উদো দার ভাল নাম একটা নিশ্চয়ই ছিল কিন্তু খুব কম লোকই তার ভালনামটা জানত। আর নাম জেনে কাজ কি? প্রয়োজনে রাত বিরেতে যাকে ডাকলেই পাশে পাওয়া যায় তাতে নামের কি দরকার, উদো দা উদো দা ই। ব্যাস সাফ কথা। কিন্তু ঐ নামের পিছনে একটা রহস্য বা সত্য লুকিয়ে আছে যেটা অনু ভাবলেও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। উদো দা যে স্কুলে পড়তেন সেই স্কুলের মাস্টার মশাই ছিলেন সদানন্দ বাবু। পাড়ার পূজো উদো দাদের বাড়িতেই হতো। একদিন সদানন্দ বাবু গল্প করতে করতে বলে ফেললেন উদো দার ভাল নাম। সবাই উদগ্রীব হয়ে শুনছে স্যারের কথা। উদো দার আসল নাম উদ্বৃত্ত নারায়ণ মিত্র। সবাই হাঁ হয়ে গেল ঐ অদ্ভুত নাম শুনে। সদা দা, এইরকম নামকরণের কি অর্থ থাকতে পারে, পানু বাবু জিজ্ঞেস করলেন। সদানন্দ বাবু অনেক পুরনো লোক, উদো দার দাদুকে ভাল মতন চিনতেন। তাহলে শুনুন ঐ নামের পিছনে আসল কি কারণ। এই যে বিশাল বাড়িটা দেখছেন যেখানে আমরা বছর বছর পূজো করছি, এটা উদোর দাদুর বাড়ি। উদোর বাবারা ছিল পাঁচ ভাই এবং উদোর বাবা ছিল সবচেয়ে বড় ভাই। বলদেব বাবু বা উদোর বাবা, এই যে দেখছেন উদোকে, তার এককাঠি বাড়া।বলদেব বাবুও ভীষণ জনদরদী ছিলেন এবং তাঁর ই গুণ উদো পেয়েছে। তাঁর ছোট ভাইদের সব বিয়ে থা হয়ে ছেলেপুলে হয়ে যাওয়ার পর বলদেব বাবু যখন কুমড়োকাটা ভাসুরের দায়িত্ব পালন করছেন তখন মায়ের একান্ত অনুরোধ ফেলতে না পেরে বলদেব বাবু বিয়ে করেন আর তার বেশ কয়েকবছর পর উদোর আগমন। বলু দা বা বলদেব বাবুর সম্বন্ধে তাঁর ডাকসাইটে জাঁদরেল উকিল বাবা কোনদিন ই উচ্চাশা পোষণ করতেন না এবং কথায় কথায় অপদার্থ হারামজাদাটার কিস্যু হবেনা বলতেন যদিও বলুদাও ওকালতি করতেন কিন্তু বাবার সঙ্গে কিছুতেই বনতো না। বলদেব বাবু ছিলেন জনতার উকিল আর উদো টাও পড়াশোনায় খারাপ ছিলনা এবং বাবার মতোই সেও হয়েছিল জনতার উকিল। ওর দাদু অবশ্য উদোর ওকালতি দেখে যেতে পারেননি কিন্তু স্কুলে ভর্তির সময় খানিকটা তাচ্ছিল্য ভরেই নাম দেন উদ্বৃত্ত নারায়ণ মিত্র। সেই উদ্বৃত্ত মুখে মুখে হয়েছে উদো।
উদো দা ছিলেন অকৃতদার। জনগণের সেবা, বিনা পয়সায় বা নামমাত্র পয়সায় গরীবগুর্বোদের হয়ে মামলা লড়া এই ছিল তাঁর নেশা। পয়সা বিশেষ করতে পারেন নি উদো দা কিন্তু তাঁর দরজা ছিল সব সময়ের জন্য খোলা। মামলা জিতে টাকা না দিতে পেরে গরীব মানুষ টা হয়তো মদের একটা বোতল দিয়েছে, তাই সই। হারামজাদা আমাকে এবার না খাইয়েই মারবে বলে বোতলটা রেখে দিয়েছেন আর আরও একটা তীক্ষ্ণ গালাগাল বর্ষণ করে ভাগিয়ে দিয়েছেন। আজ শহরের এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা মুসলমান পাড়া, বাগদী পাড়া, মেথর পাড়া, মুচি পাড়া, ডোম পাড়ার আবাল বৃদ্ধ বনিতা জড়ো হয়েছে তাদের চলে যাওয়া বাপ মা উদো দাকে একবার চোখের শেষ দেখাটা দেখতে এসেছে ফাটকখোলা বাড়ির মাঠে। কাল থেকে ফাটকটা বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরের জন্য এই সাধারণ মানুষ গুলোর কাছে, পাহারা দেবে উদো দার ডাকসাইটে জাঁদরেল উকিল দাদুর ভূত। ঐ বড় মাঠটা আজ কানায় কানায় ভর্তি এই অতি সাধারণ গরীবগুর্বোদের ভিড়ে। কান্নার রোল উঠেছে আমাদের বাপ মা চলে গেল বলে। ভগবান, আল্লা এ কি তোমার বিচার? হঠাৎই আর্তনাদ ভরা চিৎকারের রেশ বেড়ে গেল উদো দার ভাইপোকে দেখে। ওই মুখাগ্নি করবে বলে এসেছে , বড্ড ভালবাসত যে ওকে। ওর জলভরা চোখ অনুকে দেখেও চিনতে পারল না যদিও অনু তাকে চিনতে পেরেছে। অনুর মনটা ও খুবই ভারাক্রান্ত। এতদিন বাদে চেনা শহরটায় এসে অনেকের কাছে অচেনা কিন্তু যে লোকটা চিনতে পারতো সেই লোকটাও আজ বহু দূরে চলে গেছে।
সংসারে যতদিন প্রয়োজন ততদিন ই সবাই মনে রাখে আর প্রয়োজন ফুরোলেই হয়ে যায় উদ্বৃত্ত। তখন উদো দা বা উদ্বৃত্ত নারায়ণ মিত্র জানতে পারে যে এই জনমের মতো তার প্রয়োজন শেষ। অতএব, চলো ফিরে যাই তাঁর কোলে।
No comments:
Post a Comment