেন যে যদি কোন ছোটখাটো একটা কাজের সন্ধান‌ দেয়।‌ অন্তরে সবসময়ই কেঁদে চলেছেন হারুবাবু কি করে এত বড় সংসারটাকে চালাবেন। যখন প্রচুর পয়সা আসতো তখন দুহাত খুলে খরচা করেছেন, বহু লোককে অর্থ সাহায্য করেছেন কিন্তু কোনদিন  তারা সেই অর্থ ফিরিয়ে দেয়নি, বলাই বাহুল্য হারুবাবু মুখ ফুটে কোনদিন তাদের বলতে পারেন নি এবং তারাও সেই দুর্বলতার পুরো সুযোগ নিয়েছে। মাঝে দোকানদার ধারে মাল দিত কিন্তু  ঠিক সময়ের মধ্যে পয়সা না দিতে পারার জন্য তারাও মাল দেওয়া বন্ধ করেছে। চার মেয়ের বড়জন যে খুব ভাল গান করত এবং  হারুবাবু যার ওপর খুব ভরসা করতেন, সে‌ সরস্বতী পূজোর দিন বাড়ি থেকে চলে গেছে একটা ছেলের হাত ধরে যা হারুবাবুকে একদম ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। একমাত্র ছেলে যে বি কম পড়তো সে ও তার তবলার অনুশীলনে ব্যাঘাত ঘটছে দেখে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। সে মোটামুটি রোজগার করেএবং  বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। অসুস্থ হারুবাবু আজকাল আর গান গাইতে পারেন না, মেজ মেয়ে এখানে সেখানে ফাংশন করে‌ যা পায়‌ তাই দিয়ে কোনরকমে চলে সংসার।
দীর্ঘদিন  পরে তাঁরই এক ছাত্র  বিদেশ থেকে  এসেছেন তার মাস্টারমশায়ের সঙ্গে দেখা করতে। অশক্ত শরীর নিয়ে  হারু বাবুর আর সেই  সাধ্য নেই প্রিয় ছাত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরার , ক্ষীণ স্বরে বললেন, " অশোক, এসেছো, কেমন আছো ?"  অশোক প্লাস্টিকের বেত ওয়ালা চেয়ার টেনে সমস্ত খবর নিল এবং  " মাস্টারমশাই,  আমি এখনই আসছি '' বলে বাইরে বেরিয়ে গেল এবং  কাছাকাছি  এ টি এম থেকে টাকা তুলে নিয়ে এল এবং  মাস্টারমশাই এর হাতে দিল কুড়ি হাজার টাকা এবং  আরও বলল যে মাস্টারমশাই  আমি আবার  আসব । ইতিমধ্যে মাস্টারমশাই এর স্ত্রী চা করে এনেছেন । তাঁর পরনের শাড়ি দেখেই অশোক  বুঝতে পারল‌ যে‌ কি অবস্থার  মধ্য দিয়ে  সংসারটা চলছে। ইতিমধ্যে  তাঁর মেজমেয়ে কোথাও গান শিখিয়ে ফিরে এসেছে এবং সংক্ষেপে সংসারের অবস্থা বলল। চোখের জল ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে দেখে অশোক তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল এবং তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিশদ বিবরণ নিয়ে নিল এবং  ফিরে যাওয়ার আগে আবার আসবে বলে বিদায় নিল।
ফিরে যাওয়ার বেশীদিন বাকি ছিলনা, অশোকের  আর মাস্টারমশাইদের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি কিন্তু  যাবার আগে মাস্টারমশাই এর মেয়ের অ্যাকাউন্টে একলক্ষ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে । জানে সে যে এই টাকায় বেশীদিন  চলবে না তবে প্রিয় মাস্টারমশাইকে সে মাঝে মাঝেই কিছু টাকা পাঠাবে বলে মনস্থ করেছে।
এই হচ্ছে  সাবেকি মাস্টারমশাইদের অবস্থা যাঁরা সময়ের সঙ্গে চটুল গান স্বীকার করে নিতে পারেন নি।সরকার এই দুর্দশাগ্রস্ত শিল্পীদের পাশে যদি না দাঁড়ান তবে এই শিল্পীরা নিঃশেষ হয়ে যাবেন এবং শিল্পী ই  যদি না থাকেন তবে শিল্প কি করে সৃষ্টি হবে? 

Saturday, 17 May 2025

দীনবন্ধু মোটর ওয়ার্কস

কলকাতা থেকে এনবিএসটিসির বাসে বহরমপুরের পথে। মাঝে রাস্তাটা খুব খারাপ  থাকায় পৌঁছতে প্রায় ছঘন্টা লেগে গেল ।বিষ্ণুপুর কালীবাড়ির মোড়ের কাছে  এক বিশাল জ্যাম। বাড়ি পৌঁছতে এমনিতেই দেরী হয়েছে, তার উপর বাড়ির গোড়দোরায় এসে এমন জ্যামে মেজাজটা হয়ে গেল তিরিক্ষি। নেমে পড়ল কল্যান, ওখান থেকে  হেঁটেই মেরে দেবে। এখন চাকাওয়ালা ট্রলি ব্যাগের কল্যাণে স্যুটকেস বইতে হয়না, কুলি মজুরদের  পেটে লাথি  পড়েছে এই ট্রলি ব্যাগের জন্য।  অনেকেই নেমে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কল্যান নামতেই হঠাৎই একটা লোহার মতন শক্ত হাত তার কাঁধে পড়ল, বলে উঠল আরে কলু না? কল্যানকে তার ছোটবেলার  বন্ধুরা সবাই কলু বলে ডাকত। কিন্তু এতদিন পর সে আসছে নিজের  শহরে, এখানে তাকে ডাকনামে কে ডাকে?  ঘাড়  ঘুরিয়ে  দেখতেই সে দেখে একটা গাঁট্টাগোট্টা কালো কুচকুচে লোক প্রায় তারই বয়সী কিন্তু মাথায় বেশ জমিয়ে টাক পড়েছে তাকে গায়ে হাত দিয়ে  ডাকছে। কলু পড়াশোনায়  বেশ ভাল ই ছিল এবং  পাশ করার পর মোটামুটি  ভাল চাকরি করায়  চেহারায় বিশেষ  কিছু পরিবর্তন  হয়নি‌ কিন্তু যে গায়ে হাত  দিয়ে  ডাকল তাকে তো সে প্রায় চিনতেই পারছে না। 
আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না, একটু বলবেন আপনার পরিচয়? 
আরে আমি দীনু, দীনবন্ধু মজুমদার,  তোর সঙ্গে  একসাথে একই  সেকশনে পড়তাম কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলে । ক্লাস  সেভেনে  পাশ করতে না পারার জন্য বাবা আমাকে আর পড়ালো না, বাবার সঙ্গে মোটর গ্যারাজেই হাত পাকালাম, আর আমার  ভাই জয়ন্ত পাশ করল বলে বাবা ওকে পড়ালো। ও পাশ করে কলেজ থেকে  গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ  করছে আর আমি বাবা চলে যাওয়ার পরে এই গ্যারাজ সামলাচ্ছি।  মনে পড়ল অনেকদিন আগের কথা। ওকে সবাই কালবাউস বলে ডাকত । খুবই  ডাকাবুকো  টাইপের। পড়াশোনায় বিশেষ দরের ছিলনা বটে  কিন্তু  বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকে মোটর গ্যারাজে কাজ  করে সে একজন নামকরা মিস্ত্রি এবং  বাবার গ্যারাজটাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে সে এক নামকরা গ্যারাজের মালিক। বহু লোক  কাজ করছে, অনেক  গাড়ি ও বাস  দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ধীরে ধীরে  মনে পড়ছে সব পুরনো‌ দিনের কথা। সাইকেল  চালিয়ে  ও আমাদের  ঐ রাজবাড়ির মতন স্কুলের দোতলা থেকে  নীচে  নামত। স্যারেরা অনেকবার  বারণ করা সত্ত্বেও  সে শুনত না, তার সাইকেলে কন্ট্রোল এতটাই অসাধারণ  ছিল। গায়ে জোর ছিল সাধারণের তুলনায় অনেক বেশী  আর মোটর গ্যারাজে কাজ করার জন্য হাতগুলো যেন লোহা। কিন্তু এইরকম ছেলেদের  মনটা থাকে খুবই  নরম। নিজেরা পড়াশোনা করতে না পারার জন্য তারা কিন্তু  পড়াশোনায় ভাল ছেলেদের খুব  সম্মান করতো। কলু দিল্লী আই আই টিতে চান্স পাওয়ার পর যখন টাকার অভাবে  পড়তে পারেনি তখন ঐ দীনুই তাকে বলেছিল ," কলু, তুই  যা পড় গিয়ে, আমি তোর পড়ার খরচ জোগাব। তারপর তুই যখন বড়  হয়ে যাবি তখন আমার কথা ভাবিস।" মনে পড়ে গেল কলুর সেই পুরনো দিনের কথা । বড় মাটির ভাঁড়ে দুকাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে, পেঁয়াজি আর আলুর চপের সঙ্গে মুড়ি নিয়ে দুই ছোটবেলার বন্ধু স্মৃতিচারণ করছে আর গ্যারাজের সব লোকজন হাঁ করে দেখছে তাদের। তাদের মালিককে তারা কখনো এইভাবে প্রাণখুলে গল্প করতে দেখেছে বলে তাদের মনে পড়েনা। কলুর চোখে সেই কালো কুচকুচে কোঁদা চেহারায় ঝকঝকে সাদা দাঁত আর ভীষণ জ্বলজ্বলে দুটো চোখ অনেকটা নিগ্রোদের মতো সেই কালো মানিক বা কালবাউস আজ মাথার চুল অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু  মনটা তার আজও শিশুর মতোই রয়েছে । 
গ্যারাজ অন্ত প্রাণ  দীনু আজ বহু লোকের  অন্নসংস্থান করছে। নিজে  বিয়ে থাওয়া করেনি। জয়ন্তর ছেলেমেয়েরাই তার নিজের  ছেলেমেয়ে আর এই বিশাল গ্যারাজের লোকজনদের পরিবার ই তার নিজের পরিবার। 
এবার উঠি রে দীনু, বলে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য একটা রিক্সায় উঠল কলু। ভাবছে লোকে পড়াশোনা কর পড়াশোনা কর বলে পাগল করে দেয়  কিন্তু তারা নিজেরা এত ভাল করে পড়াশোনা করে কি করেছে? একটা ভাল চাকরি, তারপর বিয়ে সংসার  কেবল নিজেদের  নিয়েই শশব্যস্ত, আর পাঁচটা লোকের  কতটা উন্নতি করতে পেরেছে?   অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেরকম কিছু করতে পেরেছে বলে মনে করতে পারলনা কিন্তু সেখানে দীনু ঐ সামান্য  বিদ্যা নিয়েই বহুলোকের পরিবার সামলেছে, দীনু অনেক বড়মাপের মানুষ ।