পাত্র পক্ষ বলতে যে ছেলের বিয়ে হচ্ছে তার পরিবার বা আত্মীয়দের বলা হয় এবং কন্যাপক্ষ বললে যে মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হতে চলেছে তার পরিবার এবং আত্মীয়দের বলা হয়। কিছুদিন আগেও পাত্র পক্ষ মানেই হেব্বি রেলা আর পাত্রীপক্ষ সদাই ত্রস্ত কি হয় কি হয় ভেবে কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেই একেবারে বিপরীত চিত্র। হুঁ হুঁ বাবা, খুব মজাকি করেছ, নাও এবার বোঝ ঠ্যালা। এমন পিরকি দেব না, জীবনেও এমুখো হবেনা। বিয়ের আগে পাত্র পক্ষের হাঁকডাক সব একদম ছুঁচ ফোটানো বেলুনের মতন চুপসে যায়। কিন্তু কেন এমন অবস্থার উদ্ভব হয়? বিয়ের দিন পর্যন্ত পাত্র পক্ষের নানান বাজে বায়নার জেরে কন্যাপক্ষের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়। এটা দিতে হবে, ওটা দিতে হবে, এসব করা চলবে না, আমাদের এটাই রীতি এইসব নানান বায়নাক্কায় মেয়ের বাবা মায়ের অবস্থা রীতিমত করুণ হয়ে ওঠে। বিয়ের দিন বরযাত্রীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মেয়ের বাড়ির লোকজন। লুচিটা কাঁচা হয়ে আছে বলে ছুঁড়ে ফেলে দিল কিংবা মাছের ছালটাই সার বলে মন্তব্য করল কিংবা মাংসটা কি দাদু পাঁঠার বলে মন্তব্য করতে থাকল এবং একটা বরযাত্রীর বাঁদরামোই অন্যদের মধ্যে সংক্রামিত হতে থাকল। কিন্তু এদের মধ্যেই অনেকেই ভদ্রলোক আছেন তাঁরা লজ্জ্বা পেলেও সংখ্যায় কম হবার কারণে তাঁদের মিনমিনে প্রতিবাদ বাঁদরগুলোর অসভ্যতার কাছে ম্রিয়মান হয়ে গেল। কিন্তু এদের মধ্যেই যদি এক আধজন কেউকাটা থাকে তাহলেই জিনিসটা আর বেশীদূর এগোয় না। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। একবার মনটা বিষিয়ে গেলে আর কিছুতেই তা পূর্বাবস্থায় আসেনা। কথায় আছে না, হাড় ভাঙিলে জোড়া লাগে মন ভাঙিলে আর তো নয় , এখানেও সেই একই ব্যাপার।
বিয়ে শেষ।বরযাত্রীরা সব ফিরে গেছে। পরদিন কান্নাকাটির পালা শেষ হলে কন্যা চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বিদায় নিয়েছেন এবং মেয়েদের বাড়িতে এক শূন্য নিস্তব্ধতা। কালরাত্রি( মানে বিয়ের পরদিন রাত্রে) বিবাহিতা স্ত্রী তাঁর স্বামীর সঙ্গে শোবেন না। এ এক মহাজ্বালা। একে তো যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সে ই অজানা তার ওপর তাদের পরিবারের অন্য লোকজনদের সঙ্গে যদি শুতে হয় তাহলে যে কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। তার সুবিধা অসুবিধার কথা জানানোর জন্য মেয়ের বাড়ি থেকে মেয়ের ই ঘনিষ্ঠ কেউ আসত এবং তার কি চাই বা না চাই এইসব কথাগুলো বলত। এ তো গেল চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের বিয়ের কথা।
এবার আসা যাক এখনকার বিয়ের কথায়। এখনকার বেশিরভাগ ছেলে মেয়েই নিজেদের পছন্দের জীবন সাথী খুঁজে নেয়। বাবা মায়ের ঝক্কি অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শোনা গেল যে অমুকের আবার নাকি বিয়ে। মানে? মানে ঠিক বনিবনা হচ্ছেনা তাই জীবনসাথীও পাল্টানো দরকার। এ তো একেবারে হক কথা। তুমি স্বামী বলেই যা খুশি করবে আর আমি তা চুপচাপ মেনে নেব? অতএব, পথ দেখ বাপু। আমি চললাম। কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ তা নিয়ে বিস্তর তর্ক বিতর্ক হতে পারে কিন্তু আসল লক্ষ্য তো সংসারে শান্তি। কিন্তু সেই শান্তিটাই যদি না থাকে তাহলে কি হবে? নারীবাদীদের কথায় মেয়েরা কি চিরকাল পড়ে পড়ে মার খাবে? অতএব বেরিয়ে এস বাপু, আমাদের দল ভারী কর। আমরা সেই কোন কাল থেকে একা একা চলছি, আমাদের লেজটা যখন কাটাই গেছে তখন তোদের লেজটা না কাটলে তো আমাদের সকলের পক্ষে মানহানিকর। অতএব, আয় বাবা, আমাদের দল ভারী কর। নিজেদের সংসারের বারোটা তো বাজিয়েইছে, তোরাই বা কেন আনন্দে থাকবি। তোদের স্বাধীনতা খর্বকারী স্বামী এবং তার পরিবার নিপাত যাক। এইসব বদবুদ্ধিধারী তথাকথিত সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট আর যাই করুন না কেন কচিকাঁচাদের আখেরে কিছুই লাভ হয়না। হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই স্বামী এবং তার পরিবারের লোকজন নানাধরণের মন্তব্যে মেয়েটির জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে এবং অনেক ক্ষেত্রেই সেই শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এইসব ক্ষেত্রে এইরকম নারীবাদীদের এগিয়ে এসে মেয়েটিকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দেওয়ার ভীষণ ভাবে দরকার। এই সূক্ষ্ম সীমারেখাটির জ্ঞান খুব কম লোকের মধ্যেই দেখা যায় এবং বহুক্ষেত্রেই এর অপব্যবহার হয়।
আচ্ছা এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে কোন মেলবন্ধন আনা যায় না? একটু চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? দুই পক্ষই যদি একটু সহনশীল হয় তাহলে মনে হয় কিছু একটা সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসতে পারে। সমাজ বিজ্ঞানীরা হয়তো এর সমাধান সূত্র খুঁজে পেতে পারেন। কিন্তু আমরা তো আপামর জনতা। জ্ঞানগম্যিও তথৈবচ। তবে একটা কথা মনে হয় যে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালবাসা এর সমাধান হলেও হতে পারে। পারস্পরিক সম্মান তখনই আসতে পারে যখন আমার বদলে আমাদের বলে ভাবতে পারি। আগে প্রত্যেক বাড়িতেই পাঁচ সাতটা ছেলেমেয়ে খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থায় যৌথ পরিবারের অবলুপ্তি এবং ছোট্ট নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির আগমন এর জন্য অনেকটাই দায়ী। এখন কোন পরিবারেই একটা বা দুটো ছেলেমেয়ের বেশী দেখা যায়না। একটা সন্তান কোনরকমে মানুষ করতে না করতেই বাবা মা বুড়িয়ে যায়। দ্বিতীয় সন্তানের কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে। কে ওঠাবে এই হ্যাপা। আগে যৌথ পরিবারে বাবা মায়ের সঙ্গে কাকা কাকিমা বা পিসিরা সামলে দিত। এখন তো ছেলে মেয়েরা কাকা পিসির সম্পর্ক ভোলার পথে। আর একটা ছেলে বা মেয়ে হবার সুবাদে বাবা বা মায়েরা তাদের সাধ্যের বাইরে গিয়েও ছেলে বা মেয়ের শখ আহ্লাদ মেটায়। সুতরাং সেই ছেলে বা মেয়েরা ছোট থেকেই কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে শিখবে না এটাই কি স্বাভাবিক নয়? এই স্বার্থপরতা একবার জন্মে গেলে তার মূলোৎপাটন বাস্তবিক ই অসম্ভব । তা এরাই যখন বড় হবে তখন এরাই এক একজন মহা স্বার্থপর হবে, কোন ব্যতিক্রম হবে কি? না, নিশ্চয়ই না। এর পর আছে বৈষম্যমূলক আচরণ। অণু পরিবারের সদস্য হবার জন্য কাকা, পিসিদের অনুপস্থিতি এদের বিশেষ ভাবে ভাবায় না বরং মাসি, মামা ( যতই দূরের হোক না কেন) এবং দাদু, দিদিমারা এদের অনেক কাছের লোক হয় ঠাকুর্দা, ঠাকুমার চেয়ে। এটাই খুব স্বাভাবিক। বাচ্চারা ছোট থেকেই তার মায়ের কাছে দাদু দিদিমার এবং মাসি মামাদের সম্বন্ধে জানে যেটা তাদের বাবার কাছ থেকে শোনার অবকাশ পায় না। সুতরাং একপেশে ব্যবহারটাই বেশী হবে এটাই আশা করা যায়। মেয়ের মা বা বাবা তার শ্বশুর বা শাশুড়ির থেকে বেশী আপন হবে সেটাই বেশী স্বাভাবিক। সুতরাং সেটাই যে নাতি বা নাতনিদের মধ্যে ছড়াবে এটাই স্বাভাবিক।
সব কিছুরই কিছু ভাল কিছু মন্দ দিক আছে আর আমরা যদি মন্দ দিকটা না দেখি তাহলে আমরাও অসম্পূর্ণ হয়ে যাব এবং সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যত প্রজন্ম ও। তাই সবাইকে অনুরোধ করি এই সমস্যার সমাধান খোঁজার জন্য।
No comments:
Post a Comment