Thursday, 22 June 2023

দামাল টিকটিকি

টিউব লাইটের কাছাকাছি একটা বেশ পেটমোটা টিকটিকি ঘুরঘুর করছে আলোর পাশে আসতে থাকা পোকাগুলোর লোভে। বোঝাই যাচ্ছে যথেষ্ট  পেট ভরেছে অন্তত  পেটের সাইজটা দেখে কিন্তু তবুও  ক্লান্তি নেই সেই নির্লজ্জ টিকটিকিটার। দেখছি আর ভাবছি মানুষের সঙ্গে এদের  খুব বিশেষ  পার্থক্য নেই। মানুষের  যেমন স্বভাব প্রয়োজনের তুলনায়  বেশি জমিয়ে রাখা, এই টিকটিকিটাও  হয়তো আমাদের বাড়িতে থেকে আমাদেরই  স্বভাব  রপ্ত করেছে এবং পরিবারের ই একজন  সদস্য  হয়ে গেছে। কিন্তু বাড়ির  সবাই  এই সহাবস্থানে বিশ্বাসী নয়, তাই একে দেখলেই ঝুলঝাড়ার কথা মনে পড়ে এবং ঐ অস্ত্রে তাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ায়। দেখছি আর ভাবছি আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ  মনের  সুখে যা প্রাণে চায় তাই করে নাও কিন্তু তিনি রান্নাঘর থেকে বেরোলেই তোমার  স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা বন্ধ। হঠাৎ দেখছি ঐ মোটু টিকটিকিটা কাউকে কিছু বলতে চাইছে । ওদের  ভাষা তো আমার জানা নেই কিন্তু  চেষ্টা করছি বোঝার  ওর ভাবভঙ্গী দেখে। বারবার  ঐ লাইটের কাছ থেকে দেওয়ালের তাকের  দিকে আসছে আবার  পরমূহুর্তেই আরও  একটা পোকা দেখে কপাত করে গিলে ফেলছে। এ কি রাক্ষস রে বাবা, এত খেয়েও আশ মিটছে না অনেকটা বিয়েবাড়িতে গিয়ে কিছু লোকের যেমন আকন্ঠ খাওয়া --যেন মনে হয় বাড়িতে গিয়ে আর তিনদিন  কিছু খাবেনা। মানুষের  সঙ্গে এত সাদৃশ্য  ভেবে খুব আশ্চর্য  হচ্ছিলাম। এবার  ওর গতিবিধির  ওপর একটু নজর বাড়ালাম। মাঝখানে খুন্তি নাড়ার আওয়াজ শুনে মনে হলো এবার  ডাক পড়বে খেতে আসার  জন্য। ওই মোটু টা একবার তাকের দিকে এসেই কেন আবার  লাইটের কাছে চলে যাচ্ছে? এবার  চোখ পড়ল তাকে থাকা টাইমপিসটার ওপর। কিরকম  অদ্ভুত লাগছে আজ টাইমপিসটাকে।নিজের  চোখকে কিছুতেই  বিশ্বাস করতে পারছি না। ঘড়ির  বড় কাঁটাটা কেমন যেন  মোটা মোটা লাগছে। বাজছে মাত্র ন'টা দশ, কিন্তু বড় কাঁটাটা এরকম  কেন লাগছে। চোখে কি কম দেখছি? বয়স অবশ্যই  হয়েছে কিন্তু তা বলে এত বিভ্রান্তি?   একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে দশটা মিনিট  কেটে গেছে হুঁশ নেই। ন'টা বেজে কুড়ি। আরে ঘড়ির  বড় কাঁটাটা এমন কেন লাগছে? মোবাইলটা নিয়ে এসে একটি ফটো তুললাম।  ইতিমধ্যেই বড় কাঁটাটা আরও একটু যেই না সরেছে অমনি দেখি তিনিও কাঁটাকে ধরতে চেষ্টা করছেন।  ধাঁধায় পড়ে গেলাম। খুব  ভাল  করে লক্ষ্য করতেই  দেখি একটা ছোট্ট  বাচ্চা টিকটিকি  ঐ কাঁটাটাকে ধরার  চেষ্টা করছে। কাঁটাটা যখনই  সরে যাচ্ছে তখনই  সেই বাচ্চা টিকটিকিটা  তাকে ধরার  চেষ্টা করছে এবং এই খেলাতেই মত্ত হয়ে মায়ের  খেতে আসার ডাককে  বারবার  উপেক্ষা করছে এবং মায়ের বিরক্তি উৎপাদন করছে। ভাবলাম নিজেদের  শৈশবের কথা। যখন  খেলায় মত্ত থাকতাম মা বা দিদিরা  যদি  ডাকত তখন  খুব  বিরক্ত  বোধ  করতাম  এবং একান্তই  যখন  খেতে আসতাম  তখনই  খাওয়া শেষে পোঁ করে দৌড়ে আবার  নিজের  খেলার  জায়গায়। এই দামাল  টিকটিকিটাকে  দেখে নিজেদের  শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। পরক্ষণেই আমার  ডাক পড়ল খেতে আসার  জন্য  কিন্তু শৈশবের সেই দুঃসাহস দেখানোর সাধ্য হলো না।

Thursday, 15 June 2023

পথ চলাতেই আনন্দ( তিন )

বাঙালি ভ্রমণ পিপাসু , আমরাও  তার ব্যতিক্রম নই ।বিভিন্ন সময়ে ভাইজাগে থাকা আমাদের একদল বাঙালি আছেন যাঁদের নাম আমরা পঞ্চপাণ্ডবের  নামানুসারেই রেখেছি এবং তাঁরা হলেন যথাক্রমে যুধিষ্ঠির ও তাঁর সহধর্মিনী দেবিকা, ভীম ও ভালান্দ্রা, অর্জুন ও সুভদ্রা, নকুল ও কারেনুমতি এবং সহদেব ও দেবিকা এবং কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষের একমাত্র  সহোদরা দুঃশলা। দুঃশলা কিন্তু পাণ্ডবদের ও অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। আমাদের  এই পঞ্চপাণ্ডবের  যাত্রা বেশ সুন্দর ভাবেই  চলছিল  কিন্তু ইদানীং কালে মহাপরাক্রমশালী ভীম একটু সাংসারিক  কারণে বিচ্ছিন্ন  হয়ে পড়েছেন।  তবে এখানে সমস্ত পাণ্ডবদের উপস্থিতি ছিল। 
পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে মহাবীর অর্জুন  যেমন বাকি ভাইদের  তুলনায় বীরত্বে সর্বাগ্রগণ্য  ছিলেন  এখানেও আমাদের বর্তমান অর্জুন বাকি সকলের  তুলনায় এগিয়ে। কি অসাধারণ প্ল্যানিং, একদম নিখুঁত কারও  কোন অসুবিধা হয়না। আর এইখানেই অন্যরা ঘোড়া দেখে খোঁড়া হবার  মতো সব দায়িত্ব সেই অর্জুনের  উপর চাপিয়েই  নিশ্চিন্ত। অবশ্য সেইরকম  নিখুঁতভাবে করার  মতন ক্ষমতাও কারও নেই। যাই হোক সবাইমিলে আলোচনার পর স্থির হলো যে যাওয়া হবে ভিতরকনিকায় যা উড়িষ্যার কেন্দ্রপাড়া জেলায় অবস্থিত। চৌদ্দ ই  ফেব্রুয়ারি আঠারো সাল ধৌলি এক্সপ্রেসে হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা দিলাম এগার জনের  দল। ট্রেনের  মধ্যেই  নিয়ে যাওয়া বিভিন্ন  খাবারের মধ্য  দিয়েই ব্রেকফাস্ট সম্পন্ন  হলো। পাঁচ পরিবারের পাঁচমিশেলি  খাবারে জলখাবার বেশ জমিয়েই  হলো। ভদ্রক  স্টেশনে অর্জুনের কথামতো দুটো বেশ বড় গাড়ি মজুত ছিল।  ভাগাভাগি করে বসে মালপত্র গাড়ির  মাথায় চাপিয়ে যাত্রা শুরু হলো। ঘন্টা তিনেক চলার পর একটা নদীর  ধারে এসে পৌঁছলাম। ট্যুর অপারেটরের লঞ্চ ঠিক করাই ছিল। সমস্ত  মালপত্র গাড়ির  লোকেরাই  উঠিয়ে দিল লঞ্চে এবং বৃদ্ধ পাণ্ডব তাঁদের  স্ত্রীরা পায়ের ব্যথা, কোমরের  ব্যথা নিয়ে হেলে দুলে লঞ্চে উঠলেন।  প্রায় মিনিট কুড়ি চলার  পর বৈতরণী নদীর  অপর পারে পৌঁছলাম।  তাদের  লোকেরাই সবাইকে জেটিতে উঠতে সাহায্য করল এবং নদীর  অপর পাড়ে থাকা দুটো গাড়িতে চাপিয়ে রিসর্টে পৌঁছে দিল। যাওয়া মাত্রই সবাই সরবত খেয়ে একটু ঠাণ্ডা হয়েই নিজেদের  ঘরের  দিকে রওনা দিলাম।  এবার  বিস্ময়ের পালা। এ তো ঘর নয়, এ যে তাঁবু। কোনদিন তাঁবুতে থাকার সুযোগ হয়নি, সুতরাং মনের মনে বেশ এক রোমাঞ্চ অনুভব  করলাম। তাঁবুর  তিনটে ভাগ। প্রথম ভাগে ঢুকে যেমন বসার জন্য  একটা ছোট্ট  বারান্দা হয় সেইরকম।  দুটো চেয়ার রাখা  আছে বসে আড্ডার জন্য।  চেন টেনে বন্ধ করে দিয়ে তালা লাগানোর  ব্যবস্থা আছে অর্থাৎ,  তালা লাগিয়ে দিলে তাঁবুর  ভিতরে যাবার  আর কোন  রাস্তা নেই।  তাঁবুর দ্বিতীয় ভাগ শোবার ঘর যেখানে এ সি ও লাগানো আছে এবং খাট ছাড়াও  টেবিল,  চেয়ার ও আয়নাও মজুদ। আর তৃতীয় ভাগে টয়লেট এবং প্রত্যেক ভাগেই  চেন টেনে বন্ধ করার ব্যবস্থা। তাঁবুর  এত সুন্দর ব্যবস্থা দেখে অর্জুনের প্রশংসা মনে মনেই  করলাম।  লাঞ্চ করতে একটু দেরীই  হয়ে গেল কিন্তু ঝটপট লাঞ্চ সেরেই আমাদের  জন্য  রাখা দুটো গাড়িতে পৌঁছলাম  আবার  সেই নদীর  ধারে যেখান থেকে আমরা ভিতরকনিকায় রিসর্টে আসার জন্য উঠেছিলাম। 
সবাই  বেশ  উত্তেজনার সঙ্গে  উঠেছি। লঞ্চের  ইঞ্জিন  স্টার্ট  হওয়া মাত্রই  কি যেন একটা  সড়সড় করে জলে নেমে গেল। দুঃশলা চেঁচিয়ে উঠলেন,  আরে বাবা এ যে একটা  বেশ বড় ধরণের  কুমির। অর্জুন  তখন  বলে উঠলেন, " ঠিকই  তো, এখানে কুমির ই  তো দেখা যাবে, এটা নোনাজলের কুমিরের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ক্রমহ্রাসমান এই প্রজাতির  কুমিরের সংরক্ষণ এবং প্রজননের ব্যবস্থা এখানে রয়েছে এবং এছাড়াও  রয়েছে নানাধরণের  পাখি যা একটু লক্ষ্য করলেই চোখে পড়বে।" লঞ্চ তো আওয়াজ করে চলতে শুরু করল এবং আমরাও বিভিন্ন জায়গায় বসে নিজের নিজের মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলার  জন্য  ব্যস্ত।  ছোট, বড়, মাঝারি নানাধরণের  কুমির  এদিকে ওদিকে দেখা যাচ্ছে আর চিরিক  চিরিক  ধ্বনি করে ফটো উঠছে এর ওর মোবাইলে। আমি দেখছি বিস্তীর্ণ  জলরাশি বিভিন্ন দিকে বাঁক নিয়েছে আর ম্যানগ্রোভের ছায়া জলে পড়ে নদীর  গভীরতা যেন  আরও  বাড়িয়ে দিয়েছে। বৈতরণী, ব্রাহ্মণী, ধামড়া ও পাঠশালা নদীর ভিন্ন ধরণের বাঁক এই ভিতরকনিকাকে মনোহর রূপ দান করেছে। একবার  এই বাঁক, পরক্ষণেই অন্য  বাঁকে লঞ্চ নিজের মনে চলেছে এবং মাঝিরা মাঝেমধ্যেই  চিৎকার  করে বলছে ঐ দেখিয়ে কিতনা  বড়া মগরমচ্ছ ( কুমির)। আমরা হাঁ করে দেখছি আর মনে মনে বেশ ভয় ও পাচ্ছি। ভাবছি, এই বড় কুমিরগুলো যদি লঞ্চে ধাক্কা মারে তাহলে  তো সব জারিজুরি শেষ।  অর্জুনের এখানে ধনুর্বাণ ও নেই আর নেই ভীমের সেই গদা। কি হবে তাহলে? পঞ্চপাণ্ডবদের যতই  বীর বলা হোক না কেন, অর্জুন  আর ভীম ছাড়া বাকি ত্রয়ীকে  কেমন ম্যাদামারা  বলেই মনে হয়। যুধিষ্ঠির  তো ধর্ম আর পাশা খেলেই গেলেন  আর নকুল সহদেবকে তো দুধেভাতে  পাণ্ডব  বলেই মনে হয়। মাঝেমধ্যে মহাভারতের  এখানে সেখানে একটু আধটু তাদের  যুদ্ধ করা বা বীরত্বের  কথা উল্লেখ  আছে বটে যেটা না লিখলে ব্যাসদেবের  কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করত এই রাজতনয়দ্বয়। যাই হোক , আমার  মনের  মধ্যে যেটা ঘোরাফেরা করছিল  সেটা বললাম,  নকুলের কি হচ্ছিল  বলতে পারব না। চোখটা দেখে যে একটু আন্দাজ করব তাও সম্ভব নয় কারণ চোখে রয়েছে রোদ চশমা বা সানগ্লাস।  হঠাৎই  যেতে যেতে লঞ্চটা নদীর  এক কিনারায় পৌঁছাতেই   রোদ পোহানো একটা বিশালাকৃতি কুমির ( প্রায় ফুট পঁচিশেক) লঞ্চের  আওয়াজে বিরক্ত বোধ করে এত দ্রুত  জলে ছুটে এল যে আমার  মনে হল যে জস সিনেমায় দেখা  হাঙরের  লঞ্চকে আক্রমণের  কথা । ভয়ে বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। ভাবছি, এ যাত্রায় বাড়ি ফিরে যেতে পারব কি না। যাই হোক , সেরকম  কিছু  হলো না আর আমরাও যেখান  থেকে  লঞ্চে উঠেছিলাম  সেইখানে ফিরে এলাম। কিন্তু জেটির কাছে এসে দেখি যে জলস্তর থেকে জেটির  উচ্চতা প্রায় দশ ফুট মানে আমরা যখন  যাত্রা শুরু করেছিলাম  তখন  ছিল জোয়ার কিন্তু এখন ভাটার  টানে জলস্তর এতটাই নেমে গেছে যে কি করে  ডাঙায় উঠব তা আর ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু মাঝিরা  এতে অভ্যস্ত।  তারা লঞ্চটা নোঙর  করে লঞ্চ থেকে বিরাট  একটা মোটা তক্তা  জেটির গায়ে ফেলল। কাঠের  পাটাতনে  মাঝে মাঝেই  আড়াআড়িভাবে কাঠের  তক্তা মোটা পেরেক দিয়ে আটকানো যাতে পা পিছলে গড়িয়ে না যায়। এরপর জেটির  উপরে দুজন লোক বাঁশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর আমরা ভগবানের  নাম স্মরণ করে বাঁশ ধরে কাঠের  পাটাতনের উপর পা রেখে উঠছি। দুএকজন ছাড়া বাকি সবাই কেউ কোমর , কেউ পায়ের ব্যথায়  ভুগছে। জলে পড়লেই কুমিরের  পেটে যে যাবেনা , এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবেনা। সুতরাং , একে একে সবাই জেটির  ওপরে ওঠার  পর যুধিষ্ঠিরের মুখ থেকে  অস্ফূট স্বর বেরিয়ে এল বিজয়ী ভব এবং চোখেমুখে একরাশ অজানিত আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল।  ডরপোঁক সহদেব  তখন  ভাবছে শুধু  শুধু এত দেরী না করলে জোয়ারের জল থাকত  আর এত কসরত করতে হতো না । গাড়ি দাঁড়িয়েই  ছিল, মিনিট  দশেকের মধ্যেই  রিসর্টে। একটু হাতমুখ ধুয়েই রিসর্টের লাউঞ্জে বসে শুরু হলো চা খাওয়া। এর পরেই লাউঞ্জের পাশেই খানিকটা ফাঁকা জায়গায় কাঠকুটো জ্বালানো  হল এবং তার চারপাশে রাখা হলো চেয়ার এবং ঐ বনফায়ারের মধ্যেই  শুরু হলো গানের আসর। আসতে লাগল প্লেটভর্তি গরম গরম পেঁয়াজি এবং চিকেন  পকোড়া।  ভালান্দারা, কারেনুমতীর গানের গলা যথেষ্টই  ভাল, সুতরাং  বলাই বাহুল্য জমে উঠল আসর। ঐখানে থাকতে থাকতেই লাউঞ্জে ডিনারের  ব্যবস্থা এবং দারুণ  সুস্বাদু সব খাবার দাবার।
এরপর তাঁবুতে যেতে হবে। কেমন  গা ছমছম করছে  কারণ জঙ্গলের  মধ্যে রিসর্ট।  সাপখোপ  ছাড়াও  থাকতে পারে নানাধরণের  জন্তু জানোয়ার।  সঙ্গে নিয়ে যাওয়া কার্বলিক অ্যাসিড চারদিকে ছড়িয়ে দিলাম।  হাতের কাছে রাখলাম  টর্চ  আর একটা বড় ছুরি আত্মরক্ষার জন্য।  বাইরের  চেনটায়  লাগালাম  তালা , দ্বিতীয়টায়  চেনটা সম্পূর্ণ ভাবে টেনে দিলাম  যাতে কোন জন্তুজানোয়ার ভিতরে না আসতে পারে। দুর্গা দুর্গা বলে শুয়ে একঘুমে রাত কাবার।  ভোরের  আলো ফুটে উঠছে। মোবাইল  ও ছুরিটা  নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি ফটো তোলার  বাসনায়। নানাধরণের  পাখির  ডাক, এত মনোরম পরিবেশে নিজের ই কেমন লজ্জ্বা লাগছিল  ঐ ছুরিটা সঙ্গে করে আনার  জন্য।  যাই হোক,  এবার  শুরু হলো দ্বিতীয় দিনের  প্রস্তুতি। ব্রেকফাস্ট করেই আবার  সেই পাড়ে যাওয়া এবং  নদীর  অন্য দিকে যাওয়া। ন্যাশনাল পার্কের কাছে নামা হলো এবং হেলে দুলে ঐ পার্কের  বিশাল  চত্বর পরিক্রমা করার সাধ্য  দুএকজন ছাড়া আর কারও  ছিলনা এবং আগেরদিন ভাটার  টানে জলের স্তর এত নীচে নেমে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা বেশ টাটকাই  হয়ে আছে মনে। অতএব,  বাবা ফিরে চল নিজ নিকেতনে ,মানে  রিসর্টে। যদিও  ন্যাশনাল পার্ক  সম্পূর্ণ ভাবে ঘোরা হলো না তবুও যতটা প্রাপ্তি তাতেই মনটা ভরে গেল।  লাঞ্চ সেরে  সামান্য  বিশ্রাম  করেই পারমাদনপুর গ্রামে একটা পুরোন  মন্দির  দর্শন করতে গেলাম।  বেশ জরাজীর্ণ মন্দির,  দেখেই বোঝা যায় কোন  রক্ষণাবেক্ষণ  হয়না। পুরোহিতের চেহারাও  তেমন নধরকান্তি  নয় মানে বোঝাই যাচ্ছে দরিদ্র  গ্রামের  দরিদ্র  পূজারী।  ডেকে একশ টাকা দেওয়ায় খুবই খুশি। একটা ছবিও  তুললাম তাঁর এবং যে অভিব্যক্তি তাঁর চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল  তা ভাষায় প্রকাশ  করা যায়না। ফিরে এসে চা ও পকোড়া এবং রাতে পাঁঠার  মাংস  ও লুচি পায়েসের সমন্বয় এবং সর্বোপরি গাজরের  হালুয়া --এক দারুণ  অভিজ্ঞতা। পরদিন ফিরে আসার  সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে গাজরের  হালুয়া আমাদের  দিয়ে দেওয়া রাস্তায় খাবার জন্য। এখানে উল্লেখ করা ভাল  যে অর্জুন দীর্ঘদিন  উড়িষ্যায় থাকার ফলে স্থানীয় ভাষার  উপর যথেষ্ট দখল এবং বহুবিধ  লোকের  সংস্পর্শ তাঁকে অত্যন্ত  প্রাজ্ঞ করেছে এবং এই রিসর্টের মালিক আমাদের আতিথেয়তায় সামান্যতম  ত্রুটি হতে দেননি। দ্বিতীয়দিন রাতে তাঁবুতে অনেক স্বাভাবিক  ও সাবলীল  এবং পরদিন  ব্রেকফাস্ট  করে ফিরে আসার  পালা। জোয়ারের  জন্য  জেটিতে কোন কষ্ট  হয়নি কিন্তু একটা দুঃখ চিরদিন  থেকেই যাবে কারণ দুঃশলার  দামী মোবাইল যেখানে অনেক দুষ্প্রাপ্য  ছবি এবং ভিডিও  ছিল তা জলে পড়ে যায় এবং কুমির বাবাজীবন আমাদের  কাউকে পেটে  না ভরতে পারলেও ঐ দামী মোবাইলটি গলাঃধকরণ  করেন
( অবশ্যই  অনুমান) এবং দুধের স্বাদ  ঘোলেই মেটান। 
আবার  লম্বা যাত্রা গাড়িতে ভদ্রক স্টেশন  পর্যন্ত  এবং ঐখানেই  লাঞ্চ করে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরে আসা।

Friday, 9 June 2023

পথ চলাতেই আনন্দ (দুই)

ভাইজাগের মহারাজা তখন মহেন্দ্র বাবু।তাঁরই অধীনস্থ তিন অঙ্গরাজ্য যথাক্রমে বিশাখাপটনম,  রাজমন্দ্রি ও বিজয়বাড়া যেখানে রাজ্যপাট সামলানোর দায়িত্বে রয়েছেন শ্রীনিবাসন, নরসিমহন ও প্রভাকর। মহারাজের অর্থনীতি ও সম্পদবৃদ্ধির দায়িত্ব আমার এবং শাসন পরিচালনায় সাহায্য করার জন্য রয়েছেন সচিব  সূর্যকুমার। সচিব সূর্যর কর্মদক্ষতা ছিল অসাধারণ।  যে কোন সমস্যাই তার কাছে ছিল  জলের  মতন। প্রত্যেক মাসেই দ্বিতীয় শনিবার মহারাজের কাছে সবাইকে একসঙ্গে সেলাম ঠুকতে হতো  তাদের  কাজের  ফিরিস্তি নিয়ে এবং যথারীতি খালি পেটে তো আর গুরুগম্ভীর আলোচনা করা যায়না, সুতরাং ব্যবস্থা এলাহি। আর সেইটাই হচ্ছে সমস্যা ।সূর্য ও আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। সমস্ত কিছু নিপুণ ভাবে না হলে সূর্যর  হ্যাপা আর সেটাকে সুষ্ঠু ভাবে করতে গেলে চাই সম্পদ বৃদ্ধি। সুতরাং কাজের  সঙ্গে আমোদ প্রমোদের মূল কাণ্ডারি এই দুজনেই। একদিন  সূর্যকে বললাম এই হ্যাপাটা একটু অন্যদের  কাঁধে চাপানো যায়না? টাকা পয়সা যা খরচ হবে তা তো হবেই  কিন্তু ব্যবস্থাপনাটা একটু অন্যদের  কাঁধে চাপানো যায় না?
ঠিক বলেছো,  একটা উপায় বের করতেই হবে। এরই  মধ্যে অনেকবার আমাদের ই সামলাতে হয়েছে। সূর্যর  মাথায় খেলতো  নানাধরণের বুদ্ধি। একদিন  সুযোগ বুঝে মহারাজের কাছে ব্যাপারটা উত্থাপন করল। আমাদের এই প্রত্যেক মাসের কাজের পর্যালোচনা এখানে না করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করলে কেমন  হয়? "খরচটা তাতে কি বাড়বে না কমবে?" , মহারাজের প্রশ্ন।
সূর্যর  চটজলদি উত্তর, " এটা ঘোষের কাছেই  জানা যাক।"
তলব হলো আমার। সব কিছুই প্ল্যান মাফিক চলছে। হাজিরা দিতেই ধেয়ে এল প্রশ্ন।  চিন্তান্বিত মুখে বললাম, "একটু সময় দিন, আমি হিসেব কষে বলে দিচ্ছি।" খানিকক্ষণ পরে বললাম,  " মহারাজ,  খরচ খানিকটা কমই হবে। "
"কি করে?"
উত্তর তৈরীই ছিল, বললাম ," এখানে খাওয়ার  পিছনে অনেক বেশি খরচ, কারণ লোকসংখ্যা এখানে অনেক বেশি এবং আনুষঙ্গিক খরচও  বেশি হয়।"
"ঠিক আছে, তাহলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই মিটিং হোক।"
অনুমতি মিলতে সূর্যর চিঠি তৈরী। এখন থেকে এক এক মাসে এক এক জায়গায় এই পর্যালোচনা হবে। সেই মতো ঠিক হল পরের মাসে রাজমন্দ্রি এবং তার পরের মাসে বিজয়বাড়ায় হবে এই মিটিং এবং তার পরের মাসে আবার  ভাইজাগে।
শনিবার ভোরবেলায় গাড়িতে মহারাজ,সস্ত্রীক শ্রীনিবাসন,  আমি ও সূর্য রওনা দিলাম  রাজমন্দ্রির পথে। মাঝখানে উদুপি রেস্তোরাঁয় টিফিন  করে পৌঁছে গেলাম নরসিমহনের অফিসে। ও ব্যবস্থা করেছে এক হোটেলে আর ইতিমধ্যেই  প্রভাকর ও এসে গেছে। বেশ ছিমছাম  ব্যবস্থা কিন্তু ওর আয়োজন  ছিল  একটু বেশ ভারী রকমের যদিও  লোকসংখ্যা  কম হওয়ায় পুষিয়ে গেছে। রাতে থাকার  ব্যবস্থা করেছে সুন্দরী গোদাবরী নদীর পাড়ে গেস্ট হাউসে।  ঘুমাব  কি, জানলা দিয়ে রাতের গোদাবরীর সৌন্দর্য্য দেখছি।
সুবিশাল  গোদাবরী,  এপ্রান্ত থেকে দেখা যায়না। অন্ধকারে চোখমেলে রয়েছি কিন্তু প্রায় তিন কিলোমিটার বিস্তৃত নদীর অন্য পাড় দেখার মতো চোখের দৃষ্টি আমার  নেই। ট্রেনে যেতে যেতে নদীটা  পেরোতে লাগে যে বহু সময়। এই সুবিশাল নদীর অববাহিকায় দুই প্রান্তে গড়ে উঠেছে বহু জনপদ এবং উর্বর হওয়ায় ফসলও হয় প্রচুর।  এই কারণে এই মহান  নদীকে দক্ষিণ গঙ্গা বলে। পরেরদিন সকাল বেলায় লঞ্চে গোদাবরী ভ্রমণের  ব্যবস্থা করেছে নরসিমহন।  রাজমন্দ্রির ঘাটে আমরা সবাই  পৌঁছে গেছি। শ্রীনিবাসনের স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য নরসিমহনের স্ত্রীও এসেছেন।  সকাল বেলায় লঞ্চের ওপরের ডেকে আমরা সবাই  বসে আছি। লঞ্চেই ব্রেকফাস্ট , লাঞ্চ ও চায়ের ব্যবস্থা রয়েছে,  এছাড়াও  আছে নাচ ও গানের আসর। একটি অল্প বয়সী ছেলে ও মেয়ে যেভাবে নাচল তাতে ওরা যে অতি অল্প সময়েই  সিনেমায় নামবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আঁকা বাঁকা গতিতে লঞ্চ চলতে চলতে একটা গ্রামের  কাছে  এল। কিছু একটা পূজো হচ্ছে। ঢাক, ঢোল, কাঁসর ও নানাধরণের বাঁশি বাজছে, গ্রামের  লোকজন ও নাচছে।  ভারী মনোরম পরিবেশ। ইতিমধ্যেই  পূজো শেষ  হয়ে এসেছে। কপাল ভাল ছিল,  জুটে গেল  প্রসাদ।  ওদিকে লঞ্চের লোকজন তাড়া দিচ্ছে। গুটি গুটি পায়ে সবাই  এগোলাম লঞ্চের দিকে। 
লঞ্চ এগোচ্ছে নিজের  মতন আর আমরা মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছি। শ্রীনিবাসন মাঝেমধ্যেই ফটো তুলছে আর আমরা সবাই  গল্প গুজবে মত্ত। কোন কোন জায়গায় তিনটে চারটে বাঁক,নদীর  পাড়ে থাকা পাহাড়গুলো যেন দিক নির্দেশ করছে কোথায় যেতে হবে। গোদাবরীর দুই পাড়ই যেমন উর্বর, তার ছোঁয়াচ  ও যেন লেগেছে পাহাড়ের গায়ে। ঘন সবুজ  জঙ্গলে ভরা পাহাড়ের দিকে তাকালেই চোখ  জুড়িয়ে যায়। লঞ্চ দেখতে দেখতে একটা পাহাড়ের কাছে গিয়ে থামল। ওখানে একটা মন্দির  আছে। আমরা খানিকটা উঠে ক্ষান্তি দিলাম এবং ওখানে বসেই নরসিমহনের স্ত্রীর আনা কিছু মুখরোচক খাবার খেলাম।  একটু চায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই লঞ্চের  লোকেরা বলল চা তৈরী হয়ে গেছে। তরিঘরি উঠে পড়লাম চায়ের তেষ্টা মেটাতে। মাঝপথেই  হলো লাঞ্চ  এবং তারপরেই  ফেরার  পালা। অনতিদূরে  নির্মীয়মাণ পোলাভরমের বাঁধ চোখে পড়ল  কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও  যাওয়া হলোনা কারণ তাহলে ফিরতে অনেক দেরী হয়ে যাবে।
সন্ধে নামছে, পাহাড়ের  ছায়া গোদাবরীর জলে পড়ে আরও মায়াময়  করে তুলেছে। নিস্তব্ধ অন্ধকারে লঞ্চের আলো যেন  প্রদীপের মতো লাগছে আর ভুটভুট আওয়াজ  পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে বলছে ফিরে যা , ফিরে যা। বেশ ঘন অন্ধকার,  হঠাৎই  লঞ্চ গেল থেমে, আটকে গেছে চড়ায়। যতক্ষণ  জোয়ার  না আসছে বা অন্য  কোন লঞ্চ এসে না টানছে ততক্ষণ  নট নড়ন চড়ন।  অতএব, অপেক্ষা করা ছাড়া কোন রাস্তা নাই। যাই  হোক, খানিকক্ষণ পরেই যেন সোঁ সোঁ করে  এক আওয়াজ শোনা গেল আর দুলকি  চালে লঞ্চটাও নড়ে উঠল এবং ফের ইঞ্জিন  স্টার্ট হলো এবং আমরা ফিরে এলাম  বেশ রাতে। রাতের  খাবার গেস্ট  হাউসে খাবার  আগে আমি আর মহারাজ  বাদে ওরা একটু বসে খিদেটাকে  চাগিয়ে নিল। তারপর হৈ হৈ করে গল্প সেরে গোদাবরীর হাওয়া গায়ে লাগিয়ে টানা ঘুম।  পরদিন ছিল  সোমবার  কিন্তু কি একটা কারণে ছিল  ছুটি। বেশ দেরী করে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে এবং লাঞ্চ করেই গাড়িতে চড়ে ফিরে এলাম  ভাইজাগে।  রথ দেখা  কলা বেচা দুইই সম্পন্ন  হলো।

পথ চলাতেই আনন্দ (এক)

জীবনের অপর নাম গতি । জীবন যখন গতিহীন হয়ে যায়, তখনই  ঘটে মৃত্যু। মানুষ  যতক্ষণ চলাফেরা করছেন ততক্ষণ  তিনি অমুক বাবু বা তমুক বাবু আর স্পন্দনহীন নিথর দেহটা তার নাম গোত্র হারিয়ে হয়ে যায় বডি। ছোটবেলা থেকেই  দুরন্ত, এখানে ওখানে যেতে হলেই দে ছুট, পাড়ার লোকজন বলত ঘোড়া। একটু বড় হতেই সাইকেলের প্রতি আকর্ষণ।  জোরে সাইকেল চালিয়ে এখান থেকে সেখান, ভিড়ের মধ্যেও কাটিয়ে কুটিয়ে কাউকে ধাক্কা না মেরে সবার আগে গন্তব্যে পৌঁছানোর  এক আলাদা তৃপ্তি। কে কি বলল বা কেউ মেডেল দিল কি দিলনা  তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, নিজেই নিজের  পিঠ চাপড়ানো আর কি। আরও  বড় হয়ে স্কুটার  বা মোটরসাইকেল  নিয়ে তীব্রগতিতে পৌঁছে যাওয়াতেই যেন দারুণ তৃপ্তি। এককথায় জীবনকে গতিময়  করে তোলা যেন নিজের  কাছে এক চ্যালেঞ্জ। 
স্কুলে পড়াকালীন ইংরেজিতে রচনা লিখতে হতো "এ জার্নি বাই ট্রেন"  এবং " এ জার্নি বাই বোট"। মাঝে মাঝেই ধাঁধায় পড়ে যেতাম যখন বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা শুরু হতো যে কোনটা বেশি আনন্দ দায়ক। আমার  তো দুটোই  দারুণ লাগে কিন্তু কোনটা বেশি ভাল লাগে তা নিয়ে ধন্দেই থাকতাম। আসলে বেড়ানোর মধ্যেই আনন্দ।  যখন ট্রেনে যাই তখন মনে হয় আহ্ এর মতন মজা আর হয়না বিশেষ করে যদি থার্ড ক্লাসে  ( বর্তমানে যেটা সেকেন্ড ক্লাস কিন্তু তাতে কোন গদি আঁটা থাকত না) যাওয়া হতো। খটখটে কাঠের বেঞ্চ মাঝে মাঝে ফাঁক, ওপরে একটা বাঙ্ক  এবং তারও ওপরে লোহার শিক দিয়ে তৈরী আরও  একটা ছোট  বাঙ্ক। জেনারেল কম্পার্টমেন্ট  হলে তো কথাই  নেই, গাদাগাদি ভিড়,  পায়ের কাছে বসে লোক, প্যাসেজে বসে লোক, বাথরুম যেতে হলে ত্রাহি ত্রাহি রব। এর গায়ে লাথি,ওর কোমরে ধাক্কা, বিভিন্ন লোকের  গায়ে বিভিন্ন রকম  গন্ধ ( অবশ্যই  সুখকর নয়) সবকিছু সয়ে বাথরুম যদি বা পৌঁছানো গেল দেখা গেল সেটা ভেজানো।  ল্যাচটা ঘুরিয়ে ঢোকার  চেষ্টা করতেই ভিতর থেকে এক অস্ফূট আর্তনাদ, 
" উঁহু, আমি আছি" । তা ভাল কথা , ভেতরে আছ তো ছিটকিনিটা  দাওনি কেন বাপু বলে মনে মনে গজরাতে থাকা। এত কষ্টে মরুতীর্থ হিংলাজ হয়ে এসে নিজেকে ঠিক রাখা যে কত কঠিন কাজ  সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানেনা। ভেতরের  লোক বেরোনো মাত্রই একে তাকে গুঁতো মেরে সেঁদিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়া এবং তার পরেই বিপদের মাত্রা অনুধাবন করা। ছিটকিনিটা আছে কিন্তু যেখানে ছিটকিনিটা আটকাবে  সেটা নেই বা থাকলেও সেখানে আটকাচ্ছে না। এহেন  পরিস্থিতিতে মাথা খাটিয়ে  কার্যসিদ্ধি হলে নোবেল পুরস্কারের জন্য  মনোনয়ন হওয়া  উচিত।  তারপর বীরের  মত বাইরে এসে আবার  যুদ্ধ  করতে করতে নিজের  জায়গায় ফিরে যাওয়া। যাবার  সময় যাদের  গায়ে পা লেগেছিল  তাদের  কাছে দুঃখ প্রকাশ করে নিজের  পাপস্খালন করা। জায়গায় বসেই অসমাপ্ত কথা বা গল্পের ফের শুরু করা। এর মধ্যেই বিভিন্ন ফেরিওয়ালার ভিন্ন স্বাদের বিপণন এবং এটা সেটা করতে করতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাওয়া। এত কষ্টের মধ্যেও আনন্দটা ছিল একেবারেই বিশুদ্ধ নির্মল। তখন মোবাইল  বলে কোন  জিনিস  হতে পারে এটা    স্বপ্নেও ভাবতে পারা যেতনা কিন্তু স্মৃতিশক্তি   ছিল  বড়ই  প্রখর এবং নাম ধাম গোত্র সবই যেন মনে থাকত যদিও  ভবিষ্যতে আর কোনদিন তার সঙ্গে দেখা হবে কিনা সন্দেহ। এখন রিজার্ভ  কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত,  লোকের  সংখ্যা সীমিত  কিন্তু বন্ধুত্ব  বা আলাপ ঐ ক্যুপের মধ্যেই  সীমিত থাকে ,সাইড বার্থেও  পৌঁছায় না যদি না তাঁরা পূর্ব পরিচিত  না হন। ফার্স্ট ক্লাস ( যা আজকাল  উঠেই গেছে) বা এ সি টু টায়ার  বা এ সি ফার্স্ট ক্লাসে সেই  মজাটা পাওয়া যায়না, সবাই গোমরামুখো হয়ে তাদের  স্টেটাস সিম্বল জাহির  করে। কেউ  কারো সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে না পাছে যদি সে ছোট হয়ে যায়। গপ্পিষ্ঠি লোকের  পেট  ফুলে যাওয়ার অবস্থা। সুতরাং সাধারণ  লোক আমার  অবস্থা  সহজেই অনুমেয়। আমি সেকেন্ড ক্লাসে  খুব  স্বচ্ছন্দ যেখানে কথা বলতে বলতে  গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতে পারি।

সাঁতার  না জানায় বরাবরই  জলে আমার বড্ড ভয়। বাড়ির কাছে গঙ্গা থাকলেও বাড়ির  নিষেধে গঙ্গাস্নান হতোনা যদি না কাউকে দাহ করতে  যেতে হতো বা ঘাটে পিণ্ডদান  করতে হতো। প্রতিমা বিসর্জনের  সময় ও কড়া হুঁশিয়ারি, গঙ্গায় নামা চলবে না। সুতরাং নৌকায় চড়া,  এটা অকল্পনীয় ছিল।  কিন্তু যেখানেই  বাধা নিষেধ  সেখানেই তীব্র আকর্ষণ।  ফরাক্কা ব্যারেজ হবার আগে গঙ্গা ছিল শীর্ণ, বেশিরভাগ জায়গায় জল থাকত হাঁটু পর্যন্ত।  কিন্তু কোন কোন জায়গায় জল থাকত বেশ গভীর।  এইরকম ই একটা জায়গা ছিল  রাধারঘাট। তখন  ওখানে ব্রিজ  হয়নি, গাড়ি ঘোড়া সব পেরোত ঐ রাধারঘাটের অস্থায়ী  কাঠের ব্রিজ  দিয়ে। বর্ষার সময় যখন  গঙ্গা  টইটুম্বুর তখন  কাঠের ব্রিজ  আর থাকত না এবং তখন বড় বড় নৌকা জোড়া দিয়ে গাড়িগুলো চলাচল করত আর সাধারণ  মানুষের জন্য  ছিল  নৌকা ও মাঝি। রাধারঘাটের অন্য  পাড় থেকে ছাড়ত কান্দি যাওয়ার বাস। ওখান  থেকে  যেতে হতো খাগড়াঘাট স্টেশন যেখান থেকে হাওড়াগামী বা হাওড়া থেকে উত্তরবঙ্গ বা আসাম যাওয়ার  ট্রেন  ধরতে হতো। ফরাক্কা স্টেশন পৌঁছে গঙ্গা পেরোতে হতো স্টিমারে এবং অন্য পাড়ে গঙ্গার চর পেরিয়ে মালদহ বা উত্তরবঙ্গের জন্য  দাঁড়িয়ে থাকা  ট্রেনে উঠতে হতো। যেখানেই  বাধা সেখানেই আকর্ষণ।  অতএব নৌকায় চড়ে ভরা গঙ্গা এপার ওপার  করার  মধ্যে ভয় থাকলেও তীব্র আকর্ষণ ও ছিল। সুযোগ  জুটে গেল।ক্লাব থেকে নৌকায় লালবাগ ও নসীপুর  যাওয়া হবে। বহরমপুর থেকে লালবাগ  যেতে হলে স্রোতের বিপরীতে যেতে হয় , সুতরাং শুধু দাঁড় বেয়ে যাওয়া বেশ কঠিন  ব্যাপার ছিল। সুতরাং দাঁড় টানা মাঝি ছাড়াও  আরও  দুজন মাঝি গুণ টানতো। নৌকার পালে লম্বা দড়ি বেঁধে দুজন মাঝি গঙ্গার  পাড় বরাবর  টানতে টানতে যেত কিন্তু ফেরার সময় গুণ টানার  দরকার  পড়ত না কারণ  তখন  স্রোতের  পক্ষে নৌকা চলত। নৌকার ছই এর মধ্যে বসে থাকা এবং নৌকার  মধ্যেই রান্না করে খাওয়ার  এক আলাদাই  মজা। এখানে যেহেতু সবাই চেনাজানা গল্পের  পরিধিও  ছিল  সীমিত।  কিন্তু গঙ্গার বাতাসে যাত্রা নিত এক অন্য মাত্রা। হৈ হৈ করে কয়েক  ঘন্টা কিভাবে কেটে যেত কিছুই বোঝা যেতনা। এর পরেও জল বিহার  হয়েছে বিভিন্ন  সময়ে কোন সময় লঞ্চে বা ক্রুজে এবং  আনন্দ ও হয়েছে অসামান্য। 
ভ্রমণ যাদের  প্রিয় তাদের কি ট্রেন বা কি নৌকা বা লঞ্চ সবই আনন্দ দায়ক। তাই কোনটা বেশি ভাল সেটা বলা মুশকিল।