Wednesday, 1 May 2024

দমকা হাওয়া

টুটুটু টুটুটু  টুটু,  টুটুটু টুটুটু টুটু রিং টোনে সচকিত মোবাইলে দৌড়ে এল সুনন্দ, কে ফোন করেছে দেখতে। হ্যালো বলতেই একটা দারুণ  সুরেলা গলায় আওয়াজ  ভেসে এল কানে," কাকু, কেমন আছেন?"
গলাটা চেনা চেনা কিন্তু এই মূহুর্তে মনে পড়ছে না। কিন্তু এতটুকুও  বিচলিত  না হয়ে অত্যন্ত  সপ্রতিভ ভাবে উত্তর দিল, " ভাল, তুমি কেমন আছো?" কিন্তু মনটা তখন খুঁজতে শুরু করেছে এই দুরন্ত কণ্ঠস্বরের মালকিন  কে।ব্রেনে একটু খোঁচাখুঁচি করতেই মনে পড়ে গেল বছর সাতেক আগে মুম্বই গামী দুরন্ত এক্সপ্রেসে এক সহযাত্রীনির কথা। হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি। কিন্তু ঐ ভদ্রমহিলাকে সুনন্দ তো আপনি সম্বোধন করে কথা বলেছিল, আজ হঠাত তুমি বলে ফেলে একটু লজ্জা লজ্জা বোধ হচ্ছিল।  আসলে কাকু বলে কেউ ডাকলে তাকে আপনি বলে উত্তর দিলে হয়তো তাকে অপ্রস্তুত করে ফেলা হয়। যাইহোক,  কথোপকথন  বেশ ভালোই হলো। কাকিমা কেমন আছেন,  বম্বে আসলে একবার  আমাদের  বাড়ি আসবেন এই জাতীয় কথাবার্তায় শেষ হলো ফোনালাপ। 

কিছুদিন ধরেই  মনে হচ্ছিল  সেই অসামান্য  কণ্ঠস্বরের অধিকারিনীর কথা কিন্তু নামটা কিছুতেই মনে আনতে পারছিলনা সুনন্দ। ফোন ছাড়ার পরেই ফোনে নামটা দেখার  চেষ্টা করল কিন্তু চেনা নম্বর  নয়, অন্তত  এই মোবাইলে নম্বর টা নেই। পুরোন
 ছোট মোবাইলে এই নম্বর টা ডায়াল করতেই ফুটে উঠল নাম শ্রাবস্তী মজুমদার।  এতক্ষণে সমস্ত ট্রেন যাত্রার  পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা মনে পড়ে গেল। একেই বলে টেলিপ্যাথি,  সুনন্দ ও চিন্তা করছিল  আর সেও কিনা আজই তাকে  টেলিফোন করে খবরাখবর নিল।
শ্রাবস্তীর  বাবা টাটার উচ্চপদস্থ অফিসার  ছিলেন।  ওর স্বামী গৌরবের  বাবাও ঐখানেই  তাঁরই  সমকক্ষ অফিসার  ছিলেন  এবং ছিলেন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। তাঁদের  বন্ধুত্ব তাঁদের  ছেলেমেয়েদের মধ্যেও  ছড়িয়ে পড়েছিল এবং গৌরব ভারতীয় সেনাবাহিনীর  কর্নেল পদে ছিল। শ্রাবস্তী ছিল খুবই  ডাকাবুকো ধরণের।  পড়াশোনার  সঙ্গে সঙ্গে খেলাধূলায় ও ছিল চরম উৎকর্ষতা। কিন্তু একদিন  দুর্ভাগ্যবশত প্যারাসেলিং করার  সময় প্যারাসুট ঠিকঠাক  না খোলায় এক মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে যায় এবং ভগবানের অশেষ করুণায়  ও প্রাণে বেঁচে যায় কিন্তু তার মেরুদন্ডে আঘাতের  জন্য  তার হাত পা অবশ হয়ে যায়। কিন্তু দারুণ  লড়াকু  শ্রাবস্তী হার মানার মেয়েই নয় এবং দুর্জয় মনোবল এবং গৌরব ও তার পরিবার শ্রাবস্তীর পরিবারের  পাশে দাঁড়ানোয় তার পুনরুত্থান হয় এবং  গৌরব শ্রাবস্তীকেই বিয়ে করে যা আজকের দিনে বিরল ঘটনা। কথায় কথায় ছাড়াছাড়ি, এমনকি ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে তখনও  ছাড়াছাড়ি এবং বাবা বা মায়ের  বিয়েতে ছেলে মেয়েরাও  সেলিব্রেট  করছে, এই ধরণের  ঘটনাও আকছার আর সেইখানে ভালবাসার  মর্যাদা দিতে গৌরবের শ্রাবস্তীকে বিয়ে করা এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। এ বোধহয় আমাদের  ভারতীয় সেনাবাহিনীর  অধিকারীদের  পক্ষেই সম্ভব।  সেলাম জানাই  ভারতীয় সেনাবাহিনীর  সমস্ত সেনা এবং আধিকারিকদের। গর্বে বুক ভরে ওঠে গৌরবদের মত ছেলেদের কথা ভেবে। ট্রেনে যখন  দেখা হয় তখন সে ভাল করে ফোনটাও  ধরতে পারছিল  না  এবং ভয়েস  মেসেজ  সে পাঠাচ্ছিল। আর তাতেই আমার  কান তার অসাধারণ কণ্ঠের  পরিচয় পেয়েছিল। ছত্রপতি  শিবাজী টার্মিনাসে তার স্বামী গৌরবের  সঙ্গে সুনন্দর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল  এবং সঙ্গে সঙ্গে সুনন্দর  ছেলের সঙ্গেও।  কথায় কথায় সুনন্দ  জেনেছিল  তার স্বামী গৌরবের  ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির কথা এবং সুনন্দর ছেলের ই ব্যাচের  কিন্তু তার ছেলে সেখান থেকে বেড়িয়ে সিভিলিয়ান জব করেছিল। একই  ব্যাচের হওয়ায়  আলাদা স্কোয়াড্রন  হলেও পরস্পরকে চিনতে পারল এবং মিনিট  পাঁচেক কথাবার্তার পরেই ওরা নিজেদের গাড়িতে  উঠল।

দুহাজার একুশের  পাঁচই মে শেষ কথা হয়েছিল যখন শ্রাবস্তীর মা ও শ্বাশুড়ি দুজনেই কয়েকদিনের ব্যবধানে এই পৃথিবীর  মায়া কাটিয়েছিলেন। বাবা এবং শ্বশুর মশাই  আগেই চলে গিয়েছিলেন।  সুনন্দ জানতে পারল যে আমেরিকায় অস্ত্রোপচারের পর সে এখন যথেষ্ট  ভাল  আছে এবং নিজের কাজ নিজেই করতে পারছে। গৌরবের প্রতি সে কৃতজ্ঞ যে বিপদের  দিনে সে পাশে না দাঁড়ালে  শ্রাবস্তী হয়তো স্বাভাবিক  জীবনে  ফিরতেই পারতো  না। আমাদের  দেশে হাজার  হাজার  গৌরব  জন্ম নিক যাতে আমাদের  সমাজ কলুষ মুক্ত হয়।

No comments:

Post a Comment