Friday, 26 April 2024

এক বিরল অভিজ্ঞতা

এক বন্ধুর  মুখে শোনা তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার  কথা। চেষ্টা করছি তার হুবহু বর্ণনার কিন্তু স্মৃতি যদি বিরোধীতা করে তাহলে নিজগুণে মাফ করার প্রার্থনা রইল।
বন্ধু আমার তার নিজের এক বন্ধুর সঙ্গে একটা প্রকল্পে জুড়ে গেছিল যে বিশেষ  এক আদিবাসীদের মধ্যে বিয়ে কিভাবে সম্পন্ন হয়। শুনতে যতটা সহজ সরল নির্বিষ মনে হচ্ছিল,  বাস্তবে কিন্তু যথেষ্ট  কঠিন  ছিল।  প্রথমত, ঐ আদিবাসীদের গ্রামে যাওয়া এবং তাও তাদের  বিয়ের মরশুমে এবং সর্বোপরি একজন নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যাওয়া। কিন্তু আমার  বন্ধুর  বন্ধু ছিলেন  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  এক কৃতী ছাত্র এবং গবেষণা রত এবং অমায়িক  হবার  জন্য  তার বন্ধুত্বের পরিধিও  ছিল বিরাট। তারই  সঙ্গে কলেজে পাঠরত এক বন্ধুর  কথা মনে পড়ল যে ছিল আদিবাসী  সম্প্রদায়ের এবং তারই  এক আত্মীয়ার বিয়ের কথা চলছিল। কিছুদিনের  মধ্যেই  সেই সম্পর্ক বিয়েতে পূর্ণতা পেতেই সুযোগটা এসে গেল।

ঝাড়গ্রামের অনতিদূরে এক আদিবাসী গ্রাম।  তারা দুজনেই  ঝাড়গ্রামের ট্যুরিস্ট লজে উঠল এবং বন্ধুর  গ্রামে যেখানে বিয়ে হবে সেখানে পৌঁছে গেল। শহরের ঝাঁ চকচকে বিয়ের  থেকে এটা সম্পূর্ণ  আলাদা। ছোট ছোট চালার  মাঝে একটা প্রশস্ত  জায়গা যেটা পরিষ্কার  করা হয়েছে এবং গোবর দিয়ে নিকানোর  ফলে একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। ছাদনাতলার চারপাশে চারটে কলাগাছ  পোঁতা হয়েছে  এবং  আমপাতা  সূতলির দড়িতে বেঁধে চারটে কলাগাছকে চারকোণে বেঁধে একটা বর্গক্ষেত্রাকার জায়গা করা হয়েছে। পাত্র পক্ষের ধামসা মাদলে চারিদিক  দিরি  দিরি দিম  দিরি দিরি দিম শব্দে মুখরিত  হয়ে উঠেছে এবং কন্যাপক্ষের  কয়েকজন  মেয়ে সেই তালে তালে নৃত্যের  ছন্দে জায়গাটা মাতিয়ে তুলেছে । যতক্ষণ  এই বিয়ের অনুষ্ঠান  চলতে থাকল ততক্ষণ এই ধামসা মাদল ও নৃত্য  পালাক্রমে চলত  থাকল আর এক দারুণ  মাদকতা সৃষ্টি হল আকাশে বাতাসে।  কন্যার মামা পাত্রীকে একটা বড় ঝুড়িতে বসিয়ে মাথায় নিয়ে সমস্ত অতিথি অভ্যাগতদের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল  এবং পাত্রী তার কোলে রাখা  এক মাটির হাঁড়িতে থাকা হাড়িয়ায় ( ভাত পচিয়ে  একরকম তৈরী মদ) বড় ডালসমেত একটা আমের শাখা সেই  হাড়িয়ায় ডুবিয়ে অনেকটা যেমন পূজোর  পরে শান্তিজল দেওয়া হয় সেইরকম ভাবে ছিটাচ্ছিল।  এরপর পালা পাত্রের, সেই হাড়িয়ায়  সিক্ত আম্রপল্লব দিয়ে পাত্রের  মাথায় সপাং সপাং করে মার। পাতায় লেগে থাকা হাড়িয়া যখন চুঁয়ে চুঁয়ে গাল দিয়ে গড়িয়ে মুখের  কাছে আসছে তখন জিভ দিয়ে একবার  এদিক একবার  ওদিক করে তার আস্বাদ  গ্রহণ করা।
এরপর চলল পাত্রপক্ষ ও কন্যাপক্ষের  আত্মীয়স্বজনের আলাপ করানোর  পালা। গানের মধ্য দিয়েই  সেই আলাপ পরিচয়ের সমাপ্তি। কোনরকম আগে থেকে কোন প্রস্তুতি না নিয়ে এই পরিচয় পর্ব একটা দারুণ  অনুভূতি। এরপর পালা উদরপূর্তির।  প্রত্যেক অতিথিকে একটা গ্লাসে সেই হাড়িয়া দেওয়া হয়েছে এবং শালপাতার চোঙায়  দেওয়া মুড়িতে ঝোলা গুড় দেওয়া হচ্ছে আর অতিথিরাও সেই গুড় মুড়ি খাচ্ছে আর হাড়িয়ার গ্লাসে চুমুক  দিচ্ছে। আমার বন্ধু তো কোনদিন  হাড়িয়া খায়নি আর ওটা না খেলেও দুইপক্ষকেই  অপমান  করার সামিল। যাই হোক , কপালে যা থাকে বলে ছোট্ট  একটা চুমুক যেই না দিয়েছে অমনি জ্বলন শুরু হলো সেই গলা থেকে নামতে নাভির  শেষ  অবধি  এক অসহ্য জ্বালা। গুড় মুড়ি তো শেষ  হলো  কিন্তু গ্লাসের  হাড়িয়ায় চুমুক  দেওয়ার সাহস আর হলো না। এরপর  এল ভাত এবং অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী।  যে পরিমাণ  ভাত  দেওয়া হল পাতে  আমাদের  পরিভাষায়  তা বিড়াল  না ডিঙানো ভাতের  পরিমাণ। আমাদের  চারপাঁচজন লোক তা খেতে পারে। যাই হোক, খাওয়া দাওয়া সেরে  এক অসাধারণ  অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরে ফিরে আসা।

সম্পূর্ণ  শোনার ভিত্তিতে এই ঘটনার  অবতারণা। কিছু ভূলভ্রান্তি থাকলে অবশ্যই  ক্ষমা প্রার্থী।

No comments:

Post a Comment