পানুদা থাকতো আমোদিনী পিসির বাড়ি ছাড়িয়ে পাকুড়তলায়। ওর বাবার ছিল যথেষ্ট পয়সা। কন্ট্র্যাকটরি, রেশনের ডিলারশিপ, কয়লার ডিপো ছাড়াও জমিজমা থেকে রোজগারে একদম যাকে বলে ফুলে ফেঁপে ঢাঁই। কিন্তু ভদ্রলোক ছিলেন খুবই সাদামাটা, কখনও উঁচু গলায় কথা বলতেন না , পোশাক আশাকেও ছিলেন খুবই সাধারণ কিন্তু ব্যবসায়ী বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর। আগের দিনে সব বাড়িতেই পাঁচসাতটা ছেলেমেয়ে ছিল খুবই স্বাভাবিক। আর তাঁর বাড়িতে হাম দো হামারা দোর তো প্রশ্নই নেই। কাঁচু দা, পানুদা, পিংলে, মন্ডা ও যদুরা ছিল পাঁচ ভাই আর ছিল মাঝে রত্নাদি যে অনুর দিদির সমবয়সী। পাড়াটা ছিল জমজমাট। সবাই সবাইকে চিনতো আর জমায়েত বেশিরভাগ সময়েই উদো দাদের মাঠে নয়তো বেলতলায়। পানুদার বাড়ি যেতে পড়তো ভেলু ঘোষের বাথান এবং কোরবান শেখদের মসজিদ ।পাকুড়তলা পেরোলেই ছিল মুসলমান পাড়া। আরও একটু এগোলেই ছিল হরি ধোবানির বাড়ি। তার ডানদিকে ছিল ভট্টাচার্য পাড়া আর বাঁদিকে চলে গেল রানীবাগান। বহুদিন পর এদিকে এসেছে অনু, চারদিকে অনেক বাড়িঘর হয়ে গেছে , চেনা জায়গাই যেন কেমন অজানা অচেনা হয়ে গেছে আর যেন জিজ্ঞেস করছে কে হে বাপু তুমি, কাকে দরকার? আমোদিনী পিসির বাড়িটা ছিল অনেকটা জায়গার উপর। মাটির বাড়ি হলেও ছাদটা ছিল টিনের চাদরে মোড়া। মাঝখানে ছিল একটা বড় উঠোন আর অন্যদিকে ছিল পিসির মুড়িভাজার জায়গা। বড় মাটির খোলায় কাঠের উনুনে পিসির চালভাজা, মুড়ি, ভাজা কলাইএর ডাল, ছোলাভাজা ও জাঁতায় পেষা ছাতুর যে কি দারুণ স্বাদ বলে বোঝানো যাবেনা। জাঁতায় পেষা হতো বলে ছাতুটা মাখার পর একদম চন্দনের মতন হতোনা কিন্তু সে এক অসাধারণ স্বাদ। পানুদার বাড়ি যাওয়ার মুখে খানিকক্ষণ দাঁড়ালো অনু কাউকে যদি দেখতে পাওয়া যায়। পিসি তো বহুদিন আগেই চলে গেছে তবুও পুরোনো দিনের কথা মনে করে একটু থামল। এদিক ওদিক থেকে বেশ কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে লক্ষ্য রাখছে অজানা অচেনা অনুর দিকে । কাউকে খুঁজছেন প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে গেল সে।
না, কাউকে না, এখানেই তো আমোদিনী পিসি থাকতো, তাই না?
হ্যাঁ, উনি তো বহুদিন আগেই মারা গেছেন। তা আপনি কি ওনার কেউ হন?
এটা এক মারাত্মক ধরনের বাউন্সার। সত্যিই তো উনি তো রক্তের সম্পর্কের কেউ নন কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক কিছু। পিসির যেমন চেহারা ছিল তেমনই মানানসই ছিল তাঁর রাশভরা ব্যক্তিত্ব। মুড়িভাজা বা চালভাজার সময় কেউ কিছু জিনিস চাইলে সটান বলে দিত, বাপু একটু অপেক্ষা করতে হবে। সকাল বেলায় স্নান পূজো সেরে শুদ্ধ কাপড়ে পিসির চাল বা মুড়ি ভাজা শুরু হতো। বিক্রি করার সময় ছিল আলাদা। পড়াশোনা না জানা পিসির কাজের প্রতি যে নিষ্ঠা ছিল তার সিকিভাগ ও যদি কারও থাকে তাই যথেষ্ট। এরই মধ্যে একজন উদো দারই সমবয়সী একজন বিশাল চেহারার ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন আর অনুর দিকে আপাদমস্তক দেখতে লাগলেন।
চেনা চেনা লাগছে মনে হচ্ছে। তা আপনাকে তো উদোর বাড়ির মাঠে দেখলাম মনে হয়। কে বটেন আপনি?
অনু চিনতে পেরেছে জটু দাকে, একসময়ের বিখ্যাত ব্যায়ামবীর জটু ঘোষ , কমল ভান্ডারীর সময়ের মিঃ জুনিয়র ইন্ডিয়া। আপনি তো জটু দা।
হ্যাঁ তাতো ঠিক, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক মনে করতে পারছি না।
আমি অনুত্তম, অনু।
ও হো, এবার ঠিক মনে পড়েছে। তা কবে এলা? এখন কোথায় থাকো? তোমরা তো বহুদিন আগে চলে গেছ। তা, এখন কোথায় এসেছো?
মাসিমার বাড়ি, স্বর্ণময়ী রোডে।
ও তাই ভাবছি, চেনা চেনা লাগছে কিন্তু মনে করতে পারছিলাম না।
আপনি কেমন আছেন জটু দা, এখনও শরীরচর্চা করেন?
ওই একটু আধটু, বাড়ির পিছন দিকে ফাঁকা জায়গাটাতেই করি। তা এখানে কাকে খুঁজছো?
অনেকদিন পর এসেছিলাম এই পুরোন পাড়াটাকে দেখতে। এসে দেখি উদো দা চলে গেছেন। তারপর ভাবলাম পানুদার সঙ্গে একটু দেখা করি।
আরে পানু তো অনেকদিন আগেই এখান থেকে চলে গেছে। ওদের ভায়ে ভায়ে গন্ডগোল হয়ে সবাই অন্য অন্য জায়গায় চলে গেছে। একমাত্র কাঁচু আছে কিন্তু ওর শরীরটাও বিশেষ সুবিধার নয়।
তা ওদের এতবড় ব্যবসা?
সব ছোট ছোট হয়ে গেছে গো। লাঠি যখন একসঙ্গে বাঁধা থাকে তখন তার জোরই আলাদা। আর বাঁধন খুললেই তখন একে অন্যের শত্রু হয়ে যায় গো। অত বিশাল ব্যবসা সব নিজেদের ঝটাপটিতে শেষ হয়ে গেল। পানুটা বিয়ে থা করেনি , ওর এইসব ঝুটঝামেলা ভাল না লাগায় কোথায় যে চলে গেল কেউ জানেনা গো।
মনটা খারাপ হয়ে গেল অনুর। ভাল মানুষ হতে গেলে পড়াশোনায় ভাল হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। কত লোক আছে যাদের মধ্যে অনেক বেশি মনুষ্যত্ববোধ রয়েছে, যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। তারা নিজের বলে কিছুই ভাবেনা, অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে অথচ রাজনীতির ধারও মাড়ায় না ,এইরকম বিরল প্রজাতির মানুষ এখন ভীষণ কম, প্রায় নেই বললেই চলে। এখন হচ্ছে স্বার্থের যুগ, যতক্ষণ স্বার্থ রয়েছে ততক্ষণ আছে আর তারপরেই সব ভোঁ ভাঁ। আর একমূহুর্ত থাকতে ইচ্ছা করছিল না অনুর। একবার যদি কোন জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া হয় তবে সেই জায়গায় আর ফিরে আসা উচিত নয়। এলে মোহভঙ্গ ছাড়া আর কিছুই হয় না।
নিরুদ্দিষ্টের প্রতি কাতর আহ্বান করলেও চারিদিক থেকে অট্টহাসি ছাড়া আর কিছুই শোনা যায়না। যা অতীত, সুন্দর স্মৃতি যা মনের গহনে রয়েছে তাকে বর্তমানের লেজার রশ্মির সামনে না আনাই শ্রেয়।
No comments:
Post a Comment