Friday, 31 December 2021

নববর্ষ

বিষে বিষময় দুহাজার বিশ
মারণ গরল আনিল  একুশ 
তবুও আশায় থাকি অহর্নিশ 
আসিবে মঙ্গলদায়ী দুহাজার বাইশ

নতুন বছরের অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল। 

এযুগের দধীচি

পুরাণে মহর্ষি  দধীচির সম্বন্ধে জানেনা এমন লোকের  সংখ্যা খুবই  কম। যারা একদম নিতান্তই কোন  খবর  রাখেন না তারা ব্যতীত প্রায় সমস্ত লোকই মহর্ষি  দধীচির আত্মত্যাগের কথা জানেন। তিনি তাঁর  প্রাণ ত্যাগ  করেছিলেন দেবতাদের অসুরদের বিরুদ্ধে জয়লাভ  করার জন্য। 
দেবরাজ  ইন্দ্র তাঁর সহযোগী অন্য দেবতারা স্বর্গ থেকে প্রায় বিতাড়িত  অসুরদের দ্বারা। অসুরদের  দলপতি বৃত্রা শিবের আশীর্বাদে প্রায় অমরত্ব লাভ করেছিলেন। তাকে কোন  অস্ত্রের দ্বারা বধ করা যাবেনা। তাহলে তাকে হারাবে কে? আর সঙ্গে সঙ্গে দেবরাজ  ইন্দ্রকেও  তাঁর  চ্যালা চামুন্ডা সমেত  স্বর্গ থেকে চাটি বাটি গোটাতে  হবে। স্বয়ং রাজা ইন্দ্র মুখ কালো করে ভগবান  বিষ্ণুর শরণাপন্ন  হলেন। রাজনীতি তখনও  ছিল  এখনকার  মতো। রাশিয়া বা আমেরিকা এখন যেমন একবার  ভারতের  গালে আর একবার  পাকিস্তানের গালে চুমু খায়, তখনও  ভগবান  বিষ্ণু এবং মহেশ্বর  আমেরিকা রাশিয়ার  রোল প্লে করতো। স্বয়ং ভোলানাথ অল্পেই  তুষ্ট হন এবং বেশি কূটকচালির মধ্যে না গিয়ে খুব বেশি না ভেবেই চাওয়া এমন একটা বরকে  তথাস্তু বলে বসতেন যে তাকে সামলাতে অন্যদের  দফারফা। রাশিয়া যদি প্যালেস্টাইনকে  সমর্থন  করে তবে আমেরিকাকে ইস্রায়েলের  সমর্থনে নামতেই  হয়। সুতরাং স্বয়ং বিষ্ণু যে দেবরাজ  ইন্দ্রকে বুদ্ধি দেবেন  এতে আর আশ্চর্য  কি আছে। তিনি দেবরাজ  ইন্দ্রকে বললেন যে যাও মহর্ষি দধীচির কাছে এবং তাঁর কাছে তাঁর  অস্থি র প্রার্থনা কর। স্বর্গের  এইসব ব্যাপার স্যাপার  বড্ড গোলমেলে। দেবরাজ  ইন্দ্র, তুমি রাজা। দেবতাদের  দেখভাল  করা  তো তোমার  কাজ। কেমন তোমার  কূটনীতি হে? তুমি তো ঠিকমতো  সামলাতেই  পারনি।  তুমি থাকতে কেমন করে অসুর বাবাজী স্বয়ং মহেশ্বরের কাছ থেকে বর নিয়ে চলে গেল আর তুমি কি তখন  আঙুল  চুষছিলে? আরও  একটা জিনিস  কিছুতেই  বোধগম্য  হয়না। রাজ্যপাট  তোমার,  সামলাবে তুমি। কথায় কথায় তোমাকে দাদা ধরতে হবে কেন শুনি? অনেক  ভাবনা চিন্তার  পর একটা মিল এখনকার  রাজনীতির  সঙ্গে মিল খুঁজে পেলাম। সংবিধান  অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সর্বময়  ক্ষমতা কিন্তু কোথা থেকে তাঁর মাথার উপর উড়ে এসে জুড়ে বসল ন্যাশনাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল যার মতামত ছাড়া পাতাও  হেলবে না। অতএব যা হবার  তাই  হলো। দেবরাজ  ইন্দ্রর ক্ষেত্রেও  তার কোন  ব্যতিক্রম  নয়। সুতরাং  আমেরিকান বিষ্ণুর কথামতন  মহর্ষি দধীচির  কাছে যাওয়া এবং আবদার  ধরা, ঋষিবর, " আপনি প্রাণ ত্যাগ  করুন  এবং আপনার  অস্থি দিয়ে আমি অস্ত্র বানাবো এবং সেই  অস্ত্রে  আমি বৃত্রাসুরকে বধ করে স্বর্গ  উদ্ধার  করব।" মহর্ষি জ্ঞানী পুরুষ , উনি দেবরাজ ইন্দ্রর আগমনের  কারণ জানেন এবং একটা শর্ত  আরোপ করলেন। তিনি বললেন যে সমস্ত নদীতে অবগাহন করার পর তিনি প্রাণ ত্যাগ  করবেন। কিন্তু ইন্দ্রর আর তর সইছে  না অথচ মহর্ষিকে হত্যাও  করতে পারছেন  না। আর ঐদিকে  ঊর্বশী,  মেনকাদের  নৃত্য গীত  কতদিন  শোনা হয়নি আর সেই জায়গায় অসুররা আহ্লাদিত  হচ্ছে তাদের  নৃত্য গীতে,  এটা ভেবেই  দেবরাজের মন খুব খারাপ  হয়ে গেল। তিনি তখন  সমস্ত নদীর  জল একত্রিত  করে সেইখানে নিয়ে এলেন  এবং মহর্ষিকে বললেন, " এইখানেই  সব নদীর  জল আছে যেটা  যোগবলে আপনি জেনে নিতে পারেন  যে সব ঠিক ঠাক আছে কিনা।" এখনকার  যেমন অডিটরের  সামনে  সমস্ত বই খাতা ফেলে দিয়ে বলা হয় দেখে নিন স্যার একবার  চোখ বুলিয়ে আর চট করে সই করে স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিন। আমাকে আর বলতে হবেনা বাপধন,  আমি বুঝেছি তোমার  যথেষ্ট  তাড়া। মুনিবর তাঁর  
কথামতন সেই জলে অবগাহন  করে স্বেচ্ছায় প্রাণ ত্যাগ করে দেবরাজ  ইন্দ্রকে ব্রহ্মহত্যা থেকে নিষ্কৃতি দিলেন। আহ্লাদে আটখানা দেবরাজ  ইন্দ্র তাঁর  অস্থি নিয়ে সঁপে দিলেন  বিশ্বকর্মার  হাতে এবং তিনি মহর্ষির মেরুদন্ড  দিয়ে বানালেন বজ্র এবং সেই বজ্রাঘাতে  নিধন হলো বৃত্রাসুর এবং দেবতারাও  ফিরে পেলেন  তাঁদের মনসবদারি। আর বেশ  লোকদেখানি শান্তি স্থাপন হলো ভগবান  বিষ্ণুর মহেশ্বরের  সঙ্গে। ব্রিটেন আমেরিকা ও রাশিয়া যেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের  পুনর্মিলন  হলো।

এ তো গেল সেই পুরানের কচকচানি। এবার  আসা যাক আজকের  দধীচির  কথায়। স্বার্থ ত্যাগের  মহান আদর্শ  মহর্ষি দধীচির।  অনেকটা আমাদের  পরমবীর চক্রের  মতন।  আমেরিকা বা রাশিয়া কেউ প্যাটন ট্যাঙ্ক  বা স্যাবার জেট বা এফ সিক্সটিন  বা মিগ  বিক্রি করে যুদ্ধ করতে সাহায্য  করে কিন্তু সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর  আর কেউ নিজে মাঠে ময়দানে নেমে যুদ্ধ  করতে এগিয়ে আসেনি। তোমরা আমাদের  অস্ত্র কেনো, যুদ্ধ  কর। ফেল কড়ি,  মাখ তেল। তোমরা যত যুদ্ধ  করবে কর, অস্ত্র চাই কেনো আর আমাদের  অর্থভাণ্ডার সমৃদ্ধ কর। ব্রহ্মা তো সৃষ্টি করেই খালাস,  গোল বাধে বিষ্ণু আর মহেশ্বরের।  তা,  যা চলছিল  সেটা এখনও  চলছে। আমাদের  স্লোগানের  মতো চলছে, চলবে। এখনও  ইতি উতি  খুঁজলে  কিছু দধীচির  সন্ধান  মেলে। সংখ্যায় অল্প হলেও  এরা আছে এবং এদের  এই স্বার্থহীন কাজের  জন্য  সমস্ত  পৃথিবীটা চলছে। সেবা নিবৃত্ত  হবার  পরেও  তাদের  এই অসামান্য  সেবা যে কত অসহায় লোককে অন্ধের  যষ্টির মতো সঠিক  পথে চালিত  করে তার ইয়ত্ত্বা নেই। কোনরকম  দ্বিধা না করে এরা যে কত লোকের  উপকার  করে সেটা ভাবলেই অবাক হতে হয়। কার স্বামী অসুস্থ  হয়েছেন  বা গত হয়েছেন  এই দধীচিরা কারও  ডাকের অপেক্ষা করেন না, কেমনভাবে বাতাস যেন  তাদের  কানে পৌঁছে দেয় ওখানে তোমার  প্রয়োজন আর সেও ছোটে নির্দ্বিধায়। গুরু রামদাস যখন  শিবাজীকে ভিক্ষার  সন্ধানে বেরোতে নির্দেশ  দেন তখন যথেষ্ট  অন্ধকার। শিবাজী বলেন, " প্রভু, ভিক্ষা, এখন!  এখনও  তো হয়নি প্রভাত।" গুরু রামদাস  বলেন,  " প্রভাত কি রাত্রির  অবসানে ? যখনই  চিত্ত জেগেছে, তখনই  হয়েছে প্রভাত।  চল যাই, ভিক্ষার  সন্ধানে।"  এই দধীচিদের অন্তরেই  গুরুদেবের  অধিষ্ঠান  এবং এরা স্বতঃপ্রণোদিত  হয়েই সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে এগিয়ে যান  অন্যের  সাহায্যে। এঁরা বয়োঃকনিষ্ঠ  হলেও  এঁদের  জানাই  শত সহস্র  প্রণাম। 

Saturday, 18 December 2021

বিয়েবাড়ির চাটনি খবর

বিয়েবাড়িতে নানা ঘটনা ঘটে যেগুলো খুবই মজাদার  রসাল হয় এবং বিয়ে মিটে গেলেও তার রেশ  বহুদিন বজায় থাকে। অনেক মজাদার  ঘটনা ঘটলেও সব ঘটনার  সাক্ষী হওয়া কোন লোকের  পক্ষেই সম্ভব  নয়। সেইকারণে এই প্রবন্ধের  সংযোজন হতেই  থাকবে এবং এই প্রবন্ধ  কবে শেষ হবে তা একমাত্র ভগবানই বলতে পারেন। সবার কাছেই  অনুরোধ  থাকল  যে মুখরোচক কিছু খবরের  সন্ধান থাকলে যদি জানান তাহলে একটা  সার্থক গল্প দাঁড়ায়।

তখন মফস্বলে টেবিল  চেয়ারে বসে খাওয়া চালু হয়নি, ক্যাটারার  তো কোন দূরস্থান। বাড়ির শক্ত সামর্থ্য লোকেরাই পরিবেশন করত এবং লোকজন যদি সেরকম না থাকত তবে পাড়ার  লোকজন এসে কার্যোদ্ধার করে দিত। বিয়েবাড়িতে  তখন  মাটিতে বসেই  খাওয়া দাওয়ার রেওয়াজ  ছিল। পরিবেশনকারীরা পাজামা বা প্যান্টের উপর গামছা বা তোয়ালে জড়িয়ে শুরু করে দিত। টিমের  একজন ক্যাপ্টেন  থাকতেন  যিনি বাড়ির  মালিকের  সঙ্গে আলোচনা করে নিতেন  যে কত গেস্ট আছে এবং সেই সঙ্গে দেখে নিতেন যে কত পরিমাণ  খাবার  আছে। সেই বুঝে ঢালাও  পরিবেশন  বা হাত টেনে পরিবেশন করার  নির্দেশ তাঁর  টিমের  লোকজনদের  দিতেন। তবে প্রথম  দুটো ব্যাচ একটু টেনেই  পরিবেশন করা হতো।তারপর মালের স্টক এবং গেস্ট সংখ্যা বুঝে পরিবেশন করা হতো। তখন  আইসক্রিমের  চল আসেনি। দইয়ের হাঁড়ি বা মালসা  এক হাতে নিয়ে আর এক হাতে একটু বড় ধরণের  চামচ দিয়ে খুবই  মোলায়েমভাবে দইএর  উপর চালিয়ে দিতে হতো। সুতরাং, বুঝতে অসুবিধে  হয়না যে সবচেয়ে  অভিজ্ঞ পরিবেশকের হাতে এটা ন্যস্ত  হতো। পাঁচসেরি  একটা দইয়ের মালসা  এক হাতে নিয়ে ঝুঁকে পড়ে দই পরিবেশন করা কত কঠিন  কাজ  ছিল  সেটা অনুমেয়। এরপর  সবাই  চায় দইয়ের মাথা, আর নিজের  মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিবেশন করা এক দুরূহ  ব্যাপার ছিল। আর কিছু লোক  খেতেই  আসত যেন  মনে হয় সাতজন্মের খাওয়া ঐদিন ই খাবে। কিছু লোক  শুধু মাছ, মাংস  আর মিষ্টিই  খাবে যেন  বাড়িতে ঐরকম ই খায়। লাল শাকে বাদাম ভাজা আর তার উপর ছেটানো নারকেল কোঁড়া  দিয়ে শুরু করে নৌকার  মতন  বেগুন ভাজা কলাপাতায় পটাপট  পড়ত। এরপর গরম গরম  লুচিএবং আলুর দম বা এঁচোড়ের  ডালনা বা আলু পটলের তরকারি বা মটরশুঁটির কচুরী এবং আলু ফুলকপির  তরকারি( শীতের সময়) এবং এরপর আসত পোলাও এবং মাছের  কালিয়া এবং তারপর আসত পাঁঠার  মাংস। কম্পিটিশন করে খাবার  লোকজন এইবার  জামার হাতা ভাল করে গুটিয়ে নিয়ে বলতে থাকল বালতিটা  এখানেই  রেখে অন্য  বালতিতে  বাকিদের  সব দিন। আহা রে , চাঁদু,  বাড়িতে কটা পিস মাংস  খাও।  তখন  জিনিস পত্রের দাম  শস্তা হলেও  মাইনেও ছিল কম। সুতরাং, বাড়িতেও দুই তিন টুকরোর  মধ্যেই  সীমিত থাকত। এটাই  স্বাভাবিক। কেউ  অন্য কিছু না খেয়ে শুধু মাছ বা মাংস বা মিষ্টি খাবে এটা ঠিক  নয়। তবে অনেক  লোকেই তখন  খেতে পারত এবং সেই খাওয়াতে  যদি সামঞ্জস্য  থাকে তাহলে ঠিক  আছে। যেমন কেউ  লুচি, পোলাও এবং তার আনুষঙ্গিক  তরকারিপাতি খেয়ে মাছ বা মাংস খায় এবং তারপর আনুপাতিক হারে দই বা মিষ্টি খায় তাহলে আলাদা কথা। অনেকে রস চেপে রসগোল্লা খাওয়ার  সংখ্যা বাড়ায়। পরিবেশনকারিদের মধ্যেও  বেশ রসিক মানুষ থাকত  আর বলত ছানাচ্যাপ্টা দেব? এরকমই  সহকর্মীর  এক বিয়েতে বরযাত্রীদের  একজন আর একজনকে উস্কে দিল।   একজন সহকর্মী রসগোল্লা যতই  দেয় ততই  আলাদা একটা মাটির  ভাঁড়ে রস চিপে ফেলে দেয় এবং ছানাটা মুখের  মধ্যে দেয়।  পরিবেশন যিনি করছেন তিনি মনে মনে খুব  ক্ষুব্ধ  হলেও  কিছু বলতে পারছেন না। হাজার  হলেও  বরযাত্রী বলে কথা। যে সহকর্মীকে উস্কে দিয়েছিল সে একটু দূরে বসেছিল। সে একজন  পরিবেশনকারিকে ডেকে বলল," দাদা, একটা কথা বলব ? কিছু মনে করবেন  না তো?" না, না, না বলুন।  ঐ যে ভদ্রলোক  রসগোল্লা খাচ্ছেন,  উনি বেগুন ভাজা খেতে খুবই  ভালবাসেন  কিন্তু এখন যখন  মিষ্টি দেওয়া হচ্ছে,ও লজ্জ্বার খাতিরে চাইতে  পারছে না। ওকে গোটা কয়েক  বেগুন ভাজা এনে দেবেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটা একটা কথা হলো? উনি সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্রেতে গোটা আটেক  বড় বেগুন ভাজা এনে দিল  তার পাতে। আরে এ কি করছেন,  এ কি করছেন? না, না, একদম লজ্জ্বা পাবেন না। আমি মিষ্টির  বালতি নিয়ে আসছি। তার রস চেপে রসগোল্লা
খাওয়া মাথায় উঠল। ও তো বুঝতেই পেরেছে  যে এটা কার কম্মো। কিন্তু  এভাবে ওকে নিরস্ত করা ছাড়া আর কোন  রাস্তা ছিলনা।

এবার  আসা যাক  আরও  একটা মজাদার ঘটনায়। এটা ছিল  একটা মোটামুটি ঘ্যামা বিয়ে। বিরাট ব্যবসা ওদের। জুট মিল, কাপড়ের  দোকান ( হোলসেল ও রিটেল),সোনার  দোকান ও পেট্রোল পাম্প।  এছাড়াও  পুকুর,  জমি জমা, এককথায় বিশাল  ব্যাপার।  ওরা অনেক ভাই। সুতরাং বিশাল  ব্যবসা সামলানো কোন বড় ব্যাপার ই নয়। ওদের যিনি বড় ভাই মানে তিনি শুধু বয়সেই বড় নন ওদের  ব্যবসা সাম্রাজ্যের ও মুখ্য মাথা। বিশাল  বাড়ি ওদের, একটা নয়, দু দুটো তিনতলা বাড়ি। মাঝখানে  বিশাল  উঠোন । দুটো বাড়ির ছাদে ম্যারাপ বাঁধা । একটা বাড়ির  ছাদে যখন  খাওয়া দাওয়া হয় তখন  অন্য  বাড়ির  ছাদ পরিষ্কার  করা হয়। এখন আমরা দু কামরা বা তিন কামরার ফ্ল্যাটে থাকা লোক। সুতরাং, বিয়ে বা অন্য  কোন অনুষ্ঠান  করতে গেলে হল বা রিসর্ট ভাড়া করতে হয়। কিন্তু তখন তো ফ্ল্যাট  কালচার  আসেনি, স্টেশনে নেমে রায় ভিলা বা চৌধুরী  ম্যানসন যাব বললে রিক্সাওয়ালারা বসিয়ে নিয়ে মহাসমাদরে নিয়ে এসে বাড়ি পৌঁছে দিত। অনেক সময়ই তারা ভাড়া চাইতেও  লজ্জা পেত। ভাড়া জিজ্ঞেস  করলে তারা বলত যা হয় দেবেন কারণ ভাড়া চাইলে যদি বাবুদের সম্মান  নষ্ট হয়ে যায়। বাবুদের বাড়ির  অতিথি মানে তাদের ও যেন অতিথি। আর্থিক  ও সামাজিক  বৈষম্য  থাকলেও কেমন যেন  একটা সৌহার্দ্য  ও প্রীতির সম্পর্ক  ছিল যা কালক্রমে আজ নিশ্চিহ্ন। যাই হোক,  ফিরে আসা যাক  সেই বিয়েবাড়ির কথায়। এখানে সব কিছুই  ঢালাও। এই বিয়ে বাড়িতে খাওয়ার  প্রতিযোগিতা হতো ।শহরের  বিভিন্ন  ক্লাবকে তাঁরা নিমন্ত্রণ  করতেন এবং সেরা পেটুক মশাইকে তাঁরা পুরস্কার  দিতেন। বিভিন্ন  ক্লাবের  বিশাল দেহী  পালোয়ান তো আসতেনই,  সঙ্গে কিছু কুকুর পেটওয়ালা ডিগডিগে মার্কা লোক ও আসত এবং প্রায়শই  দেখা যেত এই লোকগুলোই  সিংহভাগ  পুরস্কার  নিয়ে যেত। আরও  একটা জিনিস  ছিল যেটা  হচ্ছে অতিথিপরায়ণাতা। খাওয়ার  সময় তদারকি ছাড়াও  খাবার  শেষে বেরোনোর  সময় জিজ্ঞেস করতেন  পেট ভরে ঠিকঠাক  করে খেয়েছে তো? কোন  ত্রুটি হয়নি তো? ট্যাডপোল দা বড় সাইজের  চল্লিশটা লুচির  সঙ্গে প্রয়োজনীয় তরকারি বা মাছ, মাংসের সঙ্গে বালতিখানেক পোলাও  ও বড় এক হাঁড়ি দইয়ের সঙ্গে পরিমাণ  মতো রসস্থ বোঁদে ও বড় সাইজের  রসগোল্লা ও সন্দেশ  মিলিয়ে খান পঞ্চাশেক  মিষ্টি খেয়ে বড় একটা ঢেকুর  তুলে ট্যাডপোল দা খাওয়া সমাপ্ত করতেন।  এ হেন  বৃকোদরের প্রথম পুরস্কার  বাঁধা। দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা সান্ত্বনা পুরস্কারগুলো কুকুরপেটওয়ালা হরি বা ভজাদের  কপালে জুটতো। 
এবার  আসা যাক, আরও  একটা আধুনিক বনেদী বাড়ির  বিয়েতে যেখানে বনেদীয়ানা এবং অতিথিপরায়ণতার সংমিশ্রণ সুন্দর ভাবে প্রতীয়মান।  কলকাতা থেকে জনা তিরিশেক এবং বম্বে থেকেও সম সংখ্যক বরযাত্রীদের দিল্লী যাবার  ব্যবস্থা হয়েছে প্লেনে এবং সেখান থেকে একটু দূরে ফরিদাবাদের  সূরযকুণ্ডে  তাজ হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কলকাতা থেকে দিল্লির যাত্রায় সাতজনের  জন্য  হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা হয়েছে।এরমধ্যে চারজনের  অপারেশন  বা অসুস্থতা এবং বাকি তিনজন অশীতিপর  বৃদ্ধা। কিন্তু এমনই ব্যাপার  যে এই বিয়েতে যেতেই  হবে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের  কথা এঁদের  মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশী বয়স্কা তিনিই সবচেয়ে বেশী ফিট। তাঁর সম্বন্ধে পরে কিছু বলতেই  হবে কারণ তিনি অনন্যা এবং  তাঁর  বয়স তিরানব্বই। তিনি পাত্রের  ঠাকুমা। যাই  হোক শীতের  শুরুতেও  দিল্লী যথেষ্টই  ঠাণ্ডা এবং শীতকাতুরে  বাঙালির তার জন্য  প্রস্তুতি সহজেই অনুমেয়। যাই হোক, সন্ধ্যে নাগাদ  দিল্লী বিমানবন্দরে পৌঁছে, মালপত্র  নিয়ে অনেকগুলো গাড়ি এবং একখানা বাসে সবাই  তাজ হোটেলে এসে পৌঁছাল। গোলাপ দিয়ে সম্বর্ধনার  পর মাটির  ভাঁড়ে গরম চায়ের  অভ্যর্থনা এক অসাধারণ অনুভূতি। খানিকটা গলা গরম করে যাওয়া হ'ল নিজের নিজের ঘরে এবং কিছুটা আনপ্যাক করতে না করতেই  সমন এসে গেছে ডিনারের। আক্রমণ  শুরু হ'ল থরে থরে সাজানো বিভিন্ন  সামগ্রীর।  ব্যূফে সিস্টেমে যার যা প্রাণে চায়  বাধানিষেধহীন হয়ে তাই দিয়ে পেট ভরাও।  কেউ  দেখতেও যাচ্ছেনা, বাধাও দিচ্ছেনা। হঠাৎই  মনে হ'ল ট্যাডপোল দা বেঁচে থাকলে কি যৎপরোনাস্তি আনন্দিতই  না হতেন। টানা ঘুমের  পরে সকালে উঠে নিজেই নিজের  চা বানিয়ে খেয়ে নেওয়া, সঙ্গে থাকা বিভিন্ন  ধরণের  স্ন্যাকসের সহযোগে।  সকাল বেলায় ব্রেকফাস্ট  ঐ হোটেলের ই একটা রেস্তোরাঁয়।  এরই মধ্যে একজনের জুতোর  সোল গেছে খুলে। সে বেচারা খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসেছে রিসেপশনে  জিজ্ঞেস  করতে কাছাকাছি কোন জুতোর দোকান  বা রিপেয়ার করার কোন জায়গা আছে কিনা । এদিকে পাত্রীর দাদার  নজরে সেটা পড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বলে দিল এক অডি গাড়ির  ড্রাইভারকে। কি আর করে বেচারা। আরও  একজনকে সঙ্গে  নিয়ে চলল মুচির খোঁজে অডি গাড়িতে চড়ে।  মুচি যেখানে বসে তার থেকে অনেক  দূরে গাড়ি রেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পকেট  থেকে খুলে যাওয়া সোলটা বের করে বলল ইসকো বানানা পড়েগা। ঠিক হায় সাব অভি পেস্টিং কর দেতে । নহী নহী ভাই আপ পেস্টিং করকে সিলাই ভি কর দিজিয়ে। তো সাব, উসমে তো বহুত  টাইম লগেগা। কুছ পরোয়া নেহী।   এর পর সঙ্গীতের  জন্য রিহার্সাল  শুরু। নাচগানের মাধ্যমে দুই পরিবারের  আরও  কাছাকাছি  আসা এই সঙ্গীতের উদ্দেশ্য। ঐদিন  সকাল  বেলায় বম্বে থেকে একটা টিম এবং কলকাতা থেকে আরও একটা টিম চলে এল সঙ্গীত সন্ধ্যাকে  আরও  মধুময় করতে। শুরু হ'ল অমিতাভ  বচ্চনের  গলায় গণেশ বন্দনা দিয়ে আর তারপরেই শুরু হ'ল নৃত্য গীতের সুষমামণ্ডিত পরিবেশন। ঐ অল্প সময়ের মধ্যেই  কি দারুণ  রিহার্সাল, দেখার মতন। যাই  হোক, রাতের  ডিনারের  পর গল্প, গল্প আর গল্প।
পরদিন  ঘুম ভাঙতে একটু দেরী হ'ল। সকাল  বেলায় নান্দীমুখ  ও গায়ে হলুদ। দুটো পাশাপাশি স্যুইটে পাত্রপক্ষ ও পাত্রীপক্ষের  অবস্থান।  সুতরাং গায়ে হলুদের  তত্ত্ব নিয়ে যাওয়া আসাতে  কোনসময় ব্যয় হ'লনা। সন্ধ্যে বেলায় বিয়ে, পাত্র এল করতে বিয়ে রোলস রয়েস  নিয়ে।  বিয়ের  মণ্ডপ খোলা জায়গায়। ঠাণ্ডা হাওয়ার  কামড়ে বসে থাকা যায়না কিন্তু চারদিকে হিটার  জ্বালিয়ে দেওয়ায় খুবই  মনোরম পরিবেশ তৈরী হয়েছিল আর কবিগুরুর  গান আগুনের  পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে মনে পড়ে যাচ্ছিল। এদিকে প্রশস্ত  হলে খাওয়া দাওয়া চলছে। বিভিন্ন  অতিথিরা আসছেন,  যাচ্ছেন  ও তাঁদের পছন্দ মতন খাওয়া দাওয়া করছেন  আর ঐদিকে অনুরাগ রাস্তোগীর ব্যাণ্ডের অপূর্ব  সুর একের পর এক মূর্ছনা সৃষ্টি করে চলেছে। এক অপূর্ব  মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। লাঠি হাতে এক স্যুট পরিহিত ভদ্রলোক রাস্তোগীর গানের ভিডিও  করছিলেন এবং আলাপ করলেন।  বাঁশি, স্যাক্সোফোন, বেহালা ও কীবোর্ডের সন্তুলন মিশ্রণে  একের পর এক পুরনো  দিনের গান বেজে উঠছে আর ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, বুড়িদের শরীর  হিন্দোলিত হচ্ছে। উপস্থিত  জনগণের  মধ্যে সবচেয়ে বর্ষীয়ান  ভদ্রমহিলার  শরীরের আন্দোলন  দেখে লাঠি হাতে হাঁটা ভদ্রলোক ঐ ভদ্রমহিলার  হাত ধরে নাচার  জন্য  অনুরোধ  করলেন।  ঐ বর্ষীয়সী  ভদ্রমহিলা তাঁর অনুরোধ  উপেক্ষা  করতে পারলেন  না। তিনিও পুরোদস্তুর নাচে অংশগ্রহণ করলেন  এবং রাস্তোগীরাও  অত্যন্ত  উদ্বুদ্ধ  হয়ে উঠলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আরও  অনেক  বর্ষীয়ান  ভদ্রলোক ও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তাল মেলালেন। কি অসাধারণ  প্রাপ্তি বর্ণনা করা যায়না। যাই হোক,  পরদিন  সকালে ব্রেকফাস্ট  করে ফিরে আসার  পালা। চারদিনের লোকজনের  ব্যবহার এতটাই  মধুর  ছিল  যে এটাকে একটা তেল খাওয়া  মেশিনের  সঙ্গে তুলনা করা যায়। পার্থক্য  এইটাই  যে মেশিনের  চলন প্রাণহীন  কিন্তু এখানে প্রত্যেকটি লোকের ব্যবহার  হৃদয়মিশ্রিত।

Thursday, 16 December 2021

সময়

সে এক বড্ড দামাল ছেলে, নামটা ছিল  সময়
ধরতে তাকে চেষ্টা সবাই  করে কিন্তু কেবলই হাত ফসকে সে পালায়
পৃথিবীর আলো যখন  চোখে পড়ে খেলতে থাকে আপনমনে নিজ মাতৃক্রোড়ে 
কেমনভাবে যায় যে কেটে বেলা,এবার  স্কুলে ভর্তি হবার  পালা
বন্ধু অনেক হ'ল যে ইস্কুলে ,কেউ বা তারা থাকল আমার  সাথে
কেউ বা গেল মেডিক্যালে কেউ বা অন্য পথে
আগের দিনে ছিল  পেশা ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারি
কেউ  বা হতো উকিল নয়তো কেউ বা প্রফেসারি
এখন তো ভাই  হরেক পেশা কেউ হয় এম বি এ
কম্পিউটারের অনেক  শাখা কেউ বা এম সি এ
ভিন্ন  পেশায় বন্ধু জোটে ভিন্ন তাদের মত
কথায় কথায় মান অভিমান পাল্টায় তাদের পথ
মেলেনা সেই  স্কুলের দিনের  বন্ধু নির্ভেজাল 
মান অভিমান ভুলে না যাওয়ায় কেটে যায় সেই তাল
চুলে ধরে পাক নড়ে যায় দাঁত শেষের আমন্ত্রণ 
বুঝতেই পারি দিনের শেষে সন্ধ্যার  আগমন
নিয়মের ফেরে সন্ধ্যার পরে রাত্রি প্রতীক্ষায়
ছেড়ে যেতে হবে এই ধরাধাম নূতন যাত্রায়
তবুও  চেষ্টা করে যাই শুধু সময়কে  ধরিবার
সময় শুধুই  হাসিয়া বলে আমি দুর্নিবার।


Wednesday, 15 December 2021

স্বপ্নের খোঁজে লেখক নিখোঁজ

মোহনবাবুর আজ খুব আনন্দ ।দীর্ঘদিন  কাজ করার  ফাঁকে আজ একটু লম্বা ছুটি পেয়েছেন। গিন্নীর অনেক অনুযোগ আজ একটু প্রশমিত করার  সুযোগ  এসেছে। যখনই  ছুটির  দরখাস্ত  করেছেন তখনই কর্তৃপক্ষের অনুরোধ  এসেছে একটু পিছানো  যায়না? মোহনবাবুর স্বভাবই  এরকম যে উনি কখনোই কর্তৃপক্ষের  আদেশ অমান্য  করেন নি। কিন্তু এবার  তাঁর ঊর্ধ্বতন  কর্তৃপক্ষ আর না করতে পারেন নি মুখরক্ষার খাতিরে। যাই হোক মহানন্দে গুনগুন করতে করতে বাড়ি ফিরছেন। অফিসের  শেষে সাধারণত  মোহনবাবু এতটাই  ক্লান্ত হয়ে  ফেরেন যে বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধুয়ে একটা বড় গামলার  মতন  কাপ চা না খেলে কথাই  বলতে ইচ্ছা করেনা। খাওয়া দাওয়া করার  পরে এই মোহনবাবুর একটা ব্যাপার আছে। কিছু না কিছু উনি লিখবেন। আজ সেই মানুষটার অন্য রকম চেহারা দেখে গিন্নী রীতা রীতিমত  চিন্তিত হয়ে পড়ল। কি গো, আজ কি লটারির  টিকিটে কিছু ভালোমন্দ  পেয়েছ নাকি?  মোহন বা রীতা কেউই  কারো নাম ধরে ডাকেনা। হ্যাঁগো, শুনছো  এরই মধ্যে ঘোরাফেরা করে। নাম ধরে ডাকতে  স্বামী বা স্ত্রীর  দুজনেরই  কেমন  লজ্জ্বা লজ্জ্বা ভাব। আজ মোহন বিনয়ের কাছ থেকে গরম গরম আলুর  চপ ও পেঁয়াজি  কিনে এনেছে। আজ শুধু চা নয় সঙ্গে তেল মাখিয়ে  মুড়ির  সঙ্গে বেশ জম্পেশ  করে আলুর চপ ও পেঁয়াজি খাচ্ছে। হঠাৎই  রীতাকে টেনে নিয়ে মুখে এক গাল মুড়ি ও আলুর  চপ ঠুঁসে  দিয়েছে, রীতা হকচকিয়ে গেল। এই বুড়ো বয়সে কি মাথার  গন্ডগোল  হল কিনা ভেবে খুবই  দুশ্চিন্তাগ্রস্ত  হলো। কি ব্যাপার,  আজ কি ভীমরতি হলো নাকি? মোহন আর হেঁয়ালির  মধ্যে রাখল না, বলল যে  অবশেষে  ছুটি পাওয়া গেছে,  আমরা যাব বেড়াতে সবাইকে নিয়ে।  তার মানে? এর মানে খুবই  সহজ। আমরা সবাই  বেড়াতে যাব । সবাই  মানে? সবাই  মানে আমরা সবাই, বাবা, মা, তোমার  বাবা, মা আমরা সবাই।  এতজন বুড়ো মানুষকে নিয়ে যেতে তোমার  বুক একটুও  কাঁপছে না? 
না। আমি  সবাইকেই  নিয়ে যাব। 
ট্র্যাভেল এজেন্টকে বলে একটু  বেশিই  টাকা দিয়ে হায়দরাবাদ  যাবার  টিকিট  কাটা হলো। টিকিট কাটা হলে উনি যাত্রাটা কি রকম  হবে সেটা নিয়ে মোটামুটি একটা নিবন্ধ খাড়া করলেন।  মোহনবাবু ছেলে, বৌমা, নাতি, নাতনি, মেয়ে, জামাই, বাবা, মা, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি এবং নিজেদের  টিকিট নিয়ে বারটা টিকিট  কেটে  রওনা দিলেন তাঁরা সবাই।  খুব  ভাল  চলছে গাড়ি। চার বুড়োবুড়ি সেই পুরনো  দিনের কথাই  রোমন্থন  করে চলেছে। এদিকে ছেলে, বৌমা ও মেয়ে, জামাই তারাও  গল্পে মত্ত। মোহন ও রীতা তাদের  নাতি ও নাতনিদের  নিয়ে ব্যস্ত।  হঠাৎই  ট্রেন টা একটা বড় স্টেশনে এসে থামল। অনেকক্ষণ  ধরেই ট্রেন টা থেমে আছে। গল্প করতে করতে সবার  চোখই  বেশ  লেগে এসেছে আর এই ফাঁকে ক্ষুদে দুটো কখন সবার  অলক্ষ্যে  ট্রেন  থেকে নেমে স্টেশন  চত্বরে খেলতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎই  একটা হ্যাঁচকা টান, ট্রেন টা চলতে শুরু করেছে। তখনও কারো খেয়াল  হয়নি যে বাচ্চা দুটো গেল  কোথায়? এরপর ট্রেন টা আস্তে আস্তে স্পীড  নিতে শুরু করেছে। হঠাৎই  মোহনের  খেয়াল  হলো যে বাচ্চা দুটো নেই। দরজার  কাছে ছুটে এসে দেখে তারা ট্রেনের  পিছনে ছুটছে কাঁদতে কাঁদতে। কালবিলম্ব না করে প্ল্যাটফর্মে লাফিয়ে নামল এবং নাতিকে কোনরকমে কামরায় প্রায় ছুঁড়ে ঢুকিয়ে দিয়ে নাতনির নাম ধরে ডাকতে থাকল কিন্তু কেমন  যেন  হাওয়ায়  উবে গেল।  ইতিমধ্যে ট্রেনটি অনেক দূর চলে গেছে  শুধু ট্রেনের  পিছনে লাল আলোটা দেখা যাচ্ছে। বোঝাই  যাচ্ছেনা যে ট্রেনটি থেমেছে না চলে যাচ্ছে। আর মোহন  পাগলের  মতন নাতনির নাম ধরে ডেকে এদিক ওদিক  ছোটাছুটি করছে।  স্বাভাবিক ভাবে জিআরপি কে খবর দেওয়ার  কথা তার  মনেও আসেনি। হঠাৎই  কেমন  ভাবে যে মোহনের  মাথা বিগড়ে  গেল এবং কি করে যে সে উধাও  হয়ে গেল  কেউ জানতেও পারল না। লাইনে লাইনে সে খোঁজে তার  নাতনিকে। 
তার  ছেলে, বৌমা, মেয়ে জামাই রা সকালে উঠে দেখে যে তাদের  বাবা বা শ্বশুর মশাই তাঁর বার্থে  নেই । প্রথমে তারা ভাবল যে হয়তো টয়লেটে  গেছেন কিন্তু অনেকক্ষণ  পরেও তাঁকে  দেখতে না পেয়ে বিজিয়ানগরম স্টেশনে জিআরপিতে  জানাল। মোহনের  বাবা, মা এবং রীতার  বাবা মা ও  খুবই  অস্থির  হয়ে পড়েছেন কিন্তু তাঁরা এতই বৃদ্ধ যে কি করা উচিত  তা তাঁরা  বুঝে  উঠতে পারছেন না। নাতি ও নাতনি তারাও এতটাই  ছোট  যে তারাও কেমন  ভীষণ  চুপচাপ  হয়ে গেছে।  রীতা তার ছেলেমেয়েদের  সঙ্গে আলোচনা করে বিজয়বাড়ায়  নেমে যাওয়ার স্থির করলেন  এবং স্টেশন  মাস্টারের সঙ্গে দেখা  করে আদ্যোপান্ত  বললেন এবং তিনিই  তাদের  ফেরার  বন্দোবস্ত  করলেন কিন্তু মোহনের  কোন খোঁজ পাওয়া গেলনা। আসলে মোহন  স্বপ্ন  দেখে তার  নাতি নাতনিদের  খেলতে দেখে মাঝরাতে কোথায় যে নেমে গেলেন  কেউ জানতেই পারল না। মোহনের  খোঁজ  এখনও  পর্যন্ত  পাওয়া যায়নি। সাধারণত  একই সঙ্গে চার জেনারেশন দেখাই যায়না কারণ  আজকাল  ছেলে বা মেয়েরা অল্প বয়সে বিয়ে করেনা, বড় জোর  তিন  জেনারেশন দেখা যায়। কিন্তু চার জেনারেশনের  একসঙ্গে যাত্রা  এক বিরল ব্যাপার। তার যে এরকম নিদারুণ পরিণতি হবে এটা সকলের বুদ্ধির অগোচরে।