কিন্তু পরিবর্তন এল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে । এখন সকাল সন্ধে বেলুড়, বালি, উত্তরপাড়ার ঘরে ঘরে হারমোনিয়াম বা সেতার, সরোদের আওয়াজ বা তার সঙ্গে তবলা সঙ্গতের আওয়াজ শোনা যায়না। হারমোনিয়াম বা তানপুরা বিক্রি ভয়ানকভাবে কমে গেছে । এখন এসেছে টেকনোলজির যুগ। কি বোর্ড এবং সিনথেজাইজারের সঙ্গে আরও অনেক যন্ত্রের মিশ্রণে গাওয়া গানে গলার উৎকর্ষতা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কে ভাল আর কে একটু কম ভাল তা বিচার করা খুবই কঠিন এবং বিচারকের আসনে যাঁরা বসেন তাঁদের পছন্দ অপছন্দ ই শেষ কথা এবং সেইখানেও যাঁরা শ্রোতা তাঁরাও হতভম্ব হয়ে যান। অবশ্য সব যুগেই এটা ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই যুগে আগের মতন আর দারুণ অনুশীলনে খুব কম জনকেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় কারণ পড়াশোনার চাপ এবং প্রত্যেক শিশুকেই তার বাবা মায়েরা নানা বিষয়ে সেরার সেরা হিসেবে দেখতে চায় যার অবশ্যম্ভাবী ফল সব জিনিস তারা অল্পবিস্তর জানে কিন্তু কোনটাই তারা ভালভাবে জানেনা। একটু শিখতে শিখতেই বাবামায়েরা তাদের নানাধরণের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করাতে নিয়ে যান। বনিয়াদ একটু মজবুত না হওয়ায় এদের বেশীরভাগ ছেলেমেয়েই বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায় । এ ছাড়া এদিক সেদিকে নানারকম স্কুল ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠায় বাবামায়েদের ও বিভ্রান্তির একশেষ। কিন্তু এদের মধ্যেই যারা একনিষ্ঠভাবে এগিয়ে যায় তারা এই প্রতিযোগিতায় টিকে যায়।
হারুবাবু ও এই পরিবর্তন একদম বুঝতে পারেন নি তাঁর ই মতো অন্যান্য অনেক শিল্পীদের মতন। চাকরি বাকরি ও নেই, নেই কোন বাঁধা আয়ের ব্যবস্থা, ছেলেমেয়েদের মধ্যেও কমে গেছে ক্ল্যাসিক্যাল গান শেখার ইচ্ছা এবং বেড়েছে চটুল গান শিখে টিভি ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে পাদপ্রদীপের আলোয় আসা। এক সময় চারদিক আলো করে থাকা শিল্পী যাঁর চারপাশে থাকত চামচার দল তারা এখন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে । ছাত্রের জন্য একে তাকে অনুরোধ করা এবং শুকনো কথায় চিঁড়ে না ভেজায় উনি বুঝতে পেরে গেছেন যে এইসব স্তাবকের দল তাঁকে এড়িয়ে যাচ্ছে এবং আজকাল আর কাউকে বলেন না। তবে খুবই ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের বলেন যে যদি কোন ছোটখাটো একটা কাজের সন্ধান দেয়। অন্তরে সবসময়ই কেঁদে চলেছেন হারুবাবু কি করে এত বড় সংসারটাকে চালাবেন। যখন প্রচুর পয়সা আসতো তখন দুহাত খুলে খরচা করেছেন, বহু লোককে অর্থ সাহায্য করেছেন কিন্তু কোনদিন তারা সেই অর্থ ফিরিয়ে দেয়নি, বলাই বাহুল্য হারুবাবু মুখ ফুটে কোনদিন তাদের বলতে পারেন নি এবং তারাও সেই দুর্বলতার পুরো সুযোগ নিয়েছে। মাঝে দোকানদার ধারে মাল দিত কিন্তু ঠিক সময়ের মধ্যে পয়সা না দিতে পারার জন্য তারাও মাল দেওয়া বন্ধ করেছে। চার মেয়ের বড়জন যে খুব ভাল গান করত এবং হারুবাবু যার ওপর খুব ভরসা করতেন, সে সরস্বতী পূজোর দিন বাড়ি থেকে চলে গেছে একটা ছেলের হাত ধরে যা হারুবাবুকে একদম ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। একমাত্র ছেলে যে বি কম পড়তো সে ও তার তবলার অনুশীলনে ব্যাঘাত ঘটছে দেখে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। সে মোটামুটি রোজগার করেএবং বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। অসুস্থ হারুবাবু আজকাল আর গান গাইতে পারেন না, মেজ মেয়ে এখানে সেখানে ফাংশন করে যা পায় তাই দিয়ে কোনরকমে চলে সংসার।
দীর্ঘদিন পরে তাঁরই এক ছাত্র বিদেশ থেকে এসেছেন তার মাস্টারমশায়ের সঙ্গে দেখা করতে। অশক্ত শরীর নিয়ে হারু বাবুর আর সেই সাধ্য নেই প্রিয় ছাত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরার , ক্ষীণ স্বরে বললেন, " অশোক, এসেছো, কেমন আছো ?" অশোক প্লাস্টিকের বেত ওয়ালা চেয়ার টেনে সমস্ত খবর নিল এবং " মাস্টারমশাই, আমি এখনই আসছি '' বলে বাইরে বেরিয়ে গেল এবং কাছাকাছি এ টি এম থেকে টাকা তুলে নিয়ে এল এবং মাস্টারমশাই এর হাতে দিল কুড়ি হাজার টাকা এবং আরও বলল যে মাস্টারমশাই আমি আবার আসব । ইতিমধ্যে মাস্টারমশাই এর স্ত্রী চা করে এনেছেন । তাঁর পরনের শাড়ি দেখেই অশোক বুঝতে পারল যে কি অবস্থার মধ্য দিয়ে সংসারটা চলছে। ইতিমধ্যে তাঁর মেজমেয়ে কোথাও গান শিখিয়ে ফিরে এসেছে এবং সংক্ষেপে সংসারের অবস্থা বলল। চোখের জল ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে দেখে অশোক তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল এবং তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিশদ বিবরণ নিয়ে নিল এবং ফিরে যাওয়ার আগে আবার আসবে বলে বিদায় নিল।
ফিরে যাওয়ার বেশীদিন বাকি ছিলনা, অশোকের আর মাস্টারমশাইদের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি কিন্তু যাবার আগে মাস্টারমশাই এর মেয়ের অ্যাকাউন্টে একলক্ষ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে । জানে সে যে এই টাকায় বেশীদিন চলবে না তবে প্রিয় মাস্টারমশাইকে সে মাঝে মাঝেই কিছু টাকা পাঠাবে বলে মনস্থ করেছে।
এই হচ্ছে সাবেকি মাস্টারমশাইদের অবস্থা যাঁরা সময়ের সঙ্গে চটুল গান স্বীকার করে নিতে পারেন নি।সরকার এই দুর্দশাগ্রস্ত শিল্পীদের পাশে যদি না দাঁড়ান তবে এই শিল্পীরা নিঃশেষ হয়ে যাবেন এবং শিল্পী ই যদি না থাকেন তবে শিল্প কি করে সৃষ্টি হবে?
No comments:
Post a Comment