বিরাট বিরাট ডিগ্রির মালিক, সমাজের এক একজন মাথা, এখানে সেখানে বহু জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান কিন্তু নিজের জীবনে সম্পর্ক শূন্য। স্ত্রী হয়তো জীবিত কিন্তু একসঙ্গে থাকেন না, ছেলে মেয়েরা রয়েছে কিন্তু সবাই যেন চলছে নিজের তালে, ঐকতান খোঁজার চেষ্টা বৃথা। প্রত্যেকেই স্বমহিমায় মহীয়ান ঠিক যেন এক একটা দারুণ ফুল কিন্তু এইসব ফুলগুলো দিয়ে মালা গাঁথা যায়না।একে তাহলে কি বলা যায়? পাঁচমিশেলি তরকারি বা চচ্চড়িতে প্রত্যেকটি সব্জি যদি নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করে তাহলে সেই পাঁচমিশেলি তরকারি বা চচ্চড়ি উপাদেয় হয়ে ওঠেনা কিন্তু প্রত্যেক অনুপান যদি নিজেদের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে একটা নতুন কিছুর সৃষ্টি করে তখন তার স্বাদ হয় অনন্যসাধারণ। একটা ছাতার যদি একটা বা দুটো শিক ভেঙে যায় তখন ছাতার সেই নিটোল রূপ আর থাকেনা, তার কঙ্কাল সার চেহারা তখন প্রকট হয়ে পড়ে। এখন আমরা স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে একসুরে বাঁধা পড়ব নাকি নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করব, সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে নিজেদের মানসিকতার উপর। বিশেষ বিদ্যার জাহাজ না হয়েও নিজেদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে যারা সীমিত থাকে তাদের সম্পর্ক হয় অনেক নিটোল এবং নানাবিধ অসুবিধা, কষ্ট থাকার পরেও তারা অত্যন্ত সুখী।
"আমি" শব্দটা দুই অক্ষরের হলেও খুবই মারাত্মক। এই আমিত্ব যে কত সংসার ছারখার করে দিয়েছে তার ইয়ত্ত্বা নেই। এই আমি সর্বস্ব হবার কারণে নানা অশান্তি গজিয়ে ওঠে। দুই অক্ষরের আমি থেকে তিন অক্ষরের আমরা হলেই কিন্তু বহুসমস্যার সমাধান চটজলদি হয়ে যায় কিন্তু সব পণ্ডিত ব্যক্তি ই যদি নিজেদের আমিত্ব বিসর্জন দিতে না রাজি হন তাহলেই বাধে ধুন্ধুমার কাণ্ড। সংসার বড় হলেই নতুন সদস্য বা সদস্যার উদ্ভব হবে যারা আসে অন্য সংসার থেকে। তাদের বড় হয়ে ওঠা ভিন্ন ধরণের, সুতরাং নতুন সংসারে তাদের মানিয়ে নিতে গেলে একটুসময়ের প্রয়োজন কিন্তু আজকাল দেখা যাচ্ছে নতুন সংসারে এসেই তার নিজের বড় হয়ে ওঠাকেই বেশি প্রাধান্য দেয় যার পরিণতি বিষাদময় হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। একটা চারাগাছ অন্য একটা জমি থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসে ভিন্ন জায়গায় রোপণ করলে চারাগাছের দায়িত্ব যেমন নতুন মাটির সঙ্গে মানিয়ে নেয়া তার থেকে ঢের বেশিগুণ দায়িত্ব নতুন মাটির চারা গাছটিকে আপন করে নেয়া। দুজনের ই দায়িত্ব রয়েছে চারাগাছটির বড় হয়ে ওঠা এবং ফুলে ফলে ভরে ওঠার মধ্যে। এই মানিয়ে নেওয়াটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জোর জবরদস্তি করে মানানোর ফল কিন্তু মোটেও শুভ হয়না বরং ধীরে ধীরে পূঞ্জীভূত অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ একদিন গোটা সংসারকে চুরমার করে দেয়। বিয়ের পর ছেলেমেয়েদের সংসারে নাক না গলানোই ভাল। প্রত্যেক মানুষের নিজস্বতা বজায় রাখার অধিকারকে স্বীকৃতি দিলে সংসারে শান্তি বজায় থাকে। একটা সময় ছিল যে শ্বশুর বা শাশুড়ি যা বলবেন বাড়ির বৌমাকে ঘোমটা মাথায় দিয়ে স্বীকৃতি জানাতে হবে।এর দিন শেষ বরং উল্টোটাই এখন বেশি সত্যি। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার এটা একটা বড় কারণ। পরিবার বড় হলেই তারা আলাদা থাকুক, সময়ে অসময়ে আসা যাওয়া থাকুক, তাহলে সংসারে শান্তি বজায় থাকবে। কিন্তু যেখানেই বর্ধিত পরিবার খুব কাছাকাছি থাকে সেখানেই কোন এক ঠুনকো কারণে মনঃকষ্টের উদ্রেক হয়। এটা যাঁরা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন ততই মঙ্গল। কোনরকম আশা না করাই বাঞ্ছনীয়। আশা না করে কিছু বাড়তি প্রাপ্তি যেমন আনন্দ দেবে তেমনই আশা করে কিছু না পেলে বা আশানুরূপ না পেলে মনঃকষ্টের ই কারণ হবে। এ তো গেল পারিবারিক সম্পর্কের কথা।
বন্ধুদের মধ্যেও যদি মানসিক ভাবে তৈরী থাকা যায় যে প্রত্যেক মানুষের ই নিজস্বতা রয়েছে এবং দুটো যখন ভিন্ন সত্ত্বা তখন সব বিষয়েই যে একমত হতে হবে তার কোন মানে নেই। বরং মতপার্থক্যতাই ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। কিন্তু কারও যদি এটাই মনে হয় যে বন্ধু মানেই সে আমার হ্যাঁ র সঙ্গে হ্যাঁ মেলাবে তাহলে সে ভুল করবে। অনেক সময় এটাও দেখা যায় শৈশবের বন্ধু যে কোন স্বার্থের সংঘাতের জন্য এই পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিচ্ছে। আবার এমনও দেখা যায় বন্ধুর জন্য অপর বন্ধু প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। এই পৃথিবীতেই ভাল ও খারাপ দুইই আছে, খারাপের দিকে না তাকিয়ে ভাল জিনিসের দিকে তাকালে মনটা শুদ্ধ থাকবে।
কোন মানুষকে বিচার করতে হলে স্বার্থের সংঘাত হওয়া সত্ত্বেও যদি নিজেদের শালীনতা বজায় রেখে ব্যবহার করতে পারে তখনই তাকে ভাল মানুষ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ঠিক সেরকমই প্রভু ভৃত্যের সম্পর্কেও মনিব যদি চাকরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় তখন সেই সম্পর্ক একটা আলাদা মাত্রা পায়। ভৃত্যের মনিবের প্রতি আনুগত্য ছাড়া আর বেশী কিছু দেবার থাকেনা কিন্তু মনিব যদি সবসময়ই এই চিন্তা করতে থাকেন যে আমি ওকে মাইনে দিচ্ছি, ওকে এটা করতেই হবে সে যতটা অসাধ্য ই হোক না কেন। সম্পর্কের মধ্যে একটা স্নেহ বা সহানুভূতি না থাকলে সেই সম্পর্কের বনিয়াদ তত মজবুত হয় না। সম্পর্ক হচ্ছে দুটো পায়ের মতো। কোন একটা পায়ে চোট লাগলে মানুষের স্বাভাবিক চলার ছন্দ যেমন ব্যাহত হয় তেমনই তাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে দুই পক্ষকেই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সহানুভূতিশীল হতে হবে। মেঘ আকাশে ভাসতে ভাসতে কখনও কোন জায়গার প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল হয়ে এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে লোকের মুখে হাসি ফোটাবে আবার কখনও তার বজ্র নির্ঘোষে অবিশ্রান্ত ভালবাসায় প্লাবন আনবে এবং মানুষের দুর্ভোগের কারণ হবে ।মানুষ আকাশকেও ভালবাসে আবার মেঘকেও এবং এই দুইজনের সম্পর্ক অটুট।
No comments:
Post a Comment