Saturday, 22 July 2023

নদীবক্ষে নিশিযাপন

নৌকায় চড়া বা লঞ্চে যাওয়া বা স্টিমারে পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা বেশ ভালোই হয়েছে কিন্তু নদীবক্ষে নিশিযাপন করার  সুযোগ কোনদিন  হয়নি।সেই সুযোগ ও এসে গেল যখন আমাদের অর্জুন বলল যে ফ্লোটেলে একটা রাত্রি কাটালে কেমন হয়? সবাই  একযোগে মাথা নাড়ালো, বলল ভালোই প্রস্তাব। কথায় আছে যে খায় চিনি তাকে যোগান চিন্তামণি । কিন্তু মনের মধ্যে একটা সংশয় থেকেই যায়, কতটা ব্যয়সাপেক্ষ হবে সেই থাকাটা। অর্জুন কিন্তু ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলেছে ততক্ষণে, বলল,"না ,সেরকম কিছুই  নয়, আসলে ও একটা অনুষ্ঠান করার জন্য কয়েকটা ঘর বুকিং বাবদ কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছিল কিন্তু অনুষ্ঠান সূচি বদলে যাওয়ায় ওকে অন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছে এবং ফ্লোটেল কর্তৃপক্ষ ও টাকা ফেরত দিতে রাজী  নয়। অতএব,  ঐ টাকা অ্যাডজাস্ট  করতে  হলে ওখানে গিয়েই থাকতে হবে।"  একটু কেমন কেমন লাগছে অথচ অর্জুন টাকাও নেবেনা আমাদের  কাছ থেকে। প্রথমে একটু নিমরাজি  থাকলেও ক্যাপ্টেনের  কথা ফেলা যায় না। অতএব  ঠিক হলো যে  একুশে মে শনিবার যাওয়া হবে এবং ওখানে রাত কাটিয়ে রবিবার  ফিরে আসা।

ফ্লোটেল হচ্ছে একটা সুন্দর ছোট্ট জাহাজ যেটা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পূর্বাঞ্চল লোকাল হেড অফিসের  উল্টোদিকে।  কয়েক বছর আগে আমাদের  স্কুলের     বন্ধুদের প্রায় একান্ন বছর বাদে গেট টুগেদার  হয়েছিল  এবং ওখানে আমরা ডিনার করেছিলাম  কিন্তু থাকার সুযোগ ঘটেনি। ওখানে দুটোর  সময় চেক ইন, কিন্তু খাওয়া দাওয়া সেরে পৌঁছাতে প্রায় বেলা চারটে। অর্জুন  বিরাট বড় প্ল্যানার, খুঁটিনাটি  সবকিছুই  একদম ঠিকঠাক ।নয়জনের  চারটে কেবিন এবং সবটাই গঙ্গার  দিকে কিন্তু একটা কেবিন  হয়ে গেল  অন্য ডেকে। কিন্তু অর্জুন  চাইছে সবার একটা ডেকে ই  হোক। রিসেপশনে একটা ছোট খাটো চেহারার মেয়ে কিন্তু অসম্ভব  ঝকঝকে চেহারা এবং ভীষণ  স্মার্ট। নাবিকের  ড্রেস, মাথায় তাদের  মতন টুপি-- এককথায় বলা যেতে পারে নাবিকোচিত। সুন্দর আঙুলগুলো  যথোচিত ম্যানিকিওর করা এবং বিভিন্ন  আঙুলে বিভিন্ন রকম চিত্র। ল্যাপটপে তার আঙ্গুলগুলো নটরাজের  নৃত্য করছে এবং অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে অর্জুনের সঙ্গে মোকাবিলা করছে। যদিও  সে বলল যে একটা ডেকে ই করে দেবে কিন্তু  শেষমেশ  তা হলো না । তখন  নিজেরাই বলাবলি করলাম যে একটাই তো রাত্রি, কেটে যাবে কোনভাবে।

বিকেল বেলায় ঠিক  আছে গঙ্গারতি দেখার।  অর্জুন  তার ও ব্যবস্থা করে রেখেছে। গাড়িগুলো আমাদের  ছেড়ে দিল যেখান  থেকে লঞ্চটা ছাড়বে কিন্তু একটু ভুল বোঝাবুঝির জন্য  অনেকখানি পিছনে হেঁটে আসতে হলো এবং দেখা  গেল যে ফ্লোটেল থেকে হেঁটেই  আসা যেত। যাই হোক, তিনটে লঞ্চ পেরিয়ে আমাদের  লঞ্চে পৌঁছলাম।  লঞ্চের  ওপরের  ডেকে উঠতে সব নড়বড়ে বুড়োবুড়িদের একদম দফারফা। যাই হোক, ওপরে উঠে বসার পর ইঞ্জিন  স্টার্ট করল আর ধীরে ধীরে যেখানে আরতি হচ্ছিল  তার একটু দূরেই নোঙর করল। বারাণসীর আদলে এখানে গঙ্গা আরতি শুরু হলো। একদিকে সূর্যাস্ত, অন্যদিকে আরতি এবং পিছনে মাঝে মাঝে চক্ররেলের হর্ন মিলেমিশে এক অন্য আবহাওয়ার সৃষ্টি হলো। গঙ্গার  জলের  যে ভিন্ন ভিন্ন রঙ হয় তা না দেখলে বিশ্বাস ই করা যায়না। ছবিগুলো মনের  মধ্যে গেঁথে আছে যেটা এখানে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আরতি শেষে  লঞ্চ  আবার  স্টার্ট করে যেখান থেকে উঠেছিলাম  সেখানেই নামিয়ে দিল এবং বাবুঘাটে স্পেশাল চা খেয়ে এলাম ফিরে ফ্লোটেলে। বাতাসে আদ্রতা থাকায় ঘামে জবজব শরীরটা এসে ঠাণ্ডা করে  রাতের  খাবারের জন্য সর্বোচ্চ ডেকে এসে পৌঁছলাম।  হরেক রকমের খাবার,  কোনটা ছেড়ে কোনটা খাব ভেবে  পাচ্ছি না,  তবে তার মধ্যেই  যেগুলো সচরাচর  বাড়িতে খাওয়া হয়না সেগুলোর দিকেই  নজর দিলাম। আগের বার যখন  এসেছিলাম  তখন খাবারের মান ততটা ভাল  ছিলনা কিন্তু এখন বেসরকারি  হাতে যাওয়ায় খাবারের মান এবং সার্ভিসের প্রভূত  উন্নতি হয়েছে। যাই হোক খাওয়া সেরে কেবিনে ফিরে আসা এবং মহিলাদের হাউসি খেলা শুরু।

অবাক হয়ে জানলা দিয়ে গঙ্গার  নানান রূপ  চোখে  পড়ছে এবং মোবাইল ক্যামেরায় একের পর এক ছবি তুলে চলেছি। দুটো পরিবারের  চারজন  দুটো কেবিনে চলে গেল, তৃতীয় কেবিনে তিনজন  মহিলা এবং চতুর্থ কেবিনে আমরা দুই বন্ধু। রাতটা বেশ গভীর  হয়েছে, বন্ধুও  বেশ  গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন আর আমারও  চোখটা একটু লেগে এসেছে। হঠাৎই  যেন মনে হল জাহাজটাকে যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে ডাকছে আর বলছে  চল্, এবার  তো ভাসার পালা। এদিকে জাহাজের ও  এলানো   শরীরে ঘুমটা  বেশ জাঁকিয়ে  এসেছে কিন্তু আমি যেন সেই জলের  বার্তা পেলাম " অ্যাই  ওঠ,  ছবি তুলবি না?" আমার  শরীরটা ও যথেষ্ট ক্লান্ত কিন্তু আমি সেই ডাকের হাতছানি  উপেক্ষা  করতে পারলাম না। আস্তে আস্তে বন্ধুর ঘুম না ভাঙিয়ে  একাই নদীর  সঙ্গে প্রেমে মত্ত হলাম।  সোঁ সোঁ করে আওয়াজ  করে জলের  ঢেউ একের পর এক ধাক্কা দিচ্ছে জাহাজটাকে আর দুলে দুলে উঠছে  সেই জাহাজ  মানে আমাদের ফ্লোটেল। একের পর এক ফটো তুলে চলেছি আর তন্ময় হয়ে দেখছি গঙ্গার  রূপ গভীর  নিশীথ রাতে। ডান দিকে দেখছি হাওড়া ব্রিজ আর জেটির  আলো আর বাঁদিকে দেখছি দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজের আলো আর মাঝখানে আমি রয়েছি জেগে এই অসাধারণ রূপ দেখার  আশায়।  কখনও কখনও একটা নৌকো লন্ঠন জ্বেলে চলছে মাছ ধরার  আশায়। নিকষ কালো অন্ধকারে সেই চলমান নৌকো এক ভৌতিক  আবেশ সৃষ্টি করেছে। দেখতে দেখতে অন্ধকার আস্তে আস্তে ফিকে হতে লাগল এবং ভোরের আলো ফুটে উঠল। কিন্তু সমস্ত  রাত্রির  জাগরণ শরীরে কোন ক্লান্তির  ছাপ ই ফেলতে পারেনি কারণ আনন্দটা যে পরিমাণ  উপভোগ করেছি তা ক্লান্তিকে  আসতে দেয়নি। কেবিনে থাকা চায়ের ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে চাঙ্গা হয়ে সাতসকালেই হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম হাইকোর্ট পাড়ার গলিতে। ফিরে এসে স্নান করে দুর্দান্ত  ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির  দিকে। ফেরার  পথে এলগিন রোডে আমূলের এক দোকানে নানাধরণের আইসক্রিমের স্বাদ চেটেপুটে  নিয়ে সোজা বাড়ি।
অসাধারণ এই ফ্লোটেলে থাকার  অভিজ্ঞতা বিশেষ করে রাতের বেলায় গঙ্গার এই আকর্ষণীয় রূপ  চিরদিন  মনে রাখার মতো।

Thursday, 20 July 2023

পথ চলাতেই আনন্দ ( চার)

পরিকল্পনা করার পর কোন  জায়গায় যাওয়া হলে আনন্দ  অবশ্যই হয় কিন্তু হঠাৎই ঠিক করে বেরিয়ে পড়লে এবং তা যদি সব ঠিকঠাক মতো হয় তাহলে সেটার  একটা বিশেষ আনন্দ  আছে। একজন বাঁশির  পোঁ ধরল এবং বাকি সবাই তার  সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলল এবং সৃষ্টি হলো এক অপূর্ব সুরের মূর্ছনার ।

জুলাই মাসের  কেমন যেন  একটা আলাদাই  আকর্ষণ আছে। যতগুলো ছোট ট্রিপ হয়েছে সবই  এই জুলাই মাসে। একটা ঘরোয়া আসরে একটা ধুয়ো  উঠল যে ঝাড়গ্রামে গেলে কেমন হয়? হাত পা ঝাড়া চারটে পরিবারের নয়জন  সদস্য একযোগে হ্যাঁ হ্যাঁ করে সমস্বরে বলে উঠল। অতএব যাওয়া এবং অবশ্যই তার ভার আমাদের অর্জুনের উপর চাপলো এবং নিখুঁত  পরিকল্পনার জোরে যাওয়া ঠিক  হলো। সকাল  সাতটায়  একটা তের সিটারের গাড়িতে যাত্রা শুরু হলো। দুই পরিবারের পাঁচজন পাশাপাশি থাকায় সময়ের  খানিকটা সাশ্রয় হলো এবং বাকি দুই পরিবারের চারজনকে তাদের  বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাত্রা শুরু।  এই অল্প সময়ের মধ্যেই কে কি সঙ্গে নেবে তা ঠিক  হয়ে গেছে এবং ড্রাইভার সমেত দশজনের জন্য বিভিন্ন উপকরণ নেওয়া হয়েছে। কেউ নিয়েছে পরোটা তো কেউ করেছে ঘুগনি ও মালপোয়া এবং কেউ  নিয়েছে কেক। এছাড়াও  রয়েছে নানাধরণের বিস্কুট,  চকোলেট।  কি করে বাদ যায় মুড়ি,চানাচুর এবং তার সঙ্গতকারী পেঁয়াজ,  কাঁচালঙ্কা এবং ধনেপাতা ও আচাড়ের তেল?
ঘ বুড়োবুড়িগুলো যেন ফিরে গেছে তাদের  কৈশোরে। একমাত্র  কচিকাঁচা  হচ্ছে ড্রাইভার যে গাড়ি চালানোর  ফাঁকে ফাঁকে কাটছে ফোড়ন। দার্জিলিঙের চা নেওয়া হয়েছে ফ্লাস্কে,  সুতরাং পুরোপুরি আসর জমজমাট। কোন  বুড়ো আবার  বায়না ধরেছে সিঙারার  এবং মিষ্টির দোকানের জন্য বিখ্যাত কলকাতার বিভিন্ন নামী দোকানের  সামনে দিয়ে গাড়ি যাওয়া মাত্রই  সেই বুড়ো হাঁ হাঁ করে উঠছে গাড়ি থামানোর জন্য  কিন্তু বাকি বুড়োবুড়িদের কড়া নির্দেশ অমান্য  করার  সাহস ছোকরা ড্রাইভার আর দেখাচ্ছে না।

সাড়ে বারোট নাগাদ  পৌঁছলাম  ঝাড়গ্রামের রাজবাড়ি। রাজবাড়ির লাগোয়া সরকার পরিচালিত  ট্যুরিস্ট লজ। কিন্তু সেখানে না থেকে দুটো দিন রাজবাড়ির অতিথি হয়ে একটু রাজারা কেমন থাকে তার একটু গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা। এক বন্ধুকে জানানো মাত্র ও বলে উঠল কিরে ফিরে এসে আমাদের মতন প্রজাদের সঙ্গে যোগাযোগ  রাখবি তো? মনে মনে একটু গর্ব হচ্ছিল  যে আমরাও  দিন এনে দিন খেয়ে রাজা হতে পারি। প্রশস্ত  বারান্দায় সোফাতে বসতেই চোখটা একটু লেগে এল। ওরে বাবা, আমার মাথায় কে যেন একটা  পাগড়ি বেঁধে দিচ্ছে। গায়ের পাঞ্জাবিটাও কেমন যেন মখমলের  মতো। পায়ে হীরে,  মণিমুক্তো খচিত নাগরাই জুতো। একি,  কোমরের  বাঁদিকে বাঁকা মতন  কি যেন একটা জিনিস।  ওরে বাবা এ যে খাপে ভরা তলোয়ার।  হাতে তালি দিতেই আশপাশ থেকে ছুটে এল দাসী বান্দাদের দল। চোখ কচলাচ্ছি,  গায়ে চিমটি কাটছি কিন্তু তারা আমার  হুকুম  তামিল  করার  জন্য  আছে দাঁড়িয়ে। কি বলব তাদের  ঠিক করতে পারছিনা। হঠাৎই  গায়ে ধাক্কা পড়ল , দিবাস্বপ্ন গেল ভেঙে। মনে মনে বললাম,  চাই না মা গো রাজা হতে। কিন্তু ঘোর তখনও কাটেনি। মাথায় হাত দিয়ে দেখছি শুধুই চুল। গায়ে অবশ্যই পাঞ্জাবি কিন্তু বাঁদিকে তলোয়ারের জায়গায় রয়েছে বড় মুঠোফোন।  আমি আমিতেই আছি। যাক বাবা বাঁচা গেল। সবসময়ই নিজের কাজ নিজে করতে যে অভ্যস্ত তাকে হঠাৎ যদি দাসী বাঁদী পরিবৃত  হয়ে থাকতে হয়  তাহলে যে কি জ্বালা হয়  সেটা  হাড়ে হাড়ে টের পেলাম  ছোট্ট স্বপ্নের মাধ্যমে।

ম্যানেজারের  পদবী বোধ হয় "জানা" আর ভীষণই রাজভক্ত। রাজাদের  অবস্থা তথৈবচ  হলেও এই বান্দাদের কথায় কথায় রাজাসাহেব আর রাণীমার  উল্লেখ তার প্রভুভক্তির পরিচয় দিচ্ছিল। এই যে মাছটা  খাচ্ছেন , ওটা ঐ দুধপুকুরের মাছ। আপনাদের জন্য ই ধরিয়েছি স্যার।  বিরাট  কাতলা স্যার,  মাছটা  কেমন  লাগছে স্যার? সত্যিই টাটকা মাছ যদি চালানি  না হয় , বরফ না পড়ে, তার স্বাদ তো ভাল হবেই-- সে রাজবাড়ির পুকুরের হোক বা পাঁচু জেলের পুকুরেরই হোক। এই যে  পনীরটা খাচ্ছেন  না স্যার,  এটা রাজবাড়ির গরুর দুধের।  কি নরম, বলুন  না স্যার ।হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক  বলেছেন। বম্বেতে পাঞ্জাব ডেয়ারির পনীরের  কথা মনে পড়ছিল। কিন্তু লোকটার  এত রাজভক্তি দেখে বুঝতে পারিনি যে ব্যাটা আমাদের জবাই করার  ধান্দা করছে। শুক্তো , মুসুরির ডাল , পোস্তর বড়া, পনীরের ডালনা আর রাজবাড়ির কাতলাতে  সম্পন্ন  হলো  দিনের ভূরিভোজ। এরপর দিবানিদ্রায় চেষ্টা করলাম সেই সুখের স্বপ্ন দেখার কিন্তু ততক্ষণে নিজের ওজন টা বুঝে গেছি এবং হাজার চেষ্টাতেও  সেই স্বপ্ন আর দেখা হলোনা। সুন্দর রাজবাড়ি, সামনে বিশাল  দুটো  গেট, সেইখানে গেঞ্জি পরে দারোয়ান আছে। বেমক্কা  ঢোকা নিষেধ। অযাচিত ভাবে প্রবেশ করলে আছে জরিমানার  বিধান,  মানে রাজাদের  যা যা থাকা প্রয়োজন  তা সবই আছে কিন্তু পেয়াদা বা বরকন্দাজের সেই পেল্লাই  গোঁফ নেই বা নেই তাদের হাতে বর্শা  বা  মাথাটা পিতলে মোড়া তেল চুকচুকে  লাঠি। রাজবাড়ির  দোতলায় থাকেন  বর্তমানের রাজা রানী,  একতলায় করেছেন গেস্ট হাউস। দক্ষিণ দিকে রয়েছে রিসেপশন । রয়েছে নানাধরণের  গাছ , রয়েছে নার্সারি। রাজবাড়ির প্রাঙ্গনে রয়েছে ফোয়ারা আর একদিকে রয়েছে বিশেষ  অতিথিশালা যেখানে কোন নেতামন্ত্রীরা এলে অবস্থান  করেন। নেতা মন্ত্রীরা তো আর যে সে লোক নন। ভোটের  আগে করজোড়ে  তাঁরা ভোট ভিক্ষা করেন আর একবার  নির্বাচিত  হয়ে  গেলেই ভো কাট্টা পাঁচবছরের জন্য।  আজকাল  আবার  করজোড়ে ভোট ভিক্ষাও  উঠে গেছে। কিছু দাপুটে দামাল  ছেলেদের জোগাড় করো , সংবৎসর  তাদের  মদমাংসের বন্দোবস্ত করো আর ভোটের সময় তাদের  লেলিয়ে  দাও যাতে অন্যমতের কোন লোক ভোট না দিতে পারে । সরকারী চাকুরেরা কথা শুনতে বাধ্য নাহলে বদলি করে দাও। আই অ্যাম ইয়োর  সার্ভেন্ট এবং ইন্ডিয়ান পেট সার্ভিস বলে দুটো  শ্রেণী আছে যারা  ভীষণ  কঠিন  পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত  হয় এবং আনুগত্য  সংবিধানের প্রতি না রেখে শাসকদলের চাটুকারে  পরিণত হয়। সবার  সহযোগীতায়  এই দাম্ভিক নেতাগুলো  আবার  ফিরে আসেন  এবং যত সাদা জামাকাপড় এঁরা পড়েন ততই মলিন  এঁদের  ভিতরটা। 
রাজবাড়ির প্রশস্ত  বারান্দায় রয়েছে রাজা, রানীর ছবি এবং রয়েছে চুয়াল্লিশ সালে ভাইসরয় প্রদত্ত জমিদার থেকে রাজা হবার  সনদপত্র। প্রত্যেক ঘরেই রয়েছে রাজা রানীর ছবি এবং নানাধরণের  পেন্টিং। সাবেকি আমলের  দরজা, জানলা যেমন আর পাঁচটা জমিদার বা রাজবাড়িতে হয়। আসবাবপত্র ও আগের দিনের মতো। বাথরুমগুলো যথেষ্ট বড়, ঘরের  সঙ্গে মানানসই। মহিলারা বিরাট খাটে বসে হাউসি  খেলছেন এবং এক বৌদি অসম্ভব  ভাগ্যশালী, বারবার  তিনিই  জেতেন। অন্য বৌদিদের  নিদান দেওয়া হলো যখন  উনি ঘুমাবেন তখন তাঁর কপালে নিজেদের কপাল ঘষে নিতে। তাতে কিছুটা হলেও  ভাগ্যের  পরিবর্তন হতে পারে। বিকেল গড়িয়ে আসছে,  সবাইকে  তাড়া দিয়ে বের করা হলো শহরের  আশেপাশের জায়গাগুলো দেখার জন্য। রাজবাড়িটা শহরের  একটু বাইরে। বাজার,  দোকান সবই আছে যেমন একটা মফস্বলের শহরে  থাকে। চোখে পড়ল গোটা দুয়েক শপিং মল।জেলার  সদর দফতর হওয়াতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে শহরটা। শহরের  একটা মোড়ে আছে  সাবিত্রী মন্দির।  মন্দির চত্বরের বাইরে গাড়ি  রেখে দেখি মন্দির বন্ধ।  অনেক  পুণ্যার্থী বসে আছে দর্শনের জন্য,  আমরাও সামিল হলাম তাদের সঙ্গে। কথিত আছে যে রাজস্থানের সামন্তরাজা  সর্বেশ্বর সিং পুরীতে জগন্নাথ দর্শন করে ফেরার পথে এই জঙ্গল মহলে অবস্থান করেন এবং স্থানীয় মালরাজাকে পরাস্ত করে মল্লদেব উপাধি গ্রহণ করেন। পরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে এখানে এই পাথরের  মন্দির স্থাপন করেন  এবং প্রায় তিনশ পঞ্চাশ বছর ধরে অত্যন্ত  নিষ্ঠার সঙ্গে সাবিত্রী দেবী রূপে পূজিত হয়ে আসছেন। রাজা সর্বেশ্বর সিং এই মন্দিরের পাশে একটা বিরাট পুকুর খনন করা কালীন বহু পুরাতাত্ত্বিক জিনিস পাওয়া যায় এবং ইতিহাসে এক নতুন  অধ্যায়ের সংযোজন করে। কিছুক্ষণ পরেই পুরোহিতের আগমন হলো এবং আমরাও  দেবীমাতা সাবিত্রী দর্শন করে রাজবাড়িতে ফিরে এলাম। রাতে খাওয়া সেরে মেয়েদের  আর একপ্রস্থ হাউসি খেলা এবং যথারীতি হাসিঠাট্টায় বুড়োবুড়িদের দিন শেষ। পরেরদিন  ব্রেকফাস্ট করে গাড়ি নিয়ে বেলপাহাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দুপাশে বিস্তীর্ণ শালবনের অপূর্ব  নয়নাভিরাম দৃশ্য। এখানে ওখানে সি আর পি এফের ক্যাম্প চোখে পড়ল অনেকটাই কাবাব মে হাড্ডির মতো। কিন্তু  না থাকলেও উপায় নেই। জঙ্গল মহলে রাজত্ব করে সন্ত্রাসবাদীরা বিভিন্ন  রাজনৈতিক দলের  মদতে। কোন সময় রেলের লাইন উপড়ে দিয়ে বিধ্বংসী দুর্ঘটনা ঘটানো এবং  কাজ শেষ   হলেই তাকে এনকাউন্টার করে মেরে ফেলে প্রমাণ লোপাট করে দেওয়া। আবার  নতুন একজন সন্ত্রাসবাদী তৈরী করা। সুতরাং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্যই  এই আধাসামরিক সুরক্ষাবলের উপস্থিতি। কিন্তু রাজনীতির পাশা পালটালে আবার  কি চেহারা হবে সেটা ভাবার  বিষয়। যাই হোক, বেলপাহাড়ি ছাড়িয়ে যাত্রা শুরু হলো তারাফেণী ব্যারেজ এবং ঘাগরা ঝর্ণার  দিকে। খুব কিছু বড় নয় তারাফেণী ব্যারেজ কিন্তু মন্দের ভাল।  কিন্তু ঘাগরায় ঝর্ণার  সেরকম  মেজাজ  কিছুই  দেখা  গেলনা ঐখানে পিকনিক  স্পট ছাড়া। অবশেষে বেলা গড়ার আগেই ফিরে আসা। পরদিন  চলে আসতে হবে। ব্রেকফাস্ট সেরে সমস্ত  মালপত্র  একটা ঘরে রেখে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চিল্কিগড়ের রাজবাড়ি ও কনকদূর্গা মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে এবং ফেরার  পথে মিউজিয়াম দেখা। কিন্তু ইতিমধ্যেই  আমাদের  একজনের  বাড়ির  চাবিসমেত মানিব্যাগ না পাওয়ায়  তড়িঘড়ি ফিরে আসতে হলো মিউজিয়াম  বা রাজবাড়ি না দেখেই।  ফিরে এসে ব্যাগ পাওয়া গেলেও আবার  নতুন করে বেড়ানোর মানসিকতা হারিয়ে গেল। অতএব,  কিছুক্ষণ  অপেক্ষা করে রাজবাড়ির  বিশেষ  কচিপাঁঠার ঝোলে মধ্যাহ্নভোজন সেরে ফিরে আসা। এই প্রসঙ্গে গেস্ট হাউসের  ম্যানেজার" জানা" সম্বন্ধে আরও  একবার  না বললেই  নয়। রাজভক্তির এক বিশেষ  নমুনা এই জানাবাবু। কথায় কথায় রাজাসাহেব বা রাণীমা না বললে বোধহয় ভদ্রলোকের ভাত হজমই হবেনা। যাই হোক,  আজকের  দিনেও  এইরকম  প্রভুভক্তি এক বিরল নিদর্শন।  অবশেষে এই বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের পরস্পরের  প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আনন্দ  উপভোগ করা  এক অতীব আনন্দের  কথা। আমাদের  ছেলেমেয়েদের  কর্মসূত্রে বাইরে থাকতেই হবে। সুতরাং সমমনস্ক কয়েকটি পরিবারের এই যৌথ ভ্রমণ আমাদের  একাকীত্ব অনেকটাই দূর করতে পারে।

Thursday, 13 July 2023

রামকেষ্টর উইল

খুবই সাদাসিধে মানুষ  রামকেষ্ট।  একটা পুরোন সাইকেল  করে সে এদিক সেদিক  চষে নানাধরণের কাজকর্ম করে এবং তা দিয়েই মোটামুটিভাবে সংসারটা চালিয়ে নেয়। মাঝেমধ্যেই  যে একটু আধটু ধার বাকি হয়না তা নয়, কিন্তু টাকা পাওয়ামাত্র আগে দেনা মিটিয়ে বাড়ি আসবে। অভাব অনটনই তো সংসারে ঝগড়াঝাঁটির মূল কারণ  কিন্তু তার বৌ যখন  রাগে গনর গনর করে তখন  চুপ করে থাকে বেচারার মতো। খানিকটা রাগ পড়লে বলবে এক কাপ চায়ের কথা আর তাতেই একপ্রস্থ ঝাঁঝালো আওয়াজ । মুখ পাঁশুটে করে ঘরে চলে যায় রামকেষ্ট।  এবার নিভার একটু মনঃকষ্টের পালা। দুধ নেই, চিনি নেই একটু জল গরম করে চা পাতা দিয়ে কোনরকম  একটু চায়ের রঙধরা  জল এগিয়ে দিয়ে আসে। আর তাতেই কি খুশি রামকেষ্ট।  চা খেয়ে একটু ধাতস্থ  হয়ে  স্নান করে ভাত খেয়েই একটু ঘুম আর তারপরেই সেই ঠা ঠা রোদে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়া লোকের  কাছে টাকা আদায়ের জন্য। এই হচ্ছে রামকেষ্টর রোজকার কাজ, কি শীত,কি গ্রীষ্ম বা কি বর্ষা। গরমকালে লু  বইছে, ঘাড়ের  কাছে একটা তোয়ালে রুমাল  দিয়ে কলারটা যাতে নোংরা না হয় তার দিকে খেয়াল রাখা কিন্তু ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে গেলেও উপায় নেই, সেই ঘাম শরীরেই  শুকায় আবার  নতুন  করে ভিজে ওঠে। একটা চিরাচরিত প্রথা আছে, কেউ ধারের টাকা  একবারে মেটায় না, তিন চারবার ঘুরিয়ে তবেই  দেবে তাও হয়তো পুরোটা নয়। কিন্তু উপায় নেই, সকালে স্কুলে পড়ানোর পরেও তাকে এই কাজটা করতেই হয় বাড়তি রোজগার করার জন্য নাহলে এতগুলো লোকের  মুখে দুমুঠো  কি করে জোগাবে? স্কুলে পড়ানোর সুবাদে একটা সুবিধা অবশ্যই ছিল,  লোকে মাস্টার জী বলে সম্বোধন করত সে টাকা মেটাক বা না ই মেটাক।  সামনাসামনি গালাগালি দিয়ে কেউ অন্তত কোনদিন  কথা বলেনি । কিন্তু পিছনে কেউ  অন্য রকম কিছু বলবেনা তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না।

এইরকম অবস্থা কিন্তু বরাবর ছিলনা তার। মহা ঠাটবাটে তার দিন চলছিল। পড়াশোনা চলছিল  শ্রীরামপুর কলেজে। একদিন কলেজে বাইবেল  ক্লাস চলাকালীন  অন্য একজন ছাত্র কিছু একটা কথা বলায়  শিক্ষক সাহেব সেই ছাত্রকে নিদারুণ ভাবে প্রহার করেন।  প্রহারের মাত্রাটা একটু  বেশিই হয়ে যাওয়ায় রামকেষ্ট এবং তার  তিনবন্ধু মিলিত ভাবে প্রতিবাদ  করে । তখন  বৃটিশ জমানা,  কয়েকজন নেটিভ ছাত্র সাহেব অধ্যাপকের কাজের  প্রতিবাদ  করবে এটা একদমই  আশা করা যায়না। সুতরাং করা হলো তাদের  বহিষ্কার। আবার  প্রতিবাদ শুরু হলো। বাইবেল  ক্লাসে  কথা বলা অপরাধ কিন্তু ঐ ছাত্রটিকে যেভাবে মারা হয়েছে সেটা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ের।  কলেজের অধ্যক্ষ ডেকে পাঠালেন ছাত্র এবং শিক্ষককে আলাদা আলাদাভাবে। শিক্ষক  অধ্যক্ষকে জানান  যে ঐ ছাত্ররা তাঁকে মেরেছে।  অধ্যক্ষ ও ছিলেন বৃটিশ,  সুতরাং কোন কথা নয়, তাদের সবাইকেই  রাস্টিকেট করা হলো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন  শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কাছে আর্জি জানালেন ঐ চার ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকেরা এবং  সাহেবের মিথ্যে কথা তাঁর  কানে তুললেন।  উনি বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন এবং সব শুনে বুঝতে পারলেন  যে সাহেব অধ্যাপক মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।  যাই হোক, একটা সমাধান সূত্র তিনি বের করলেন।  উনি বললেন  যে তোমাদের  রাস্টিকেট করা হচ্ছে না কিন্তু তোমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোন কলেজ থেকে  প্রথম বর্ষ থেকে পড়তে পারবে। রাস্টিকেট হলে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কলেজেই  পড়তে পারতো না। তখন তারা ছিল  তৃতীয় বর্ষের ছাত্র,  সুতরাং তাদের  তিনটে বছর  নষ্ট  হলো। রামকেষ্টর বাবা, ঠাকুর্দারা সব বড় বড় সরকারী চাকরি করতেন,  সুতরাং তাঁরা আর জিনিসটাকে  বেশী গুরুত্ব দিলেন না। তখনকার দিনে শ্রীরামপুরে থেকে ভবানীপুরে চুল কাটতে আসাটা একটু বাড়াবাড়িই ছিল। পাশ করেই রেলে একটা চাকরি, তারপরেই বিয়ে রামকেষ্টকে আর পায় কে? কিন্তু বলেনা, মাথা  যাদের গরম তাদের  হঠকারিতার ফল অবশ্যই  আসে। একদিন  দুম করে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে চাকরিতেই  দিল ইস্তফা।  ছিল বাবার পয়সা, নেমে গেল ব্যবসায়। কিন্তু  সহজ  সরল লোকের দ্বারা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া  সহজ কথা নয়। সুতরাং, যা হবার  তাই হলো। প্রচুর টাকা লোকসান হল সেখানে। বড় বড় ব্যবসাদাররা ধারে জিনিস নিয়ে আর টাকা দেয়না, আজ দেবো কাল দেবো করে ব্যবসাটাকেই  লাটে  ওঠালো। গোদের উপর বিষফোড়া হল ব্যাঙের  ছাতার মত গজিয়ে ওঠা ব্যাঙ্কের  লালবাতি জ্বলা।  সুতরাং ইমারতের  ইট খসা  শুরু হলো। এরপর  একের পর এক ব্যবসা শুরু করল এবং যথারীতি মুখ  থুবড়ে পড়া। এককথায় রামকেষ্টর  সুদিন এবং দুর্দিন দুইই খুব কাছ থেকে দেখা। বহু অভিজ্ঞতা  সমৃদ্ধ রামকেষ্ট কিন্তু নিজে আদ্যোপান্ত সৎ এবং কঠোর পরিশ্রমী  আর সেই কারণেই ঐ অত্যন্ত  দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকেও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা একটা আদর্শ  উদাহরণ। 

কোন কোন মানুষ  ভাগ্যের সহায়তায় এবং পরিশ্রমের দ্বারা অনেক  উঁচু জায়গায় তার স্থান  করে নেয়। আবার  কিছু কিছু লোক অত্যন্ত সৎ এবং পরিশ্রমী হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগা হবার জন্য একটু এগিয়েই থেমে যায়। যদি কোন  লোককে পাথর ভেঙে, জঙ্গল সাফ করে রাস্তা তৈরী করে এগোতে হয় তাতে তার পরিশ্রমের বেশিরভাগটাই ঐ কাজে চলে যায় এবং তার পক্ষে আর বেশী দূর এগোনো সম্ভব হয়না। রামকেষ্টর  ক্ষেত্রেও  তা ব্যতিক্রম নয়। রিটায়ার করার  একমাস পরেই পরিশ্রমী রামকেষ্ট একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল এবং সেটাই তার অন্তিম যাত্রা। জীবনের  বেশিরভাগ সময়টাই তার সংগ্রাম  করে কেটেছে , সুতরাং বুড়িয়ে  যাওয়াটাই স্বাভাবিক। একটা মেয়ের বিয়ে বাড়ির কাছেই হয়েছিল এবং তাকে খুব  ভালবাসতো রামকেষ্ট।  শরীরটা  বিশেষ ভাল  যাচ্ছেনা কিছুদিন ধরে। একদিন রামকেষ্ট বাড়ি ফেরার  পথে তার মেয়ের বাড়ি এসে একটা বন্ধ করা খাম তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, " এই খামটা তোমার কাছে রাখো এবং এটা আমার মারা যাবার পরেই খুলবে।" মেয়েও  তার  বিশ্বাসের অমর্যাদা করেনি। হঠাৎই  একদিন  অসুস্থ  হয়ে পড়ল সে যখন  তার পাশে স্ত্রী, ছেলে বা বৌমা কেউ ই নেই। একা বাড়িতে, কি করে খবর দেবে মেয়েকে বুঝে পাচ্ছেনা।  হঠাৎই  বাড়ির  সামনে দিয়ে যাওয়া পাড়ার ই একজন লক্ষ্য  করল রামকেষ্টর অবস্থা এবং সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ের বাড়িতে খবর দিল এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল। বাড়ির কাছেই  গঙ্গার ধারে হাসপাতালে ভর্তি হল রামকেষ্ট।  এরপর  খবর দিল  তার  ছোটছেলেকে কিন্তু মানুষ যখন অন্তিম যাত্রা শুরু করে তখন  পৃথিবীর  কোন  শক্তির  ক্ষমতা নেই তাকে প্রতিহত করে। রামকেষ্ট ও চলে গেলেন কয়েকদিন হাসপাতালে থেকে। ছোটছেলেও খুবই  প্রিয় ছিল  রামকেষ্টর এবং প্রায় বন্ধুর মতো আচরণ ছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু কোমায় চলে যাওয়া রামকেষ্ট  আর বিশেষ কিছুই  বলতে পারল না তার প্রিয় সন্তান  এবং বন্ধুকে। চলে গেলেন  রামকেষ্ট এবং তাঁর মেয়ে  যথারীতি খামটা এনে ভাইয়ের  হাতে দিল।খাম খুলে এক অপার  বিস্ময়। একটা ছোট্ট  চিঠি আর সঙ্গে আরও  একটা ছোট্ট  খাম। দিদিই  চিঠিটা পড়ল। ছোট্ট  কয়েক লাইনের।  আমি আমার  স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের জন্য  কোনও  সুখ দিতে পারিনি যার জন্য  আমি অত্যন্ত দুঃখিত।  সেই কারণেই  আমার  মৃত্যুর পর আমার  ছেলেমেয়েদের  কাঁধে কোনরকম  বোঝা  চাপাতে চাইনা। ছোট্ট  খামে রাখা আছে মাত্র  একশ বারো টাকা। ঐ টাকা দিয়ে আমার জন্য  তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ এবং সম্ভব হলে বারোজন ব্রাহ্মণকে অন্তত ডাল ভাত খাওয়াবে।  কারও জন্য  কিছু না করতে পারার জন্য  আমাকে ক্ষমা কোর। জানিনা আশীর্বাদ  করার যোগ্যতা আমার  আছে কি না তবুও  জানাই তোমাদের প্রতি আশীর্বাদ।  এবার  আমি আসি।
সবার চোখে জল কিন্তু কারও মুখে নেই কোন কথা।  সবার মুখেই এক কথা, রামকেষ্ট  একজন অত্যন্ত সৎ এবং ভদ্রলোক  ছিলেন। তাঁর আত্মার  শান্তি হোক।

Wednesday, 5 July 2023

জীবন ও মৃত্যু

জীবনের  সংজ্ঞা কি? হঠাৎই  আচমকা এই প্রশ্নে হতচকিত  হয়ে যেতে হয়। কেন জীবন মানে যার স্পন্দন আছে। শুধু এইটুকু? তাহলে তো কোমায় চলে যাওয়া মানুষটাকেও বলতে হয় যে হ্যাঁ বেঁচে আছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী একদম ঠিক।  কিন্তু ওই বাঁচাটা সেই  অর্থে বাঁচা নয়। যখন  সেই মানুষটি জাগতিক মহাজীবনের তালের   সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে, যখন তার সুখ দুঃখের বহিঃপ্রকাশ হবে তখন বোঝা যাবে সে জীবিত। সন্ন্যাসীরা কি করে শোক দুঃখের ঊর্ধ্বে উঠে বা আনন্দেও ভাবলেশহীন হয়ে থাকতে পারেন  তা আমাদের  মতন সাধারণ  লোকের চিন্তার অগম্য কিন্তু তাঁরাও তো জীবিত। হঠাৎই  মাথায় এই দুর্বোধ্য বিষয় কেন এল তা জানিনা কিন্তু যখন একবার  এসেই পড়েছে তখন তার  একটা সন্তোষজনক  ব্যাখ্যার প্রয়োজন। 

প্রত্যেক মানুষ ই জন্মগ্রহণ করে ধীরে ধীরে বড় হয় এবং শৈশব থেকে যৌবন এবং পরে বার্ধক্যের দ্বারে এসে না ফেরার দেশে চলে যায় এবং এই বৃত্ত আবহমান কাল থেকে চলে আসছে এবং এই চলার ও  কোন শেষ নেই। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, 
" জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে
 চিরস্থির কবে নীড় হায়রে জীবন নদে" তখন  কিন্তু এত গভীরভাবে চিন্তা করিনি। মাঝের এই কয়েকটা বছর মানে জন্ম থেকে মৃত্যু  পর্যন্ত  যে যেরকম ভাবে নিজেকে তৈরী করে বা তার আর্থসামাজিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাকে গড়ে উঠতে সাহায্য করে সে সেইরকম অবস্থায় পৌঁছায় এবং দিনের  শেষে ফিরে যায় সে যেখান থেকে এসেছিল সেইখানে। মাঝের এই সময়টাতে কেউ ভাগ্যের সহায়তা পায় আবার  কেউ বা দুর্ভাগ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে এগিয়ে যায়। ভাগ্যের সহায়তা পেলে সে আরও একটু ভাল  জায়গায় পৌঁছতে পারতো। শৈশবটা যাদের  একটু ভাল ভাবে কাটে যৌবনে তারা একটু সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে কিন্তু এসত্ত্বেও যদি ভাগ্য তাকে  সাহায্য না করে তাহলে জীবন তার বিষময়  হয়ে ওঠে। সবাই  চায় বিবাহিত জীবন  সুখের হোক এবং তার  সন্তান তার  সংসারের  মান মর্যাদা বাড়াক কিন্তু সকলের  ভাগ্যে  কি সেটা থাকে? কত ভাল মানুষের প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও তার স্ত্রী বা সন্তানের  হাতে এতটাই নিগৃহীত  হতে হয় যা ভাষায় প্রকাশ  করা যায়না। একজন মানুষ  যখন  তার স্ত্রী বা সন্তানের কাছে ছোট  হয়ে যায় তখনই তার হয় মৃত্যু, সে যতই তার শ্বাস প্রশ্বাস  চলুক  বা অন্যান্য কার্যকলাপ বজায় থাকুক। স্ত্রী এবং সন্তানের হাতে নিগৃহীত  ব্যক্তির বেঁচে থাকা মৃত্যুর ই সামিল। পিতৃহত্যা  বা প্যাট্রিসাইড বা স্বামীহত্যা বা ম্যাটিরিসাইড পড়েছিলাম  স্কুলে থাকাকালীন কিন্তু এই ধরণের ঘটনার  গুরুত্ব  অনুধাবন করতে পারিনি কিন্তু জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে এইরকম অনেক ঘটনার কথা শুনি তখন  অত্যন্ত  ব্যথিত  হই এবং প্রাণের  স্পন্দন থাকলেও তাকে মৃত বলেই মনে করি। কিন্তু যাঁরা এইরকম ঘটনার জন্য দায়ী, তাঁরাও  কিন্তু ছাড় পাবেন না, কালের  অমোঘ নিয়মে তাঁদেরও এই জনমেই হিসেব মিটিয়ে যেতে হবে। কেবল সময়ের অপেক্ষা। একটু বিবেচকের মতো ব্যবহার কি আশা করা যায় না?