Saturday, 30 March 2024

আশ্রিত ও আশ্রয়দাতা

এই প্রসঙ্গে কিছু মন্তব্য করতে গেলেই  মহানতা বা মহানুভাবিতার কথা এসে যায়। যদি কেউ প্রশ্ন করে কে বেশী মহান, তবে সবাই একবাক্যে বলবে যে অবশ্যই  আশ্রয়দাতা। কোন সন্দেহ ই নেই তাতে। এই স্বার্থপরতার যুগে যেখানে সবাই  আপনি কোপনি নিয়েই ব্যস্ত সেখানে অন্যের কথা ভাবার মতন লোক ই বিরল। একটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ  করলে দেখা যাবে প্রকৃত চিত্রটা। এই কঠিন  যুগে  যেখানে নিজের অস্তিত্ব  টিকিয়ে রাখাটাই  এক বিরাট সমস্যা সেইখানে এই পরার্থে চিন্তা করাটাই এক বিশেষ গুণের পরিচয়। যদি জিজ্ঞেস করা হয় কেন এই পরের জন্য  ভাবা, তবে কয়েকটা উত্তর  অবশ্যই  মনে আসবে। প্রথম এবং সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর  হলো যে আশ্রয়দাতা অত্যন্ত  উদার মনোভাবাপন্ন।  নাক সিঁটকে কোন কোন  সমালোচক  বলবে যে না না ব্যাপারটাকে এত সহজ সরলভাবে দেখাটা মোটেও  উচিত  হবেনা। তাঁদের  মতে দেখ বাপু কোন স্বার্থ পিছনে লুকিয়ে আছে কিনা কিম্বা এটাও বলা অস্বাভাবিক  নয় যে তাঁর  আত্মমহিমার প্রচার  করা।সে যাই  হোক, ব্যাপারটাতে যে একটা মানবিক  দিক আছে সেটা একেবারেই  অনস্বীকার্য। 

সন্ধে হতেই কিচির মিচির কলরবে পাখিরা শশব্যস্ত নিজের নিজের জায়গা দখল করতে। রোজ করবে তারা ঝগড়া অথচ আশ্রয়দাতা গাছ কিন্তু নির্বিকার।  সে কিন্তু ভুলেও মাথা ঘামায়না তাদের  এই কলহে। সে জানে অন্ধকার  একটু বেশী ঘনিয়ে এলেই সবকিছুই  থিতিয়ে যাবে এবং তার অল্পক্ষণ পরেই ঘুমে ঢুলতে থাকবে ক্লান্ত এই পাখিরা। আচ্ছা, এই পাখিগুলো তো একই জায়গায় থাকে, তাহলে রোজ ঝগড়া কেন? ভাবতে বসলে মনে হয় যে প্রতিদিন আশ্রয়স্থলের কিছু না কিছু পরিবর্তন  অবশ্যই  হয়। প্রতিদিন গাছের তলায় একগাদা পাতা  পড়ে থাকে, চাঁদু বা মনোজ রোজ ঝাঁট দিয়ে  জায়গাটা পরিষ্কার  করে বলে আমরা ঠিক বুঝতে পারিনা যে গাছের মধ্যে কি পরিবর্তন  এসেছে। যে পাতার ডালে আগেরদিন শালিকটা বা বুলবুলিটা বসেছিল  সেটা ঝরে পড়ে গেলে তো তাকে অন্যত্র বসতেই  হবে আর সেইখানে যে আগেরদিন  বসেছিল  তারসঙ্গে তো ঝগড়া হবেই। কিন্তু গাছের এটা গা সয়ে গেছে। সে জানে যে পুরাতনকে একদিন  না একদিন  নতুনকে  জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে এবং আবহমান  এই চক্র চিরদিন  চলতে থাকবে যতদিন  তার নিজের  অস্তিত্ব ই টলোমলো না হয়ে যাবে। আশ্রয়দাতা গাছ এখন এক শান্তির  নীড়ে  পরিণত হয়েছে, পাখিদের  কলরব সব গেছে থেমে, ঢুলুনি শুরু হয়েছে তাদের। পরদিন  ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আবার  শুরু হয়ে যাবে পাখিদের  ব্যস্ততা এবং গাছ আবার  সেই প্রতীক্ষায় থাকবে সন্ধে নামার জন্য কখন তার অধিবাসীরা আবার  শুরু করবে কিচির মিচির করে ঝগড়া।

মানুষের  মধ্যেও  রয়েছে গাছের মতন মানসিকতার লোক যদিও  এখন অনেকটাই  গেছে কমে। পঞ্চাশ ষাট বছর আগে বহু সহৃদয় ব্যক্তি ছিলেন  যাঁদের আশ্রয়ে বহু দুঃস্থ অথচ মেধাবী ছেলেরা নিখরচায় খেয়েদেয়ে স্কুল ও কলেজে পড়েছেন এবং পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। কেউ হয়েছেন  মাস্টারমশাই, কেউ বা আবার  অধ্যাপক আবার  কেউ বা হয়েছেন  ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা উকিল বা জজ। তাঁরা কি নিজের  স্বার্থ  দেখেছিলেন  এই ছাত্রদের গড়ে ওঠার পিছনে? না, একদমই  নয়। হয়তো বা মনের মধ্যে একটা সুপ্ত বাসনা লোকের  হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া। তাঁদের  অনেকেই ছিলেন  হয়তো সুদের ব্যবসায়ী বা বড়মাপের জমিদার বা রাজা এবং ব্যক্তিগত জীবনেও হয়তো খুব স্বচ্ছ মাপের  ছিলেন না কিন্তু তাঁদের  মধ্যেও  অনেকেই এই আশ্রয়দাতার ভূমিকা  পালন  করেছিলেন এবং স্কুল, কলেজ  বা হাসপাতাল তৈরির ব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন। তাঁদের  এই অসামান্য দানকে কোনভাবেই  অস্বীকার করা যায় না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় তাঁরা নাম কামানোর জন্য এটা করেছিলেন (সমালোচকদের মতে) তবুও এটামানতেই হবে যে সমাজ এতে বহুলাংশে উপকৃত  হয়েছে। সমালোচকদের অনেকেই বলেছেন  যে তাঁদের  নিজেদের  স্বার্থসিদ্ধির জন্য এইসব কাজ করেছেন।  এইকথাটাকে একেবারে নস্যাৎ করে না দিয়ে একটু তাঁদের  দৃষ্টিভঙ্গিটাকে একটু গভীরে গিয়ে দেখা যাক। আগে বহু ভূমিপতিরাই নিজেদের  থাকার জায়গাকে বাসযোগ্য  করে তোলার  জন্য বহুলোককে জমিজমা  দিয়েছেন।  চাষী, ধোপা,  নাপিত, জেলে , কামার, কুমোর বা বামুনদের তাঁরা জমি বা পুকুর দিয়ে তাঁদের  নিজেদের  জায়গাটাকে খুব  সুন্দর এক গ্রামে পরিণত করেছেন।  গ্রামে তাঁরা স্কুল তৈরী করেছেন যেখানে আশপাশের গ্রাম  থেকে বহু ছেলেরা পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।  এতে যে সেই ভূমিপতিরাই লাভবান  হয়েছেন তা নয়, দুই পক্ষই  এটা থেকে  উপকৃত  হয়েছেন।  কোন  জনপদ গড়ে উঠলে যে শুধু ভূমিপতিরাই  লাভবান  হন তা নয়, দুই পক্ষই উপকৃত  হন এর থেকে। অধুনা একমতের  প্রচলন হয়েছে যে শাসক এবং শোষক। শাসক মানেই তারা খারাপ  এবং তারা শোষণ করেছে দুর্বল সমাজকে এবং তাদের  মুনাফা বাড়িয়েই চলেছে এবং দরিদ্র আরও  দরিদ্র হয়েছে। অর্থনৈতিক  বৈষম্য  অবশ্যই আছে কিন্তু দুর্বল শ্রেণীর মনের মধ্যে এই বিষটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার নীট ফল আমরা দেখেছি যে একের পর এক শিল্প আমাদের রাজ্য থেকে অন্যত্র চলে গেছে এবং আমাদের  রাজ্যর স্থান প্রায় নীচের দিকে কিছু অত্যন্ত  অনগ্রসর  রাজ্যের  উপরে। কোনটা ভাল  আর কোনটা মন্দ  সেটা নিয়ে ভাবার  সময় হয়েছে।

আশ্রিত ও আশ্রয়দাতার উভয়ের ই স্থির মস্তিষ্কে চিন্তা করা উচিত  যে একে অন্যের  পরিপূরক এবং কেউ  কাউকে ছেড়ে থাকতে পারেনা। সহমর্মিতা একটা আলাদা জিনিস  এবং এটাকে যতদিন  বাঁচিয়ে রাখা যায় ততই  মঙ্গল। 

Saturday, 16 March 2024

গুরুকুল

গুরুকুল শব্দটা কানে এলেই মনটা যেন ফিরে চলে যায় পুরোন দিনে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে একদল ছোট ছোট ছেলে তাদের মাস্টার মশাইএর কাছে পড়ছে। মাস্টার মশাই বা গুরুদেব মাটির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন এবং মাঝে মাঝে একটা হাতপাখা দিয়ে নিজের শরীরকে একটু ঠাণ্ডা করে নিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে বসে থাকা ছাত্রদের নানা জিনিস বোঝাচ্ছেন এবং ছাত্ররাও তাঁর কথা একমনে শুনছে। এটা খানিকটা টোলের মতন। অমুক চক্কোত্তির টোল কিংবা তমুক শাস্ত্রীর টোল নামেই পরিচিত ছিল।  কিন্তু এই টোলের থেকে  গুরুকুলের মধ্যে যে পার্থক্য ছিল সেটা হচ্ছে গুরুকুলে সমস্ত বিদ্যার্থীরাই  ছিল  আবাসিক অর্থাৎ সেইসমস্ত ছাত্ররা গুরুগৃহে থেকে পড়াশোনা করত এবং গুরুগৃহে সমস্ত কাজ তারাই করতো এবং সেখানেই খাওয়া দাওয়া পড়াশোনার সঙ্গে তারা করতো এবং শিক্ষাশেষে তারা নিজের নিজের ঘরে ফিরে যেত এবং তারাও শিক্ষাদানে ব্রতী হতো। অনেক সময়ই এই শিক্ষার্থীরা বহু দূরদূরান্ত  থেকে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে আসতো। এই গুরুকুল  শুধুমাত্র পড়াশোনায় ই সীমিত থাকতো না, সঙ্গীতে ও অস্ত্রবিদ্যায় ও প্রচলিত ছিল। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের  গুরুদেবের  কাছে বা ওস্তাদজীর কাছে নাড়া বা গাণ্ডা বাঁধতে হতো এবং যতদিন  একজন গুরুর কাছে শিক্ষা সম্পূর্ণ  না হয় ততদিন সে অন্য কোন গুরু বা ওস্তাদের কাছে  যেতে পারত না। এইভাবেই  তৈরী হতো এক বিশেষ ঘরানা। এক ই রাগের সঙ্গীতশৈলীর পরিবেশন এক ঘরানা  থেকে অন্য ঘরানার থেকে ভিন্ন ধরণের থাকায় বোঝা যেত যে শিল্পীর কি ঘরানা।  অনেক সময় সঙ্গীত সম্মেলনে বিভিন্ন ঘরানার শিল্পীর  সমাবেশ  হতো এবং গুরুজী তাঁর শিষ্যদের নিয়ে নিজের  পরিবেশনের সময় আসতেন এবং নিজের পরিবেশন সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই শিষ্যদের নিয়ে আসর ছেড়ে চলে যেতেন।  এর একটাই উদ্দেশ্য ছিল  যে কোনভাবেই  যেন তাঁর শিষ্যরা অন্য  ঘরানার  শিল্পীদের  দ্বারা প্রভাবিত  না হন। মহাভারতেও এই গুরুকুলের  উল্লেখ  আছে। কৃপাচার্য  বা দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষা পরশুরাম  বা বলরামের  শিক্ষা থেকে অবশ্যই আলাদা ছিল।

ইদানিংকালে  গুরুকুলের  কথা প্রায় শোনাই যায়না। কিন্তু একেবারেই  শোনা যায়না তা ঠিক  নয়। যাঁরা পিএইচডি করেন তাঁদের একজন গাইডের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে যাঁর তত্ত্বাবধানে তিনি রিসার্চ  করছেন  তিনি গুরু হলেও সেই গুরুকুলের সোঁদা গন্ধ বিহীন কারণ এখানে ছাত্রকে তাঁর  গুরুগৃহে  থাকতেও হয়না বা তাঁর সংসারের  যাবতীয় কাজ ও করতে হয়না। একটা কথা প্রচলিত আছে যে "কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ,  পাকলে করে ট্যাঁসট্যাঁস।" গুরুকুলের ছাত্রদের  পড়াশোনার  সঙ্গে চরিত্র গঠন ও হতো  এবং কাদামাটির তালকে  যে কোন রূপ দেওয়া যায় কিন্তু  মাটি শুকিয়ে গেলে তাকে আর অন্য কোন রূপ দেওয়া যায়না। সুতরাং, গুরুকুলের নাম শোনামাত্র মনটা একটু ছটফট করে ওঠে আধুনিক  গুরুকুলের চেহারা দেখতে।

রাঁচি থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরে নেতারহাট বলে একটা জায়গা আছে যেখানে এই গুরুকুলের অস্তিত্ব আছে বলে জানা গেল। স্বাভাবিক ভাবেই মনে একটা চিন্তা উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করল। পরের  মুখে ঝাল খেয়ে ঠিক উপলব্ধি করা যায় না। সুযোগ একটা এসে গেল। অর্জুনের প্ল্যান মাফিক সবকিছুই  ঠিকঠাক  হয়ে গেল।  হোটেল প্রভাত বিহার ডিল্যুক্সের অনতিদূরে শ্যালেট হাউস যেখানে বিহার ও উড়িষ্যার  লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার এডোয়ার্ড গেট বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে তৈরী করিয়েছিলেন একটি মনোরম কাঠের বাড়ি এবং সেটা গ্রীষ্মকালীন বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এখন সেখানে একটি মিউজিয়াম  তৈরী হয়েছে। মনোরম পরিবেশ কিন্তু সাপ সম্বন্ধে বিশেষ  সতর্কীকরণ থাকায় ঘুরে দেখার  ইচ্ছে সম্বরণ করতে হলো।  মিউজিয়ামের একাংশ বন্ধ থাকলেও  ঘুরে ঘুরে অপরদিকের  দোতলা অংশে বিভিন্ন ধরণের সুষমামণ্ডিত কাঠের  কাজ বিশেষ আকর্ষণ করে। তারই পাশে চোখে পড়ল গৌতম আশ্রম। অনেকটা জায়গা জুড়ে এক একটা আশ্রম। কিন্তু সমস্ত আশ্রমের  গেট ই বন্ধ। মনে হচ্ছে এটাই হয়তো গুরুকুল।  কিন্তু কে দেবে এর আসল পরিচয়? একটার  পর একটা এইরকম আশ্রম।  কোনটার নাম প্রেম আশ্রম, কোনটার নাম আনন্দ আশ্রম। বিরাট এলাকা জুড়ে একটার পর একটা এইরকম বাড়ি এবং তার সংলগ্ন  জমি। অনেক খোঁজ করার পর একটা বাড়ির  সামনে দেখা গেল কয়েকটা ছেলে কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল যে ঐটাই  গুরুকুলের একাংশ। কিন্তু কোন বড় কোন মানুষ  চোখে না পড়ায় অনুসন্ধিৎসা মিটলনা।  ঠিক তার পাশেই আরও  একটা গেট খোলা থাকায় ভেতরে ঢুকতেই এক ভদ্রমহিলা বেড়িয়ে এলেন। আগে শুনেছিলাম  যে এই আশ্রমের  পরিচালিকা একজন গুরু মা বা মাতাজী।একটু হেসে নিজেদের পরিচয় দিয়ে আসার  কারণ বললাম। উনি আমাদের  ভেতরে আসতে বললেন। এরপর ভদ্রমহিলার  জায়গা নিলেন  একজন গাঁট্টাগোট্টা ভদ্রলোক যিনি ওঁর স্বামী।  ভদ্রলোক জানালেন  যে এই গুরুকুলে এইরকম  একুশটা আশ্রম রয়েছে এবং প্রত্যেক  আশ্রমে  রয়েছে পঁচিশ জন ছাত্র। তাঁর ই তত্ত্বাবধানে এইছাত্ররা থাকে এবং তাঁর স্ত্রী এই ছাত্রদের খাওয়া দাওয়া ও সমস্ত কিছুই  দেখাশোনা করেন। এই ছাত্রাবাসে বিভিন্ন  শ্রেণীর  ছাত্ররা থাকে এবং পড়াশোনা ছাড়াও  সমস্ত কাজ মায় ঘর ঝাঁট দেওয়া এবং বাথরুম  পরিষ্কার  রাখাও  তাদেরই  দায়িত্ব। এককথায় বলা যায় স্বাবলম্বী হতে শেখা এখানেই হয়। কথায় কথায় জানা গেল যে তিনি ফিজিক্সের  টিচার  এবং তিনি ডক্টরেট। একদম মনেই হয়না চেহারা দেখে, একটা সাধারণ  জামা গায়ে একজন ষণ্ডাগোণ্ডা ধরণের  লোককে দেখলে কেই বা মনে করতে পারে যে ইনি ডক্টর রাকেশ গুপ্ত, পিএইচডি। মানুষের  চেহারা দিয়ে কিছু বিচার  করা যায়না। তাঁর মতন এইরকম বিভিন্ন  শাখার  মাস্টার মশাই রয়েছেন।  যখন  ক্লাস  টেনের  ছাত্রদের  ফিজিক্সের  ক্লাস  থাকে তারা তখন তাঁর  ঘরে এসে পড়াশোনা করে এবং পরবর্তী ক্লাসের মাস্টার মশাইএর  ঘরে তারা চলে যায় এবং তাঁর  ঘরে অন্য  বিভাগের ছাত্ররা আসে। জানতে চাইলাম  যে এই স্কুলে মাস্টার মশাইরা ক্লাসে আসেন না এবং ছাত্ররা মাস্টার মশাইএর ঘরে আসেন , এতে কি বিশেষ  ফল হয়?  উনি জানালেন  যে ছাত্ররা একজন শিক্ষকের ঘর থেকে যখন  আরও একজন শিক্ষকের  ঘরে যায় , ঐ সময়টাতে তাদের  মনটাও একটু ভাল  হয় নিজেদের  মধ্যে কথোপকথনে  এবং  আগের  ক্লাসের যে পড়াটা হয়েছে  তার থেকে সাময়িক  মুক্তি এবং পরের  ক্লাসের  জন্য  মানসিক  প্রস্তুতি মেলে। যুক্তিটা  বেশ গ্রহণযোগ্য মনে হলো। বিরাট  খেলার  মাঠ  এবং  ছাত্রদের বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের  উৎকর্ষতা লাভের  জন্য  সমস্ত সুযোগ  রয়েছে। স্কুলের অ্যাডমিশনের সময় এককালীন  দুশো টাকা দিতে  হয় আর বাকি সমস্ত খরচ ঝাড়খণ্ড সরকারের। পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের পড়াশোনা এবং অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শী করার এই সামগ্রিক  প্রয়াস অবশ্যই ধন্যবাদার্হ। ডক্টর গুপ্ত জানালেন  যে মেয়েদের  জন্য ও হাজারিবাগে  ঝাড়খণ্ড সরকারের  একটি স্কুল  রয়েছে। সরকারের  তরফে এই উদ্যোগকে সত্যিই  স্বাগত জানাতে হয়। তথাকথিত  পিছিয়ে পড়া রাজ্য যদি এই প্রয়াস নিতে পারে, অন্য রাজ্য কেন এই বিষয়ে পিছিয়ে থাকবে? সবকিছুই  কি রাজনীতির  আড়ালে হারিয়ে যাবে?

Monday, 11 March 2024

প্রেম আসছে

বসন্ত এসে গেছে, মদন দেব ও ইতি উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করেছেন, সুযোগের অপেক্ষায় কাকে কখন তাঁর পঞ্চশরে বিদ্ধ করা যায়। আগে তাঁকে এত বেশি কারিগরি করতে হতো না কারণ ছেলেমেয়েগুলো ছিল  হ্যাবলার একশেষ। কিন্তু এখনকার  ছেলে ও মেয়ে ভীষণ  ক্যালকুলেটিভ,  ছোট্ট বয়স থেকেই আখেরে কোথায় লাভ হবে সেটা না জেনে এক পা ও এগোবে না। তা বলে কি খুঁজে পেতে দু চারটে হ্যাবলাও জুটবে না? আলবত  জুটবে এই আশায় বুক বেঁধে তিনি এদিক সেদিক খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই হ্যাবলাগুলোকে।

বসন্ত এলেও রোদের তাপ বেশ বেড়ে উঠেছে, ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের তলা খুঁজছেন তিনি। সেটাও আজকাল  বড্ড অমিল। গাছ একটু বড় হতেই না হতেই বুকড  ফর শিবু দা বা বড় ঠাকুর বা শ্রী হনুমানজীর।  তাঁদের  মতো ছোটখাট দেবতাদের  কেউ পাত্তাই দেয়না। কিন্তু এটা মানুষ ভুলে যায় এই পঞ্চশরে বিদ্ধ না হলে জীবনটাই জ্বলেপুড়ে  খাক। ছোটবেলায় হলে কাট্টি, বড় বয়সে হলে ডিভোর্স।  আর ডিভোর্স যেন ঘরে ঘরে। কচিকাঁচা দম্পতি থেকে বুড়োবুড়ির ডিভোর্স যেন আকছার  ঘটনা। জজসাহেবরা পর্যন্ত হয়রান। কোর্টে উচ্ছেদ  আর বিচ্ছেদ  সামলাতে সামলাতে নিজের পারিবারিক জীবনে পর্যন্ত  অশান্তির  একশেষ। উৎস সেই একই  জায়গায়। মদনদেবের কথা তখন  মনে পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে তিনি তো পগারপাড়।  অতএব,  মদনদেবের ও মন্দির তৈরী  করার তোড়জোড় করতে হবে। দরকার  হলে বিভিন্ন বয়সের স্বামী স্ত্রী বা প্রেমিক  প্রেমিকাদের মিছিল  করে ডেপুটেশন দিতে হবে। মদনদেব তো মিটি মিটি হাসছেন। যতই  বাবার মাথায় জল ঢালো বা শনিবার বড়ঠাকুরের সামনে ধর্ণা দাও বা  নির্বিঘ্নে জীবন যাপনের জন্য  হনুমান চালিশা  পড়, এই বিশেষ জায়গায় আমার  আশীর্বাদ ছাড়া এক পা ও চলতে পারবে না।হতে পারি আমি নাক কান গলার ডাক্তার  কিন্তু রাতে কানব্যথা  হলে আমি ছাড়া অন্য  কেউ সেখানে আসবে না। অতএব,  কর ভজনা আমার,  লাগাও মন্দির। 

প্রেম বললেই কৈশোরের প্রেমের  কথা মনে পড়ে। একটু কারো বিলোল কটাক্ষে হৃদয় হলো উদ্বেলিত,  তবেই না? মদন দেবের তীরগুলো যেন  ঠিক ছুঁচের  মতো, নরম চামড়ায় পুটুশ করে ঢুকে জ্বালা ধরাতে  পারে। কিন্তু কথায় আছে না, কাঁচায়  না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ট্যাঁসট্যাঁস।  সুতরাং, বয়স হলে চামড়া ও মোটা, তীর ও ঢোকেনা,  প্রেম ও আর আসেনা। তাহলে কিশোর বয়সের প্রেম ছাড়া আর কোনটাকেই প্রেম বলা যাবে না? যাবে, কিন্তু ব্যাপারটা একটু খটোমটো। অপারেশনের  আগে বুড়োমানুষের হাতে চ্যানেল করা হাসপাতালের স্টাফদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ  হয়ে দাঁড়ায় যদিও  অনেকের কাছেই এটা  একটা জল ভাত।  শিরা খুঁজে পেতেই তাদের  হিমশিম খেতে হয়। ঠিক  সেরকমই বুড়োবুড়িদের মধ্যে প্রেম সঞ্চার করা। এরা অনেক সুখ দুঃখের মুখোমুখি হয়েছে। এদের  কাত করা বা হাতে চ্যানেল করা ও একই রকম কঠিন কাজ। মদনদেবকে অনেক ভেবেচিন্তে এগোতে হয়। প্রথমে দে বুড়োর সঙ্গে বুড়োর বৌ বুড়ির সংসারে আগুন  লাগিয়ে। ক্রমাগত  বুড়ির কাছে ধ্যাঁতানি খেয়ে খেয়ে বুড়ো একেবারে খাপচুরিয়াস। ভাল করে চোখে দেখেনা , কানে শোনেনা,  হাঁটুতে কোমড়ে উঠতে বসতে ব্যথা তবুও  জজসাহেবের সামনে ডিভোর্স নেবার  জন্য  আর্জি জানাতে আসা। বেচারা জজসাহেব ছেলের  বয়সী কিন্তু খাণ্ডারনি বুড়ির সামনে একেবারে কেঁচো।  বুড়োর প্রতি সমবেদনা থাকলেও এই বয়সে বুড়ো কি করে বাঁচবে এই চিন্তায় ঘোর মগ্ন। ঠিক করতে না পেরে শুনানির তারিখ  পিছিয়ে দেন এই ভেবে যে এর মধ্যে যদি দুই যুযুধান পক্ষ  নিজেদের  মধ্যে মিটমাট  করে নেয় বা ভগবান  যদি কোন  একজনকে তাঁর নিজের  কাছে ডেকে নেন এই ভেবে। কিন্তু মোটামুটি শক্ত সামর্থ্য বুড়োবুড়িদের ক্ষেত্রে ডিসিশন  নেওয়া সুবিধা  হয়। মদনদেব হয়তো এরকম ক্ষেত্রে অন্য এক জুড়িদের মধ্যে কাউকে আলাদা করে দেন এবং দুইজোড়া বুড়োবুড়িদের মধ্যে বিপক্ষ লিঙ্গের  মাঝে সেতুবন্ধনের চেষ্টা করেন। ওঁর একটা কেস করা নিয়ে কথা যেমন ভাল হোক, মন্দ হোক একটা পলিসি তো গছিয়ে দাও, আমার রোজগার হলেই হবে। সুতরাং এখানেও  তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।  এইভাবেই  দেখা যায় একজন প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ যাঁর নিজেরই  রয়েছে বিবাহযোগ্য পুত্র ও কন্যা তিনিও তাঁর প্রেম করে বিয়ে করা স্ত্রীকে আইনত বিচ্ছেদ  নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে চড়ে বসলেন।  একবারও  তাঁর মনে পড়লনা তাঁর  ছেলেমেয়েদের মনে সেটা কি রকম  প্রভাব ফেলবে। আগের দিনে হয়তো দাঁতে দাঁত চেপে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিত এবং প্রাকবিবাহ জীবনে অসম্পূর্ণ প্রেমের  সমাপ্তি ঘটাতে ব্যগ্র হতো এবং সেটাও অত্যন্ত  চুপিসারে কিংবা সেরকম কিছু না থাকলে নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে নিজেকে একটু হাল্কা করে আসত। কিন্তু আজকের  দিনে সবাই খুব সাহসী এবং অধৈর্য্য এবং চটজলদি সমাধান  হচ্ছে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া এবং সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ  মিটিয়ে নিজেকে নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা তাতে  ছেলেমেয়েদের উপর কি প্রতিক্রিয়া হলো, তার থোড়াই কেয়ার। এইসব ক্ষেত্রে মদনদেবের কারিগুরি যে আছে সেটা কে অস্বীকার করবে? 
অতএব,  প্রেম ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও  থাকবে তবে কতটা ঘন সেটা পরিস্থিতির  উপর নির্ভরশীল।  সুতরাং, মদনদেবের  মন্দির  এবার  হলো বলে।

Monday, 4 March 2024

গুড় খাও/ গুড় যাও

সুবোধ বাবুর মেয়েজামাইরা এসেছে প্রায় ৪বছর পরে,  সঙ্গে তাদের ছোট্ট মেয়ে সদ্য বছর  বেরিয়েছে। ওরা যেখানে থাকে সেখানে ঠাণ্ডা, সুতরাং আমরা যেখানে গরম জামাকাপড় নিয়ে শশব্যস্ত,  ওরা একটা পাতলা টি শার্টেই স্বচ্ছন্দ । সুবোধ বাবুর স্ত্রী শমি ও  আজকাল ঠিক সবকিছু সামলে উঠতে পারেন না বয়সোচিত কারণে। সুতরাং একরকম বাধ্য হয়েই ন্যানি সেন্টারে করতে হয়েছে ফোন । খানিকক্ষণ পরেই মোটরবাইকের পিছনে বসে  ন্যানি এলেন। একটা ছোট্ট ইন্টারভিউ হলো, কোথায় কাজ করেছে,  কি ধরণের কাজ করেছে,  নাম ধাম, প্যান কার্ড, আধার কার্ডের ফটোকপি দেখে নিয়ে কি করতে হবে বুঝিয়ে  দেওয়া হল।
বাচ্চার কাজ করতে হবে  বলে স্নান করে নিতে বলা হলো। মিনু স্নান সেরে তুলির কাছে যেতেই তুলি একবার  চোখ মেলে দেখে নিল যে কার কাছে  তাকে যেতে হচ্ছে । ওদের  ওখানে তো মানুষ জন ই কম দেখা যায়,  সুতরাং একটা লোক অন্তত তার কাছে সবসময় থাকবে ভেবে কোনরকম  কান্নাকাটি  না করেই হাসিমুখে চলে গেল। কিন্তু খাওয়ানোর সময়ই হল বিপদ,  ও তো ইংরাজি ভিডিও  দেখা  ছাড়া খেতেই চায়না  আর মিনু জানেইনা ইংরাজি । ও কাকিমা, কি করে খাওয়াই বল তো? এই খুদে মেয়ে যে আমার  কাছে  একদম আসছে নি। শমি এবার প্রমাদ গুনলো। একদিন  এসেই যদি বলে পারছি না তাহলে তো সেন্টারে আবার  খবর দিতে হয়। খুবই ঠাণ্ডা মাথার মহিলা শমি, কোনরকম বিচলিত না হয়ে মেয়ে তিতলিকে বলল ভিডিও চালু করে দিতে।ভিডিও চালু হতেই ছোট্ট তুলি গিলে নিল । তিতলি বলে উঠল গুড জব। তারপর যতবার তুলি খাবার খায়  তিতলি বলে ওঠে গুড জব। তখনকার  মতো সমস্যার সমাধান হলেও পুরোপুরি  মিটল না। মিনুকে দেখিয়ে দেওয়া হল  কি করে ভিডিও চালু করতে এবং বন্ধ করতে হয় ।
মিনু  একটু চালু হলো এবং  তুলির সঙ্গে  ভাব ও জমলো। সুবোধ বাবুর তো কাজ কর্ম বিশেষ  কিছুই  নেই,   নাতি নাতনিদের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। কিন্তু  তুলিকে খাওয়ানোর সময়  কি রকম  একটা  শব্দ কানে খটখট করে বাজছে। প্রত্যেক বার  গেলার পর মিনুর গলায়  আওয়াজ  বেরোচ্ছে  গুড় খাও,  গুড় খাও । যাদবপুর থেকে  বেশ কিছুদিন  হলো আখের গুড় কিনে এনেছেন এবং তা থেকে  তিনি তো রোজ ই খানিকটা  করে  খান। তাহলে এত গুড়  আসছে কি করে? মাঝে মাঝে  তিতলি ও তুলিকে খাওয়ার জন্য  উৎসাহিত করছে। তারপর মিনু ও বলতে শুরু  করল গুড় যাও যেটা সুবোধ বাবুর কান এড়ায়  নি। মিনুকে ডেকে বললেন যে গুড জব বলো। হঠাৎ ই মিনুর মুখের  চেহারাটা কেমন যেন  হয়ে গেল  আর বলল ," কাকু আমরা তো গেরামের লোক,  ইঞ্জিরি তো জানিনা , আর তুলি ও ইঞ্জিরি ছাড়া কিছুই  বোঝেনা,  আমাকে দিয়ে এই কাজ  হবেনা। তোমরা সেন্টারে  বলে অন্য  লোক  নিয়ে  নাও গো।" একেবারে থ বনে গেলেন তিনি । ও যদি চলে যায়  তাহলে আর যাই হোক  সুবোধ বাবুর  নিজের  যে কি হবে ভেবেই ভেতরে ভেতরে  শঙ্কিত হয়ে উঠলেন আর বললেন তুমি যেমন ইঞ্জিরি জানো, তেমনই বল। আর তুলিরা যতদিন  থাকবে  তুমি ছাড়া আর কেউ এ বাড়িতে  আসবে না।

পাত্র পক্ষ কন্যা পক্ষ

চর্বিত চর্বন এই বিষয়টি নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে এবং বিভিন্ন ভাবে এই ব্যাপারে তাঁদের  নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। সেই হিসেবে দেখতে গেলে এই বহু আলোচিত বিষয়ে নতুন কোন সংযোজন হবে কিনা তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ  রয়েছে । যদি কোনও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েও যায় তবে নিজগুণে ক্ষমা করে  নেবার  জন্য  অনুরোধ থাকল। 
পাত্র পক্ষ বলতে যে ছেলের বিয়ে হচ্ছে তার  পরিবার  বা আত্মীয়দের  বলা হয় এবং  কন্যাপক্ষ বললে যে মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হতে চলেছে তার পরিবার  এবং আত্মীয়দের  বলা হয়। কিছুদিন আগেও  পাত্র পক্ষ  মানেই হেব্বি রেলা আর পাত্রীপক্ষ সদাই ত্রস্ত কি হয় কি হয় ভেবে কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেই একেবারে বিপরীত  চিত্র। হুঁ হুঁ বাবা, খুব  মজাকি করেছ, নাও এবার  বোঝ ঠ্যালা। এমন পিরকি দেব না, জীবনেও  এমুখো  হবেনা। বিয়ের  আগে পাত্র পক্ষের  হাঁকডাক  সব একদম ছুঁচ ফোটানো  বেলুনের মতন চুপসে যায়। কিন্তু কেন এমন অবস্থার উদ্ভব  হয়? বিয়ের দিন পর্যন্ত  পাত্র পক্ষের নানান বাজে বায়নার জেরে কন্যাপক্ষের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়। এটা দিতে হবে, ওটা দিতে হবে, এসব করা চলবে না, আমাদের  এটাই রীতি এইসব নানান বায়নাক্কায় মেয়ের  বাবা মায়ের  অবস্থা রীতিমত  করুণ হয়ে ওঠে। বিয়ের দিন  বরযাত্রীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ  হয়ে ওঠে মেয়ের বাড়ির  লোকজন। লুচিটা কাঁচা হয়ে আছে  বলে ছুঁড়ে ফেলে দিল  কিংবা মাছের ছালটাই সার বলে মন্তব্য  করল কিংবা মাংসটা  কি দাদু পাঁঠার বলে মন্তব্য করতে থাকল এবং একটা বরযাত্রীর বাঁদরামোই অন্যদের মধ্যে সংক্রামিত হতে থাকল।  কিন্তু এদের  মধ্যেই  অনেকেই  ভদ্রলোক  আছেন  তাঁরা লজ্জ্বা পেলেও সংখ্যায় কম হবার  কারণে তাঁদের  মিনমিনে প্রতিবাদ বাঁদরগুলোর অসভ্যতার কাছে ম্রিয়মান  হয়ে গেল। কিন্তু এদের মধ্যেই  যদি এক আধজন  কেউকাটা থাকে তাহলেই  জিনিসটা আর বেশীদূর  এগোয় না। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার  তা হয়ে গেছে। একবার মনটা বিষিয়ে গেলে আর কিছুতেই তা পূর্বাবস্থায় আসেনা। কথায় আছে না, হাড় ভাঙিলে  জোড়া লাগে মন ভাঙিলে আর তো নয় , এখানেও সেই একই  ব্যাপার। 
বিয়ে শেষ।বরযাত্রীরা সব ফিরে গেছে। পরদিন  কান্নাকাটির পালা শেষ  হলে কন্যা চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বিদায় নিয়েছেন এবং মেয়েদের  বাড়িতে এক শূন্য  নিস্তব্ধতা।  কালরাত্রি( মানে বিয়ের  পরদিন  রাত্রে) বিবাহিতা স্ত্রী তাঁর স্বামীর  সঙ্গে শোবেন না। এ এক মহাজ্বালা। একে তো যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সে ই অজানা তার ওপর তাদের  পরিবারের অন্য লোকজনদের  সঙ্গে যদি শুতে হয় তাহলে যে কি অবস্থা তা সহজেই  অনুমেয়। তার সুবিধা অসুবিধার কথা জানানোর জন্য  মেয়ের  বাড়ি থেকে মেয়ের ই ঘনিষ্ঠ  কেউ আসত এবং তার কি চাই বা না চাই এইসব কথাগুলো  বলত। এ তো গেল চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের  বিয়ের  কথা।
এবার  আসা যাক এখনকার  বিয়ের  কথায়। এখনকার  বেশিরভাগ ছেলে মেয়েই  নিজেদের  পছন্দের  জীবন সাথী খুঁজে নেয়। বাবা মায়ের  ঝক্কি অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই  শোনা গেল যে অমুকের  আবার নাকি বিয়ে।  মানে? মানে ঠিক বনিবনা  হচ্ছেনা তাই জীবনসাথীও পাল্টানো দরকার।  এ তো একেবারে হক কথা। তুমি স্বামী বলেই যা খুশি করবে আর আমি তা চুপচাপ মেনে নেব? অতএব,  পথ দেখ বাপু।  আমি চললাম। কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ তা নিয়ে বিস্তর তর্ক বিতর্ক  হতে পারে কিন্তু আসল লক্ষ্য  তো সংসারে শান্তি। কিন্তু সেই শান্তিটাই যদি না থাকে তাহলে কি হবে? নারীবাদীদের  কথায় মেয়েরা কি চিরকাল  পড়ে পড়ে মার খাবে? অতএব  বেরিয়ে এস বাপু,  আমাদের  দল ভারী কর। আমরা সেই কোন কাল থেকে একা একা চলছি, আমাদের  লেজটা যখন  কাটাই গেছে তখন  তোদের  লেজটা না কাটলে তো আমাদের সকলের  পক্ষে মানহানিকর।  অতএব,  আয় বাবা, আমাদের  দল ভারী কর।  নিজেদের  সংসারের বারোটা তো বাজিয়েইছে, তোরাই বা কেন আনন্দে থাকবি। তোদের স্বাধীনতা খর্বকারী স্বামী এবং তার পরিবার  নিপাত  যাক। এইসব বদবুদ্ধিধারী তথাকথিত সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট আর যাই করুন না কেন কচিকাঁচাদের আখেরে কিছুই  লাভ হয়না। হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই  স্বামী এবং তার পরিবারের  লোকজন  নানাধরণের মন্তব্যে মেয়েটির  জীবন  অতিষ্ঠ  করে তোলে এবং অনেক ক্ষেত্রেই  সেই শারীরিক  ও মানসিক  অত্যাচার  সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এইসব ক্ষেত্রে এইরকম নারীবাদীদের এগিয়ে এসে মেয়েটিকে প্রয়োজনীয় সাহায্য  দেওয়ার  ভীষণ ভাবে দরকার। এই সূক্ষ্ম সীমারেখাটির  জ্ঞান  খুব কম লোকের  মধ্যেই  দেখা যায় এবং বহুক্ষেত্রেই এর অপব্যবহার হয়।

আচ্ছা এই দুই ব্যবস্থার  মধ্যে কোন মেলবন্ধন  আনা যায় না? একটু চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? দুই পক্ষই  যদি একটু সহনশীল হয় তাহলে মনে হয় কিছু একটা সমাধান সূত্র  বেরিয়ে আসতে পারে। সমাজ বিজ্ঞানীরা হয়তো এর সমাধান সূত্র খুঁজে পেতে পারেন।  কিন্তু আমরা তো আপামর জনতা।  জ্ঞানগম্যিও তথৈবচ।  তবে একটা কথা মনে হয় যে পারস্পরিক  সম্মান ও শ্রদ্ধা মিশ্রিত  ভালবাসা এর সমাধান  হলেও  হতে পারে। পারস্পরিক  সম্মান  তখনই  আসতে পারে যখন আমার  বদলে আমাদের  বলে ভাবতে পারি। আগে প্রত্যেক বাড়িতেই  পাঁচ সাতটা ছেলেমেয়ে খুবই  সাধারণ  ব্যাপার ছিল। কিন্তু সময়ের  সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থায় যৌথ পরিবারের  অবলুপ্তি এবং ছোট্ট  নিউক্লিয়ার  ফ্যামিলির আগমন এর জন্য  অনেকটাই দায়ী। এখন কোন পরিবারেই  একটা বা দুটো ছেলেমেয়ের  বেশী দেখা যায়না। একটা সন্তান কোনরকমে মানুষ করতে না করতেই বাবা মা বুড়িয়ে  যায়। দ্বিতীয় সন্তানের  কথা ভাবলেই গায়ে  জ্বর আসে। কে ওঠাবে  এই হ্যাপা। আগে যৌথ পরিবারে বাবা মায়ের  সঙ্গে কাকা কাকিমা বা পিসিরা সামলে দিত।  এখন তো ছেলে মেয়েরা কাকা পিসির সম্পর্ক  ভোলার  পথে। আর একটা ছেলে বা মেয়ে হবার  সুবাদে  বাবা  বা মায়েরা  তাদের  সাধ্যের  বাইরে গিয়েও  ছেলে বা মেয়ের  শখ আহ্লাদ  মেটায়। সুতরাং সেই ছেলে বা মেয়েরা  ছোট থেকেই কারো  সঙ্গে ভাগ করে নিতে  শিখবে না এটাই কি স্বাভাবিক  নয়? এই স্বার্থপরতা একবার  জন্মে গেলে তার মূলোৎপাটন বাস্তবিক ই অসম্ভব । তা এরাই যখন  বড় হবে তখন  এরাই এক একজন মহা স্বার্থপর  হবে, কোন ব্যতিক্রম  হবে কি? না, নিশ্চয়ই না। এর পর আছে বৈষম্যমূলক  আচরণ।  অণু পরিবারের  সদস্য হবার জন্য কাকা, পিসিদের অনুপস্থিতি এদের  বিশেষ ভাবে ভাবায় না বরং মাসি, মামা ( যতই দূরের  হোক না কেন) এবং  দাদু, দিদিমারা এদের অনেক কাছের লোক হয় ঠাকুর্দা,  ঠাকুমার  চেয়ে। এটাই খুব  স্বাভাবিক।  বাচ্চারা ছোট থেকেই তার মায়ের  কাছে দাদু দিদিমার এবং মাসি মামাদের সম্বন্ধে জানে যেটা তাদের  বাবার কাছ থেকে শোনার  অবকাশ  পায় না। সুতরাং একপেশে ব্যবহারটাই  বেশী হবে এটাই আশা করা যায়।  মেয়ের মা বা বাবা তার  শ্বশুর বা শাশুড়ির  থেকে  বেশী আপন হবে সেটাই  বেশী স্বাভাবিক।  সুতরাং  সেটাই  যে নাতি  বা নাতনিদের  মধ্যে ছড়াবে  এটাই স্বাভাবিক। 
সব কিছুরই  কিছু ভাল  কিছু মন্দ   দিক আছে আর  আমরা যদি মন্দ দিকটা না দেখি তাহলে আমরাও  অসম্পূর্ণ  হয়ে যাব এবং সঙ্গে সঙ্গে  ভবিষ্যত  প্রজন্ম ও।  তাই সবাইকে অনুরোধ করি এই  সমস্যার  সমাধান  খোঁজার  জন্য। 


Friday, 1 March 2024

অজানা পাখী

সকাল সকাল চায়ের কাপে চুমুক দিতেই খস খস শব্দে সেগুন গাছের  দিকে চোখ চলে গেল। আওয়াজের উৎস কোথায় দেখার চেষ্টা করছি কিন্তু বারবারই ভ্রমিত হচ্ছি। কানটা ঠিক আছে তো? হ্যাঁ, ঠিকই  আছে , কিছু একটা যেন এই ডাল থেকে ওই ডালে চলে যাচ্ছে আর ঠিক মতন পছন্দ না হওয়ায় আবার  যেন যাচ্ছে চলে আর এক ডালে। পাশের কাঠ বাদাম গাছের পাতাগুলো সম্পূর্ণ ভাবে ঝরে নতুন কচি পাতা গজিয়ে গেলেও সেগুন গাছের পাতাগুলো এখনও  রয়েছে আধ শুকনো অবস্থায় , অপেক্ষারত ঝরে পড়ার। কেউ হয়তো সেই আধা শুকনো  পাতাগুলো দিয়েই তাদের  ঘর বানাতে চায়।
অন্ধ্রপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করার সুবাদে চোখে পড়েছে গরীব মানুষদের ঘরের ছাউনি ফি বছরই বানাতে কারণ প্রত্যেক বছরেই উত্তাল ঝড়ে উড়ে যায় তাদের তালপাতার ছাউনি আর হাজির  হতে হয় মহাজনদের কাছে জোড় হাতে যাদের আছে  সারিসারি তালগাছ আর আছে পাকা বাড়ী ও শয়ে শয়ে একর জমি। এককথায় বলা যায় জমিদার বা পেদ্দা  মনুষ্যম।  কোন  বিপর্যয় হলেই যেমন রাজনৈতিক নেতাদের মুখের হাসিটা চওড়া হয় এখানেও এই পেদ্দা মনুষ্যমদের সেইরকম ই আনন্দে বুক ভরে ওঠে এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর  মুখের  দিকে চেয়ে কিন্তু এই শ্বাপদগুলোর চোখে মুখে কৃত্রিম বেদনার ভাব ফোটাতেই  হয়। সবজায়গায় ই এই একই  চিত্র। এদের দুঃখ শুনে এই পেদ্দা মনুষ্যমরা তাদের তালগাছের পাতা কাটতে দেয় কিন্তু বিনিময়ে এদের চাষের  সময় নামমাত্র  মজুরিতে কাজ করতে হয়। উননব্বই সালে তাদের  দেওয়া হতো মাত্র আট আনা  প্রতিদিন  যখন  ঐ গ্রামে চারটাকা  লিটার দুধ পাওয়া যেত। সুতরাং, শোষণটা সহজেই অনুমান করা যায়। যাই হোক, আসা যাক আজকের  পাতার  খসখসানি আওয়াজ অনুসন্ধানে। 
চোখটা এদিকে ওদিকে ঘুরিয়েও কোন  সুরাহা হচ্ছেনা। মোবাইলের  ক্যামেরা অন করেই বসে আছি। হঠাৎই দেখি একটা আধাশুকনো পাতা ছাড়ানোর আলতো এক আওয়াজ। আজ পর্যন্ত আমার  চোখে কোনদিন  এই পাখির  ছবি আসেনি-- না চাক্ষুষ, না কোন ছবি। অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে  আছি, ভুলে গেছি ক্যামেরার ক্লিক করতে। গিন্নিকে ফিসফিসিয়ে ডেকে দেখানোর  আগেই তিনি আলতো ভাবে  পাতা ঠোঁটে তুলে নিয়ে চলে গেলেন।  মনটা খারাপ  হয়ে গেল  ঐ অজানা পাখিকে  ক্যামেরা বন্দী না করতে  পারার জন্য। কিন্তু একটা পাতা  দিয়ে তো আর বাসা বাঁধা যাবেনা, আসতেই হবে তাকে। তক্কে তক্কে থাকলাম কাপের  চা শেষ করে। আবার  সেই  খসখসানি আওয়াজ। এবার আর কোন ভুল  নয়। দেখলাম  এক অপূর্ব সুন্দর পাখি। টিয়া পাখির মত সবুজ তার পাখনা কিন্তু  অত উজ্জ্বল  নয় আর চেহারাটা হচ্ছে পায়রার মতো কিন্তু যথেষ্ট বড়। অত বড় পায়রা হয়না, অন্তত আমার  চোখে পড়েনি। গোলাপায়রার ডানার  রঙ খানিকটা সবুজ  হলেও এতটা সবুজ নয়, তাহলে এটা কি ধরণের পাখি, কি তার নাম? যাই  হোক,  এবার  আর কোন ভুল নয়, ক্যামেরাবন্দী করলাম  সেই  অজানা পাখিকে আর  পাঠালাম বার্তা বন্ধুবান্ধবদের যদি কেউ কোন  হদিস  দিতে পারে এর সম্বন্ধে।