পরিকল্পনা করার পর কোন জায়গায় যাওয়া হলে আনন্দ অবশ্যই হয় কিন্তু হঠাৎই ঠিক করে বেরিয়ে পড়লে এবং তা যদি সব ঠিকঠাক মতো হয় তাহলে সেটার একটা বিশেষ আনন্দ আছে। একজন বাঁশির পোঁ ধরল এবং বাকি সবাই তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলল এবং সৃষ্টি হলো এক অপূর্ব সুরের মূর্ছনার ।
জুলাই মাসের কেমন যেন একটা আলাদাই আকর্ষণ আছে। যতগুলো ছোট ট্রিপ হয়েছে সবই এই জুলাই মাসে। একটা ঘরোয়া আসরে একটা ধুয়ো উঠল যে ঝাড়গ্রামে গেলে কেমন হয়? হাত পা ঝাড়া চারটে পরিবারের নয়জন সদস্য একযোগে হ্যাঁ হ্যাঁ করে সমস্বরে বলে উঠল। অতএব যাওয়া এবং অবশ্যই তার ভার আমাদের অর্জুনের উপর চাপলো এবং নিখুঁত পরিকল্পনার জোরে যাওয়া ঠিক হলো। সকাল সাতটায় একটা তের সিটারের গাড়িতে যাত্রা শুরু হলো। দুই পরিবারের পাঁচজন পাশাপাশি থাকায় সময়ের খানিকটা সাশ্রয় হলো এবং বাকি দুই পরিবারের চারজনকে তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাত্রা শুরু। এই অল্প সময়ের মধ্যেই কে কি সঙ্গে নেবে তা ঠিক হয়ে গেছে এবং ড্রাইভার সমেত দশজনের জন্য বিভিন্ন উপকরণ নেওয়া হয়েছে। কেউ নিয়েছে পরোটা তো কেউ করেছে ঘুগনি ও মালপোয়া এবং কেউ নিয়েছে কেক। এছাড়াও রয়েছে নানাধরণের বিস্কুট, চকোলেট। কি করে বাদ যায় মুড়ি,চানাচুর এবং তার সঙ্গতকারী পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা এবং ধনেপাতা ও আচাড়ের তেল?
ঘ বুড়োবুড়িগুলো যেন ফিরে গেছে তাদের কৈশোরে। একমাত্র কচিকাঁচা হচ্ছে ড্রাইভার যে গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে কাটছে ফোড়ন। দার্জিলিঙের চা নেওয়া হয়েছে ফ্লাস্কে, সুতরাং পুরোপুরি আসর জমজমাট। কোন বুড়ো আবার বায়না ধরেছে সিঙারার এবং মিষ্টির দোকানের জন্য বিখ্যাত কলকাতার বিভিন্ন নামী দোকানের সামনে দিয়ে গাড়ি যাওয়া মাত্রই সেই বুড়ো হাঁ হাঁ করে উঠছে গাড়ি থামানোর জন্য কিন্তু বাকি বুড়োবুড়িদের কড়া নির্দেশ অমান্য করার সাহস ছোকরা ড্রাইভার আর দেখাচ্ছে না।
সাড়ে বারোট নাগাদ পৌঁছলাম ঝাড়গ্রামের রাজবাড়ি। রাজবাড়ির লাগোয়া সরকার পরিচালিত ট্যুরিস্ট লজ। কিন্তু সেখানে না থেকে দুটো দিন রাজবাড়ির অতিথি হয়ে একটু রাজারা কেমন থাকে তার একটু গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা। এক বন্ধুকে জানানো মাত্র ও বলে উঠল কিরে ফিরে এসে আমাদের মতন প্রজাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবি তো? মনে মনে একটু গর্ব হচ্ছিল যে আমরাও দিন এনে দিন খেয়ে রাজা হতে পারি। প্রশস্ত বারান্দায় সোফাতে বসতেই চোখটা একটু লেগে এল। ওরে বাবা, আমার মাথায় কে যেন একটা পাগড়ি বেঁধে দিচ্ছে। গায়ের পাঞ্জাবিটাও কেমন যেন মখমলের মতো। পায়ে হীরে, মণিমুক্তো খচিত নাগরাই জুতো। একি, কোমরের বাঁদিকে বাঁকা মতন কি যেন একটা জিনিস। ওরে বাবা এ যে খাপে ভরা তলোয়ার। হাতে তালি দিতেই আশপাশ থেকে ছুটে এল দাসী বান্দাদের দল। চোখ কচলাচ্ছি, গায়ে চিমটি কাটছি কিন্তু তারা আমার হুকুম তামিল করার জন্য আছে দাঁড়িয়ে। কি বলব তাদের ঠিক করতে পারছিনা। হঠাৎই গায়ে ধাক্কা পড়ল , দিবাস্বপ্ন গেল ভেঙে। মনে মনে বললাম, চাই না মা গো রাজা হতে। কিন্তু ঘোর তখনও কাটেনি। মাথায় হাত দিয়ে দেখছি শুধুই চুল। গায়ে অবশ্যই পাঞ্জাবি কিন্তু বাঁদিকে তলোয়ারের জায়গায় রয়েছে বড় মুঠোফোন। আমি আমিতেই আছি। যাক বাবা বাঁচা গেল। সবসময়ই নিজের কাজ নিজে করতে যে অভ্যস্ত তাকে হঠাৎ যদি দাসী বাঁদী পরিবৃত হয়ে থাকতে হয় তাহলে যে কি জ্বালা হয় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম ছোট্ট স্বপ্নের মাধ্যমে।
ম্যানেজারের পদবী বোধ হয় "জানা" আর ভীষণই রাজভক্ত। রাজাদের অবস্থা তথৈবচ হলেও এই বান্দাদের কথায় কথায় রাজাসাহেব আর রাণীমার উল্লেখ তার প্রভুভক্তির পরিচয় দিচ্ছিল। এই যে মাছটা খাচ্ছেন , ওটা ঐ দুধপুকুরের মাছ। আপনাদের জন্য ই ধরিয়েছি স্যার। বিরাট কাতলা স্যার, মাছটা কেমন লাগছে স্যার? সত্যিই টাটকা মাছ যদি চালানি না হয় , বরফ না পড়ে, তার স্বাদ তো ভাল হবেই-- সে রাজবাড়ির পুকুরের হোক বা পাঁচু জেলের পুকুরেরই হোক। এই যে পনীরটা খাচ্ছেন না স্যার, এটা রাজবাড়ির গরুর দুধের। কি নরম, বলুন না স্যার ।হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। বম্বেতে পাঞ্জাব ডেয়ারির পনীরের কথা মনে পড়ছিল। কিন্তু লোকটার এত রাজভক্তি দেখে বুঝতে পারিনি যে ব্যাটা আমাদের জবাই করার ধান্দা করছে। শুক্তো , মুসুরির ডাল , পোস্তর বড়া, পনীরের ডালনা আর রাজবাড়ির কাতলাতে সম্পন্ন হলো দিনের ভূরিভোজ। এরপর দিবানিদ্রায় চেষ্টা করলাম সেই সুখের স্বপ্ন দেখার কিন্তু ততক্ষণে নিজের ওজন টা বুঝে গেছি এবং হাজার চেষ্টাতেও সেই স্বপ্ন আর দেখা হলোনা। সুন্দর রাজবাড়ি, সামনে বিশাল দুটো গেট, সেইখানে গেঞ্জি পরে দারোয়ান আছে। বেমক্কা ঢোকা নিষেধ। অযাচিত ভাবে প্রবেশ করলে আছে জরিমানার বিধান, মানে রাজাদের যা যা থাকা প্রয়োজন তা সবই আছে কিন্তু পেয়াদা বা বরকন্দাজের সেই পেল্লাই গোঁফ নেই বা নেই তাদের হাতে বর্শা বা মাথাটা পিতলে মোড়া তেল চুকচুকে লাঠি। রাজবাড়ির দোতলায় থাকেন বর্তমানের রাজা রানী, একতলায় করেছেন গেস্ট হাউস। দক্ষিণ দিকে রয়েছে রিসেপশন । রয়েছে নানাধরণের গাছ , রয়েছে নার্সারি। রাজবাড়ির প্রাঙ্গনে রয়েছে ফোয়ারা আর একদিকে রয়েছে বিশেষ অতিথিশালা যেখানে কোন নেতামন্ত্রীরা এলে অবস্থান করেন। নেতা মন্ত্রীরা তো আর যে সে লোক নন। ভোটের আগে করজোড়ে তাঁরা ভোট ভিক্ষা করেন আর একবার নির্বাচিত হয়ে গেলেই ভো কাট্টা পাঁচবছরের জন্য। আজকাল আবার করজোড়ে ভোট ভিক্ষাও উঠে গেছে। কিছু দাপুটে দামাল ছেলেদের জোগাড় করো , সংবৎসর তাদের মদমাংসের বন্দোবস্ত করো আর ভোটের সময় তাদের লেলিয়ে দাও যাতে অন্যমতের কোন লোক ভোট না দিতে পারে । সরকারী চাকুরেরা কথা শুনতে বাধ্য নাহলে বদলি করে দাও। আই অ্যাম ইয়োর সার্ভেন্ট এবং ইন্ডিয়ান পেট সার্ভিস বলে দুটো শ্রেণী আছে যারা ভীষণ কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত হয় এবং আনুগত্য সংবিধানের প্রতি না রেখে শাসকদলের চাটুকারে পরিণত হয়। সবার সহযোগীতায় এই দাম্ভিক নেতাগুলো আবার ফিরে আসেন এবং যত সাদা জামাকাপড় এঁরা পড়েন ততই মলিন এঁদের ভিতরটা।
রাজবাড়ির প্রশস্ত বারান্দায় রয়েছে রাজা, রানীর ছবি এবং রয়েছে চুয়াল্লিশ সালে ভাইসরয় প্রদত্ত জমিদার থেকে রাজা হবার সনদপত্র। প্রত্যেক ঘরেই রয়েছে রাজা রানীর ছবি এবং নানাধরণের পেন্টিং। সাবেকি আমলের দরজা, জানলা যেমন আর পাঁচটা জমিদার বা রাজবাড়িতে হয়। আসবাবপত্র ও আগের দিনের মতো। বাথরুমগুলো যথেষ্ট বড়, ঘরের সঙ্গে মানানসই। মহিলারা বিরাট খাটে বসে হাউসি খেলছেন এবং এক বৌদি অসম্ভব ভাগ্যশালী, বারবার তিনিই জেতেন। অন্য বৌদিদের নিদান দেওয়া হলো যখন উনি ঘুমাবেন তখন তাঁর কপালে নিজেদের কপাল ঘষে নিতে। তাতে কিছুটা হলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে। বিকেল গড়িয়ে আসছে, সবাইকে তাড়া দিয়ে বের করা হলো শহরের আশেপাশের জায়গাগুলো দেখার জন্য। রাজবাড়িটা শহরের একটু বাইরে। বাজার, দোকান সবই আছে যেমন একটা মফস্বলের শহরে থাকে। চোখে পড়ল গোটা দুয়েক শপিং মল।জেলার সদর দফতর হওয়াতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে শহরটা। শহরের একটা মোড়ে আছে সাবিত্রী মন্দির। মন্দির চত্বরের বাইরে গাড়ি রেখে দেখি মন্দির বন্ধ। অনেক পুণ্যার্থী বসে আছে দর্শনের জন্য, আমরাও সামিল হলাম তাদের সঙ্গে। কথিত আছে যে রাজস্থানের সামন্তরাজা সর্বেশ্বর সিং পুরীতে জগন্নাথ দর্শন করে ফেরার পথে এই জঙ্গল মহলে অবস্থান করেন এবং স্থানীয় মালরাজাকে পরাস্ত করে মল্লদেব উপাধি গ্রহণ করেন। পরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে এখানে এই পাথরের মন্দির স্থাপন করেন এবং প্রায় তিনশ পঞ্চাশ বছর ধরে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সাবিত্রী দেবী রূপে পূজিত হয়ে আসছেন। রাজা সর্বেশ্বর সিং এই মন্দিরের পাশে একটা বিরাট পুকুর খনন করা কালীন বহু পুরাতাত্ত্বিক জিনিস পাওয়া যায় এবং ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করে। কিছুক্ষণ পরেই পুরোহিতের আগমন হলো এবং আমরাও দেবীমাতা সাবিত্রী দর্শন করে রাজবাড়িতে ফিরে এলাম। রাতে খাওয়া সেরে মেয়েদের আর একপ্রস্থ হাউসি খেলা এবং যথারীতি হাসিঠাট্টায় বুড়োবুড়িদের দিন শেষ। পরেরদিন ব্রেকফাস্ট করে গাড়ি নিয়ে বেলপাহাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দুপাশে বিস্তীর্ণ শালবনের অপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য। এখানে ওখানে সি আর পি এফের ক্যাম্প চোখে পড়ল অনেকটাই কাবাব মে হাড্ডির মতো। কিন্তু না থাকলেও উপায় নেই। জঙ্গল মহলে রাজত্ব করে সন্ত্রাসবাদীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মদতে। কোন সময় রেলের লাইন উপড়ে দিয়ে বিধ্বংসী দুর্ঘটনা ঘটানো এবং কাজ শেষ হলেই তাকে এনকাউন্টার করে মেরে ফেলে প্রমাণ লোপাট করে দেওয়া। আবার নতুন একজন সন্ত্রাসবাদী তৈরী করা। সুতরাং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্যই এই আধাসামরিক সুরক্ষাবলের উপস্থিতি। কিন্তু রাজনীতির পাশা পালটালে আবার কি চেহারা হবে সেটা ভাবার বিষয়। যাই হোক, বেলপাহাড়ি ছাড়িয়ে যাত্রা শুরু হলো তারাফেণী ব্যারেজ এবং ঘাগরা ঝর্ণার দিকে। খুব কিছু বড় নয় তারাফেণী ব্যারেজ কিন্তু মন্দের ভাল। কিন্তু ঘাগরায় ঝর্ণার সেরকম মেজাজ কিছুই দেখা গেলনা ঐখানে পিকনিক স্পট ছাড়া। অবশেষে বেলা গড়ার আগেই ফিরে আসা। পরদিন চলে আসতে হবে। ব্রেকফাস্ট সেরে সমস্ত মালপত্র একটা ঘরে রেখে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চিল্কিগড়ের রাজবাড়ি ও কনকদূর্গা মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে এবং ফেরার পথে মিউজিয়াম দেখা। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমাদের একজনের বাড়ির চাবিসমেত মানিব্যাগ না পাওয়ায় তড়িঘড়ি ফিরে আসতে হলো মিউজিয়াম বা রাজবাড়ি না দেখেই। ফিরে এসে ব্যাগ পাওয়া গেলেও আবার নতুন করে বেড়ানোর মানসিকতা হারিয়ে গেল। অতএব, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রাজবাড়ির বিশেষ কচিপাঁঠার ঝোলে মধ্যাহ্নভোজন সেরে ফিরে আসা। এই প্রসঙ্গে গেস্ট হাউসের ম্যানেজার" জানা" সম্বন্ধে আরও একবার না বললেই নয়। রাজভক্তির এক বিশেষ নমুনা এই জানাবাবু। কথায় কথায় রাজাসাহেব বা রাণীমা না বললে বোধহয় ভদ্রলোকের ভাত হজমই হবেনা। যাই হোক, আজকের দিনেও এইরকম প্রভুভক্তি এক বিরল নিদর্শন। অবশেষে এই বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আনন্দ উপভোগ করা এক অতীব আনন্দের কথা। আমাদের ছেলেমেয়েদের কর্মসূত্রে বাইরে থাকতেই হবে। সুতরাং সমমনস্ক কয়েকটি পরিবারের এই যৌথ ভ্রমণ আমাদের একাকীত্ব অনেকটাই দূর করতে পারে।