কখনও কখনও নিজেদেরকেও তাঁদের ই আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছি কিন্তু সাম্রাজ্য স্থাপন সেটা কি করে সম্ভব। আকবরের বিরাট সাম্রাজ্য না হয় নাই বা হলো কিন্তু ছোটখাট ফ্ল্যাটের মালিক তো আমরা হতেই পারি এবং সেটাকে সাম্রাজ্য হিসেবে মনে করতে তো কোন বাধা নেই। হোস্টেলের সিট থেকে মেসে অনেকের সঙ্গে একটা রুমে থাকা সেটাও একটা বিরাট অভিজ্ঞতা। একটা ছোট্ট খাট এবং খাটের তলায় একটা ট্রাঙ্ক, একটা স্যুটকেস এবং ব্যাগ এবং তারই পাশে জুতো, চটি সব গাদাগাদি করে রাখা, মাথার কাছে বা পায়ের কাছে রাখা একটা টেবিলে রাখা কিছু বই খাতা এবং একটা টেবিল ল্যাম্প যাতে অসুবিধা না হয় গভীর রাতে পড়াশোনার জন্য । দেওয়াল ধরে দুটো পেরেকে বাঁধা দড়িতে ঝুলছে জামা কাপড়--- এই নিয়েই সাম্রাজ্য। ঐ খাট বা খাটের তলা বা টেবিল এইখানে আমারই আধিপত্য, এখানে অন্য কেউ কিছু রাখতে গেলেই সম্রাটের অনুমতি নিতে হয়। এটাই বা কম কিসে? নিজের গ্রামের কোন চেনা পরিচিত ছেলে শহরে কোন কাজে এসেছে, রাতটা কাটাতে হবে কিন্তু পকেটের রেস্ত সেরকম নেই, তখন অগত্যা মধুসূদন আমার খাটের অর্ধেক। দুজনে ঐ ছোট্ট খাটে কত আরামে থেকেছি। তার কাজ একদিনে না হলে তিন চারদিন ও আমার গেস্ট হিসেবেই থেকেছে। আমার সাম্রাজ্য ছোট হলেও একজনকে তো আশ্রয় দিতে পেরেছি এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জন আমার সাম্রাজ্যে অতিথি হিসেবে থেকেছে , এর থেকে বড় আনন্দ আর কিসে আছে?
প্রত্যেক ছেলে বা মেয়েরই কিছুদিন হোস্টেলে বা মেসে থাকা উচিত। এতে অন্যদের সঙ্গে সুখ দুঃখের ভাগীদার হওয়া যায়। যেসব ছেলেমেয়েরা বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেছে বরাবর, যারা কোনদিন হোস্টেল বা মেসে থাকেনি তাদের খুব কম জনেই নিঃস্বার্থপর হয়েছে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু সংখ্যায় নিতান্তই কম। মেসে থাকাকালীন বহু ভিন্ন চরিত্রের লোকের সংস্পর্শে আসা যায় এবং তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখা যায়। রমেন দা ছিলেন এক আদর্শ লোক। যেমন সুন্দর হাতের লেখা, আঁকা এবং ঝকঝকে চেহারা, দারুণ স্মার্ট , এককথায় বলা যায় ওঁকে অনুকরণ করলে লাভ বই ক্ষতি নেই। কিছু পড়তে পড়তে গান ধরতেন নিজের মনে আর মাঝেমধ্যেই একটা লেখা নিয়ে এসে পড়তে বলতেন আর পরে জিজ্ঞেস করতেন কেমন লাগল। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির আর্কিটেকচার বিভাগের গোল্ড মেডালিস্ট হঠাৎই বিদেশে একটা লোভনীয় চাকরি পেয়ে যাওয়ায় মেস এবং দেশ ত্যাগ। মফস্বলের ছেলেরা বড় শহরে এসে কেমন যেন হকচকিয়ে যায়। যাবার আগে একটা দামী কথা বলে গেলেন, " ভীড়ের মধ্যে হাঁটবে কিন্তু নিজেকে কখনোই ভীড়ে হারিয়ে ফেলো না।" কি দারুণ সুন্দর কথা, আজও মনে পড়ে তাঁর কথা যদিও দ্বিতীয়বার তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। প্রফেসর সেন রুমমেট ছিলেন, এক আশ্চর্য মানুষ। আমরা সবাই যদিও দুটো চোখ, দুটো কান, একটা নাকের মালিক কিন্তু সবার দৃষ্টিভঙ্গী এক হয়না বা সবাই একই জিনিস একই ভাবে শোনেন না। প্রফেসর সেন নিজেকে প্রফেসর বলতেন কিন্তু তিনি ছিলেন আদতে টিউটোরিয়াল হোমের মাস্টার মশাই। প্রায়ই ঠিক সময়ে টাকা দিতে পারতেন না বলে মেসের মালিকের গঞ্জনা শুনতেন আর সবার জিনিস ই তিনি নিজের মনে করে ব্যবহার করতেন, সেটা টুথপেস্ট ই হোক বা সাবান বা শার্ট ই হোক না কেন। জামাটা দেখতে না পেলেই জানতাম যে ওটা প্রফেসর সেনই পড়ে গেছেন। কিছু বলাও যেতনা, একটা ম্লান হাসিতে সবাই মাত হয়ে যেত। শিবুদা ছিলেন শিবপুর থেকে পাশ করা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অদ্ভূত দর্শন তাঁর। একঝাঁক তরুণীর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ দেখতে যে মেয়েটি ,তাকেই উনি পছন্দ করতেন বান্ধবী হিসেবে পেতে। একদিন কৌতূহল চেপে থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম তাঁর এই অদ্ভূত সিলেকশনের কথা। একটা দারুণ বুদ্ধিমানের হাসি হেসে বললেন,
"ভাই , আমি কম্পিটিশনে যেতে চাইনা। সবাই সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গেই আলাপ করতে চাইবে আর আমি সেখানে পাত্তাই পাব না। দরকার কি এত ঝামেলাতে ? আমি তাকেই বন্ধু হিসেবে পেতে চাই যার সঙ্গে আমি নিশ্চিন্ত মনে নির্ভয়ে কথা বলত পারব এবং যে আমার উপর ভরসা করে ফুরুৎ করে পালাবে না।" সত্যিই তো, শিবুদার যুক্তি তো একদমই ফেলনার নয়। গজুদার মেসে আসা বাড়িতে রাগারাগি করে। কিছুদিনের জন্য থাকলেও মেসের সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। রাগ পড়ে গেলে ফিরে গেলেন বাড়িতে কিন্তু সেই ছোট্ট স্মৃতির কথা তিনি ভোলেন নি, বিয়ের সময় আমাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। দীপক, শক্তি, সুভাষ প্রায় সমবয়সী থাকায় চুটিয়ে আড্ডা চলত। দীপকের ঘুমের কথা না বললেই নয়। পরেরদিন সকালে ইন্টারভিউ আছে চাকরির। আমার উপর ভার পড়ল ঘুম থেকে ওঠানোর। ঠিক সময়ে ডেকে দেওয়ায় , ধন্যবাদ বলল আর তাতে ধারনা হলো যে উঠে পড়েছে কিন্তু আমার চলে যাওয়ার পর আবার ঘুমিয়ে পড়ল এবং বেলা দুটোয় যখন ঘুম ভাঙল ততক্ষণে ইন্টারভিউ শেষ। কিন্তু ও ছিল এক অসাধারণ ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। ঐ কোম্পানির বড় সাহেবের দীপকের উপর নজর ছিল। উনি বললেন যে ঠিক আছে পরের শুক্রবার তোমার ইন্টারভিউ হবে। বৃহস্পতিবার দীপক আমাকে বলল," আমি উঠে গেছি বললেও তুমি ছাড়বে না, আমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে আচ্ছা করে ঝাঁকিয়ে দেবে, দরকার হলে চোখে জলের ঝাপটাও মারবে।" পরদিন সকালে ওকে উঠিয়ে শুধু ঝাঁকানিই নয় , সোজা তৈরী করে ট্যাক্সি করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিয়ে অফিস যাওয়া। শক্তি সবসময়ই ফিটফাট, ড্রেস সম্বন্ধে ভীষণই পার্টিকুলার। সুভাষ ছিল সদাই হাসিখুশি।হুগলির খন্নানের সুজিত ছিল পাশের ঘরে। বেদম জ্বরে যখন বেহুঁশ, তখন সারারাত জেগে জলপটি দিয়ে হাওয়া করে একই খাটে ঘুমিয়ে পড়েছিল পাশের ঘরে নিজের খাটে না গিয়ে। অমলদা, ধীরেন দা আমাকে প্রায় একরকম জোর করে বুঝিয়ে নতুন মেসে নিয়ে গেল।
ধীরে ধীরে মেস জীবনের সমাপ্তি। গানবাজনা করতে চাইলে মেসে থেকে সম্ভব নয় বলে আলাদা ঘর নিতে হলো। তখন ব্যাচেলর ছেলের বাড়ি ভাড়া পাওয়া সোজা ছিলনা কিন্তু কেন জানিনা ভদ্রমহিলার পছন্দ হলো আমার কথা বার্তা শুনে। তখন আমার সাম্রাজ্য হলো মেজানাইন ফ্লোরের একটা ঘর। মাথায় বিশেষ উঁচু নয় কিন্তু এই সাম্রাজ্যেই আমি মহীয়ান। বাড়ি থেকে বিয়ের কথাবার্তা ওঠায় সাম্রাজ্য বিস্তার করার প্রয়োজন হলো এবং হাউসিং বোর্ডের ছোট্ট একটা দুই কামরার ফ্ল্যাট নেওয়া হলো। কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে এবং অফিসের দাক্ষিণ্যে অনেক বৃহৎ পরিসরে আশ্রয় হলেও নিজের সাম্রাজ্য বলতে সেই দুই কামরার ফ্ল্যাট যা সরকারের অনুমতির পর তিন কামরার হয়েছে। যখন ভাবি যে একটা খাট থেকে তিন কামরার ফ্ল্যাটে উত্তরণ, তখন নিজেকেও একটু কেমন রাজা রাজা ভাবতে ইচ্ছে করে। ছোট হলেও এখানে তো আমিই রাজা এবং এটাই আমার সাম্রাজ্য।
No comments:
Post a Comment