Tuesday, 13 May 2025

উবের ড্রাইভার

উবের ড্রাইভারদের সম্পর্কে নানান জনের নানা অভিজ্ঞতা । বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায় ফোনে পিন নম্বর এসে গেল এবং  ড্রাইভারের যাবতীয় ঠিকুজি কুলজি সমেত গাড়ির নম্বর এবং হাসি হাসি মুখে ড্রাইভারের ছবি সমেত কতক্ষণে আসছে তাও এসে গেল কিন্তু  নির্দিষ্ট  সময় পরেও তাঁর দেখা নাই রে তাঁর দেখা নাই। ফোনে যোগাযোগ করা হলে অপরপ্রান্ত থেকে প্রশ্ন এসে গেল  কোথায় যাবেন এবং  তার পর মূহুর্তেই নিথর নীরবতা এবং  মোবাইলে চাকা ঘুরতে থাকল এবং  লিখিত মেসেজ আসতে লাগল( অবশ্য যদি খুব দেরী হয় পরিবর্ত গাড়ি না পেলে) । আর দেরী দেখে যদি ক্যান্সেল করা হলো তাহলে আপনার  ঘাড়ে তার কোপ অবশ্যই পড়বে। আমরা যারা পুরনো দিনের লোক তাদের  ভাগ্যে অবশ্যই এই শাস্তি বহাল থাকবে । খোঁজাখুঁজি করে কোথায় কিভাবে ক্যান্সেল করতে হবে পাওয়া যাবেনা এবং  যখন পাওয়া গেল ততক্ষণে সময়  অতিক্রান্ত । অতএব,  গ্যাঁট গচ্ছা যাবেই। আজকের যুগের ছেলেমেয়েদের  কাছে কিন্তু এরা মহা জব্দ। এরা খুটখাট করে ঠিক সময়ের মধ্যেই তাকে ক্যান্সেল করে দেবে। এদের কাছ থেকে  পয়সা ভুগিয়ে ভাগিয়ে নেওয়া শিবের বাবার ও অসাধ্য।  অনেকদিন  আগে একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন যে কম্পিউটার না জানলে সে অশিক্ষিত। তিনি একজন  ভারতবর্ষের  সেরা ইনস্টিটিউটের ইঞ্জিনিয়ার এবং অত্যন্ত পণ্ডিত  ব্যক্তি,  সুতরাং  তাঁর কথাকে একবাক্যে নস্যাৎ করা যায়না এবং  বাস্তবিক ক্ষেত্রে সেটাই ঠিক । এখন বাচ্চাদের  মোবাইল না খুলে দিলে খাবেনা আর নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হওয়ার দরুণ বাবা মায়েদের এত ধৈর্য্য ধরে খাওয়ানোর সময় ও নেই। সুতরাং,  প্রেশার কুকারে সেপারেটর দিয়ে ভাত, ডাল, সব্জি সেদ্ধ করে চটপট বাচ্চাকে ডে কেয়ারে দিয়ে অফিসে দৌড়াও। মাঝে কোভিডের জন্য অবশ্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম হচ্ছিল এবং  বাবামায়েদের একটু হ্যাপা কম ছিল । কিন্তু কর্মদাতারা দেখলেন যে এদের অভ্যেস খারাপ হয়ে যাচ্ছে এবং  অনেকেই  একই সঙ্গে একাধিক  সংস্থায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং,  ঘোরাও চাকা উল্টোদিকে । যাক এ তো হয়ে যাচ্ছে ধান ভানতে  শিবের গাজন গাওয়া। ফিরে যাওয়া যাক উবের ড্রাইভারের কথায় ।
উবের বুক করা হয়েছে  গড়িয়াহাটের অ্যাপোলো ক্লিনিকে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বলে। পাঁচ মিনিটে আসছে বলে আর পাত্তাই নেই। ড্রাইভার সাহেব  আসছেন না দেখে ক্যান্সেল করলাম যখন তখন পনের  মিনিট  পেরিয়ে গেছে, গত্যন্তর না দেখে একটা হলুদ ট্যাক্সি ধরে পৌঁছলাম  প্রায় কুড়ি মিনিট বাদে। ওঁরা আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রায় ক্যান্সেল করেই দিচ্ছিলেন ( হাজার হলেও নামী ডাক্তার তো) কিন্তু অনেক অনুরোধে তাঁরা আর এতটা নির্দয় হতে পারলেন না কিন্তু  আমার দেখানোর সময় অনেকটাই  পিছিয়ে গেল। অনেক কষ্টে একটু জায়গা পেয়ে বসেছি, এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল, আমার ড্রাইভার সাহেবের গলা, বললেন আপনি অ্যাপোলো ক্লিনিকের জন্য গাড়ি বুক করেছিলেন? আমি বললাম,  হ্যাঁ,  সে তো অনেকক্ষণ আগে আর আপনাদের  দেরী দেখে আমি ক্যান্সেল ও করে দিয়েছি এবং  মিনিট দশেক  হলো আমি পৌঁছে ও গিয়েছি। আমাকে একটু  ধমক দিয়েই বললেন যত্তো সব ভুলভাল পাব্লিক । আমার তখন উত্তর দেওয়ার মতন মানসিক অবস্থা ছিলনা । ঘন্টা পাঁচেক পর ফেরার সময়ের উবের বুক করতে গিয়ে দেখি কোম্পানি আমার উপর ৭৯.৫২ টাকার খাঁড়ার ঘা চাপিয়েছে। আমিও ঠিক করলাম  এই জরিমানা আমি কিছুতেই  দেব না। যাই হোক,  আর একজন সহৃদয় হলুদ  ট্যাক্সির ড্রাইভার  ১৮০ টাকা নিয়ে আমাকে পৌঁছে দিয়ে উদ্ধার  করলেন ।

এ তো গেল এক ধরণের  অভিজ্ঞতা । কয়েকদিন আগে সদ্য হারানো   এক বন্ধুর  শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পরদিন নিয়মভঙ্গে যেতে হবে । পৌনে একটায় গাড়ি বুক করতেই দেখালো তিন মিনিটে আসছে। মাঝপথে আরও এক বন্ধুকে নিয়ে  যাব, ফোন করলাম তৈরী থাকার জন্য কিন্তু আবার সেই  গোল গোল চাকতি ঘোরা শুরু হলো কিন্তু  যেহেতু পিন নম্বর দিয়ে দিয়েছে আমি ভাবছি এই এল বলে কিন্তু নাহ, পাত্তা নেই আর মেসেজ আসতে শুরু করল ধন্যবাদ  জানিয়ে ধৈর্য্য ধরার জন্য। বন্ধুকে জানালাম সব কথা। দুজনেই যথেষ্ট  ধৈর্য ধরে আছি, শেষমেশ একটা গাড়ি আসছে আট মিনিট বাদে দেখাল। তখন একটা বেজে কুড়ি। দেখতে দেখতে  আট মিনিট  প্রায়‌ এসে গেল । অনেক কষ্টে গলার স্বর যথেষ্ট  মোলায়েম করে ড্রাইভার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম,  ভাই কোথায়  আছেন,  আসছেন কি, না আপনিও সেই ক্যান্সেল করার দলে? না ,না আমি একজনকে নামিয়ে দিয়েই আসছি। বন্ধুর  দেওয়া ডেড লাইন দেড়টা পেরিয়ে গিয়ে আরও  দু মিনিট  হয়েছে,  নীচে  গাড়ির আওয়াজ পেয়ে ব্যালকনি থেকে দেখলাম একটা সাদা গাড়ি বাড়ির  সামনেই থামল এবং  একটা টেলিফোন  পেলাম  তাঁর কাছ থেকে । নেমে গাড়িতে চেপে বন্ধুকে জানালাম  অলিম্পিকে পদক পাওয়ার কথা এবং  বললাম বাড়ির কাছে এসে একটা ফোন করব । ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ আর পারদের মাত্রা চড়চড়  করে বাড়ছে আর উবেরের এসি পুরো মাত্রায় চড়িয়েও  গরমকে বাগ মানানো যাচ্ছেনা। এর মধ্যেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির জন্য  বিশাল জ্যাম, গাড়ির চাকা নড়েনা আর ড্রাইভার সাহেবের অবস্থাও তথৈবচ । ভদ্রলোক,  একবার ও বিরক্তি প্রকাশ করছেন না। পৌনে তিনটে নাগাদ  পৌঁছলাম । ততক্ষণে লোকজন ফিরে যেতে শুরু করেছে। ড্রাইভার সাহেব গাড়ি বন্ধ করে বললেন ২৫২ টাকা হয়েছে । আমি একটা পাঁচশ টাকার নোট  দিয়ে বললাম  আমাকে দুশো টাকা দিন। উনি আমাকে আড়াইশো টাকা দিতে চাইছিলেন এই ভেবে যে দুটাকা আমার কাছে নেই। একটু ইতস্তত করে  বললেন যে স্যার  আমার তো হয়েছে দুশো বাহান্ন টাকা। আমি বললাম  ভাই অনেকটা সময় চলে গেছে জ্যামের জন্য , আপনি ওটা রেখে দিন ।

আবার একটা দিন উবেরে যাওয়া। ভদ্রলোককে দেখে কেমন নিষ্পাপ বলে মনে হলো। যেতে হবে বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ । পার্ক সার্কাসে  এসে ও কলামন্দিরের দিকে মোড় নিচ্ছে  দেখে বলে উঠলাম  ঐদিকে কেন মোড় নিচ্ছেন, ওদিক দিয়ে তো অনেক ঘুরতে হবে। আপনি ডান দিকে মোড় নিন এবং  ফ্লাই ওভারে উঠুন । ও বলল, হ্যাঁ স্যার,  আমি জিপিএস দেখেই এই দিকে ঘুরলাম কিন্তু এখন দেখছি ভুল করে ফেলেছি। আসল কথা স্যার,  আগে আমি ট্রাক চালাতাম এবং দিল্লী, বোম্বে ও মাদ্রাজ হাইওয়েতে প্রচুর গাড়ি চালিয়েছি এবং  টাকা পয়সা জমিয়ে এবং  লোন নিয়ে  এই গাড়িটা কিনেছি। স্যার,  এই উবের চালানো য় আমি একদম আনকোরা এবং কলকাতার রাস্তাঘাট ও এখনো পর্যন্ত চিনে উঠতে পারিনি । আমি বললাম,  কোন চিন্তা নেই,  আমি আপনাকে রাস্তার ডিরেকশন দিয়ে দেব । গাড়ি চলছে পার্ক সার্কাস ফ্লাইওভার দিয়ে কিন্তু ভীষণ  জ্যাম । একটা অ্যাম্বুল্যান্স হুটার বাজিয়েই চলেছে কিন্তু কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই এমনকি ফ্লাইওভারের জ্যাম মিটলেও গাড়িগুলো একটুও জায়গা ছাড়ছে না। গাড়ির ভেতর থেকে  দেখলাম আইসিইউ অ্যাম্বুল্যান্স অথচ কারও কোন হেলদোল নেই। আমি মনে মনে বিরক্তি প্রকাশ করছি দেখে ড্রাইভারটি বলে উঠল যে স্যার, আমি মাঝে কিছুদিন অ্যাম্বুল্যান্স ও চালিয়েছি। একদিন  এইরকম জ্যামের মধ্যে আটকে গিয়ে একজন রোগীকে চলে যেতে দেখেছি আর সেই দিন থেকে আমি অ্যাম্বুল্যান্স চালানো  বন্ধ করে দিয়েছি। খুব আশ্চর্য লাগল ছেলেটির‌ মনের নরম দিকটা দেখে।
রাস্তা প্রায়ই শেষ হয়ে আসছে।   অনেক ধন্যবাদ জানালো ছেলেটি। বলল যে কয়েকদিন আগে এক ভদ্রলোক গাড়িতে উঠেছিলেন এবং  জিপিএস দেখতে ভুল হাওয়ায় ভদ্রলোক খুব গালমন্দ করেছিলেন। ড্রাইভারটি আরো জানালো যে স্যার, আমি এই উবের চালানো য় নতুন  এবং  আপনি যদি রাস্তা জানেন তাহলে আমাকে বলে দিন কিন্তু উল্টে ভদ্রলোক  আরও গালাগালি করে বললেন যে রাস্তাই যদি না চেনো, তাহলে গাড়ি বের করেছ কেন? এটাও তার একটা অভিজ্ঞতা । পৃথিবীতে কেউই সব কিছু জানেনা, আস্তে আস্তে সব কিছুই রপ্ত হয় কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে  এমন ব্যবহার  করি যে আদৌ আমরা মানুষ  কিনা তাতে  সন্দেহ জাগে । পৌঁছলাম গন্তব্যস্থলে এবং  ছেলেটিকে ভাড়ার চেয়েও পঞ্চাশ টাকা বাড়তি দিলাম ছেলেটিকে ঐদিন যে গালাগালি  হজম করতে হয়েছিল  তাকে কিছুটা প্রশমন করার জন্য।
পৃথিবীতে  কেউই আমরা সর্বজ্ঞ নই  এবং আমাদের  প্রত্যেকের মধ্যেই অনেক খামতি আছে কিন্তু আমরা সহমর্মীতা দেখিয়ে নিজেদের আরও  উন্নত করতে পারি এবং  এই পৃথিবীর চেহারাটা কিছুটা হলেও  ভাল করতে পারি।

No comments:

Post a Comment