সন্ধে হতেই কিচির মিচির কলরবে পাখিরা শশব্যস্ত নিজের নিজের জায়গা দখল করতে। রোজ করবে তারা ঝগড়া অথচ আশ্রয়দাতা গাছ কিন্তু নির্বিকার। সে কিন্তু ভুলেও মাথা ঘামায়না তাদের এই কলহে। সে জানে অন্ধকার একটু বেশী ঘনিয়ে এলেই সবকিছুই থিতিয়ে যাবে এবং তার অল্পক্ষণ পরেই ঘুমে ঢুলতে থাকবে ক্লান্ত এই পাখিরা। আচ্ছা, এই পাখিগুলো তো একই জায়গায় থাকে, তাহলে রোজ ঝগড়া কেন? ভাবতে বসলে মনে হয় যে প্রতিদিন আশ্রয়স্থলের কিছু না কিছু পরিবর্তন অবশ্যই হয়। প্রতিদিন গাছের তলায় একগাদা পাতা পড়ে থাকে, চাঁদু বা মনোজ রোজ ঝাঁট দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে বলে আমরা ঠিক বুঝতে পারিনা যে গাছের মধ্যে কি পরিবর্তন এসেছে। যে পাতার ডালে আগেরদিন শালিকটা বা বুলবুলিটা বসেছিল সেটা ঝরে পড়ে গেলে তো তাকে অন্যত্র বসতেই হবে আর সেইখানে যে আগেরদিন বসেছিল তারসঙ্গে তো ঝগড়া হবেই। কিন্তু গাছের এটা গা সয়ে গেছে। সে জানে যে পুরাতনকে একদিন না একদিন নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে এবং আবহমান এই চক্র চিরদিন চলতে থাকবে যতদিন তার নিজের অস্তিত্ব ই টলোমলো না হয়ে যাবে। আশ্রয়দাতা গাছ এখন এক শান্তির নীড়ে পরিণত হয়েছে, পাখিদের কলরব সব গেছে থেমে, ঢুলুনি শুরু হয়েছে তাদের। পরদিন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আবার শুরু হয়ে যাবে পাখিদের ব্যস্ততা এবং গাছ আবার সেই প্রতীক্ষায় থাকবে সন্ধে নামার জন্য কখন তার অধিবাসীরা আবার শুরু করবে কিচির মিচির করে ঝগড়া।
মানুষের মধ্যেও রয়েছে গাছের মতন মানসিকতার লোক যদিও এখন অনেকটাই গেছে কমে। পঞ্চাশ ষাট বছর আগে বহু সহৃদয় ব্যক্তি ছিলেন যাঁদের আশ্রয়ে বহু দুঃস্থ অথচ মেধাবী ছেলেরা নিখরচায় খেয়েদেয়ে স্কুল ও কলেজে পড়েছেন এবং পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। কেউ হয়েছেন মাস্টারমশাই, কেউ বা আবার অধ্যাপক আবার কেউ বা হয়েছেন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা উকিল বা জজ। তাঁরা কি নিজের স্বার্থ দেখেছিলেন এই ছাত্রদের গড়ে ওঠার পিছনে? না, একদমই নয়। হয়তো বা মনের মধ্যে একটা সুপ্ত বাসনা লোকের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া। তাঁদের অনেকেই ছিলেন হয়তো সুদের ব্যবসায়ী বা বড়মাপের জমিদার বা রাজা এবং ব্যক্তিগত জীবনেও হয়তো খুব স্বচ্ছ মাপের ছিলেন না কিন্তু তাঁদের মধ্যেও অনেকেই এই আশ্রয়দাতার ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং স্কুল, কলেজ বা হাসপাতাল তৈরির ব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন। তাঁদের এই অসামান্য দানকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় তাঁরা নাম কামানোর জন্য এটা করেছিলেন (সমালোচকদের মতে) তবুও এটামানতেই হবে যে সমাজ এতে বহুলাংশে উপকৃত হয়েছে। সমালোচকদের অনেকেই বলেছেন যে তাঁদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এইসব কাজ করেছেন। এইকথাটাকে একেবারে নস্যাৎ করে না দিয়ে একটু তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিটাকে একটু গভীরে গিয়ে দেখা যাক। আগে বহু ভূমিপতিরাই নিজেদের থাকার জায়গাকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য বহুলোককে জমিজমা দিয়েছেন। চাষী, ধোপা, নাপিত, জেলে , কামার, কুমোর বা বামুনদের তাঁরা জমি বা পুকুর দিয়ে তাঁদের নিজেদের জায়গাটাকে খুব সুন্দর এক গ্রামে পরিণত করেছেন। গ্রামে তাঁরা স্কুল তৈরী করেছেন যেখানে আশপাশের গ্রাম থেকে বহু ছেলেরা পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এতে যে সেই ভূমিপতিরাই লাভবান হয়েছেন তা নয়, দুই পক্ষই এটা থেকে উপকৃত হয়েছেন। কোন জনপদ গড়ে উঠলে যে শুধু ভূমিপতিরাই লাভবান হন তা নয়, দুই পক্ষই উপকৃত হন এর থেকে। অধুনা একমতের প্রচলন হয়েছে যে শাসক এবং শোষক। শাসক মানেই তারা খারাপ এবং তারা শোষণ করেছে দুর্বল সমাজকে এবং তাদের মুনাফা বাড়িয়েই চলেছে এবং দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য অবশ্যই আছে কিন্তু দুর্বল শ্রেণীর মনের মধ্যে এই বিষটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার নীট ফল আমরা দেখেছি যে একের পর এক শিল্প আমাদের রাজ্য থেকে অন্যত্র চলে গেছে এবং আমাদের রাজ্যর স্থান প্রায় নীচের দিকে কিছু অত্যন্ত অনগ্রসর রাজ্যের উপরে। কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ সেটা নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে।
আশ্রিত ও আশ্রয়দাতার উভয়ের ই স্থির মস্তিষ্কে চিন্তা করা উচিত যে একে অন্যের পরিপূরক এবং কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারেনা। সহমর্মিতা একটা আলাদা জিনিস এবং এটাকে যতদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় ততই মঙ্গল।