দীর্ঘদিন ধরে প্ল্যান করে বেড়িয়ে পড়ার মধ্যে অবশ্যই আনন্দ আছে কিন্তু হঠাৎই যাব মনে করে দুম করে বেড়ানোর আনন্দ বোধ হয় আরেকটু বেশী যদি সবকিছুই ঠিকঠাক চলে। কিন্তু তার জন্য যিনি প্ল্যান করলেন তাঁকে অনেক বেশী ঝুঁকি নিতে হয়, যেটা অল্পবয়সীদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব কিন্তু অনেকদিন আগে যাঁরা যৌবনকে বিদায় জানিয়েছেন তাঁদের অনেক হিসেব করে এগোতে হয়।
গরমের ছুটিতে ছেলে, বৌমা ও নাতি নাতনিদের আসা নিয়ে বাসু বাবু ও তাঁর স্ত্রী খুব উত্তেজিত। ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে নিত্যদিন কিছু না কিছু নিয়ে মতান্তর চলছেই। মানে পরিষ্কার করতে গিয়ে এলোমেলোভাবে চলায় অভ্যস্ত বাসুবাবু নিজের জিনিসপত্র ঠিক জায়গায় দেখতে না পেয়ে মাথা গরম করছেন আর আগুনকে আগুন দিয়ে নেভানোর নীতি মেনে বাসুগিন্নীর তাঁর থেকে দুই ডিগ্রী উপরে গলা চড়ানোতে ব্যাপারটা খুব সাধারণ জায়গায় থেমে থাকছে না। আশেপাশের বাড়িতে রীতিমত গুঞ্জন উঠছে যে বাসু বাবুর বাড়িতে নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু হতে চলেছে। অবশ্য এই ফ্যাঁস ফোঁস যতদিন চলতে থাকবে ততদিন ই ভাল। যে কোন একটা স্তব্ধ হয়ে গেলেই ব্যালকনিতে বসে গাছ, পাখি দেখা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। যাই হোক, এর ই মধ্যে ভাঙা নৌকায় আধখানা ভালবাসা নিয়ে ছেলে আর নাতনি এসে পৌঁছেছে। বৌমার অফিসের কাজ আর নাতির ক্লাস কামাই না করানোতে তারা পরে আসবে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হলো বাসুবাবুদের। একদিন কেটে গেল, পরদিন বৌমার নাতিকে নিয়ে আসার কথা। হঠাত খেতে খেতে ছেলে বাবা মাকে সুটকেস গোছানোর কথা বলতেই তাঁরা আকাশ থেকে পড়লেন। একটু শাল, সোয়েটার নেবার কথা বলতেই একটু ধন্দে পড়ে গেলেন বাসুবাবুরা। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না তাঁরা কিন্তু নাতনির আবদারের কাছে মাথা নোয়াতেই হলো । প্ল্যানটা কি জিজ্ঞেস করাতে তাঁরা জানলেন যে পরদিন তাঁদের যেতে হচ্ছে বাগডোগরা এবং সেখানে সন্ধে বেলায় বৌমা আসবে নাতিকে নিয়ে এবং সেইদিন শিলিগুড়িতে থেকে পরদিন যাত্রা হবে কালিম্পঙের পথে। বাসুবাবুরা তো পৌঁছলেন বাগডোগরা কিন্তু জানা গেল যে বৌমার ফ্লাইট কোন বিশেষ কারণে বাতিল হয়েছে। সুতরাং প্ল্যান বাতিল করে শিলিগুড়ির কোন এক হোটেলে যেতে হলো। হোটেল তারা ঠিকই করে রেখেছিল কিন্তু বৌমা ও নাতিকে বাদ দিয়েই তারা হোটেল সালুজাতে গিয়ে উঠল। রাতের খাবার ঐ হোটেলের রেস্তোরাঁয় সেরে পরদিন সকালে গাড়িতে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে বৌমা ও নাতনিকে নিয়ে সরাসরি কালিম্পঙের পথে দিল রওনা। এখন পুরো পরিবার সমেত চেটেপুটে আনন্দ নিতে নিতে চললেন বাসু বাবু ও তাঁর পরিবার। মাঝপথে প্রয়াস হোটেলে চায়ের সঙ্গে একটু হাত পা ছাড়িয়ে নিয়ে আবার চলা শুরু হলো কালিম্পঙের পথে। বেলাবেলি কালিম্পঙের হোটেল এলগিন সিলভার ওকসে পৌঁছালেন তাঁরা। স্বাগত জানাতে এলগিন হোটেলে মজুত ছিল রাশিয়ান হাস্কি "ফেরো।" অত বড় সাদা ধবধবে লোমশ কুকুর ফেরোকে দেখে একটু ভয় ই পেয়েছিলেন তাঁরা কিন্তু এই কাজ ফেরো গত পনের বছর থেকে করে আসছে। সুতরাং, খুব শান্তভাবে সবাইকে একঝলক দেখে নিয়ে সব ঠিক আছে এই গ্রীন সিগন্যাল দিয়ে দিল। দারুণ সুন্দর এই হোটেল এলগিন সিলভার ওকস। দোতলায় পাশাপাশি দুটো ঘরে তাঁদের ঠাঁই হলো এবং পর্দা সরিয়ে জানলা দিয়ে অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখা গেল। কোথায় যাব, এইখানে বসে থাকলেই তো হৃদয় মন জুড়িয়ে যায়। একটু ফ্রেশ হয়ে একতলায় ডাইনিং হলে লাঞ্চ করতে আসতে হলো। যেমন সুন্দর হোটেল, তেমনই সুন্দর হোটেলের কর্মীবৃন্দ এবং অসাধারণ খাবার মেনু। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাওয়া উচিত এটা ভাবতে ভাবতেই একটু একটু করে সব জিনিস চাখতে চাখতেই পেট একেবারে ভরপুর।একটু বিশ্রাম নিয়ে হোটেলের লনে বসে চা খাওয়া সাব্যস্ত হলো। একটু দূরে দূরে রয়েছে ছাতা যাকে ঘিরে রয়েছে বেতের চেয়ার। এইরকম ই একটা ছাতার তলে তাঁরা বসে চায়ের সঙ্গে কিছু টা ও অর্ডার করলেন। সুসজ্জিত ওয়েটার কিছুক্ষণ পরেই হাসিমুখে হাজির। নাতি নাতনিদের আবার অন্য কিছুর বায়না, তাও হাসিমুখে তাদের আবদার মেটালেন সেই সুন্দর হাসির ওয়েটার। ভাল হোটেলের এইটাই বিশেষত্ব কারণ গোমরামুখো স্টাফদের কেউই পছন্দ করে না এবং হোটেলের সুনাম এদের সঙ্গেই জড়িত। রাস্তার পাশেই হোটেল এবং আস্তে আস্তে সেই রাস্তা উপরের দিকে চলে গিয়েছে যার ফলে হোটেলের জানলা দিয়ে অনেক দূর অবধি নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়। ভিতরের দিকের লনে বসে দূর উপত্যকায় গাছপালা ঘেরা কিছু বসতি, সন্ধে বেলায় আলো জ্বলে উঠে তা আরও মনোরম হয়ে উঠেছিল। লনে নানাধরণের ফুলগাছ, একপাশে ফেরোর জন্য সুন্দর ঘর, মাঝেমাঝেই এসে তদারকি করে যাচ্ছে অতিথিদের কোন অসুবিধে হচ্ছে কি না, তারপর নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম কর্তামশায়ের। অনেক রাত অবধি চুপ করে বসে পাহাড়ের সেই চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখে রাতের খাবারের জন্য ডাইনিং হলে জমায়েত হলো সবাই। পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে কালিম্পঙ শহরের দ্রষ্টব্য স্থান দেখার জন্য বেড়িয়ে পড়লেন তাঁরা। ছোট্ট শহর পরিক্রমায় বেশিক্ষণ সময় লাগেনা, তাই বিভিন্ন স্থানে অনেকক্ষণ সময় কাটাতে কোন অসুবিধা হলো না তাঁদের। আর্মির একটা ক্যাম্পের খুব কাছে একটা বৌদ্ধমন্দির যেখানে প্রার্থনা চলছে আর সেই কারণেই ভেতরে না গিয়ে বাইরে থেকে পরিক্রমা সেরেই ফিরতে হলো। বৌদ্ধমন্দিরগুলোয় গেলেই কেমন যেন একটা শান্তির পরিবেশ অনুভূত হয়। এরপর তাঁরা গেলেন কালিম্পঙের সায়েন্স সেন্টারে। অনেকটা ওপরে এই সায়েন্স সেন্টার যেখানে আমাদের ভারতবর্ষের নামী বিজ্ঞানীদের আবক্ষ মূর্তি দেখে সত্যিই ভীষণ আনন্দ হয়। কে নেই সেখানে? ডক্টর হোমি ভাবা, বিক্রম সরাভাই, সি ভি রমন, বীরবল সাহনি, জগদীশ চন্দ্র বোস, রামানুজম , সত্যেন বোস এবং আরও অনেক দিকপাল বিজ্ঞানীদের দেখে মনটা উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। নাতি নাতনির ঔৎসুক্য বাবা মা এবং ঠাকুমা ও ঠাকুর্দাদের মধ্যে সঞ্চারিত হলো এবং ছোট হলেও ছিমছাম এক সুন্দর অডিটোরিয়াম যা সবাইকেই আকৃষ্ট করে। এবার যাওয়ার পালা ডেলো পার্কে। গাড়ি যেখানে পার্ক করা হলো সেখান থেকে অনেকটা ওপরে উঠতে হয় ডেলো পার্কের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে। বেশ হাঁফ ধরে যাচ্ছিল বাসুবাবু ও তাঁর স্ত্রীর কিন্তু এতদূর এসে না দেখে ফিরে যাওয়া যায়না। সুতরাং মাঝে মাঝেই বিশ্রাম করে ওপরে উঠলেন তাঁরা। ওপরে উঠে পৌঁছানো মাত্রই ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো।পাহাড়ে বৃষ্টি নামলে যে কত নয়নাভিরাম দৃশ্য হয় তা সাধারণ লোকের পক্ষে বর্ণনা করা মুশকিল। কিন্তু ভাসমান মেঘের একটু দয়ার সঞ্চার হলো, তাই হাসতে হাসতে ভেসে চলল অন্য দিকে আর বৃষ্টি ও হলো উধাও। উপস্থিত সমস্ত ছেলেমেয়েরা এবং বৃদ্ধ বৃদ্ধারা সবাই মনে মনে বলে উঠল, " বনরাজি উচ্ছসিল তোমার আগমনে, এখন যাও ফিরে ওই দূরদিগন্তের পানে।" মেঘ সে তো কারো তোয়াক্কা করেনা, চলে গেল , ঘরেখে গেল নূপুরের ছন্দ। নাতি নাতনিদের ঘোড়ার পিঠে চড়া, সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। ফিরে আসা হলো এলগিনে ফেরোর সান্নিধ্যে। পরের দিন সকাল বেলায় ব্রেকফাস্ট সেরে গ্যাংটকের রাজধানী সিকিমের উদ্দেশ্যে যাত্রা। বিদায় ফেরো, বিদায়। জানা নেই এর পরের বার এখানে এলে বৃদ্ধ ফেরো আবার অভিবাদন করবে কি না।
শুরু হলো গ্যাংটকের পথে যাত্রা। সাথী সেই পরমাসুন্দরী তিস্তা চলেছে তার নিজস্ব তালে। কত জনপদকে সিঞ্চিত করেছে তার অববাহিকায় কিন্তু তার রুদ্রমূর্তিও সাঙ্ঘাতিক। উত্তাল জলরাশিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। অনেকটা মা দূর্গার মতন মনে হয়। মায়ের সেই শান্ত স্নিগ্ধ অভয়ারূপ আর অসুরবিনাশীর রূপ দুটোই যেমন চরম, তিস্তার রূপ ও অনেকটাই সেইরকম। কোন কোন জায়গায় চোখে পড়ল ছেলেমেয়েদের ওয়াটার র্যা্ফটিং, নিপুণ হাতে তাদের নৌকাটাকে জলের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। নাতনি বড় হলেও নাতিও কিছু কম যায়না। প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলছে তাদের মা ও বাবাকে। মাঝপথে থামতে থামতে ছবি তোলার জন্য পৌঁছাতে খানিকটা বেশী সময়ই লাগল। এসে পড়ল গ্যাংটকের নরখিল হোটেল। মনে হয় এটাও সেই কালিম্পঙের এলগিন সিলভার ওকসের একটা চেন। সাজানো গোছানোতে সেই এলগিনের ই প্রতিচ্ছবি। পাশেই একটা স্টেডিয়াম যেখানে চলছে ছেলেদের খেলা। বাইরের লনে বসে থাকতে থাকতেই ফেরোর ই এক ছোট সংস্করণ দেখে চমকে ওঠার মতো ব্যাপার। এখানেও একটা রাশিয়ান হাস্কি সাদা ধবধবে লোমশ কুকুর, নাম যার হিলটন। হিলটনের বোধহয এখনও ট্রেনিং শেষ হয়নি কারণ বয়স তার খুবই কম। যাই হোক সখ্যতা জমতে বেশী সময় লাগল না। ও তো বাচ্চাদের ও খুব ন্যাওটা। যাই হোক, খাওয়া দাওয়া সেরে গ্যাংটকের ম্যালে যাওয়া স্থির হলো। ভারী সুন্দর এই ম্যাল, গমগম করছে এবং শহরের মান মর্যাদা বাড়াতে সদাই উন্মুখ।বছর পাঁচেক আগে দুহাজার আঠারো সালে নভেম্বরের শেষাশেষি একবার আসার সৌভাগ্য হয়েছিল পাণ্ডবসাথী হয়ে কিন্তু এতটুকুও গ্ল্যামার কমেনি সেই ম্যালের। শহরের প্রাণ কেন্দ্র এই ম্যাল। রাতে নরখিলের অপূর্ব খাবার এবং থাকার এই সুন্দর বন্দোবস্তে বাসুবাবুদের আনন্দের শেষ নেই। আগের বারেও হোটেলটা ছিল ফায়ার ব্রিগেডের ঠিক উল্টোদিকে এবং প্রত্যেকটি ঘরের জানলা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখা যেত। বাসুবাবুদের মনে পড়ল ভোরবেলায় অর্জুনের ডাকে কয়েক মুহুর্ত হলেও সেই সূর্যোদয় তাঁরা দেখেছিলেন। এর পরে দিন তিনেক থাকলেও তিনি আর দেখা দেননি, লুকিয়েছিলেন মেঘের ফাঁকে। পরদিন সকালে বেড়িয়ে পড়লেন বাঞ্জাখারি ঝর্ণা দেখতে এবং সেখান থেকে রামটেক বৌদ্ধ মঠের উদ্দেশ্যে। রামটেক বৌদ্ধমঠের কাছে কোন গাড়িকে যেতে দেওয়া হয়না। মিলিটারিদের গাড়িতে বৃদ্ধ এবং অক্ষমদের মঠের গেট অবধি পৌঁছে দেওয়া হয়। বাসুবাবুদের বয়স দেখে এবং চলাফেরায় অসুবিধা দেখে আর্মির গাড়ি তাঁদের পৌঁছে দিল এবং ছোট বলে নাতি নাতনিরাও তাঁদের সঙ্গে গেল। তাঁর ছেলে এবং বৌমা হাঁটতে হাঁটতে অনেক উপরে থাকা মঠে পৌঁছাল। মঠের ভিতরে অনেকখানি বর্গক্ষেত্রাকার জায়গা যেখানে সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন শারীরিক কসরত দেখাচ্ছিলেন যেটা সচরাচর চোখে পড়েনা। ফেরার পথে আর গাড়ির প্রয়োজন হলো না কারণ ঢালু রাস্তা। মাঝপথে ঐখানেই একটা হোটেলে কিছু খেয়ে নিয়ে নরখিল হোটেলে ফেরার পালা। ফেরার পথে চোখে পড়ল কোন কোন জায়গায় সাদা কাপড়ের ফ্ল্যাগ বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে আবার কোন কোন জায়গায় সেটা লাল , হলুদ এবং নানা রঙবেরঙের । বাসুবাবুর মনটা উশখুশ করছে কারণটা জানার জন্য কিন্তু কোন সঠিক উত্তর হাতড়াতে না পেরে স্থানীয় ড্রাইভারের শরণাপন্ন হলেন। ড্রাইভার জানাল যে কারও বাড়িতে কোন মৃত্যুশোক হলে সাদা কাপড় এবং কোন আনন্দানুষ্ঠান হলে রঙবেরঙের পতাকা লাগানো হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এই শোকের পরিবেশ একশ আটদিন পর্যন্ত রাখা হয়। ঠিক সেইরকম ই আনন্দানুষ্ঠান ও ঐভাবেই পালন করা হয়। আমরা ভাবি আমরা অনেক কিছুই জানি কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আমাদের জানার থেকে অজানাই বেশী। সামনা সামনি দুটো ঘরে বাসুবাবুরা এবং তাঁদের ছেলে বৌমারা আছেন। নাতনি ঠাকুমা অন্ত প্রাণ, অতএব বলাই বাহুল্য যে তিনি তাঁদের সঙ্গেই থাকবেন। ভোরবেলায় ছোট্ট ছয় বছরের নাতনি উঠে তার ঠাম্মাম ও ভাইয়ের জন্য চা করেছে এবং ডাকছে ভাই ওঠো, ওঠো। ঘরেই রাখা ইলেকট্রিক কেটলিতে জল গরম করে, চা বানিয়ে ঠাম্মাম এবং ভাইকে ডাকছে , এটা অভাবনীয়। প্রত্যেক মানুষকেই একদিন এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়েচলে যেতে হবে কিন্তু কোন কোন সৌভাগ্যবানের এই বাড়তি পাওনা ভগবানের আশীর্বাদ বলেই মনে হয়। অনেকেই কথায় কথায় বলেন যে আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সভ্যতা ভব্যতার বড়ই অভাব কিন্তু না তারা খুব নিশ্চুপে দেখে যে তার বাবা এবং মা তাদের বাবামায়েদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করছে এবং কোনরকম বইয়ে না পড়লেও তাদের মস্তিষ্কতে কিভাবে যেন ঢুকে যায়। বাসুবাবুর হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল কৃতজ্ঞতায় ভগবানের প্রতি। পরেরদিন সকালে যাত্রা শুরু নাথুলার পথে।
সঙ্গে নেওয়া হয়েছে কর্পূর এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার নাথুলার উচ্চতার কথা ভেবে কারণ আগের বার বাবামন্দিরের কাছে গিয়ে অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে প্রায় মরতে বসেছিলেন বাসুবাবু। নাথু লা তো বাবামন্দিরের চেয়েও উঁচুতে। সুতরাং এবার আর কোন রকম রিস্ক নেওয়া নয়। তবে হিমালয়ের কোলে যদি কারও মৃত্যু হয় সেটা তো ভগবানের ই আশীর্বাদ। কিন্তু মানুষ ভাবে যে আরও কিছুদিন বাঁচলে হয় না? লম্বা জীবন নিয়ে কি হবে যদি তা অন্য কারও প্রয়োজনে না লাগে? সব কথা জেনেও মানুষ তো নিজেকেই সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। পথে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব রূপ ধরা হলো মোবাইল ক্যামেরায়। সামনে চলছে নাথু লার রাস্তা। মাঝপথে নাথু লা যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র সংগ্রহ করা হলো। তারপর পিঁপড়ের সারির মতো গাড়ি চলতে শুরু করল নাথুলার পথে। পথে পড়ল সোমগো বা ছাঙ্গু লেক কিন্তু ওখানে না থেমে আগে নাথুলা যাওয়াই সাব্যস্ত হলো। প্রচুর গাড়ি ওখানে। কোথায় পার্কিং করা হয়েছে না দেখলে ফেরার সময় গাড়ি খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। যাই হোক, বাসুবাবু ও তাঁর স্ত্রী খানিকটা উঠে একটা প্রশস্ত জায়গায় বসলেন। ছেলে, বৌমা ও নাতি নাতনিদের বয়স কম হবার কারণে আরও অনেক উপরে উঠল। অনতিদূরে চীনের সীমানা। আমাদের দেশের প্রহরীদের তাই সদাই সতর্ক থাকতে হয়। খানিকক্ষণ সময় ওখানে কাটিয়ে এবার ফেরার পালা। গাড়ির ড্রাইভার আগেই বলেছিল কোথায় থাকবে, সুতরাং খুঁজে পেতে সময় লাগল না। চারিদিকে বরফ, ওখানে খানিকক্ষণ থাকলেই কেমন হাঁফ ধরে যায় আর আমাদের জওয়ানরা প্রাণপাত পরিশ্রম করে আমাদের নিশ্চিন্তে ঘুমানোর বন্দোবস্ত করে অথচ সুযোগ পেলেই আমরা তাদের গালিগালাজ করতে ছাড়িনা। কি বিচিত্র মানুষের এই ব্যবহার। এবার সুন্দরী নাথুলাকে বিদায় জানিয়ে ফেরার পালা। মাঝপথে সোম গোতে( ছাঙ্গু লেকে) খানিকক্ষণ বিশ্রাম এবং চা ও খাবার খাওয়া। নাতি ও নাতনির বাসনা হলো চমরি গরুর পিঠে চাপা। আর তা ই বা অপূর্ণ থাকে কেন? সন্ধেবেলায় হোটেল নরখিলের লনে হিলটনের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটানো। পরদিন সকাল বেলায় ফিরে আসার প্রস্তুতি। গাড়িতে বসে আসতে আসতেই বাসুবাবুর মনে হলো যেন হঠাৎই একটা স্বপ্ন চোখের সামনে বাস্তব রূপ নিল। মাঝখানে খানিকটা চায়ের ব্রেক এবং লাঞ্চ ব্রেক করে ছেলে বৌমারা নাতি নাতনিদের নিয়ে বম্বের পথে এবং বাসুবাবুদের কলকাতার ফ্লাইট ধরা। একটা সপ্তাহ যে কি করে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল ভাবলেই যেন গায়ে কাঁটা দেয়। আসলে বোম্বাই কা বাবু বিবিরা সব ঠিক করে রাখলেও কলকাত্তাইয়াদের একেবারে অন্ধকারে রেখে দিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে এরকম হলে ক্ষতি কি?