Saturday, 6 April 2024

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত

অনেক সময় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে কোনটা বেশী আকর্ষণীয় ---- সূর্যোদয় না সূর্যাস্ত? দুই যুযুধান গোষ্ঠীর ই অনেক বাঘা বাঘা প্রবক্তা রয়েছেন যাঁরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে জামার আস্তিন গোটাচ্ছেন অপর পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তাঁদের  যুক্তি দিয়ে। সত্যি কথা বলতে কি কোনদিন  সিরিয়াসলি ভেবেই দেখিনি যে কোনটা বেশী সুন্দর। 
সূর্যোদয়ের পক্ষে প্রথম বক্তা তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন কবিগুরুর আজি এ প্রভাতে রবির কর আবৃত্তি করে। বর্ণনা তাঁর দারুণ সুন্দর,  বক্তব্য ও অত্যন্ত বলিষ্ঠ।  ভোর বেলায় ধীরে ধীরে আলো ফুটে উঠছে আর অন্ধকারের ঘনত্ব ধীরে ধীরে কমছে, পূর্ব দিকে লাল আভা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে,ঘোষণা করছে তাঁর  আগমন বার্তা। পাহাড় এবং সমুদ্রে সূর্যোদয় একটু যেন ভিন্ন। পাহাড়ের চূড়ার  পিছন দিক থেকে তিনি যেন টুকি টুকি বলে লুকিয়ে পড়ছেন আর অনেকক্ষণ  একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখটা একটু কচলে ভাল করে দেখার জন্য   যেই না হাতটা চোখে দিয়েছে অমনিই তাঁর  আত্মপ্রকাশ  হলো আর সূর্যোদয় দেখার  জন্য  হাজির  সমস্ত লোক সমস্বরে চিৎকার  করে উঠল। বেচারা ভদ্রলোক,  সেইসময় ই তাঁর  চোখ রগড়াতে হলো। আগামীকাল  আবার  আকাশের  অবস্থা কেমন থাকবে না থাকবে এই ভেবে মনটা খুব খারাপ  হয়ে গেল। তবেএটা সাময়িক  প্রতিক্রিয়া। তিনি প্রচণ্ড জোরালোভাবে বক্তব্য  রাখতে থাকলেন  যে নতুন সূর্যর আগমনে নতুন  দিগন্ত  খুলে যাবে এবং পৃথিবী নতুন উদ্যমে জেগে উঠবে এবং ঝেড়ে ফেলবে পুরোন  সবকিছু। নতুন প্রভাত, নতুন উদ্যম,নতুন আশা সরিয়ে ফেলবে  মনের জঞ্জাল।  এইসব নানাবিধ বিশেষণে তাঁর  বক্তব্য  পেশ হলো এবং পরিশেষে বিরাট হাততালি। জনগণের অভিব্যক্তি দেখে খুবই খুশী বক্তা, ডায়াস ছেড়ে তাঁর  চেয়ারের  দিকে এগিয়ে গেলেন। হাততালি আর থামতেই চায়না। এই পরিস্থিতিতে  এসে অপর পক্ষের  বক্তব্য  রাখা ভয়ানক  কঠিন।  যাই হোক,  হাততালির  রেশ একটু কমতেই অন্যপক্ষের বক্তা ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য  রাখার জন্য  মাইক তুলে নিলেন  হাতে। মনে হচ্ছে তাঁর  বক্তব্য  শোনার জন্য  কেউই খুব  আগ্রহী নন। এইরকম  প্রতিকূল  পরিবেশে বক্তব্য  পেশ করা বেশ কঠিন। কিন্তু তিনিও  অত্যন্ত  পণ্ডিত মানুষ,  জনতাকে কি করে আকর্ষণ  করতে হয় তাও তাঁর  অজানা নয়। তিনি শুরু করলেন হাট কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে, " বকের পাখায়  আলোক লুকায় ছাড়িয়া পূবের  মাঠ, দূরে দূরে গ্রামে জ্বলে ওঠে দীপ আঁধারেতে থাকে হাট।" পরক্ষণেই  তিনি শ্রোতাদের বিভিন্ন  শ্রেণী থেকে তাঁদের  বয়স জিজ্ঞেস  করতে শুরু করলেন।  কেউ বা বলেন পঁচিশ  তিরিশ, কেউ বা বলেন  সত্তর এবং দেখা গেল বর্ষীয়ান  লোকের  সংখ্যাই অধিকতর যেটার অ্যাডভান্টেজ তিনি পুরোপুরি নেওয়ার চেষ্টা করলেন। শুরু হলো সূর্যাস্তের  সময় পাহাড়ের  বর্ণনা। জ্বলন্ত সূর্য কেমন ম্রিয়মান  হয়ে  আসছে, গনগনে  হলুদ  রঙ কেমন স্তিমিত হয়ে  লাল হয়ে আসছে, আঁধারের  কালগ্রাস যেন গিলে ফেলতে চাইছে সেই পরম শক্তিমান সূর্যকে আর তিনি যেন পাহাড়ের  আড়ালে সেই শক্তিমান অন্ধকারের  থেকে লুকিয়ে পড়তে চাইছেন।  কিন্তু নাছোড়  আঁধার, ছাড়িবনা আজ তোমারে, নির্বল করে গ্রাসিব আজি দেখাব বিশ্বমাঝারে।  সূর্যের  এই আত্মসমর্পণ বিষাদিল আজি মোরে। অসাধারণ এই রূপ সূর্যাস্তের এককথায় অবর্ণনীয়।  সূর্যোদয়ের পরাক্রমী রূপ এবং সূর্যাস্তের এই আত্মসমর্পণের  রূপ এ তো চিরন্তন সত্য।  আমরা আজ জীবন  সায়াহ্নে পৌঁছেছি,  আমাদের  নিজেদের  সাধ্যমত  এই বিশ্বসংসারে দিয়েছি যা পরিপুষ্ট  করেছে আগামীদিনের প্রজন্মকে এবং তারাও তাদের  নিজেদের  সাধ্যমত  এই সংসারে  তাদের কর্তব্য করবে এবং এই চক্র চলতে থাকবে চিরদিন যতদিন  মানব সভ্যতা বজায় থাকবে। পরিশেষে এটাই বলি যে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত এক প্রবহমান  চক্র এবং তাদের  দুজনকেই  জানাই স্বাগত।
হাততালিতে গমগম করে উঠল সারা হল এবং এখানে কোন হারজিত  নেই, সবাই বিজয়ী, বিজয়ী মানবসমাজ। 

No comments:

Post a Comment