প্রথম ব্যক্তি হচ্ছেন একজন ইনকাম ট্যাক্স কমিশনারের কথা। তিনি হচ্ছেন মিস্টার হেমন্ত কুমার মোতোয়ানি। হেমন্ত বাবু ছিলেন অত্যন্ত সৎ একজন অফিসার ছিলেন। অফিসে থাকাকালীন ঠিক সকাল নটায় অফিসে ঢুকতেন এবং সন্ধ্যে আট টার সময় বেরিয়ে যেতেন এবং তাঁকে দেখে লোক ঘড়ি মিলিয়ে নিত। অনেকদিন ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট এইধরনের অফিসার দেখেনি। একটু কড়া ধাতের মানুষ হিসেবে তাঁর পরিচিতি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধে কেউ ভুলেও সততার প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তাঁর একমাত্র ছেলের প্রতি সেরকম নজর দিতে পারেননি এবং ভাল ছেলে হওয়া সত্বেও আজকের দিনে যেখানে বেশী ভাগ লোক শঠ এবং ধূর্ত সেখানে তাঁর ছেলে যতীন একেবারেই অচল। যতীন কিন্তু পরীক্ষা দিয়েই একটা সরকারী অফিসেই ঢুকেছিল। চাকরি করে কিন্তু সাংসারিক বুদ্ধি একেবারে নেই বললেই চলে। মাইনে পায় কিন্তু বন্ধুবান্ধবরা তার কাছে টাকা ধার নেয় আর কয়েকদিন বাদে ফেরত দেবে বলে আর দেয় না। এতই ভদ্রলোক যতীন , টাকা ফেরত না দিলেও সে জোরকরে বলতে পারেনা টাকার কথা। এমতাবস্থায়, সংসার চালাতে গিয়ে হিমসিম খাওয়া হেমন্ত বাবুকেই এই বৃদ্ধ বয়সে কাঁধে জোয়াল টানতে হয়। রিটায়ারমেন্ট এর পর যে টাকা পেয়েছিলেন সেটার বেশীরভাগ টাকা চলে গেছে তাঁর স্ত্রীর খরচ যোগাতে কিন্তু বাঁচাতে পারেননি ।বৃদ্ধ হেমন্ত বাবু তাঁর ছেলের সংসারেই একটা নাতি ও নাতনিকে নিয়ে বরোদায় একটা এক কামরার সরকারি ফ্ল্যাটে থাকেন।
যতীনকে তার সহকর্মীরা মাথায় ঢোকাল যে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়ার কথা এবং লোন নিয়ে শোধ না করলেও ব্যাঙ্ক কিছুদিন বাদে ভুলে ই যায় আর টাকা ফেরত না দিলেও চলে। তাঁর নিজের ঘটে বুদ্ধি না থাকলেও তার বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারতো কিন্তু তার না করে সে বন্ধুদের প্ররোচনায় লোন নিল এবং যথারীতি শোধ না করায় ব্যাঙ্ক থেকে নোটিশ পাঠানো হলো। প্রথম নোটিশ পাবার পরে হেমন্ত বাবু ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন এবং ব্যাঙ্কে ফোন করলেন।ম্যানেজারের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলেন যে তাঁর ছেলে দুলাখ টাকা ধার নিয়ে আর শোধ করেননি এবং সেই টাকা বেড়ে বেড়ে প্রায় আড়াই লাখ ছুঁই ছুঁই। ভদ্রলোক তো আকাশ থেকে পড়লেন। এত টাকা নিয়েছে অথচ সংসার তাঁর পেনশনের টাকায় চলে। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। তিনি যে রকম মানুষ তাতে কোনরকম চিঠি চাপাটি পেলেই অস্থির হয়ে পড়বেন এটাই খুব স্বাভাবিক। তিনি ফিল্ড অফিসারকে একটু সময় দেবার কথা বললেন। ছোট্ট একটা বারান্দা যেখানে বাইরের লোককে বসানো হয়, মাঝে একটা ছোট টেবিলের চারপাশে চেয়ার পাতা-- দেখেই বোঝা যায় ওটা একটা মাল্টিরুম এবং তার পরে একটা বেডরুম। বাইরে এক চিলতে উঠোন এবং এক পাশে রান্নাঘর আর অন্যপাশে পায়খানা ও বাথরুম। এইটাই হেমন্ত মোতয়ানি সাহেবের রাজপ্রাসাদ। প্রথমে কোন ম্যানেজার ই বিশ্বাস করতে চাইবে না যে একজন ইনকাম ট্যাক্স কমিশনারের বাড়ি এরকম হতে পারে। কিন্তু এটাই ছিল বাস্তব। ফিল্ড অফিসারের কথা এককথায় ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ম্যানেজার নিজে না দেখে কোন মতামত প্রকাশ করবেন না বলেও জানিয়ে দিলেন।
এক রবিবার সেই ম্যানেজার ফিল্ড অফিসারকে নিয়ে হাজির হলেন বরোদায়। গাড়ি বেশ খানিকটা দূরে রেখে আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে থাকলেন হেমন্ত মোতয়ানি সাহেবের বাড়ি। তখন দুপুর বেলা। তাঁকে এইসময় ডিস্টার্ব করার ইচ্ছা হচ্ছিল না কিন্তু তিনি সম্যক দেখতে চাইছিলেন যে বাস্তবটা কি। দরজায় বেল টিপতেই মোতয়ানি সাহেব চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলে দিলেন এবং ফিল্ড অফিসার মনোজকে দেখেই চিনতে পারলেন এবং তাড়াতাড়ি চাদর ও বালিশটা উঠিয়ে লাগোয়া মাল্টিরুমে রেখে তাঁদের অভ্যর্থনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মনোজ যে এক বিন্দু বাড়িয়ে বলেনি সেই কথাটাও উনি ভাল করেই বুঝতে পারলেন। এইদিকে হেমন্ত বাবু তাঁর ছেলে যতীনকে ও ডাকলেন। কথায় কথায় জানা গেল যে ওকে যে দুই বন্ধু ব্যাঙ্কে নিয়ে গিয়েছিল তারা টাকা পাওয়ার পরেই টাকাটা তার কাছ থেকে নিয়ে নেয় এবং আজ দেব কাল দেব করে টাকাটা আর ফেরত দেয়না।কিন্তু এই সত্যি কথাটা সে বাড়িতে এসে বলতে পারেনি এবং পরবর্তী ঘটনাটা সবারই জানা হয়ে গেছে। মিস্টার মোতয়ানি একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক, অতবড় পোস্টে কাজ করেছেন সেটা তাঁর আচার ব্যবহারে সুস্পষ্ট কিন্তু বাড়ির আসবাবপত্রে নিশ্চয়ই নয়। সব ঘটনা জেনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল ম্যানেজারের কিন্তু চাকরি এমনই জিনিস তেতো কথাটা বলতেই হয় গলায় যথা সম্ভব মধু ঝরিয়ে। উনি জিজ্ঞেস করলেন যে কিছু ছাড় দেওয়া সম্ভব কিনা। একটা অ্যাপলিকেশন দিতে বলে ম্যানেজার উঠে পড়লেন। তিনি জানালেন যে তাঁর একাউন্টে যে টাকা আছে সেটা যথেষ্ট নয় কিন্তু টা সত্বেও তিনি ফ্রিজ, টিভি এবং অন্যান্য আসবাবপত্র বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা শোধ করে দেবেন। লজ্জায় ম্যানেজার এবং তাঁর ফিল্ড অফিসারের মাথা হেঁট হয়ে গেল। ছেলের অনবধানতায় যে ক্ষতি হয়ে গেছে তাতে তাঁর সংসারে যে কি প্রভাব ফেলতে পারে সেদিন তাঁরা বুঝতে পারলেন। যিনি একজন ইনকাম ট্যাক্স কমিশনারের পদ থেকে রিটায়ার করেছেন তাঁর তো কোন অসুবিধে হবার কথা নয় কিন্তু সেই মানুষটাকে ঐ অবস্থায় দেখে যে কোন মানুষের মন খারাপ হবারই কথা।
মিস্টার হেমন্ত মোতয়ানি তাঁর ছেলের বয়ানে একটা অ্যাপলিকেশন পাঠালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর একটা ব্যক্তিগত চিঠিও পাঠালেন যেখানে তিনি টিভি বিক্রি করে কত টাকা পাওয়া যাবে এবং অন্যান্য আসবাবপত্র বিক্রি করে কত টাকা পাওয়া যাবে এবং তাঁর ব্যাংক একাউন্টে যে টাকা আছে সেটা দিয়েও তাঁর ছেলের লোনের টাকা পুরো মিটবে না। বাকি টাকা তাঁর পেনশন থেকে মাসে মাসে তিনি দিয়ে দেবেন। চিঠি পড়ে এই কথাটাই মনে পড়ে যায় যে সিংহ বুড়ো হয়ে গেলেও সে সিংহ ই থাকে। যতীন ও হেমন্ত বাবুর চিঠি এত ই মর্মস্পর্শী ছিল যে জেনারেল ম্যানেজার সুদ পুরোই মকুব করে দিয়েছিলেন।
এর মধ্যেই মনোজের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যতীনের অফিসের বড় সাহেবের নজরে আসে ঘটনাটি এবং উনি তাদের ধমকানোর ফলে তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে এবং টাকাটা তারা ফেরত দেয় আর হেমন্ত মোতয়ানি সাহেবকে আর ফ্রিজ বা টিভি বিক্রি করতে হয়নি। সৎ লোকদের ভগবান বোধহয় এইভাবেই রক্ষা করেন।
No comments:
Post a Comment