Friday, 23 May 2025

আমফানের পাঁচ বছরের জন্মদিন

দেখতে দেখতে  আমফান পাঁচ বছরে পা দিল। ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা মনে এখনও  দগদগে ঘায়ের মতো রয়েছে ।ছেলেমেয়েদের পাঁচ বছরের জন্মদিন আজকাল খুব ঘটা করে পালন করা হয়। বাচ্চাদের জন্মদিন মানে সে এক ঘনঘটা। আগে বাড়িতে মা কাকিমারা একটু পায়েস করে দিত, সঙ্গে একটু দু চার রকমের ভাজা আর একটু মাংস। তখন খুব কম বাড়িতে মুরগীর মাংস ঢুকত। যৌথ পরিবারে এর বেশী সম্ভব হতো না। এখন পরিবার  হয়েছে ছোট,  বলা যায় সংক্ষিপ্ততম( যদি হয় একটা বাচ্চা) আর যদি একের থেকে দুই হয়। তাহলে পরিবার সম্পূর্ণ। কাকা, কাকিমা , জ্যাঠামশাই, জেঠিমা নামগুলো কেমন যেন  অচেনা শব্দ শোনায়। ঠাকু্র্দা, ঠাকুমাও যেন শোনা শোনা মনে হয়। তবু মন্দের ভাল মাসিমা ও মেসোমশাই যেটা তার মেদ বর্জন করে হয়েছে মাসি ও মেসো এবং দাদু ও দিদু( দিদিমাও ফিগার নিয়ে সচেতন)একটু চেনা চেনা মনে হয় এবং ইংরেজিতে কাজিন বললে মাসতুতো ও মামাতো ভাইবোনদের বোঝায়, পিসতুতো,  খুড়তুতো ও জ্যাঠতুতো ভাইবোনদের  একটা আলাদা  ইংরেজি প্রতিশব্দের খোঁজে আছেন অভিধান প্রণয়িতারা। যাই হোক  বাচ্চাদের জন্মদিনে এখন কেক কাটা আবশ্যিক, পায়েস হলেও সেটা এক চামচ বা বড়জোর দুচামচ । বাচ্চারা আজকাল  মিষ্টি এড়িয়ে চলে মোটা হয়ে যাবার ভয়ে। সারাদিন  স্কুল,  টিউশন করে খেলাধূলোর সময় নেই,  তাহলে গোলগাল লাল্লু লাল্লু হবে না তো কি হবে?  তাদের মিষ্টি বর্জন তো স্বাভাবিক । এখন বাচ্চাদের বন্ধুবান্ধব এবং  তারা একা আসতে পারবে না বলে তাদের বাবা, মাকে( নিদেন পক্ষে মা) বলতেই হয় আর তা ও সম্ভব না হলে বাচ্চাদের ন্যানিকে নিয়ে আসতে হয়। জন্মদিনের এই ঘনঘটা পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সে এক মহাসমারোহ।

আমফান এর পাঁচবছর পূর্তি আমরা কেউ সেইভাবে মানাতে পারিনি কারণ তার দাপাদাপির ভয়ানক নির্ঘোষ আজও  মনে আছে ভীষণভাবে । গোঁ গোঁ শব্দে ১৫০/১৬০ কিলোমিটার বেগে উত্তর পূর্ব দিক থেকে ধেয়ে আসা ঝড়ের গতি যে কি ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরী করে তা যারা না দেখেছেন তাঁরা কিছুতেই বুঝতে পারবেন না। কলকাতা শহর তো সমুদ্র থেকে প্রায়‌ দুশো কিলোমিটার দূরে  কিন্তু তা সত্ত্বেও তার যা প্রকোপ পড়েছে তাহলে সমুদ্রের ধারে  যে কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয় । কংক্রিটের  বিরাটজঙ্গলে ভরা কলকাতা শহরের গল্ফগ্রীন তো সবুজে সবুজময় গাছপালার আধিক্য এখানে অনেক বেশী অন্য জায়গার তুলনায় । সবুজ গল্ফগ্রীনে তাই ঝড়ের মাতন আলাদা। গাছগুলো প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে কিন্তু নাছোড়বান্দা ঝড়ের সঙ্গে কতক্ষণ যুঝতে পারে সেটাই  দেখার বিষয় । দক্ষিণ দিকে একটা বিরাট দারুণ সুন্দরী ইউক্যালিপটাস গাছ ঝড়ের কাছে হাত জোড় করে মিনতি করছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু নির্দয় আমফানের হৃদয় গলে না কিন্তু তাকে একেবারে মেরে না ফেলে তার অঙ্গ ছেদন করে ছেড়ে দিল । সুন্দরী ইউক্যালিপটাস মনের দুঃখে অন্নজল ত্যাগ করে মৃত্যু বরণ করল। এদিকে ওদিকে যারা বড় যোদ্ধা বলে নিজেদের উপস্থিতি জাহির করত তাদের  একে একে সমূলে উৎপাটিত করে ফেলল আমফান ।  ফেজ থ্রি অ্যাসোসিয়েশন হলের বাঁ দিকে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ও ডানদিকে একটা রাধাচূড়া গাছ পরস্পর পরস্পরের সম্পূরক ছিল। কৃষ্ণচূড়ার লাল রং আমফানের সহ্য হলো না, তাকে সমূলে উৎপাটিত করে ফেলল আর অনেক কাকুতি মিনতি করায় রাধাচূড়োর ঝুঁটি ছেঁটে দিয়ে তাকে অব্যাহতি দিল। পিছনের হিলহিলে সুপুরী গাছ আমফান যা বলে তাই করে, সুতরাং সে একেবারই ছাড় পেয়ে গেল কিন্তু সে তার পাঁচ বছরের জন্মদিন পালন করতে পারল না, অসুস্থতার কারণে  কর্পোরেশনের লোকজন তাকে কেটে ফেলল। একটা ছোট্ট তিন কোণা পার্কে দুটো কাঠবাদামের গাছ তারাও একদম ছাড় পেলনা কিন্তু তাদের গোস্তাখি সেবারের মতো মাফ করে দিল কিন্তু অবশ‌্য ই তাদের হাত পা ভেঙে দিয়ে।
হাজার হলেও  আমফান তো নিছক ঝড় নয়, সে প্রবল সামুদ্রিক ঝড়। তাকে তো সম্মান জানাতেই হয়। তার জন্মদিনে আমরা ফেজ থ্রির অধিবাসীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের গানের রিহার্সাল দিচ্ছিলাম। যেই না শেষ হলো রিহার্সাল,  অমনি শুরু হলো গোঁ গোঁ আওয়াজে আমফানের পদধ্বনি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে জানলা, দরজা বন্ধ করে তাকে স্বাগত জানালাম । আমফান  মোটামুটি খুশী যে আমরা তাকে ভুলে যাইনি এবং একটা সাময়িক ঝলকে আমাদের  গা হাত পা জ্বলে যাওয়া গরম থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে তার আমাদের  প্রতি খুশীর বার্তা দিয়ে বলে গেল," ভুলিও না মোরে কভু, ছিলেম আমি, আছি আমি, থাকব সদাই তবু।"

No comments:

Post a Comment