Wednesday, 12 June 2024

জামাইষষ্ঠী

কথায় আছে জন,  জামাই, ভাগনা তিন নয় আপনার। কথাটার দম কতটা আছে একটু যাচাই করা যাক। আজ জামাইষষ্ঠীর দিনে প্রথমে মধ্যম জন অর্থাৎ জামাইকে নিয়েই আলোচনা হোক, পরে সময় পাওয়া গেলে জন এবং ভাগনাকেও আলোচনায় আনা যাবে।
আগে বেশিরভাগ সময়েই জামাইষষ্ঠীর দিন ছুটি পড়ত না। ক্কচিৎ কদাচিৎ রবিবার পড়ত এই বিশেষ  জামাইবরণের দিনটি। এসব সত্ত্বেও সরকারি অফিসগুলো খাঁ খাঁ করত কর্মীদের  অনুপস্থিতিতে। কেউ বা অনেক আগে থেকেই  ছুটির দরখাস্ত  দিয়ে নিশ্চিন্তে ছেলেমেয়ে বৌকে নিয়ে ট্রেনে বা বাসে পাড়ি দিত ( দূরবর্তী জায়গা হলে) আর শহরের  মধ্যে হলে সাতসকালে স্নান টান করে সেজেগুজে বেড়িয়ে পড়ত শ্বশুর বাড়ির দিকে যাতে ভিড়ে জামাকাপড়ের ভাঁজ নষ্ট না হয়ে যায়। সবার তো একই রকম চিন্তা, সুতরাং বাস বা লোকাল ট্রেনে সাতসকালেই গাদাগাদি ভিড়। কেউ বা আবার  ভিড় এড়াতে আগের রাত থেকেই শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান।  এই মাগ্গিগণ্ডার বাজারে শ্বশুর মশাইদের তো  নাভিশ্বাস  ওঠার  যোগাড়। কিন্তু শ্বশুর মশাই রা অতি কষ্টে মনের  দুঃখ মনেই চেপে রেখে যতটা স্বাভাবিক হওয়া যায় ততটাই করতেন কিন্তু যাঁরা অত্যন্ত  শাঁসালো শ্বশুর এবং পয়সার  কোন অধিবধি নেই তাঁরা একদম হৈচৈ বাধিয়ে মেয়ে,জামাই,  নাতিনাতনিদের নিয়ে উৎসবে মেতে উঠতেন। একান্নবর্তী পরিবারে ভাইদের মেয়ে জামাই ও তাদের  পরিবারের   সবাই মিলে এক বিরাট  উৎসবের  আয়োজন  হতো। 
এইরকম ই  এক পরিবার সিংজীমশাই। পদবী ছিল  সিংহ কিন্তু পাড়ায় বুড়ো, বুড়ি, ছোঁড়া,  ছুঁড়ি সবার  কাছেই  এই পরিবার ছিল সিংজীমশায়ের বাড়ি এবং ঐ বাড়ির  ছেলেমেয়েরাও  সিংজীমশায়ের ছেলে বা ভাইপো বা নাতি বা নাতনি নামেই পরিচিত  ছিল। হয়তো  বা একটু বাড়াবাড়িই  ছিল কিন্তু কাকে দোষ  দেওয়া যায়, লোকজন তাদের  ঐভাবে ডাকলে সিংজীমশায়ের কি দোষ?  যাই হোক, জামাইষষ্ঠীর কয়েকদিন আগে থেকেই বাড়িতে কেমন যেন  এক উৎসবের আবহ তৈরী হতো। আগের দিন  সন্ধের ট্রেনে গ্রাম থেকে বিশু বাইন পুকুরের সদ্য ধরা মাছ এনেছে। শুধু মাছই নয়, এনেছে জমির কামিনীভোগ ও গোবিন্দভোগ চাল, তেল, ঘি ও গুড়। গুড়ের  রঙ দেখলে মনে হবেনা ছুঁয়ে দেখার কিন্তু একটু আঙুলে লাগিয়ে মুখে দিলেই বোঝা যায় কি স্বাদ। কামিনীভোগ চালের পোলাও এবং গোবিন্দভোগ চালের  পায়েসের গন্ধে ম ম করে ভরে উঠত সারা বাড়ি এবং ছড়িয়ে পড়ত সারা মহল্লায়। আম এসেছে সাদুল্লা ( আজকের  দিনের  হিমসাগর), মোলায়েমজাম, রানী,  বিমলী এবং কালাপাহাড় কিন্তু সেরার সেরা কোহিতুর পাওয়া না যাওয়ায় সিংজীমশায়ের আক্ষেপ জামাইবরণ ঠিকঠাক  হলো না।
গিলে করা পাঞ্জাবি আর সুপারফাইন ধুতিতে সজ্জিত  জামাই বসে আছেন সোফায়। ভাইয়ের জামাই তখনও  এসে পৌঁছায়নি। সিংজীমশায় ঘরবার করছেন  আর ভাইকে বলছেন একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করতে কোথায় আছে। তা করতে করতেই এসে পড়েছে ভাইয়ের জামাই। সাজের ঘনঘটায়  তিনিও কম যাননা। আজ জামাইদের আবাহন প্রথম তারপর সব কিছু। মার্বেল পাথরের  মেঝেতে গালিচা আসন পাতা হয়েছে। বিরাট প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে নানান ফল ও বিভিন্ন ধরণের  মিষ্টি এবং কাঁসার বাটিতে দেওয়া হয়েছে গোবিন্দভোগ চালের  পায়েস। পিলসুচের উপর জ্বলছে প্রদীপ,  মূহূর্মূহু শঙ্খনাদে বরণ  হচ্ছে জামাইদের।  শ্বাশুড়ি , খুড়শ্বাশুড়ি ও পিসশ্বাশুড়িদের একে একে ফোঁটা দেওয়া শুরু হলো এবং প্রণাম ও আশীর্বাদের ঘনঘটায় সারা বাড়িতে ঘোষিত হতে থাকল  সিংজীমশায়ের বাড়ির জামাইষষ্ঠী। আশীর্বাদ করার পর কানে হলুদ মাখানো সলতে  দেওয়া হতো প্রত্যেকের  তরফে। ঐ একটাই  যা অত্যন্ত  বিরক্তিকর। জামাই ফলমূল খেয়ে লুচি দিকে হাত বাড়াতেই কান থেকে ঝুলে পড়ল একটা সলতে যাতে ধুতি এবং পাঞ্জাবি দুটোই  গেল একটু পাঁশুটে হয়ে। অবশ্য  প্রাপ্তির  পরিমাণ  এতটাই যে এতে জামাইরা সামান্যতম বিচলিত  হলোনা। ফোঁটা পর্ব সমাধার পর বিরাট  ঢেকুর তুলে সোফায় গা এলিয়ে  দেওয়া। এরপর এসে গেল দার্জিলিঙের সুন্দর চা। আর পায় কে জামাইদের, আজ তাদেরই  দিন। এরপর বাকিদের  জলখাবারের আয়োজন।  একটু আধটু ধূমপানের  ইচ্ছে থাকলেও  সিংজীমশায়ের চোখের  আড়াল  হওয়া এক দুঃসাধ্য ব্যাপার।  বড় আরাম কেদারায়  বসে থাকা সিংজীমশায়ের  হাতলে রাখা হাভানার জ্বলন্ত চুরুট  ও অ্যাশট্রে এবং তাতে মাঝেমধ্যেই সুখটান ও ধোঁয়া ছাড়া এবং সেই ধোঁয়ায় অন্যদের  কাশির উদ্রেক করা। মাঝেমধ্যেই  জামাইদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তাদের  পরবর্তী কর্মসূচী।
একে একে জলখাবার পর্ব সমাপ্ত হতে হতেই মধ্যাহ্নভোজনের পর্ব। এখন না একটু পরে বলে খানিকটা সময় না কাটাতে পারলে খাবে কি করে? পেটে তো একটু জায়গা থাকা দরকার।  একটু ঘুরে বেরিয়ে আসতে না পারলে টাঁসানো তো আর যাবেনা। অথচ এক একটা পদ যেন  এক এক ধরণের  অমৃত। শ্বাশুড়ি ছোট  মেয়েকে দিয়ে সিংজীমশাই কে ডেকে পাঠিয়ে একপ্রস্থ  ক্লাস নিলেন,  ঐরকম  হাঁ করে জামাইদের  সামনে বসে থাকলে ওরা নিজেদের  মধ্যে কি করে কথাবার্তা বলবে? একদম বেআক্কেলে লোক বলায় সিংজীমশায়ের  একটু অভিমান  হলো এবং মেয়েকে দিয়ে চুরুটও অ্যাশট্রে আনিয়ে নিয়ে নিজের  ঘরের দিকে চলে গেলেন  এবং জামাইরাও  একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সিগারেটের ধোঁয়া ধীরে ধীরে চুরুটের ধোঁয়াকে বাইরে বের করতে লাগল। 
মধ্যাহ্নভোজনের বিরাট পর্ব। কামিনীভোগ আতপ চালের  পোলাও,  বাদাম দিয়ে লাল শাক, নারকেল কোঁড়া দিয়ে মুগের ডাল,পাঁচ রকম ভাজা, পটলের  দোরমা,  মাছ,মাংস, চাটনি, পাঁপড়ভাজা,অমৃতর দই ও মিষ্টি। মিষ্টির  বর্ণনা না দিলে সিংজীমশায়ের অপমান  হয়। কৃষ্ণনগরের সরভাজা ও সরপুরিয়া,  বহরমপুরের ছানাবড়া, গিরীশের সন্দেশ,  কান্দীর কৃষ্ণপ্রসন্ন ও জনাইয়ের  মনোহরা, চন্দননগরের মালাই চমচম আর হাবড়ার কাঁচাগোল্লা। এত রকমের আয়োজন অথচ এই পরিমাণ  খাওয়া একমাত্র  দারা সিংরাই পারেন।  এতসব বিভিন্ন  ধরণের  খাবারের  স্বাদ  নিতে গেলে অন্তত এক সপ্তাহ  ছুটি না নিলেই নয়। বিয়ের পর প্রথম জামাইষষ্ঠীর  সময় সিংজীমশায়ের জামাই  দুদিনের  বেশী ছুটি পাননি। তাঁর উপরওয়ালা  সাহেব যাতে জামাইএর উপর অসন্তুষ্ট  না হন সেইকারণে সাতদিন  ছুটি কাটিয়ে বড় সাহেবের জন্য একবাক্স বিভিন্ন  ধরণের  মিষ্টি ও একঝুড়ি মুর্শিদাবাদের আম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। হাজার  হলেও  প্রথম জামাই ষষ্ঠী  তো।
এই জমজমাট  জামাই ষষ্ঠীর পর নিশ্চয়ই জন বা ভাগনার  গল্প বললে আসরটাই নষ্ট  হয়ে যাবে বলে ওটা মুলতুবি থাকল।

No comments:

Post a Comment