ভগবানের আশীর্বাদে আমাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মোটামুটি ভাল সম্পর্ক থাকার সুবাদে মাঝে মাঝেই নির্মল বাতাসের সন্ধানে আমরা বেরিয়ে পড়ি। মাঝে দুটো বছর আপদ করোনার উৎপাতে এটা যথেষ্ট ব্যাহত হয়েছে, শুধু আমাদেরই নয় ,সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে ছেড়েছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে কোথাও যাওয়ার ভীষণ প্রয়োজন। গোদের উপর বিষফোড়ার মতন আবার বহুদিনের হাঁটুর ব্যথাকে বিদায় জানাতে হাঁটু প্রতিস্থাপন করতে হয়েছে। সুতরাং শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রায় বিপর্যস্ত অবস্থা। যাই হোক, সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর ঠিক হলো ঘাটশিলা যাওয়া হবে। সেখানে প্রখ্যাত লেখক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত কিছু ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং সুবর্ণরেখার ধারে কিছু সময় কাটানোর এক প্রলুব্ধ হাতছানি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসপাতালের লাউঞ্জে বসে ডাক্তার বাবুর জন্য অপেক্ষারত সময়ে যোগাযোগ করলাম ওখানকার এক হোটেলের সঙ্গে। ম্যানেজারের সপ্রতিভ জবাবে খুবই খুশি হয়ে জানুয়ারির তেইশ এবং চব্বিশ তারিখে কুড়ি জনের জন্য দশটা ঘর বুক করা হলো শহর থেকে একটু দূরে। কিন্তু একটা মুশকিল হলো যে একতলা, দোতলা এবং তিনতলায় মিলে দশটা ঘর হলো এবং খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা তারাই করবে জানালো। কিন্তু আবার সেই করোনা নামক দৈত্যর তৃতীয় ঢেউ এসে পড়ায় সমস্ত উৎসাহে আবার জল পড়ে গেল। এর মধ্যে একজন আসবে বম্বে থেকে, সুতরাং তার আসার পরেই দিন স্থির করতে হবে এবং মার্চ মাসের নয় তারিখ সকাল বেলায় যাত্রা করে এগার তারিখ সন্ধেবেলায় ফিরে আসা। বাস ঠিক করা হলো এবং সাড়ে পাঁচটায় যাত্রা শুরু করে সবাইকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা দুটো বেজে গেল। ইতিমধ্যে এক বিপত্তি ঘটেছে। যে হোটেল প্রথমে বুক করা হয়েছিল এবং পরে বহুচেষ্টায় তারিখ বদলানো হয়েছিল তারা জানালো যে তাদের পক্ষে খাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। এক ভীষণ সমস্যার মুখোমুখি হলাম। আমাদের সবাই সিনিয়র সিটিজেন, কেউ কেউ সুপার ডুপার সিনিয়র সিটিজেন। এদের খাওয়ার ব্যবস্থা না করলে সেখানে যাওয়াই বৃথা। অতএব শুরু হলো অন্য হোটেলের খোঁজ। ভগবান সহায় হলে সব কিছুই সম্ভব। বিভূতিভূষণের বাড়ির কাছেই এক হোটেলের খোঁজ পাওয়া গেল, নাম তার হোটেল বিভূতি বিহার। এই হোটেলের ম্যানেজার ওমপ্রকাশ জী অত্যন্ত ভদ্রলোক। তিনি আমাদের সবার জন্য একতলায় ব্যবস্থা করে দিলেন। আগেভাগে বলে দেওয়ায় খাওয়ার কোন কষ্টই হলোনা। বিকেল বেলায় বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি দেখা হলো। বাড়ির কম্পাউন্ডেই একটা বাংলা মাধ্যমের স্কুল চালান স্থানীয় কিছু বাংলাপ্রেমী ভদ্রলোক কোনরকম সরকারি অনুদান ছাড়াই। তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টা এবং আমাদের মতন কিছু বেড়াতে আসা লোকজনদের সহায়তায় স্কুলটি চলে এবং কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও করে তারা। যাই হোক কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি সঞ্চয় করে সুবর্ণরেখার তীরে সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য রওনা দিলাম। মাঝপথে হিন্দুস্থান কপারের কারখানাকে রেখে ফিরে আসতে আমাদের দেরী হয়ে যাওয়ার জন্য মাঝপথেই দিনকর সেদিনের মতো আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। অতএব, হোটেলেই ফিরে আসা এবং বিশ্রাম নেওয়া। অনেকটা জায়গা জুড়ে হোটেলের অবস্থান এবং নানা ফুলের সমাহারে এক অপূর্ব সুন্দর দোতলা হোটেল। দশ তারিখ ভোরবেলায় উঠে স্নান করে জায়গার চারপাশ ঘুরছি এবং কোনও জায়গায় চা পাওয়া যায় কিনা তার খোঁজ করছি কিন্তু না, আশে পাশে কোন চায়ের দোকান নজরে এলনা। হঠাত, দূরে দেখি একটা দাড়িওয়ালা লোক বাবা জী হোটেলের সামনে ঝাঁট দিচ্ছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম কখন খুলবে এই হোটেল? ও জানালো যে একটু পরে আসবে মালিক। আমি এধার ওধার ঘুরে চা না পেয়ে ভগ্নমনোরথ হয়ে যখন ফিরছি তখন দেখি দাড়িওয়ালা বাবাজীর ঝাঁট দেওয়া শেষ। এখনও আসেনি লোক জিজ্ঞেস করায় সে হোটেল সংলগ্ন একটা বাড়ি থেকে একজন মহিলাকে ডেকে আনল। আমি জিজ্ঞেস করলাম বহেনজী, অভি চায়ে মিল সকতা হায়? হাঁ, বাবুজী অভি বনা কে দে রহা হুঁ। তুলসী পাতা দিয়ে খাঁটি দুধের চায়ে হাল্কা মিষ্টি দিয়ে যে চা খেলাম, এককথায় অপূর্ব। ওখানে আসা দুটো দেহাতি ছেলে, দাড়িওয়ালা বাবাজী এবং কুনি দেবী( হোটেলের মালকিন) এবং আমার দুকাপ চায়ের দাম ষাট টাকা মিটিয়ে ফিরে এলাম। বাড়তি প্রাপ্তির মধ্যে কুনি দেবীর ঘরে ভাজা একমুঠো মুড়ি সম্পূর্ণ আলাদা স্বাদের। সন্ধেবেলায় তাঁকে বলে রাখা কুড়িজনের জন্য চা হয়ে গেল ত্রিশটা, এতই ভাল লেগেছে সকলের।
পরের দিন অর্থাৎ দশ তারিখ সকাল বেলায় ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়লাম গালুডি ড্যামের দিকে। শীর্ণকায় নদীর কঙ্কালসার ফল্গুধারায় উজ্জীবিত হয়নি বাঁধের ধরে রাখা জল, সুতরাং একটু হতাশই হতে হলো কিন্তু বর্ষার আগমনে এই বাঁধই জলে টইটম্বুর হয়ে ওঠে এবং বিস্তীর্ণ এলাকার চাষে হাত বাড়িয়ে দেয়। খানিকক্ষণ থেকে রওনা দেওয়া হলো যাদুগুড়ায় রঙ্কিনী দেবীর মন্দিরের উদ্দেশ্যে। যাদুগুড়া বিখ্যাত তার ইউরেনিয়াম ভান্ডারের জন্য। সুতরাং ভারত সরকারের কড়া নজরদারিই স্বাভাবিক। যাই হোক, তাকে পেরিয়ে রঙ্কিনী দেবীর মন্দির পৌঁছলাম। মায়ের মন্দিরে দূরদূরান্ত থেকে বহু লোক পূজো দিতে আসা মনস্কামনা পূরণের জন্য। একটা জিনিস চোখে পড়ল যে পুণ্যার্থীরা সবাই খুব সুশৃঙ্খলভাবে পূজো দিচ্ছেন যা সাধারণত অন্যান্য মন্দিরে সচরাচর চোখে পড়েনা। এরপর যাত্রা শুরু হলো নয়নাভিরাম বুরুডি ড্যামের দিকে। এটা গালুডির মতো আধুনিকা নয় বরং বেশ পৃথুলা। সুতরাং এক বিস্তীর্ণ সুগভীর জলরাশি মনকে বেশ টানে। ওখানে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা ছিল কিন্তু সময় হাতে না থাকায় এবং এত সুপার সিনিয়র সিটিজেনদের নিয়ে তা অসমাপ্ত রেখেই চলে আসতে হলো। ওখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের টিলায় থাকা ঝর্ণা ধারা না দেখেই চলে আসতে হলো। আসলে আমাদের একটা ভুল হয়েছিল কোন গাইড না নেওয়ায় আর আমাদের ড্রাইভার ও ছিল আনকোড়া। হোটেলে ফিরে এসে খাওয়ার পর একটু ছোট্ট ভাতঘুম দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্দেশ্যে। সান্ধ্য আরতির এক বিশেষ আকর্ষণ এই রামকৃষ্ণ মিশন। হোটেলে ফিরে আমাদের সদা যুবতী তিরানব্বই বছরের মাসিমা চল্লিশ পঞ্চাশের আধুনিকাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাচে গানে মেতে উঠলেন যা সব পাওয়াকেই ছাড়িয়ে গেল। পরের দিন এগার তারিখ ফেরার পালা। ব্রেকফাস্ট সেরে চল ফিরে নিজ নিজ ডেরায়, মাঝখানে কোলাঘাটে শের ই পাঞ্জাবে অবশ্যই মধ্যাহ্নভোজন সেরে।
Nice. But the retired life can be enjoyed if we can for a picnic with all retirees. But corona has made our life miserable. What to do we have to adjust.
ReplyDelete