Wednesday, 15 December 2021

স্বপ্নের খোঁজে লেখক নিখোঁজ

মোহনবাবুর আজ খুব আনন্দ ।দীর্ঘদিন  কাজ করার  ফাঁকে আজ একটু লম্বা ছুটি পেয়েছেন। গিন্নীর অনেক অনুযোগ আজ একটু প্রশমিত করার  সুযোগ  এসেছে। যখনই  ছুটির  দরখাস্ত  করেছেন তখনই কর্তৃপক্ষের অনুরোধ  এসেছে একটু পিছানো  যায়না? মোহনবাবুর স্বভাবই  এরকম যে উনি কখনোই কর্তৃপক্ষের  আদেশ অমান্য  করেন নি। কিন্তু এবার  তাঁর ঊর্ধ্বতন  কর্তৃপক্ষ আর না করতে পারেন নি মুখরক্ষার খাতিরে। যাই হোক মহানন্দে গুনগুন করতে করতে বাড়ি ফিরছেন। অফিসের  শেষে সাধারণত  মোহনবাবু এতটাই  ক্লান্ত হয়ে  ফেরেন যে বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধুয়ে একটা বড় গামলার  মতন  কাপ চা না খেলে কথাই  বলতে ইচ্ছা করেনা। খাওয়া দাওয়া করার  পরে এই মোহনবাবুর একটা ব্যাপার আছে। কিছু না কিছু উনি লিখবেন। আজ সেই মানুষটার অন্য রকম চেহারা দেখে গিন্নী রীতা রীতিমত  চিন্তিত হয়ে পড়ল। কি গো, আজ কি লটারির  টিকিটে কিছু ভালোমন্দ  পেয়েছ নাকি?  মোহন বা রীতা কেউই  কারো নাম ধরে ডাকেনা। হ্যাঁগো, শুনছো  এরই মধ্যে ঘোরাফেরা করে। নাম ধরে ডাকতে  স্বামী বা স্ত্রীর  দুজনেরই  কেমন  লজ্জ্বা লজ্জ্বা ভাব। আজ মোহন বিনয়ের কাছ থেকে গরম গরম আলুর  চপ ও পেঁয়াজি  কিনে এনেছে। আজ শুধু চা নয় সঙ্গে তেল মাখিয়ে  মুড়ির  সঙ্গে বেশ জম্পেশ  করে আলুর চপ ও পেঁয়াজি খাচ্ছে। হঠাৎই  রীতাকে টেনে নিয়ে মুখে এক গাল মুড়ি ও আলুর  চপ ঠুঁসে  দিয়েছে, রীতা হকচকিয়ে গেল। এই বুড়ো বয়সে কি মাথার  গন্ডগোল  হল কিনা ভেবে খুবই  দুশ্চিন্তাগ্রস্ত  হলো। কি ব্যাপার,  আজ কি ভীমরতি হলো নাকি? মোহন আর হেঁয়ালির  মধ্যে রাখল না, বলল যে  অবশেষে  ছুটি পাওয়া গেছে,  আমরা যাব বেড়াতে সবাইকে নিয়ে।  তার মানে? এর মানে খুবই  সহজ। আমরা সবাই  বেড়াতে যাব । সবাই  মানে? সবাই  মানে আমরা সবাই, বাবা, মা, তোমার  বাবা, মা আমরা সবাই।  এতজন বুড়ো মানুষকে নিয়ে যেতে তোমার  বুক একটুও  কাঁপছে না? 
না। আমি  সবাইকেই  নিয়ে যাব। 
ট্র্যাভেল এজেন্টকে বলে একটু  বেশিই  টাকা দিয়ে হায়দরাবাদ  যাবার  টিকিট  কাটা হলো। টিকিট কাটা হলে উনি যাত্রাটা কি রকম  হবে সেটা নিয়ে মোটামুটি একটা নিবন্ধ খাড়া করলেন।  মোহনবাবু ছেলে, বৌমা, নাতি, নাতনি, মেয়ে, জামাই, বাবা, মা, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি এবং নিজেদের  টিকিট নিয়ে বারটা টিকিট  কেটে  রওনা দিলেন তাঁরা সবাই।  খুব  ভাল  চলছে গাড়ি। চার বুড়োবুড়ি সেই পুরনো  দিনের কথাই  রোমন্থন  করে চলেছে। এদিকে ছেলে, বৌমা ও মেয়ে, জামাই তারাও  গল্পে মত্ত। মোহন ও রীতা তাদের  নাতি ও নাতনিদের  নিয়ে ব্যস্ত।  হঠাৎই  ট্রেন টা একটা বড় স্টেশনে এসে থামল। অনেকক্ষণ  ধরেই ট্রেন টা থেমে আছে। গল্প করতে করতে সবার  চোখই  বেশ  লেগে এসেছে আর এই ফাঁকে ক্ষুদে দুটো কখন সবার  অলক্ষ্যে  ট্রেন  থেকে নেমে স্টেশন  চত্বরে খেলতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎই  একটা হ্যাঁচকা টান, ট্রেন টা চলতে শুরু করেছে। তখনও কারো খেয়াল  হয়নি যে বাচ্চা দুটো গেল  কোথায়? এরপর ট্রেন টা আস্তে আস্তে স্পীড  নিতে শুরু করেছে। হঠাৎই  মোহনের  খেয়াল  হলো যে বাচ্চা দুটো নেই। দরজার  কাছে ছুটে এসে দেখে তারা ট্রেনের  পিছনে ছুটছে কাঁদতে কাঁদতে। কালবিলম্ব না করে প্ল্যাটফর্মে লাফিয়ে নামল এবং নাতিকে কোনরকমে কামরায় প্রায় ছুঁড়ে ঢুকিয়ে দিয়ে নাতনির নাম ধরে ডাকতে থাকল কিন্তু কেমন  যেন  হাওয়ায়  উবে গেল।  ইতিমধ্যে ট্রেনটি অনেক দূর চলে গেছে  শুধু ট্রেনের  পিছনে লাল আলোটা দেখা যাচ্ছে। বোঝাই  যাচ্ছেনা যে ট্রেনটি থেমেছে না চলে যাচ্ছে। আর মোহন  পাগলের  মতন নাতনির নাম ধরে ডেকে এদিক ওদিক  ছোটাছুটি করছে।  স্বাভাবিক ভাবে জিআরপি কে খবর দেওয়ার  কথা তার  মনেও আসেনি। হঠাৎই  কেমন  ভাবে যে মোহনের  মাথা বিগড়ে  গেল এবং কি করে যে সে উধাও  হয়ে গেল  কেউ জানতেও পারল না। লাইনে লাইনে সে খোঁজে তার  নাতনিকে। 
তার  ছেলে, বৌমা, মেয়ে জামাই রা সকালে উঠে দেখে যে তাদের  বাবা বা শ্বশুর মশাই তাঁর বার্থে  নেই । প্রথমে তারা ভাবল যে হয়তো টয়লেটে  গেছেন কিন্তু অনেকক্ষণ  পরেও তাঁকে  দেখতে না পেয়ে বিজিয়ানগরম স্টেশনে জিআরপিতে  জানাল। মোহনের  বাবা, মা এবং রীতার  বাবা মা ও  খুবই  অস্থির  হয়ে পড়েছেন কিন্তু তাঁরা এতই বৃদ্ধ যে কি করা উচিত  তা তাঁরা  বুঝে  উঠতে পারছেন না। নাতি ও নাতনি তারাও এতটাই  ছোট  যে তারাও কেমন  ভীষণ  চুপচাপ  হয়ে গেছে।  রীতা তার ছেলেমেয়েদের  সঙ্গে আলোচনা করে বিজয়বাড়ায়  নেমে যাওয়ার স্থির করলেন  এবং স্টেশন  মাস্টারের সঙ্গে দেখা  করে আদ্যোপান্ত  বললেন এবং তিনিই  তাদের  ফেরার  বন্দোবস্ত  করলেন কিন্তু মোহনের  কোন খোঁজ পাওয়া গেলনা। আসলে মোহন  স্বপ্ন  দেখে তার  নাতি নাতনিদের  খেলতে দেখে মাঝরাতে কোথায় যে নেমে গেলেন  কেউ জানতেই পারল না। মোহনের  খোঁজ  এখনও  পর্যন্ত  পাওয়া যায়নি। সাধারণত  একই সঙ্গে চার জেনারেশন দেখাই যায়না কারণ  আজকাল  ছেলে বা মেয়েরা অল্প বয়সে বিয়ে করেনা, বড় জোর  তিন  জেনারেশন দেখা যায়। কিন্তু চার জেনারেশনের  একসঙ্গে যাত্রা  এক বিরল ব্যাপার। তার যে এরকম নিদারুণ পরিণতি হবে এটা সকলের বুদ্ধির অগোচরে। 

No comments:

Post a Comment