আগামী চৌঠা জুন সুজিতের চলে যাওয়া তিন বছর পূর্ণ হবে।গতকাল অর্থাত তিরিশ তারিখ রাতে ওকে দেখলাম এবং অনেকক্ষণ কথা হলো ওর সঙ্গে। শুধু ও একা আসেনি, এসেছিল শুভ, চৌধুরী ও শঙ্খকে নিয়ে। অনেক কথার পর চৌধুরী বলল," ঠিক জমছে না আসর, কবে আসছেন বলেন?" শুভ বলল, অনেকদিন তো কাটালি এখানে, এবার অন্যদিকটা দেখার ব্যবস্থা কর।" শঙ্খ ওর সদাহাস্য মুখে জিজ্ঞেস করল," ভাল আছেন?"
সুজিতের আমার বাড়িতে আসার কথা ছিল কুড়ি সালের উনত্রিশে সেপ্টেম্বর। ও তখন ছিল হায়দরাবাদে ছেলে মাণিকের কাছে। আমি হাঁটুর ব্যথার জন্য কোথাও যেতে না পারার জন্য ও ই আসবে বলেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু ও তার প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেনি কারণ পায়ে ওঠা সামান্য এক ফোড়া চুলকে ফেলে যে এই বিপত্তি ঘটতে পারে তা সম্ভবত সুজিত নিজেও আঁচ করতে পারেনি। সেপটিক হয়ে এমন বাড়াবাড়ি হলো যে ওকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। সুদীপ্তর কাছে খবর পেয়ে ফোন করলাম, ও তার স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বলল,"আছি ফার্স্ট ক্লাস। হাসপাতালে ডাক্তার জমে ওঠা পূঁজটা কেটে বের করে দিয়েছে এবং ব্যাণ্ডেজ করে দিয়েছে এবং দিন দুয়েকের মধ্যেই ছেড়ে দেবে বলেছে।" কিন্তু ডাক্তার তাঁর কথা রাখতে পারেন নি এবং জহর ও সুদীপ্তর কাছে জানলাম যে ওর হাঁটু থেকে নীচের অংশটা কেটে বাদ দিতে হয়েছে। শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল কিন্তু মানুষের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে অনেক সময়ই ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে হয় ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিলাম। ও কিন্তু এসবের পরেও বলত ফার্স্ট ক্লাস আছি। বেশ কিছুদিন পর ওকে প্রস্থেটিক লেগ দেওয়া হলো এবং তাতেও সে নিজেকে রপ্ত করে নিল। কলকাতায় ফিরে এসে সব সময় জমিয়ে রাখা সুজিত দিব্যি আড্ডা মেরে, আসর জমিয়ে, রিক্সায় চড়ে বাজার করে আপনাকে বুঝতেই দেয়নি ওর অসুবিধার কথা বা দুঃখের কথা। মাঝেমধ্যেই সকাল বেলায় ফোন করে বলত," একটা গান করছি শোন। কেমন লাগল বলবে।" বলেই সেই দরাজ গলায় গান শোনাতো ও। যেমন সুন্দর মিষ্টি গলা, তেমনই ভরাট। ভারী সুন্দর। ব্যাঙ্কের ফাংশনে বা যে কোন ফাংশনে ও গাইত এবং সকলের প্রশংসা কুড়াতো। তখন আমি হাঁটুতে একটা ইঞ্জেকশন নিয়ে বেশ ভাল আছি। ও আমাক বলল কালীঘাটের মন্দিরে আসতে, ও গান গাইবে। আমি যথারীতি ওখানে গেলাম এবং মায়ের সামনে চাতালে বসে অসাধারণ গান গাইল। মাটিতে বসার জন্য খানিকক্ষণ পর আর উঠতে না পারায় ও আমাকে উঠতে সাহায্য করল এবং ট্যাক্সিতে বসিয়ে ও ফিরে গেল। তখন ওর পা ভালই ছিল।
রসবোধ ছিল অসাধারণ। হাসতে এবং হাসাতে একেবারে মাস্টার ক্লাস। মাঝেমধ্যেই গুরুগম্ভীর পরিস্থিতির মধ্যে এমন একটা ফুট কেটে দিত যে সবার গোমড়ামুখে ঠোঁট দুটো চওড়া হয়ে হাসির ঝিলিক দেখা যেত। এটা মানুষের একটা বিরাট গুণ। শুভ আর সুজিতের মধ্যে কে বেশি সিগারেট খেত তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে কিন্তু মনে হয় শুভ ই বোধ হয় বেশি খেত। চৌধুরীর আঙুলের টোকা তবলাকে দিত প্রাণ। এত মিষ্টি করে বাজাতো যে কেউ বলতেই পারবে না যে ওর প্রথাগত কোন শিক্ষা নেই। এটা সম্পূর্ণ ভগবানদত্ত। শঙ্খর নীরব উপস্থিতি জানাচ্ছিল আর কতদিন? শঙ্খ তো সুজিতের পরদিনই তার সাথী হয় যদিও শুভ তার কিছুদিন আগেই গিয়ে সবার জন্য বন্দোবস্ত করে রেখেছে। বেশ গল্পগুজব চলছিল আর একদম ভেবেই উঠতে পারছিলাম না যে ঐ চারজনের কেউই আর ইহজগতে নেই। হঠাৎই মেঘেরগর্জন এবং আকাশে বিদ্যুতের ঝিলিকে সমস্ত ঘরটা যেন আলোয় আলোকময় হয়ে উঠল আর সবাই যেন কোথায় উধাও হয়ে গেল। ঘড়িতে দেখি দুটো বেজে তের মিনিট। বৃষ্টির তোড় বেশ জোরালো, উঠে জানলাগুলো ঠিকঠাক লাগানো আছে কিনা দেখতে গেলাম কিন্তু ওদের উপস্থিতির রিমঝিম শব্দটা মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল।
ভাল থাকবেন সবাই ।